খেলাঘরখেলাঘর

 

পুজোর চিঠি


(২)
স্নেহের বাপন,   

তোর চিঠি পেয়েই মনটা ভালো হয়ে যায়।এখানে সবাই ভালো।নারে এবাড়ীর পূজোর বাজার হয়নি এখনো।এ্যাই জানিস তো,তোর বড়মামা একটা হাঁসের বাসা তৈরী করেছে বাড়ীর ভেতরে।বেশ বড়সড় আর লম্বাটে।ভেতরে হাঁসগুলো প্যাঁকপ্যাঁকাচ্ছে রাত দিন।তোর দিদা মাঝে খুব রেগে গেছিলো।একদিন একটা হাঁস নাকি ঠোঁট বাগিয়ে তেড়ে এসেছিলো তোর দিদার দিকে।সেই থেকে তোর দিদা আর ওই ঘরে ওদের খেতে দিতে যায়না।তোর বড়মামাকে তো জানিস,রোজ সক্কালে উঠে তিনতলার ঘরে পূজো টূজো সেরে লুঙ্গি পরে গামছা কাঁধে নিয়ে নীচতলার মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড়ে যায় ডুবকি লাগাতে।ভুস ভুস করে চারপাঁচটা ডুব মেরে ঠাকুর প্রনাম সেরে ,ওর সাধের হাঁসেদের জন্য কেঁচো,গেঁড়ি গুগলি, পোকা মাকড় জোগাড় করতে যায় জেলেদের কাছে।জেলেরা এর মধ্যেই সপাং করে নীল জাল ছড়িয়ে দিয়েছে পুকুরের জলে আর ছোট ছোট ভেলা নিয়ে সারা পুকুর ভেসে বেড়াচ্ছে মাছ ধরার জন্য।আমি দোতলা ঘরের জানলা দিয়ে সব দেখি।সক্কালের হলদেটে রোদ্দুর পুকুরের সবুজ পানা কচুরী ঢাকা জলে পড়ে চক চক করে ওঠে আর কালো কালো জেলেদের নীলচে জালে রুপোলী মাছে রোদের হলদে রঙ পিছলে গিয়ে চোখটা ধাঁধিয়ে দেয় জানিস।তোর বড়মামা সদর দরজা খুলে সোজা ঢুকে যায় হাঁসেদের ঘরে।সকাল সকাল খাবার দাবার খেয়ে হাঁসগুলোর সে কি প্যাঁকপ্যাঁকানি রে!আমার এখন নীচে যাওয়া বারণ,তাই আমি ওপর সব দেখি বাপন।নারে সোনা আমার জ্বর জ্বালা হয়নি।আমার শরীরে একটা কালচে ঘা ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরের বেশীরভাগ ঘরে।রক্তকে দূষিত করে দিয়েছে ওই ঘা-টা।এই ঘা-এর কোনো চিকিতসে এখনো নেই দাদু।আমি তাই এখন জীবনটাকে বেশী বেশী করে উপভোগ করছি।খুব ছোট ছোট জিনিষেও খুব মজা পাওয়ার চেষ্টা করছি।আর আশ্চর্য্য কি জানিস,মজা পাচ্ছিও!এই ছুটির দিনগুলোতেই আমি বুঝেছি আরো বেশী করে আমাদের হাতেই আছে আমরা কিসে মজা পাবো আর কিসে মজা পাবোনা এর চাবিকাঠি!আমি যখন তোর মতো ছিলাম ,এই ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়তাম,তোর মতো আরাম তো আমি পাইনি কখনো।আমার জীবন ছিলো কষ্টে ভরা।আমার স্কুল মাষ্টার বাবা সিল্কের ব্যবসা করতে গিয়ে ভিটে মাটি সর্বস্ব খুইয়ে বসে।আর আমি পড়াশোনার নেশায় মাহেশের কাছে এক জমিদার বাড়ীর আশ্রিত হয়ে বড় হতে থাকি।সেসব বড় কষ্টের দিন রে দাদু।আমার খাওয়া হতো মন্দিরের ভোগে।আর সারাদিন জমিদার বাড়ীর নানা কাজকম্মের ফাঁকে ফাঁকে নানা পড়াশোনা।এভাবেই আমার কেটে গেছে তোর মতো বেলাটা।এখন তাই তো তোকে বলি,বড় হবার কথা ভাববিনা।বড় হলেও মজা আছে কিন্তু ছোটবেলার মজাটা সবচেয়ে সেরা মজা জানিস।ভাববি কি করে মজা করবো আরো…রোজ।আমি এখন জানি আর কিছুদিন পরেই এই পৃথিবী থেকে আমাকে চলে যেতে হবে।কেন জানিনা আমার মনে হয় আমি আবার আমার ছোটবেলায় ফিরে গেছি।তাই তো দোতলার ঘরের এই কাঠের চেয়ারটায় বসে আমি আমার ছোটবেলার আনন্দগুলোকে দেখতে চাই রোজ।কি যে মজা লাগে রে।যেন উলোটপূরাণ!বেলা বাড়লেই পুকুরের ওপারের ডোমপট্টির ছেলে গুলো ঝপাং ঝপাং করে করে লাফিয়ে পড়বে জলে,হাপুস হুপুস করে চান করবে।মাছরাঙা পাখিটাও দত্তবাড়ীর পুকুর ঘেঁষা বাঁশ ঝাড় থেকে নজর রাখবে বুদবুদকরে চোখ পিটপিটানো মাছের দিকে।সুযোগ পেলেই সোঁ করে উড়ে এসে খপ করে ধরবে কোনো মৃগেল পোনা।
রাস্তা দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে লাল দই যাবে নীচে।লাল লাল ইট ভর্তি গাড়ী যাবে গাঁক গাঁক করে।আর কত যে লোক যায় সারাদিন,আমি শুধু দেখতেই থাকি।এই বয়সে এসে মনে হয় রবীঠাকুরেরও নিশ্চয়ই এমন দিন গেছে না হলে ডাকঘরের মতো ছবি বড়বেলায় আঁকা যায়?
বাবার ওপর রাগ করিস না রে।কত দায়িত্ব জানিস তোর বাবার?হুট করে দায়িত্ব ছেড়ে চলে এলে আমিই তো রাগ করবো।পূজোর ছুটিতে আসবি যখন অনেক কথা হবে।আমি কিন্তু তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবো বাপন...

ইতি,দাদুভাই