খেলাঘরখেলাঘর

আনমনে
পর্ব-৬
 
পুজোর পর অনেকদিন পরে দেখা হল। ভালো আছো তো? নতুন বছরের আন্তরিক ভালবাসা নিও  ।
আমার ছোট বেলার কথা শুরু করি এবার কি বল ? শরতে যেমন দুর্গা পূজো , পরের ঋতু হেমন্তে তেমনি রয়েছে কালীপূজো । এ বছর অবশ্য শরতেই হয়ে গেল পঞ্জিকার  নির্দেশে ।
 
এখন কালীপুজোয় কত কিছু হয় । আলো, মাইকের হল্লা,বাজী, বিরাট বিরাট সব মন্ডপ ইত্যাদি নিয়ে বিশাল এক কান্ডকারখানা । আমাদের ছোটবেলায় এত সব হোত নাকি ? আলোই বা কোথায়, আর বাজীই বা কোথায় । অবশ্য একটা বাজীর কথা জানতাম , সেটা যথা সময়ে বলব ।
    
গ্রামে একটা কালীবাড়ি ছিল, যেমন সব গ্রামেই থাকে । সেখানে পুজো হোত ।পুজোর দিন হৈ চৈ হত বটে তবে আমরা বিশেষ অংশ নিতে পারতাম না। অন্ধকারে অত রাতে কোথায় আর আনন্দ করব বল ?
     
তবে পুজোর আগের দিনটা ছিলো আনন্দের। সেদিন হোত চৌদ্দ শাক খাওয়া আর সন্ধ্যায় চৌদ্দ প্রদীপ দেওয়া । তোমরা হয়ত বলবে, এ আর এমন কি কথা, এ ত এখনো সবাই করে। ঠিক কথা। কিন্তু যারা শহরে থাক তারা ত বটেই, অন্যেরাও শাক আর প্রদীপ বাজার থেকে কিনে আন, তাই না ?
 
আমি কি করতাম বলত ? দিয়ানী আর ছোট  মাসির সাথে শাক সংগ্রহে লেগে পড়তাম বাগান ঘুরে ঘুরে ।
 
আর প্রদীপ ? দিয়ানী নিজের হাতে প্রদীপ গড়তেন । কয়েক দিন আগে তৈরী করে রোদে শুকিয়ে নিয়ে, পরে সেগুলোকে উনুনের আগুনে পুড়িয়ে নিতেন। এরপর পলতে পাকাতেন নিজেই। পুজোর আগের দিনটা হল ভূতচতুর্দশী । ঐ দিন সন্ধ্যায় প্রতি ঘরের দরজায়, সব ক'টি উঠোনের প্রবেশপথে ঐ সব প্রদীপ দেয়া হত।
     
আমারও আর একটা কাজ থাকত ঐ দিন সন্ধ্যায় । এক গোছা পাটকাঠিতে আগুন জ্বেলে মশাল তৈরী করে বাড়ীর চারপাশ দৌড়ে ঘুরে আসতে হত । সব বাড়ীর সব ছেলেরাই এটা করত । মশাল নিভে যাবার আগে কে কত বার চক্কর দিয়েছে সেটা নিয়ে বড়াই করতাম আমরা।
      
প্রদীপ জ্বালান, মশাল দৌড়-- এসব করে কি হত বলত ?এতে নাকি ভূতেরা ভয় পেয়ে বাড়ীর চৌহদ্দী ছেড়ে পালায়। পূজোর দিন রাতে কালিবাড়ীতে যে পূজো হচ্ছে সেটা টের পেতাম রাতে শুতে গিয়ে। মানুষ জনের কথাবার্তা, ঢাকের বাদ্যি -- সবই শোনা যেত আমাদের বাড়ী থেকে। কাছাকাছি ছিল কিনা । সকালে পূজোর প্রসাদ পেতাম।
      
কালী পূজোর এক দিন বাদেই ত আবার ভাইফোঁটা। মামার বাড়ীতে ত আমার বোনেরা থাকত না, ওরা থাকত পাবনায়। আর মামার বাড়ীতে মামাত বা মাসতুতো বোনও ছিল না। তাই আমাকে ফোঁটা দেবার কেউ ছিল না।
       
অথচ ছোট  মাসি মামাদের ফোঁটা দিতেন। মামাদের হবে আর আমার হবেনা তা কি হয় ? দিয়ানীই আমাকে সাজ গোজ করিয়ে একসাথে বসিয়ে ফোঁটা দিতেন। খুব মজা লাগত আমার দিয়ানীর হাতে ফোঁটা পেয়ে। তার পর সবার সাথে ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া হত মজা করে।
       
এর আগে শরতের কথা বলতে গিয়ে সন্ধ্যায় হিম পড়ার কথা বলেছি। হেমন্তেসেই হিমের পরিমাণ বাড়ত আস্তে আস্তে।
       
সন্ধেটা হয়ে যেত ধোঁয়াটে। বাইরে খোলা জায়গায় দাঁড়ালে হিম পড়ে চুল ভিজে যেত। চারিদিক কেমন একটা ভুতুরে চেহারা নিত। সকালে ঘাসের ডগায় থাকত বিন্দু বিন্দু শিশির। সেই সব শিশির বিন্দু সকালের রোদে হিরের মত জ্বলজ্বল করত। কোন কোনওটা আবার ভিন্ন ভিন্ন রং ছড়াত। রামধনুর মত।
       
একেবারে প্রথমে লিখেছিলাম যে রোজ একটা ঘুঘুপাখি আমার ঘুম ভাঙাত!হেমন্তের কোন কোন দিন ঘুঘুর ডাকের আগেই ঘুম ভেঙে যেত। শিশিরের শব্দে! নিশ্চয় অবাক হচ্ছ, ভাবছ শিশির পড়ার আবার শব্দ হয় নাকি ? আমি বলি হয়। আমি যে ঘরে শুতাম তার গা ঘেঁসে একটা লিচু গাছ ছিল। বেশ বড়,অন্য লিচু গাছের তুলনায়। তবে সেটা টিনের চালা ছাড়িয়ে বেশী উঁচুতে উঠতে পারে নি। শিশির পড়ে পড়ে সেই গাছের পাতা ভিজে শপ শপে হয়ে যেত। পাতায় জল বেশী হয়ে গেলে গড়িয়ে সেটা টপাত টপাত করে থেমে থেমে পড়ত টিনের চালায়। কি মিষ্টি যে সে শব্দ যে না শুনেছে তাকে বলে বোঝানো যাবে না।
       
ঘুঘু ডাকার আগেই ঘুমটা ভাঙত ঐ শব্দে। আর ঘুম আসত না। কি করে আসবে বল। সেই জলের ফোঁটা টিনের চালা গড়িয়ে মাটিতে পড়ত আবার। এবার শব্দটা হত অন্য রকম। কি রকম ?সেটাও ত বোঝানো যাবে না। তবে শব্দটা ছিল ভারি মিঠে। এর মধ্যেই কখন ঘুঘুটা এসে চালে বসে পড়ত আর ডাকত,'গোপাল ঠাকুর-----'।

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।