খেলাঘরখেলাঘর

স্বাধীনতার গল্প

পূজো এসে গেল, মানে পূজোর ছুটি-ও এসে গেল। নতুন জামা-কাপড় পরে বড়দের সঙ্গে ঠাকুর দেখা, কত্তো রকমের খাবার খাওয়া, বন্দুক নিয়ে টিভি-র সুপার হিরো হয়ে যাওয়া – এত কাজের মধ্যে কি আর আমার গল্প শুনতে ভাল লাগবে? তুমি পড়াশোনা কর নম্বর পাওয়ার জন্য। আমি কিন্তু লিখি তোমার মন ভাল থাকবে বলে। এর সঙ্গে ভাল-খারাপ, পাশ-ফেল এসবের কোন সম্পর্ক নেই।এই সংখ্যা থেকে আমি তোমাকে একটা বিরাট বড় গল্প বলতে শুরু করলাম। এই গল্প আমাদের দেশের সুপার-হিরোদের নিয়ে,যাঁরা আমাদের এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা, উতসর্গ করেছেন নিজেদের প্রাণ। এখন আমরা তো স্বাধীন হয়ে গিয়েছি, তাই ঠিক বুঝব না কাজটা কত কঠিন ছিল। তোমার ঐ গল্পের সুপার-হিরোরাও হার মেনে যাবে, এঁদের সত্যিকারের গল্পের কাছে।

তুমি তো জান যে, ইংরেজরা আমাদের দেশকে প্রায় দু’শো বছরের ও একটু বেশিদিন শাসন করেছেন বটে, কিন্তু, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শান্তিতে রাজত্ব তাঁরা করতে পারেন নি।

তখন ১৬০০ সাল। ইংল্যান্ডের রানী তখন এলিজাবেথ। পৃথিবীর খুব পরাক্রমী, শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একটা ছিল ইংল্যান্ড। ব্যবসায়ীক পরিধি বাড়ানোর জন্য রাণী নিজে এক বাণিজ্যিক সংস্থাকে প্রাচ্যে ব্যবসা করার অনুমতি দেন। সেই সুবাদে ‘ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নাম হয় তার। ইউরোপে বিরাট তার ব্যবসা, বিশাল তার প্রতিপত্তি।

ভারতে দিল্লির সিংহাসনে তখন আউরঙ্গজেবের দাদু জাহাঙ্গীর। সাল ১৬০৮। ততদিনে ইংল্যান্ডের মসনদে রাজা প্রথম জেমস। ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে আসেন।তাতে খুব একটা কাজ হয় না।কিন্তু কোম্পানি হাল ছাড়ে নি। আবার ১৬১৫ সালে স্যর টমাস রো –কে আবার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে পাঠায় কোম্পানি।এবার কোম্পানির ভারতে আসার বানিজ্যিক উদ্দেশ্য সফল হয়।

শুনলে অবাক হবে যে তখন বঙ্গদেশ বিদেশী দের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল। কলকাতার খুব কাছ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। সরস্বতী তার নাম। তবে এখন যে কোনো সাধারণ সরু খাল-ও তার থেকে চওড়া। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে কোম্পানির বিরাট বিরাট জাহাজ ঐ নদীপথেই যাতায়াত করত।

যাক গে, যে কথায় ছিলাম তাতে ফিরে আসি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর কোম্পানি তাদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয় বাংলার হুগলী ও ওড়িশার বালেশ্বরকে। এছাড়া ইংরেজরা আগ্রা, আমেদাবাদ, সুরাট, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বানিজ্য-কুঠি স্থাপনের অধিকার পায়।

ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি যাঁরা চালাতেন, মানে তার যে বোর্ড অফ ডিরেক্টরস, ভারতে ব্যবসা করতে আসার আগে তাঁরা তাঁদের মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নেন যে কোম্পানি ভারতে শুধুমাত্র ব্যবসা করতেই যাবে; সেখানকার রাজনীতি বা সমাজতন্ত্রে কোনও ভাবেই নাক গলাবে না। ব্যবসা করতে ঠিক যতটুকু প্রয়োজন সেইটুকু কূটনীতির ব্যবহার করা যাবে।

কোম্পানি ব্যবসা করতে এল ভারতে সেই নীতি নিয়ে। ব্যবসাও বেশ ফুলে ফেঁপে উঠল। কিন্তু কোম্পানিতে কর্মরত বিভিন্ন সাহেব আধিকারিক ও কর্মচারী-দের লোভ বাড়তে থাকে। তখন তারা ঐ অনুমোদিত কূটনীতি-কে অস্ত্র করে নিজেদের অত্যধিক লাভের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেন।

১৬১৫ সালে যখন স্যার টমাস রো সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি নিচ্ছেন, তখন কিন্তু পর্তুগীজ-রা ভারতে জাঁকিয়ে ব্যবসা করছে। পশ্চিম ভারতে ইংরেজরা সুরাটে তাদের প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে। পর্তুগীজদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না রাখলে সেখানে ব্যবসা করাই দায়। তাই ১৬৬১ সালে কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগীজ রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রাগানজা কে বিয়ে করেন। আর বিয়ের যৌতুক হিসেবে পান গোটা বোম্বাই শহর।রাজা দ্বিতীয় চার্লস আর ইংল্যান্ড-এ বসে বোম্বাই নিয়ে কি করবেন! প্রত্যেক বছর ১০ পাউন্ড কর পাওয়ার বিনিময়ে রাজা এই বোম্বাই শহর কোম্পানিকে দিয়ে দেন।

অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি কোন সুযোগ ছাড়েনি। তারা মাদ্রাজে তৈরী করে এক সুরক্ষিত কুঠি। আউরংজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে শুল্ক দেওয়া নিয়ে ইংরেজ আর মোগলদের যুদ্ধ শুরু হয়। বাংলার শক্ত ঘাঁটি হুগলী ছেড়ে ইংরেজরা চলে যায়। আবার পরে দুই পক্ষের সন্ধি হলে জোব চার্ণক নামে কোম্পানির এক ইংরেজ কর্মচারী হুগলী নদীর তীরে সুতানূটি গ্রামে এক কুঠি তৈরী করেন। ধীরে ধীরে সুতানূটি, গোবিন্দপুর ও কোলকাতা গ্রাম নিয়ে পত্তন হয় কলকাতা শহরের। এর ও কিছুদিন পরে ১৭০০ শালে তৈরী হয় ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ। পরে যে কোলকাতা শহর ইংরেজদের ভারত শাসনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে, সে তো তোমার জানা।

মোগল সম্রাট অনুমতি দিলে কি হবে, এই বিদেশী ব্যবসায়ীদের অনেক ভারতীয় রাজাই কিন্তু পছন্দ করতেন না। বলতে গেলে এঁদের সঙ্গে ইংরেজদের আদায়-কাঁচকলায় ছিল। এঁদের মধ্যে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ, সুজাউদ্দিন খাঁ, আলিবর্দী খাঁ, হায়দরাবাদের শাসক চিন কিলিজ খাঁ, মহীশুরের রাজা দেবরাজ ও নজ্ঞরাজ, অযোধ্যার শাসক সাদ্দাত খাঁ, আবুল মনসুর খাঁ, মারাঠার শাসক শাহু, বালাজি বিশ্বনাথ, বালাজি বাজিরাও, কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলি ও আরও অনেকের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক খুব খারাপ হয়।

দিল্লীর মসনদে তখন ঢাল-তরোয়াল-বিহীন সম্রাট ফারুকশিয়র। তাঁকে ব্যবহার করে বাংলায় হঠাত্ জারী হয় ‘ফারুকশিয়রের ফরমান’। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরাট কূটনৈ্তিক জয় হয় বটে, কিন্তু সারা বাংলায় আগুণ জ্বলে ওঠে।
প্রায় ১০০ বছরের কিছু বেশি দিনের গল্প  শুনে ফেললে তুমি। বলতে পারো আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুপার হিরোদের যুগ শুরু হল এখান থেকেই।
বিভিন্ন পর্বে আমি পর পর সেই সব বীরগাথা তোমাকে বলব।  কেমন লাগছে, আমাকে জানিও কিন্তু।

 

 

আর্য চ্যাটার্জি
কলকাতা

 

আর্য চ্যাটার্জি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বেশ কয়েকবছর বিভিন্ন ইংরেজি পত্র-পত্রিকায় নানা বিষয়ে লেখালিখি করেন। বর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্যের টানে একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। হাওড়া সালকিয়ার বাসিন্দা আর্য নিয়মিত গান বাজনার চর্চা করেন; নিজের ইচ্ছায় একাধিক তাল যন্ত্র বাজানো রপ্ত করেছেন তিনি। নিজের শখের কিছু লেখা আর ইচ্ছামতী-তে লেখা ছাড়া এখন আর কোনো পত্র-পত্রিকার সঙ্গে আপাততঃ যুক্ত নন। শখের লেখা ব্লগে লেখেন। বেশিরভাগই বড়দের জন্য কবিতা।