খেলাঘরখেলাঘর


ধপধপে ফর্সা, চ্যাপ্টা মিষ্টি গোল মুখ, গালে গোলাপি রঙের আভা, তারি মাঝখানে বসানো একটা চ্যাপ্টা নাক, সেই নাকের দুই ধারে দুটি ছোট্ট কৌতুহলী চোখ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার ক্যামেরার লেন্স এর দিকে...তার চারপাশে তারই মত আরও কিছু ছোট্ট মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে...কেউ বা বেঞ্চের উপর উঠে লাফাচ্ছে, কেউ বা পেন্সিল চিবোতে চিবোতে মাতৃভাষার কিছু অক্ষর খাতায় এঁকে ফেলছে...আঁকতেই হচ্ছে, কারণ ভাষাটাই এইরকম - এঁকে সব বোঝাতে হয়। ইংরাজিতে যাকে বলে 'pictorial language'।
ভাষাটা চাইনিজ, আর জায়গাটা ট্যাংরার একটি স্কুল...চিনা শিশুদের জন্য এই স্কুলের নাম 'কিম পাউ চাইনিজ স্কুল'।


অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে...

ট্যাংরা চেন কি? ট্যাংরা হল মধ্য কলকাতার একটি বিশেষ অঞ্চল। খুব বেশি পরিচিত 'চায়না টাউন' নামে। চলো, একটু ঘুরে দেখি চায়না টাউন, আর জেনে নিই এই জায়গাটার বিশেষ ইতিহাস।

চিনারা প্রথম কলকাতায় আসে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। প্রথম চিনা মানুষ যিনি চিনদেশ থেকে চা এবং চিনি এনেছিলেন তাঁর নাম 'আতাচিউ' [Atachew]। অনেকে মনে করেন এই 'আতাচিউ' নাম থেকেই এসেছে কলকাতার কাছেই 'ইছাপুর'জায়গাটির নাম। 'চা' এবং 'টি' দুটি শব্দই চিনা ভাষার দুটি আঞ্চলিক রূপ। একই পানীয়ের জন্য একটি শব্দ গ্রহণ করেছে ইংরেজরা আর অন্যটি নিয়েছি আমরা মানে বাঙালীরা।

১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চিনে গৃহযুদ্ধ হয়। সেই সময় হাজারে হাজারে মানুষ চিনদেশ ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। এক সময় কলকাতায় প্রায় দশ হাজার চিনা মানুষ ছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে শুরু হল চিন ভারত যুদ্ধ। তখন আবার সেইসব ঘরছাড়া মানুষ কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন অন্য দেশে। যাঁদের এখানে ব্যবসা ছিল, তাঁরা রয়ে গেলেন। তাঁদের নিয়েই কলকাতার চায়না টাউন এখনো তার শব্দ-গন্ধ বাঁচিয়ে রেখেছে।

চায়না টাউনের চিনারা মূলতঃ চামড়া পাকা করার কারখানা চালান, যাকে বলে 'ট্যানারি'। কেউ বা চালান বিখ্যাত সেইসব রেস্তোঁরা, যেখানে কলকাতার মানুষেরা কারণে-অকারণে দারুন সব চাইনিজ খাবার খেতে যান। আর আছে 'সিং চিউং সস ফ্যাক্টরি', যেখানে তৈরি সুস্বাদু সস ওইসব রেস্তোঁরাগুলিতে বিক্রি হয়।

 



ট্যানারির কিছু ছবি

 


চায়নাটাউনের বিখ্যাত রেস্তোঁরাগুলি


যাঁরা রেস্তোঁরা বা ট্যানারিতে কাজ করেন না, তাঁরা ছোটখাটো দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কেউ আবার রিকশা চালান।

চায়না টাউনে আছে দুটি ক্লাব হাউস। সেখানে 'Overseas Chinese Commerce in India' নামে একটি সম্পূর্ন চিনা ভাষার পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার মাত্র ৩০০ টি কপি ছাপা হয় ! বুঝতেই পারছ, কলকাতা এখন কতজন চিনা মানুষ থাকতে পারেন!


কলকাতা থেকে প্রকাশিত চিনাভাষায় পত্রিকা


চায়না টাউনে মাত্র দুটি স্কুল - একটির কথা তো আগেই বলেছি, অন্যটির নাম 'গ্রেস লিং লাং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল'। দুটি স্কুলের সাথে আছে উপাসনালয়। 'গ্রেস লিং লাং' এ আছে একটি চার্চ, আর 'কিম পাউ' এর সাথে আছে চিনা দেবতার মন্দির।

স্কুলের ভিতর কচিকাঁচারা

 


চিনা উপাসনালয়

 

 

উপাসনালয়ের ভিতর



চিনাদের ক্যালেন্ডার চাঁদের গতিবিধি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়। এই ক্যালেন্ডার অনুসারে ২১ দিনে মাস হয়, তাই যখন ইংরাজি ক্যালেন্ডারের তুলনায় ২১ দিনের বেশি পিছিয়ে পড়ে, তখন একটা নতুন মাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

চায়না টাউনের চিনারা কালীপুজো করেন...ভেবে কেমন অবাক লাগে না?মন্দিরের নাম 'চাইনিজ কালী মন্দির'। এই মন্দিরে শুধুমাত্র চিনারা পুজো করতে যান।

চায়না টাউন ছাড়া আরেকটা জায়গার কথা না বললে কলকাতা শহরের চিনাদের নিয়ে এই গল্পটা শেষ হবে না, সেটা হল টেরিটিবাজার বা টিরেটা বাজার। টিরেটা বাজারে প্রায় ৮-১০টি চিনা পরিবার এখনও বসবাস করেন। প্রতিদিন ভোর ছটা থেকে সকাল আটটা অবধি এখানে একটি "ব্রেকফাস্ট মার্কেট" বসে, যেখানে ঘরে তৈরি জিভে-জল-আনা চিনা খাবার বিক্রি হয়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চলে গেলেই হল...

 


টেরিটিবাজারের ব্রেকফাস্ট মার্কেট

কেমন লাগল তোমার এই চায়না টাউন ভ্রমণ? এরপর যেদিন কোন এক রেস্তোঁরায় খেতে যাবে তোমার প্রিয় চাইনিজ ডিশ, তখন নিশ্চয় মনে পড়ে যাবে এই চায়না টাউনের গল্প, তাই না?



লেখা ও ছবিঃ
রশ্মি সেন
বালিগঞ্জ, কলকাতা