খেলাঘরখেলাঘর

নীল ছাতা

হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রামে থাকে বীণা। পড়ার সাথে সাথে সে বাড়ির অনেক কাজ করে দেয়,বন্ধুদের সাথে খেলে আবার রাগ হলে ঝগড়া করতেও ছাড়ে না।
বীনা
বীনা

তাদের গ্রামটা খুব সুন্দর  তাই মাঝে মাঝেই ট্যুরিস্টরা সেখানে ঘুরতে আসে, সবার ছবি তোলে...গ্রামের বাইরের মাঠে তখন যেন এক জমজমাট আসর বসে। আর সেই সময় নন্দকিশোরের ফূর্তি দেখে কে। ও নন্দ কিশোরকে তুমি চেনো না বুঝি? নন্দকিশোর হল এক মুদি। যার দোকান থেকে গ্রামের মানুষরা সারা বছর কেনাকাটা করে আর নন্দকিশোর মাঝে মাঝেই সেই গ্রামের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে,পয়সার গরম দেখায়। বিদেশীদের ডেকে ডেকে গরম কোকাকোলা খাওয়ায় আর বলে যে তার তো ফ্রিজ নেই তাই ঠান্ডা করবে কোথা থেকে?

নন্দ
নন্দকিশোর
জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ী এই ধরনের গ্রামে যদি তুমি কোনোদিন যাও তাহলে দেখবে সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই খুব গরীব,কষ্ট সহিষ্ণু। কারণ তাদের কাছে পৌঁছোয় না জীবন ধারণের প্রাথমিক সুযোগটুকুও। এই রকমেরই একটা গ্রামের মেয়ে বীণা। যার গলায় ভাল্লুকের নখ দিয়ে তৈরী একটা মাঙ্গলিক লকেট দেখে এক জাপানী ট্যুরিস্টের খুব পছন্দ হবে আর সে তার নীল রঙের ছাতার বিনিময়ে লকেটটা নিয়ে নেবে। বাড়িতে ফিরে বীণা অবশ্য বকুনি খাবে কিন্তু তার সেই ছাতা দেখে গ্রামের মানুষরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।

ছাতা

গ্রামে বীণার খাতির যত্ন বেড়ে যাবে। সবাই তাকে সমীহ করে চলবে। বন্ধুরাও শুনতে থাকবে তার কথা। আর এদিকে দুষ্টু নন্দকিশোর হিংসায় জ্বলতে থাকবে। তার ঠিক ওই রকম একটা ছাতা চাই। কিন্তু পাবে কোথা থেকে? অজ পাড়াগাঁয়ে ছাতা বললেই কি আর ছাতা পাওয়া যায়? তাও আবার জাপানী ছাতা!

 নন্দকিশোর বীণার কাছ থেকে ছাতাটা কিনতে চায়। কিন্তু বীণা দেবে কেনো? ছাতাটা যেন তার প্রাণ...তেপান্তরের মাঠ...রাজকন্যের জীয়ন কাঠি। বীণা ছাতা দেয় না,বরং ডাকাবুকো মেয়েটা বলে আসে খবরদার নন্দকিশোর তার ছাতার দিকে যেনো ফিরেও না তাকায়। কিন্তু তাই কি হয়? নন্দকিশোর তার দোকানের পুঁচকে বদমাশ ছেলেটাকে দিয়ে ছাতাটা চুরি করে। বীণা তন্নতন্ন করে খোঁজে,ছাতা পায় না। সে পুলিশ কাকুদের বলে নন্দকিশোরের ঘরে তল্লাশি চালায় কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় না। হঠাত একদিন সবাই দেখে নন্দকিশোর একটা  লাল রঙের জাপানী ছাতা মাথায় দিয়ে ঘুরছে। গ্রামে তার প্রতিপত্তি আবার বাড়তে থাকলো আর সবাই বীণা আর তার বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিলো। মনমরা হয়ে থাকলো বীণা। একদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো সে পিছু নিলো নন্দকিশোরের। আর সেখান থেকেই জানতে পারলো নন্দকিশোর আসলে তার ছাতাটা চুরি করে রঙ করে ফেলেছে।

এদিকে গ্রামে খুব ঘটা করে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। সভাপতির আসন অলংকৃত করছেন নন্দকিশোর। তার তো অহংকারে আর মাটিতে পা পড়ছে না। এই রকম এক সময় হয়েছে কি বৃষ্টি নেমেছে। আর পাহাড়ের বৃষ্টি জানোই তো কেমন তেড়ে হয়। সেই বৃষ্টির পরোয়া না করেই নন্দকিশোর তার ছাতা নিয়ে খেলা দেখতে থাকলো আর ছাতার সব লাল রঙ গলে গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকলো। লাল ছাতাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই বীণার সেই নীল ছাতা হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা সবাই ছি ছি করতে থাকলো। একটা ছোট্ট মেয়ের ছাতা চুরির অপরাধে নন্দকিশোরকে সবাই বয়কট করলো। কেউ তার দোকান থেকে কোনো জিনিস কেনে না...কথা বলে না...বিয়েতে, নানা অনুষ্ঠানে কেউ আর তাকে ডাকে না। এইভাবে সময় বয়ে চলে,গুটি গুটি পায়ে শীত চলে আসে... গাছের পাতা ঝরতে শুরু করে বরফে ঢেকে যায় গোটা গ্রাম...নন্দকিশোর একা।

 এরকমই এক শীতের সকালে গ্রামের বাইরে নন্দকিশোরের দোকানের সামনে হঠাত একদিন কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। নন্দকিশোর তখন সেই সকালবেলা নিজের মনে বকবক করছিলো আর চা খাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। খুট করে আওয়াজ শুনে নন্দকিশোর দেখে তার দোকানের সামনে বীণা দাঁড়িয়ে। তার হাতে নীল রঙের সেই ছাতা। বীণা একটা বিস্কুট কেনে। কতদিন পর নন্দকিশোরের দোকান থেকে কেউ কিছু কিনলো। বীণা চলে যাওয়ার পর নন্দকিশোর দেখলো তার দোকানের দরজার গায়ে হেলান দেওয়া সেই নীল রঙের ছাতা। বীণা ভুলে ফেলে গেছে। নন্দকিশোর সারাদিন ছাতাটাকে বুকে আগলে নিয়ে বসে থাকলো...কাঁদলো...রাতে ঘুমলো না...এক সময় রাগে ছাতাটাকে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু পারলো না...সে যে বড় ভালোবাসে ছাতাটাকে। আবার সকাল হলো...আবার ঝিরঝিরে বরফের বৃষ্টির মধ্যে বীণাকে হাঁটতে দেখে নন্দকিশোর তাকে ডাকলো। ছাতাটা বীণার হাতে তুলে দিল। এবার কিন্তু  অবাক করে দিয়ে বীণা ছাতাটা আর নিলো না। সে বললো এটা তার ছাতা নয়,নন্দকিশোর ইচ্ছে করলে নিতে পারে। ভেউভেউ করে কেঁদে ফেললো নন্দকিশোর কারণ সে ততদিনে জেনে গেছে চুরি করা, মিথ্যে কথা বলা অন্যায়...জীবনের বড় পাপ। ছোট্ট মেয়েটার কাছে সেদিন তার থেকেও বড় একটা মানুষ অনেক কিছু শিখলো।

আমিও সিনেমার হল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ফাঁকা লন দিয়ে হাঁটার সময় মনে মনে ভাবলাম বীণার ভূমিকায় অভিনয় করা শ্রেয়া শর্মার কথা। এইটুকু সময়ের মধ্যে সে আমাদের সবার মন জুড়ে বসে আছে। ভারতে পাহাড়ে ঘেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত অসংখ্য গ্রামের ছোট্ট বীণাদের প্রতিনিধি আজ সে। রাস্কিন বন্ডের গল্পের অনুপ্রেরণায় এমন এক মিষ্টি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ। 

 

কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী

 

ছবি
স্ম্যাশহিটস

চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, ফিল্ম ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যরচনা, এবং ফাঁকে ফাঁকে পেলে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের লেখালিখি - বিবিধ ধারার ব্যস্ততার মধ্যে চাঁদের বুড়ির সাথে ইচ্ছামতীর প্রথম পায়ে হাঁটার দিনগুলিতে হাত ধরেছিলেন কল্লোল । এখনো সময় পেলে মাঝেমধ্যেই ইচ্ছামতীর জন্য কলম ধরেন হুগলী, উত্তরপাড়া নিবাসী কল্লোল।