খেলাঘরখেলাঘর

স্বাধীনতার গল্প

 

কি কেমন আছ তুমি? সেই পুজোর সময়ে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। এই শীত কেমন উপভোগ করছ? সব আমাদের লিখে জানিও কিন্তু।
তবে আমি কিন্তু একটা কথা জানি – এতো সব কিছুর মধ্যেও কিন্তু তোমার মনে সেই প্রশ্নটা লুকিয়ে আছে – ‘ফারুকশিয়রের ফরমান’-এ কি এমন ছিল যে সারা বাংলায় আগুন জ্বলে উঠল?
আসলে কি জান, মোগল সম্রাট ঔরংজেবের পর কোনো মোগল সম্রাট-ই আর সেই বিশাল সাম্রাজ্যকে সেভাবে বেঁধে রাখতে পারেননি। নামেই তাঁরা সম্রাট ছিলেন।ফারুকশিয়র-ও তাই।তখন বাংলার নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি বাংলার বুকে দাপটের সাথে স্বসাশন চালাতেন। মোগল সম্রাটের অধীনতা শুধু একটা তকমা ছিল।মোগল সম্রাটের নীতির বিরোধিতা করলেও তিনি কখনই তার অবমাননা করেন নি।
‘ফারুকশিয়রের ফরমান’-বেশ জটিল ব্যাপার। তবে তোমাকে তো ব্যাপারটা জানতে হবে!তোমায় বরং চুম্বকে বলিঃ
ফারুকশিয়রের ফরমান অনুসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
১) মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনাশুল্কে বাংলায় বানিজ্য করার অধিকার পায়;
২)কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের পাশাপাশি আরও ৩৮-টি গ্রাম কেনার অনুমতি পায়।
৩)প্রয়োজনে মুর্শিদাবাদের অর্থাৎ বাংলার নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহার করার অনুমতি পর্যন্ত লাভ করে।
১৭১৭ সালের এই ফর্মান কে ঘিরে বাংলার তখনকার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর সংগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ চরমে ওঠে, কারণ, মুর্শিদের মত প্রতাপশালী নবাবের পক্ষে এই ফর্মান নীরবে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এর জন্যে বিরাট বানিজ্য শুল্ক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। কোম্পানির নিঃশুল্ক বাণিজ্যের ফলে দেশীয় বণিকদের বিরাট ব্যবসা কমে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তবে নবাবের পক্ষে এই সনদকে অস্বীকার করা অসম্ভব ছিল, কারন নবাবের যতই ক্ষমতা থাক না কেন, আসলে তিনি ছিলেন দিল্লী-র সম্রাটের অধীনস্থ কর্মচারী। আইনতঃ  সম্রাটের আদেশ মানতে তিনি বাধ্য। মুর্শিদ ছিলেন বিচক্ষণ নবাব। তাই তিনি সরাসরি এই সনদের বিরোধীতা না করলেও, পরোক্ষভাবে কোম্পানি যাতে এর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে না পারে, সে চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেন নি। মুর্শিদ কোম্পানিকে সরাসরি জানিয়ে দেন যে তারা কেবল আমদানি-রপ্তানী বানিজ্যে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পাবে; দেশের মধ্যে ব্যবসার ক্ষেত্রে এই সু্যোগ তারা পাবে না। কলকাতার কাছে ৩৮ তা গ্রাম কেনার ক্ষেত্রেও তিনি প্রবল বাধা সৃস্টি করেন। ওই সব গ্রামের জমিদারদের তিনি অনু্রোধ করেন যাতে তাঁরা কোম্পানিকে ওই সব গ্রাম বেচতে রাজী না হন। মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের কাজেও তিনি গোপনে বাধা দেন। মুর্শিদের এই প্রবল আভ্যন্তরীন প্রতিরোধের ফলে কোম্পানি বাংলার নবাবের সাথে বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হন। বন্দোবস্তে এই ঠিক হয় যেঃ
১)কোম্পানির বাংলা থেকে রপ্তানি করা দ্রব্যের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে।
২) কোম্পানি বাংলার ভিতরের বাণিজ্যে দস্তকের ব্যবহার করতে পারবে না।
৩) কয়েকটি পণ্য যেমন লবণের ব্যবসা কোম্পানি করতে পারবে না।
৪) কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই দস্তকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু এত করার পরও কোম্পানির বানিজ্য বাড়তে থাকে খুব তাড়াতাড়ি। এই দস্তকের অপব্যবহার করে তারা শুল্ক ফাঁকি দিতে থাকে। কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে এই দস্তক ব্যবহার করা শুরু করে। এর ফলে বাংলার নবাবের প্রাপ্য শুল্কে বিরাট ফাঁকি পড়তে থাকে। অন্যদিকে দেশীয় বণিকরা শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করার ফলে তাদের ব্যবসা মার খেতে থাকে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে বারংবার অভিযোগ জানালে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেন।
মুর্শিদকুলির যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন (১৭২৭-৩৯)। তিনি সরাসরি কোম্পানির বাণিজ্যে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করে তাঁদের পর্যুদস্ত করে তোলেন। নানা অজুহাতে ইংরেজ বণিকদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতে থাকেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তিনি কাশিমবাজার কুঠির ‘ভকিল’-কে আটক করেন। সুজাউদ্দিনের কঠোর মনোভাবের জন্য ফারুকশিয়র অনুমোদিত দস্তকের অপব্যবহার খুবই কমে গিয়েছিল। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে তাঁর অযোগ্য পুত্র সরফরাজ। তিনি ছিলেন অপদার্থ ও অযোগ্য শাসক। তিনি সারাদিন বিলাস-ব্যসনে মত্ত থাকতেন। কোম্পানির বণিকরা এই চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেওয়ার আগেই বিহারের নায়েক নাজ়িম আলিবর্দী খাঁ গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে বসেন। নবাব আলিবর্দী এককথায় বলতে গেলে বাণিজ্যের বাইরে বিদেশী বণিকদের ক্ষমতা বিস্তারের বিশেষ সু্যোগ তিনি দেন নি। তিনি মনে করতেন  ইউরোপীয় বণিকদের শ্রীবৃদ্ধির ওপর বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে কোনো সময়েই তিনি ইংরাজ বণিকদের অন্যায় দাবীর কাছে মাথা নোয়ান নি। প্রথমতঃ তিনি নিজের সার্বভৌম ক্ষমতা ও মর্যাদা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ ইংরাজ বণিকরা যাতে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে না পারে সে দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। বিদেশী বণিকরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি তা কঠোর হস্তে দমন করতেন। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত নবাব আলিবর্দীর আমলে ইংরেজ বণিকরা বাংলায় ব্যবসা করা ছাড়া বিশেষ কোনো ক্ষমতার শ্রীবৃদ্ধি করতে পারেন নি।
এর পর কি হল?...জানি তোমার রূদ্ধশ্বাস অপেক্ষা রইল। কি করব বল, তোমার-আমার অন্য বন্ধুদের ও তো জায়গা দিতে হবে, না কি!

 

 

আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা

আর্য চ্যাটার্জি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বেশ কয়েকবছর বিভিন্ন ইংরেজি পত্র-পত্রিকায় নানা বিষয়ে লেখালিখি করেন। বর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্যের টানে একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। হাওড়া সালকিয়ার বাসিন্দা আর্য নিয়মিত গান বাজনার চর্চা করেন; নিজের ইচ্ছায় একাধিক তাল যন্ত্র বাজানো রপ্ত করেছেন তিনি। নিজের শখের কিছু লেখা আর ইচ্ছামতী-তে লেখা ছাড়া এখন আর কোনো পত্র-পত্রিকার সঙ্গে আপাততঃ যুক্ত নন। শখের লেখা ব্লগে লেখেন। বেশিরভাগই বড়দের জন্য কবিতা।