খেলাঘরখেলাঘর

কলেরা ক্যাম্প

কলেরা এক জীবনঘাতী রোগ। দূষিত জল আর খাবারের মাধ্যমে এই রোগের জীবাণু আমাদের শরীরে ঢোকে এবং অন্ত্রে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। জীবাণুকোষে এক ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয় যার প্রভাবে অন্ত্রের দেওয়াল থেকে প্রচুর পরিমাণ জল নিঃসৃত হয়। বিপুল পরিমাণ চাল ধোয়া জলের মত মল রোগীর শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। মলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু আয়ন-ও (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড) বেরিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ঘন ঘন বমি হতে থাকে। রোগী ক্রমশই অবসন্ন ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শরীরে অতি তীব্র জলাভাব দেখা দেয়। রক্তের তারল্য কমতে থাকে। একটা সময় আসে যখন এত ঘন হয়ে যাওয়া রক্তকে পাম্প করে সারা শরীরের ছড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে আমাদের হৃদযন্ত্রের পক্ষে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীর মলের সঙ্গে রোগ জীবাণুও বাইরে বেরিয়ে আসে এবং জলের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কলেরা মহামারীর আকারে দেখা দেয়। ইতিহাসে, সাহিত্যে কলেরা মহামারীর অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। ২০১০ সালে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যার অনুসারে প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হন এবং লক্ষাধিক মানুষ এই রোগে মারা যান।

কলেরার আর এক নাম বিসূচিকা রোগ। আবার ওলাউঠা নামেও এই রোগ পরিচিত। (ওলাঃ মল, উঠাঃ বমি)। এই রোগের প্রকোপ সেই সব জায়গাতেই দেখা যায় যেখানে জীবাণুমুক্ত পানীয় হল পাওয়া যায়না এবং স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই। এদেশে মানুষের মনে কলেরার বিভীষিকাময় প্রভাব ওলাইচণ্ডী, ওলাবিবি এইসব লৌকিক দেবীদের জন্ম দিয়েছে।

জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কখ্‌ কলেরা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন। কিন্তু এই জীবাণু , যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে সেটা ঠিক কিভাবে কাজ করে বহুদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের তা জানা ছিল না। অনেকেই বিশ্বাস করতেন জীবাণু কোষের অভ্যন্তরেই থাকে এই বিষাক্ত পদার্থ। জীবাণুর মাধ্যমেই তা রক্তের সঙ্গে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া অন্ত্রের দেওয়ালে সে আস্তরণ থাকে তারও ক্ষতি হয় এই বিষাক্ত পদার্থের প্রভাবে। কিন্তু প্রাণীদেহে কলেরার জীবাণু ইঞ্জেকশন করে ঢুকিয়ে কেউই গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে এই রোগ সৃষ্টি করতে পারেন নি।

এ ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করলেন ডাঃ শম্ভুনাথ দে। হুগলি জেলার গড়বাটিতে এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম হয় ১৯১৫ সালে। ব্যক্তিগত স্কলারশিপ আর কিছু ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় তিনি কলকাতা মেডিকাল কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে ডাক্তারি পাশ করেন। এরপর লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হসপিটাল মেডিকাল স্কুলে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি কলকাতা মেডিকাল কলেজের প্যাথলজি ও ব্যাক্টিরিয়লজি বিভাগে যোগ দেন এবং কলেরা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কলেরা সম্বন্ধে বিজ্ঞানী সমাজে সেইসময়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন কলেরা রোগের জীবাণু অন্ত্রের আস্তরণের কোন ক্ষতি করে না। জীবাণু কোষের বাইরে এসে এই জীবাণুনিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ অন্ত্রের মধ্যেই কাজ করে। এই ধারণা প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের কিছুটা অংশ ওপর নীচে সুতো দিয়ে বেঁধে, মাঝে ইঞ্জেকশন করে কলেরার জীবাণু ঢুকিয়ে দিলেন। পরদিন দেখা গেল ক্ষুদ্রান্ত্রের ওই অংশ চাল ধোয়া জলের মত তরল পদার্থে (কলেরা রোগীর মলের মত দেখতে) ভরে গেছে। এর পর তিনি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে কলেরা জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে কোষ নিঃসৃত তরল পদার্থ খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রে ঢুকিয়ে একই ফল পেলেন। প্রমাণিত হল কলেরার জীবাণু যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে তা এক ধরণের exotoxin(exo:outside)  এবং  enterotoxin(enteron:intestine বা অন্ত্র)

খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের অংশবিশেষ বেঁধে (rabbit ilieal loop) তাঁর পরীক্ষা পদ্ধতি জীবাণু বিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি নিজেও এই পদ্ধতির সাহায্যে প্রমাণ করেন আমাদের অন্ত্রে Escherichia coli নামে সে নিরীহ জীবাণু বাস করে তারই এক জাতভাই এক বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে। ঐ জীবাণু এখন Enterotoxigenic E coli নামে পরিচিত।