খেলাঘরখেলাঘর

পর্ব তিন

১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে সিনেমা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠছিল। এই বড় হয়ে যাওয়ার পাঠশালা কিন্তু আটলাণ্টিকের ওপারে, নিউ ইয়র্ক শহরে। সেখানকার একজন সাহেবের গল্প আমরা শোনাব যার নাম এডউইন পোর্টার। মেলিয়ে ছবির মাধ্যমে গল্প বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারেননি কিভাবে ছবিগুলোকে এমন ভাবে সাজানো সম্ভব যাতে কখনই মনে হয়না যে ছবিগুলো জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। পোর্টার ঠিক এই কাজটাই সেরে ফেললেন। তিনি আনলেন গল্প বলার নতুন কায়দা। তিনি এমন ভাবে গল্প বললেন যে ছবিও থেলে থাকল না আর একসঙ্গে দুটো বা তিনটে গল্প বলা গেল।


এডউইন এস পোর্টার

সিনেমায় যেটুকু হাতের কাজ লাগে পোর্টার সেটুকু খুব ভালো করে জানতেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এডিসন সাহেবের কোম্পানিতে মেকানিক হিসাবে। সেখানে কাজ করতে করতেই তিনি মাথা ঘামিয়ে পার করে ফেলেন কিভাবে বইএর মত করে সিনেমার গল্প বলতে হয়। উপন্যাসে যেমন নানা ঘটনার সমাবেশ হয়, তিনি ছবিতে সেই স্বাদ দিতে চেয়েছিলেন।

তাঁর সবথেকে বিখ্যাত ছবি হল 'দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি' (১৯০৩)। ১২ মিনিটের এই ছবির বেশিরভাগটাই স্টুডিও তে তোলা। স্টুডিও সেটের মধ্যে আলো ব্যবহারে তিনি যে কত দক্ষ ছিলেন তার প্রমান এই ছবি। এই ছবির আউটডোর শুটিং অবশ্য হয়েছিল নিউ জার্সি শহরের কাছে।


ছবির পোস্টার

'দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি' কে বলা হয় প্রথম ওয়েস্টার্ন ছবি (western). কথাটা হয়ত একটু সহজ করে বলি। তোমরা নিশ্চয় বিখ্যাত হিন্দি ছবি 'শোলে' দেখেছ? জয়-বীরু আর গব্বর সিং ডাকাতের গল্প? 'দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি' কে বলতে পার 'শোলে'র ঠাকুমা!! এখানে একটা ট্রেন ডাকাতি আর কিভাবে দস্যুদের উদ্দ্যেশ্য ব্যর্থ হল সেই গল্প বলা আছে। পোর্টার এখানে তৈরি করলেন প্যারালেল অ্যাকশন, ব্যবহার করলেন ক্রস- কাটিং। তার ফলে আমরা নানারকম উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে গল্পটাকে পেলাম।


ছবির একটি দৃশ্য
 

শেষ দৃশ্যে একজন ডাকাত দর্শকদের দিকেই গুলি ছুঁড়ছে !

এইরে! প্যারালেল অ্যাকশন বা ক্রস-কাটিং এসব তো খুব ভারি শব্দ! কি করে বুঝব! জিনিষটা কিন্তু খুব সহজ। ধর, ট্রেনে ডাকাতি হচ্ছে। আর ওদিকে, টেলিগ্রাফ অফিসের অপারেটর টেলিগ্রাফ করে খবরটা চারিদিকে পৌঁছাতে চাইছে। সে অতি কষ্টে গিয়ে কাছের সরাইখানায় সবাইকে খবর দেয়।তখন সবাই বন্দুক বাগিয়ে ডাকাতদের ধরতে বেরিয়ে পড়ে। ততক্ষনে তো ডাকাতরা ট্রেন চালিয়ে অনেকদূর চলে গেছে।পোর্টার করলেন কি, এমনভাবে দুটো ঘটনাকেই দেখালেন যে দর্শক পুরো ব্যাপারটা টানটান উত্তেজনা নিয়ে দেখল- ভুলেই গেল যে দুটো আসলে আলাদা ঘটনা আলাদা জায়গায় ঘটছে। এ এক নতুন রকমের অভিজ্ঞতা হল দর্শকদের কাছে! গল্পটাকে যেন আরো ভাল করে বুঝতে শুরু করল তারা। গল্প বলার এই কৌশল তৈরি করার জন্য পোর্টার বিখ্যাত।

পোর্টার যখন এডিসন স্টুডিও ছেড়ে দিলেন তখন ১৯০৯ সাল। তার আগের বছর এক তরুন অভিনেতা এসে তাঁর কাছে অভিনয়ের সুযোগ চান। পোর্টার তাঁকে সু্যোগও দেন। তৈরি হয় একটি অতি সাধারন ছবি, যার নাম Rescued From An Eagle's Nest. এই কথাটা মনে থাকার কথা নয় এতদিন পরে। কিন্তু সিনেমা নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা সেদিনের সেই তরুন অভিনেতাটিকে মনে রেখেছেন। কেন বলতো? কারণ তিনিই প্রথম সিনেমাকে যথার্থ সিনেমা করে তুললেন। ১৯১৪ সালে তৈরি তাঁর ছবি 'বার্থ অফ এ নেশন' [Birth of a Nation] এর  হাত ধরেই শুরু হল প্রথম কাহিনীচিত্র - বা গল্প বলা ছবি। তাঁর নাম ডেভিড ওয়র্ক গ্রিফিথ। সত্যজিত রায় তাঁকে বলেছিলেন 'ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের পিতা' । ভাবছ ধ্রুপদী চলচ্চিত্র মানে কি? -ডেভিড ওয়র্ক গ্রিফিথ আর  ধ্রুপদী চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা গল্প বলব এর পরের বার।

 

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক, চলচ্চিত্র বিদ্যা বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

ছবিঃ উইকিপিডিয়া

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। ইচ্ছামতীর আবদারে ছোটদের জন্য প্রথম বাংলা ভাষায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন তিনি।