সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
অতিরিক্ত আলোর কুফল

অনেক বছর আগের কথা, তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় নি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিয়ে নানাধরনের আবিষ্কারের কথা ভাবছিলেন ওদের বিজ্ঞানীরা! সে সময়ে 'সোভিয়েত দেশ' বলে এক পত্রিকা আসত আমাদের বাড়িতে,যার আমি নিয়মিত গ্রাহক ছিলাম। একটি ভাবনার কথা পড়েছিলাম সেই পত্রিকায়, যা ছিল রাতের আকাশে পৃথিবী জুড়ে দিনের আলোর ব্যবস্থা করা!

মানেটা বোঝা গেল? কিন্তু কি ভাবে আসবে আলো?

রুশ বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী থেকে অন্ধকার দূর করা! পৃথিবীতে যাদের বিদ্যুৎ আছে,অন্ধকার দূর করার জন্য তাদেরও বিদ্যুৎ লাগবে না, আর এর ফলে উদ্‌বৃত্ত বিদ্যুৎ অন্য উন্নয়নমুলক কাজে ব্যয় করবেন!

এর মানে হল সূর্য ডুবে গেলেই রাতে আরও একটা সূর্য উঠবে! কি করে ?

পরমানু চুল্লিতে উৎপন্ন হবে আলো। অতি উজ্জ্বল আলো।সেই আলো ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে, রকেটের সাহায্যে পাঠানো আকাশে রাখা চুল্লী থেকে। চাঁদ উঠুক আর না উঠুক তাতে কিছু এসে যাবে না! কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর সেটা আর করা হয়নি,সম্ভবত পারিপার্শ্বিক নানারকমের পরিবর্তনের আশঙ্কায়!

হয়নি ভাগ্যিস্‌ !

হলে কি বিপত্তিই যে হত!

কি বিপত্তি হত তাহলে ? সেটা বলি। এক কথায় তো বলা যায় না, একটু বিস্তারিত বলি।

আমি এখন কলকাতার কাছে এক শহরতলীতে থাকি। এখানে চারিদিকে অনেক গাছপালা। মফস্বল থেকে যখন আসি সে সময় এখানকার বাড়িগুলোর ফাঁকে ফোকড়ে অনেক জংলী পায়রা থাকত, আর থাকত প্যাঁচা! সমস্ত দিন প্যাঁচাদের দেখা যেত না, কোন আড়ালে-আবডালে ফাঁকে-ফোকড়ে চোখ বুঁজে বসে থাকত। কেন বলত ? আসলে প্যাঁচারা দিনের উজ্জ্বল আলো সহ্য করতে পারে না!

অতিরিক্ত আলোর কুফল

সন্ধ্যা হলেই ওরা জেগে উঠে পায়রা শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ত! প্রতি সন্ধ্যায় প্যাঁচা আর পায়রাদের ডাকাডাকিতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়তাম। প্যাঁচারা পায়রাদের আক্রমন করে ওদের মাংসে ভোজ জমাতো! অনেকদিন জখম পায়রাদেরকে সকালে কাজের লোক এসে উদ্ধার করত বা মৃত পাখির পালক ইত্যাদি ঝাঁট দিয়ে সাফ করত!

কিন্তু ইদানিং আর এমন হয় না। কেন বল দেখি? আমরা কিছুদিন থাকার পর আলোর ব্যবস্থা উজ্জলতর করা হল, যাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাগুলোতে আলো যায়, চোর-ডাকাত লুকিয়ে না থাকতে পারে, পাহারাওলাদের অন্ধকারে অসুবিধা না হয়!

এতে আমাদের সুবিধা হল ঠিকই, কিন্তু প্যাঁচারা অসুবিধায় পড়ে পালালো! পায়রাগুলো আছে কিন্তু প্যাঁচারা নেই!

কারনটা সংক্ষেপে বলি। প্যাঁচা দেখেছ ? মুখের অনুপাতে চোখ ওদের খুব বড় বড়! কারণটা কি, জান? ওরা চোখে কম দেখে, তাই অন্ধকারে দেখতে চোখের যে আলো প্রয়োজন, সেই অল্প আলোয় ওরা দেখতে সফল হয় বড় চোখ হওয়ার সুবাদে। তাই আলো বেশি হলে কিছু অসুবিধা তো হবেই। সুতরাং আলো বেশি হওয়াতে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে খুব অসুবিধায় পড়ে গিয়ে ওরা আমাদের আবাসন ছেড়ে পালিয়েছে! উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে তোমারও তো অসুবিধা হয়, নাকি ? তেমন ওদেরও হল! এখন পায়রাদের সংখ্যা বেড়ে গেছে, ওরা খুব উৎপাত করছে! পায়রা ছাড়াও প্যাঁচারা অন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড়ও শেষ করত!

অতিরিক্ত আলোর কুফল

বাদুরদের আবার অন্য রকমের অসুবিধা! নিজেদের দেখতে অসুবিধা না হলেও বেশি আলোয় ওদের খাদ্য, পোকামাকড়গুলি অন্ধকার ছেড়ে বেরোয় না! ওরা খাবার পাবে কোথায় ? সুতরাং কেটে পড়াই সুবিধাজনক! তাতেই তো প্যাঁচা, বাদুর--এরা সব লোকালয় ছেড়ে আরও অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। তাই ওদের দেখা পাওয়াও মুশকিল। এখন শহরে দেখতে পাও এদের ?

বাদুররা চলে যাওয়াতে কিন্তু আমাদের খুব অসুবিধা হল! কি ভাবে ? বাদুরের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে পোকা মাকড়ের সংখ্যা বেড়ে গেল আর মানুষের অসুখবিসুখ ইত্যাদি অসুবিধা বেড়ে গেল!

অতিরিক্ত আলোর কুফল

কচ্ছপদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় রাতে বেশি আলো থাকলে! টেলিভিশনে নিশ্চয়ই দেখেছ কি করে কচ্ছপের বাচ্চাগুলো ডিম ফুটে বেরোবার পর বালির গর্ত থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে চলে যায় ?

ওদের চিরকালীন অভ্যাস হল ওরা আলো দেখলেই সাড়া দেয়। ওরা সাধারনত রাতে গর্ত থেকে বেরোয়। গর্ত থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলো দেখে অনুসরণ করতে করতে সমুদ্রে নেমে যায় আস্তে আস্তে।

কিন্তু সমুদ্রের পাশে রাস্তায় মানুষ প্রচুর আলোর ব্যবস্থা করে নিজেদের সুবিধার জন্য। কচ্ছপ চারিদিকে অত উজ্জ্বল আলোর মধ্যে চাঁদকে দেখতেই পায় না। পথের আলো দেখে ওরা চাঁদের দিকটা পুরো গুলিয়ে ফেলে, সমুদ্রে না গিয়ে রাস্তার দিকে চলে যায়, আর গাড়ি চাপা পড়ে!

অতিরিক্ত আলোর কুফল

মানুষেরও নানা অসুবিধা হয় আলোর প্রভাবে! জানালা দিয়ে বেশি আলো ঢুকলে রাতে ঘুমের অসুবিধা হয়। কেন হয় বল দেখি! অন্ধকারে আমাদের দেহে একরকমের রস নিঃসৃত হয়, যার নাম 'মেলাটোনিন'। এ রাসায়নিকটি আমাদের খুব উপকার করে। ঘুম বাড়ায়, অন্যান্য শারিরীক অসুবিধা যেমন, রক্তচাপ, রক্তের শর্করা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রন করে। রাতে জানালার আশপাশে উজ্জ্বল আলো থাকলে আর গায়ে লাগলে এ রস নিঃসৃত হতে পারে না। ফলে নিদ্রাহীনতা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, রক্তে শর্করা বৃদ্ধি ইত্যাদি রোগে আমরা আক্রান্ত হই।

তাহলে পুজোর সময় জানালার দিয়ে পাড়ার মন্ডপের আলো ঘরে ঢুকে পড়লে কি ঝামেলা বলত !

অতিরিক্ত আলোর কুফল

কোকিলরা রাত দুটো আড়াইটার সময় হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠে! এমনিতে সকালে কুহু কুহু করার কথা,রাতে ডেকে ওঠে কেন বলতে পারো ? চারিদিকে এত আলো দেখে সময় হওয়ার আগেই জেগে যায়! কম ঘুম হলে ওদেরও অসুবিধা হওয়ার কথা, কিনা বল !

আমাদের শরীরটা একটা যন্ত্রের মত, সব কিছুতেই একটা নিয়ম মেনে চলার কথা আমাদের, যা নিয়ন্ত্রন করে একটা অদৃশ্য ঘড়ির মত কিছু, যাকে বলে Biological clock বা জৈবিক ঘড়ি। প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে সব কিছু। তাই রাত জেগে টিভি/সিনেমা দেখা, বই পড়া বা অন্য কারণে রাত জাগা খুব খারাপ অভ্যাস! কিছু মানুষকে বাধ্যতামুলক ভাবে রাতে কাজ করতে হয়। তাঁদের নানা শারিরীক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। রাত জাগলে জৈবিক ঘড়ির চলন বিঘ্নিত হয়, ফলে শরীর গোলমাল করে। তাই রাতে অন্ধকার ঘরে অন্ততঃ ৭/৮ ঘন্টা ঘুমোন প্রয়োজন।

সুতরাং অন্ধকার দূর করতে গিয়ে আলো তো জ্বালাতে হবে। কিন্তু তাই বলে যথেচ্ছ জ্বালানো চলবে না!

কারণ, আলো বেশি হলেই বিপত্তি!


ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও পিক্সাবে

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা