খেলাঘরখেলাঘর





বাড়ি ঢুকে যথারীতি মার কাছে রোজকার বরাদ্দ একটু বকুনি খেয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসেছি। পিসিরা এসেছে বলে যে আমার পড়ার ছুটি তা নয়। মা’র কড়া শাসন - অন্ততঃ দুঘন্টা পড়তেই হবে, নইলে কপালে দুঃখ আছে। আগে যে কয়েকবার সে দুঃখ আমায় পেতে হয়েছে তা ভুলিনি। পিঠটা বেশ চড়চড় করে উঠেছিল। এখন পিসিরা এসেছে। এর মধ্যে বিন্তি যদি শোনে আমি মার খেয়েছি না পড়ার জন্য তাহলে যেটুকু প্রেস্টিজ আছে তার আর ছিঁটেফোটাও বাকী থাকবে না। কাজেই রোজকার মত টেবিল চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছি আর ভাবছি কি করে সময়টা কাটানো যায়। পড়ার জন্য বরাদ্দ এই দুঘন্টা শেষ হবে সাড়ে সেই আটটায়। মা গরম দুধের গ্লাসটা দিয়ে গেছে টেবিলে। সেটা ঠান্ডা হলেও শেষ হয়নি। আরো কিছুক্ষন পঁয়ষট্টি পাতায় আটকে রইলাম। ইচ্ছে করেই ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি। কারন কেউ জিজ্ঞেস করলে তালে গোলে একটা কিছু বলে দেওয়া যায়। নিদেন পক্ষে আগের চ্যাপ্টারটাই বলে দেওয়া যাবে। অঙ্ক নিয়ে বসলে যদি খাতা সাদাই থেকে যায়, তাহলে মুশকিল।

এদিকে মুশকিল হচ্ছে আমার টেবিলে কোন ঘড়ি নেই। সেটা আছে পিছন দিকে, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি কটা বাজল। শেষ পনেরো মিনিট যেন কাটতেই চাইছে না।  মনে মনে ভাবছি কি করেই বা প্রমান হবে। বিন্তি আটটার সময় ঠিক কি করবে? আর যদি প্রমান করেই দেয় - তার মানে কি এই যে আমাদের বাড়ির চারপাশে জলজ্যান্ত সব ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে? আমরা তো আবার খালি চোখে ওদের দেখতে পাই না। তার মানে কি এরকম হতে পারে এই ঘুরে বেড়াচ্ছি আর একটা ভূতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল, তাহলে কি আমরা বুঝতে পারব? না কি পারব না? এতদিন কেটে গেছে কিন্তু আমরা ভূতেদের সম্পর্কে কত কম জানি। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একবার জানলার বাইরের দিকে চোখ গেল। মনে হল অন্ধকারে কি যেন একটা নড়ে গেল। শিউরে উঠলাম। গল্পে যে বলে ভূত নাকি অন্ধকারেই থাকতে ভালোবাসে। ঐ ভূতুড়ে চশমার টানে ওরা এসে এই বাগানের গাছ গুলোতে জটলা পাকিয়েছে কিনা কে জানে? আবার একটা লেবু গাছও আছে। কথাটা ভাবতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন যেন শিউরে উঠল একটু। ভূত আছে কি নেই সেই প্রমানটা না নিলেই নয়? উফফ! এই সময় যদি টুবলুটা পাশে থাকতো।

এমন সময় বারান্দার ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল।

শিবাজীর রাজ্যবিস্তার আর পড়া হল না। আরো খানিকক্ষন এদিক ওদিক করে বই ফেলে উঠে পড়লাম। বাইরের ঘরে আড্ডা বসেছে। বড়রা সবাই, বিন্তিও আছে সেখানে। আমিও পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সবাই না না রকম কথা বলছে। কিন্তু সেদিকে আমার কান যাচ্ছে না। পিসেমশাই বলছিলেন যে বিন্তি কিরকম ভালো পড়াশোনা করছে, আবৃত্তিতেও প্রাইজ পাচ্ছে। এসব তো আমি জানিই। আমিও প্রত্যেক বছর এক আধটা প্রাইজ পেয়েই যাই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় - সেকথা কেউ তুললোই না।

ঘন্টাখানেক চলার পর মা এসে সবাইকে খেতে ডাকতে সব্বাই উঠে পড়ল। আমি আর বিন্তি পাশাপাশিই বসেছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে কি রে প্রমানটা কি হল?
বিন্তি বললে, “প্রমানের আর কি আছে, সেটা তো প্রোফেসর শঙ্কুই করে দিয়েছেন। তবে আমি একটা ছোট্ট প্রমান দিচ্ছি তুই আজকে দুঘন্টা ধরে বসে কেবল পঁয়ষট্টি পাতা ওলোট পালোট করেছিস। কিচ্ছু পড়িস নি।” প্রোফেসর শঙ্কুর নামটা কোথাও যেন শুনেছি। পেটে আসছে মুখে আসছে না। আর ও জানলোই বা কি করে যে আমি পড়তে বসেও পড়িনি। সব মিলে কিন্তু কিন্তু করছি এমন সময় বাবা আমাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, “কিসের প্রমান নিয়ে কথা হচ্ছে শুনি?”
বিন্তিটা এত পাজি দুম করে কথা পালটে ফেলে অন্য একদিন ইস্কুলে কি হয়েছে সেই ঘটনায় চলে গেল। আমি বেগতিক দেখে চুপ করে গেলাম। পড়ায় ফাঁকি মেরেছি এটা যত গোপন থাকে ততই ভালো।