খেলাঘরখেলাঘর

পুজোর চিঠি

(১)

প্রিয় দাদুভাই,                                                        

কি করছো তুমি?এখন?আমার একদম ভাল্লাগছেনা মনটা।কি করি কি করি উশখুশানির মাঝেই হাল্কা নীলচে ইনল্যান্ড নিয়ে বসে গেছি।বুকের তলায় বাঁধানো খাতার ওপরে ইনল্যান্ড রেখে লিখতে বসেছি তোমায় এখন,তোমার পাঠানো কালিপেনটা সুলেখাতে চুবিয়ে।
ঘড়িতে দশটার ঘন্টা সবে পড়লো ট্যাং ট্যাং করে।বাবা অফিসে বেরিয়ে গেছে আধ ঘন্টা আগেই।অন্য সময় হলে এসময় ফিটফাট হয়ে সাইকেল নিয়ে চোঁ করে ...স্কুলে।কিন্তু আমার কলার ওঁচানো লাল টুকটুকে সাধের সাইকেলটা গোঁত্তা খেয়ে মুখ ভার করে উঠোনের চৌবাচ্চার পাশে বন্দী।আমার জ্বর!বাইরে ঘরের হলদেটে সানমাইকারে মোড়া উঁচু ডিভানের বেশ তুলতুলে গদিতে আমি বন্দী,সামনে জাল লাগানো জানলার গরাদ আর গরাদের ওপারে মেঘলাটে রোদ আর ঝুপঝুপে বৃষ্টির লুকোচুরি,মাঝে মাঝে বাগান ভরা জল আর জলে কিলবিলে তেচোখা মাছ আর সাঁই করে টেঁরিয়ে বেঁকিয়ে চলে যাওয়া হেলে সাপ।আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।অন্যবারের মতো।আকাশের মুখভার কি আমায় দেখেই!কে জানে?জানলায় বসেই বাইরেটা দেখা... গেলোবারে দেখা অমল ও দইওয়ালা নাটকের অমলের মতো।ফিক করে হাসি পেলো।উঁচু ক্লাসের বাংলার স্যার গোপাল জ্যেঠু একতাড়া কাগজ দেখে এমন জোরে পেছন থেকে ডায়লগ গুলো বলে দিচ্ছিলো যে যারা নাটক করছে তাদের থেকে জ্যেঠুর আওয়াজ বেশী পাওয়া যাচ্ছিলো।স্যার দিদিমনিরাও তো হেসেই কুটিপাটি।আমিও যেন সেই অমল।কিন্তু আমার এই জানলাটা এক্কেবারেই রাস্তার ওপরে নয়।তারওপর জানলার ঠিক ওপারেই...বারান্দায় টাঙানো তারে, মা সার সার করে শাড়ী মেলে দিয়েছে শুকোতে,এই মেঘ বাদলের দিনে।টুপ টুপ করে জল পড়ছে লাল নীল হলদে শাড়ী বেয়ে...চুঁইয়ে চুঁইয়ে।লোহার গেট ছাড়া অনেকটাই দেখা যাচ্ছে না বাইরের।মনটা কি করি কি করি করছে আবার আনচানও করছে শরীর খারাপে।
ঠিক কালকে , এমন সময়ে গেটে সাইকেলের কিড়িং!চেনা শব্দ।মোটাসোটা কাকুটা,খাঁকি ফুল শার্ট আর ফুল প্যান্টের।সাইকেলের দুপাশে কালো ইয়াব্বড় ব্যাগে আমাদের স্বপ্ন দিয়ে বাড়ী বাড়ী গিয়ে গেটের সামনে সাইকেল থামিয়ে ঐ একটা আওয়াজে মনটা খুশীতে ঝলমলিয়ে দেয়...কিড়িং।কাকুর নাম জিজ্ঞেস করিনি কখনো।কেন?জানিনা,ভাবিইনি কখনো হয়তো।গা থেকে লেপ ছেড়ে এক দৌড়ে গেটের সামনে।মুখে এক ফালি মায়াবী হাসি নিয়ে গেটের লোহার শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে আমাকে বাড়িয়ে দিলো আমার অদেখা জানলা,এমাসের নতুন শুকতারা।আমার সব মুখভার সূর্য্য ওঠা রোদের মতো ঝকঝকিয়ে হেসে ফেললো।নাচতে নাচতে বাইরে ঘরের ডিভানে আবার।ততক্ষনে মা এসে গেছে হাত মুছতে মুছতে।রান্না করছিলো মাগুর মাছের ঝোল, হাল্কা গোলমরিচ দিয়ে।‘বাবলাই... তুই খালি পায়ে কেনো বেরোলি? তোকে বললাম না হাওয়াই চটি পরে বেরোতে?আবার জ্বরে পড়লে কি হবে?’ আমার কানেই ঢুকছেনা মায়ের রোজকার ঢিস্যুম ঢিস্যুম।আমি একমনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি নতুন শুকতারার গন্ধ শুঁকতে।
বাঁটুলের বুকফোলানো অবিশ্বাস্য কান্ড কারখানা পড়ে যা হাসি পায় না!আর হাঁদাটার ওপর খুব রাগ হয়;ঠাস ঠাস করে দুটো চড় কষিয়ে দিলে ভালো হতো।অনেকটা আমাদের কেল্টুদার মতো।কেল্টুদার যেমন যত কেদ্দানি নন্টে-ফন্টের ওপর!তেমনি হাঁদাটার খালি ধান্দ্বা বেকায়দায় ফেলা ভোঁদাকে!আর ভোঁদাটা কিন্তু ভীষন মিচকে; কেমন বোকা বোকা মুখ করে থাকে আর একদম শেষে গিয়ে পট করে জিতে গিয়ে কিরকম বিজ্ঞের হাসি দেয়!তখন হাঁদার মুখটা দেখে যা হাসি পায় না!দাদুমনির চিঠি পড়ে ফেলি মন দিয়ে।তারপর পাতা ওল্টাই... ফর্ ফর্।এপাতা ওপাতা,কোনটা যে আগে পড়ি!এমন সময় মায়ের গলার আওয়াজ।মা চান করতে ডাকছে!হিটারে হাঁড়ি ভর্তি গরম জল বাথরুমের বালতিতে ঢেলে,চৌবাচ্চার জলের সাথে মিশিয়ে।খোলা শুকতারাটা বিছানায় উপুর করে ফেলে রেখে উঠে পড়লাম আড়মোড়া দিয়ে।আজ এটুকুই।আমার এত্তো ভালবাসা নিও।ও আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গেছি।জানোতো, মা সেদিন কাঁদছিলো তোমার কথা বলে আর বলছিলো তোমার নাকি অসুখ হয়েছে? কি অসুখ গো?জ্বর? সেতো আমারো হয়েছে!বাবা ছুটি পেলেই আমরা তোমাকে দেখতে যাবো , মা বলছিলো।কিন্তু বাবার অফিসের খুব চাপ এখন ,বাবা বলছিলো।খুব রাগ হয় বাবার ওপর;খালি কাজ...কাজ... কাজ !তবে পূজোতে তো যাচ্ছিই তোমার কাছে।এখনো মা নিয়ে যায় নি গো কলোনী মার্কেটের ক্যালকাটা টেলরে ।শার্ট আর প্যান্টের পিসগুলো আলমারিতেই বন্দী এখনো।তোমার পূজোর বাজার হয়ে গেছে দাদুভাই? কেমন আছে সবাই ওখানে?

ইতি তোমার বাপন