সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
নন্দিনী ও বিশ্বামিত্র

তুমি নিশ্চয় শুনেছ ঋষি বিশ্বামিত্রের নাম। সেই যে, যাঁর সঙ্গে রাম-লক্ষ্মণ বনে গিয়ে তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করে ঋষিদের নির্বিঘ্নে যজ্ঞ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু প্রথমেই ঋষি ছিলেন না। ছিলেন এক রাজার সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন কান্যকুব্জ বা কনৌজের রাজা গাধি।

বিশ্বামিত্র তাঁর আসল নাম ছিল না। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন গাধিনন্দন কৌশিক। রাজা হয়ে তিনি অনেক যুদ্ধ জিতেছিলেন। এরকমই এক যুদ্ধশেষে কৌশিক রাজ্যে ফিরছেন। পথশ্রমে সৈন্য-সামন্ত সকলেই ক্লান্ত। একটা মহাবন পেরিয়ে তাঁর রাজ্য। কিন্তু রাত হয়ে গেছে বলে সৈন্যরা আর এগোতে চাইল না। সেখানেই বসে পড়ল।

সেই বনে ছিল মহামুনি বশিষ্ঠের আশ্রম। মহর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন ক্রোধহীন প্রেমময়। তাঁর স্বভাবগুণে রাজা প্রজা সকলেই তাঁকে সম্মান করত আর ভালবাসত। তিনি ছিলেন তখনকার ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ বংশ সূর্যবংশের কুলপুরোহিত। কৌশিক ক্লান্ত সেনাদের নিয়ে খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য সেই আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন।

তখন বেশ রাত হয়েছে। সেই সময় এতগুলি ক্ষুধার্ত লোকের উৎপাতে বশিষ্ঠের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দরজা খুলে বাইরে আসতেই কৌশিক এগিয়ে এসে একটু হুকুমের সুরেই বললেন, "মুনিবর, আজ যুদ্ধক্লান্ত আমি আর আমার সেনারা ক্ষুধার্ত হয়ে আপনার কাছে এসেছি। রাতটা আমরা এখানেই কাটাতে চাই। আপনি আমাদের খাদ্য ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে অতিথিসৎকার করুন।"

বশিষ্ঠ একটু হেসে মৃদু গলায় বললেন, "মহারাজ, আমি আপনাদের পরিচয় জানি। দেশের রাজা আমার গৃহে উপস্থিত হয়েছেন। আপনাকে নমস্কার। আপনার সৈন্যদের সামনের জলাশয় থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে শান্তভাবে বসতে বলুন। আমি যথাসাধ্য আহারের ব্যবস্থা করছি।" শিষ্যদের তিনি অতিথিদের জন্য আলোর ব্যবস্থা করতে বলে ঘরে ঢুকলেন।

সেই সময় ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমে গোমাতা সুরভির কন্যা নন্দিনী থাকতেন। নন্দিনী ছিলেন কামধেনু, অর্থাৎ তাঁর কাছে যা চাওয়া যেত, তিনি তা-ই দিতে পারতেন। বশিষ্ঠের আশ্রমে থাকতেন বলে তিনি ঋষির সমস্ত ইচ্ছাই পূর্ণ করতেন। তাঁর আদেশ ছাড়া কোন কাজ করতেন না। ঋষিও তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। এত রাতে বশিষ্ঠ তাঁকে জাগিয়ে রাজার আগমনের সংবাদ দিলেন এবং সমস্ত সৈন্য সমেত রাজার জন্য খাদ্য ও শয্যা প্রার্থনা করলেন। নন্দিনী আশ্রয়দাতার বিপদে সাহায্য করতে পেরে খুশিই হলেন। তিনি বিভিন্ন রকমের এত পরিমাণ খাদ্য দিলেন যে, রাজা ও সৈন্যরা পরিতৃপ্ত হয়ে আকন্ঠ ভোজন করলেন। শুধু তাই নয়, পরদিন সকালেও ঋষি তাদের তৃপ্তিসহকারে খাওয়ালেন।

কিন্তু এত আপ্যায়ন সত্ত্বেও রাজার মন তুষ্ট হল না। রাজার মন তো- সব সময়েই বাঁকা পথে চলে। পেট ভরল তো মনে হতে লাগল, এই রকম উৎকৃষ্ট খাদ্য ও শয্যা এই রাতে ঋষি পেলেন কোথা থেকে? বশিষ্ঠ মুনি বনে থাকেন, চারদিকে দারিদ্র্যের চিহ্ন, কিন্তু তাঁর পরিবেশিত খাবার তো রাজার ঘরের মতন। রহস্যের কিনারা করতে না পেরে রাজার আর ঘুমই এল না।

সকালে উঠে রাজা বিদায় নেবার জন্য তৈরী হয়েছেন। বশিষ্ঠ রাজার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কুশল জিজ্ঞাসা ও আশীর্বাদের পর বিদায় প্রার্থনা করে রাজা বললেন, " মুনিবর, আপনার আতিথ্যে আমি ও আমার সৈন্যদল অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছি। একটা প্রশ্ন মনে জাগছে, এত রাত্রে আপনি এই রকম রাজকীয়ভাবে আমাদের আহার ও শয়নের ব্যবস্থা করলেন কি ভাবে? এই আয়োজন তো রাজপ্রাসাদেও দুর্লভ। "

ঋষি মৃদু হেসে বললেন, " মহারাজ, এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। গোমাতা সুরভির কন্যা নন্দিনী এই সময় দয়া করে আমার আশ্রমে রয়েছেন। তিনি প্রকৃতিতে কামদুঘা। তিনি আমার প্রার্থনা পূর্ণ করেছেন মাত্র।"

রাজা কৌশিক উত্তেজিত হয়ে বললেন, " সুরভি-কন্যা নন্দিনী কামদুঘা? তবে তো তিনি রাজ-অধিকারে থাকবার যোগ্য। ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ বস্তু রাজার জন্যই সৃষ্টি করেন। এই দুর্লভ সৃষ্টিকে আপনার মত দরিদ্র ব্রাহ্মণ কি ভাবে সমাদর করবেন? মহামুনি, একে আমায় দান করুন।"

বশিষ্ঠ বললেন, " মহারাজ, নন্দিনী আমার অধিকারভুক্ত সম্পত্তি নন। তিনি আমার আশ্রমে দয়া করে কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছেন। তাই তাঁকে দান করার অধিকার আমার নেই।"

রাজা অত্যন্ত অবজ্ঞার সঙ্গে হাতটা নাকের সামনে নেড়ে কথাটা উড়িয়েই দিলেন। বললেন, " ওসব কথার কথা মুনিবর। আসল কথা হল, নন্দিনীর আপনার কাছে থাকবার কোন যুক্তিই নেই। একটি গাভীর এরকম অদ্ভুত ক্ষমতা যদি রাজার কাজেই না লাগল তো তার থেকেই বা কি লাভ! আর রাজা কিছু চাইলে সেটাতো তাঁকে পেতেই হবে। ভাল কথায় কাজ না হলে বলপ্রয়োগে। "

বশিষ্ঠ বিরক্ত হলেন। তিনি একটু কঠোর স্বরে বললেন, " রাজা, নন্দিনী আমার কন্যাসমা। তিনি দেবীতুল্যা, সামান্য রাজা তাঁকে পেতে পারেন না। তাছাড়া তিনি আমার মাননীয়া, আমার কাছে গচ্ছিতা আছেন। আপনা্র অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। "

কৌশিক স্বভাবে মোটেই ভাল রাজা ছিলেন না। তাঁর খেয়ালখুশিতে বাধা পড়লেই তিনি ভীষণ রেগে যেতেন। মান্যজনকে তিনি উপযুক্ত সম্মান করতেন না। এখন তাঁর মনে হল, দরিদ্র ঋষির এত সাহস যে, তাঁর মত রাজাকে অমান্য করে। তবেতো একে কেড়েই নিতে হবে। তিনি সৈন্যদের হুকুম দিলেন নন্দিনীকে নিয়ে যাবার জন্য।

সৈন্যরা হুকুম পেয়ে নন্দিনীর দড়ি ধরে টানাটানি শুরু করল। নন্দিনী আর্তস্বরে ঋষিকে বললেন, " মুনিবর আমায় রক্ষা করুন। এই দুষ্ট লোকেরা আমায় চুরি করার মতলব করেছে।"

বশিষ্ঠ দুঃখিতস্বরে বললেন, " মা, আমি ব্রাহ্মণ মানুষ। পূজা-অর্চনা, পঠন-পাঠন এসব নিয়েই থাকি। তোমায় রক্ষা করার মত ক্ষাত্রবল আমার নেই। দুষ্ট রাজার কবল থেকে উদ্ধার পেতে তুমি নিজ শক্তির ব্যবহার না করলে তো তোমার রক্ষার উপায় দেখি না।"

ঋষির অনুমতি পেয়ে নন্দিনী ভয়ংকরস্বরে ডাকতে শুরু করলেন। তাঁর চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরোতে লাগল। কিছু সৈন্য তো তাতেই মরে গেল। তাঁর মুখ দিয়ে খস, পুক্কুস প্রভৃতি বন্য দুর্ধর্ষ সৈন্যরা স্রোতের মত বেরিয়ে আসতে লাগল। তাদের সামনে রাজসৈন্যেরা জলের মত ভেসে গেল। রাজা কৌশিককে তারা দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রচন্ড প্রহারে প্রায় অর্ধমৃত করে বশিষ্ঠের সামনে এনে ফেলল। রাজা কোনরকমে হাত জোড় করে ঋষির কাছে জীবন ভিক্ষা চাইলেন। বশিষ্ঠ তাঁকে নন্দিনীর কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন।

নন্দিনীর কাছ থেকে মার্জনালাভের পর বশিষ্ঠ রাজাকে বললেন, " হে রাজা, প্রজারা রাজার শক্তি। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে নিজের শক্তি ক্ষয় কোরো না। কেড়ে নেওয়া রাজার ধর্ম নয়। দান করতে শেখো। লোভ কোরো না। লোভ থেকে হিংসার জন্ম হয়, ও পরিণামে তা মানুষকেই ধ্বংস করে। অক্রোধ মানুষকে মহান করে। ক্ষমা মহতের স্বভাব। এই ক'টি কথা মনে রেখো। তোমার মঙ্গল হোক।"

কৌশিক রাজ্যে ফিরে এলেন। তাঁর মনে বশিষ্ঠের উপদেশে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তিনি ভাবছিলেন, এতবড় ঘটনাটা ঋষিকে একটুও বিচলিত করেনি। কোন উপায়ে তিনি এত শান্ত থাকতে পারলেন? এই শক্তি তাঁকেও পেতে হবে। তাঁর মনে হল, যে কোন কারণে বিচলিত হতে সবাই পারে। কিন্তু এই অবিচল থাকতে পারাটাই অনেক বড় ক্ষমতা।এটা রাজশক্তির থেকেও বড়।

রাজা তাঁর ছেলেদের কাছে রাজ্যের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন এই শক্তি লাভের জন্য মনকে জয় করার তপস্যা করতে। তপস্যার সময় অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তাঁর রাজসত্ত্বার বিলোপ ঘটল। অহংকার ও আত্মাভিমান মুছে গিয়ে বেরিয়ে এলেন নতুন মানুষ, ঋষি বিশ্বামিত্র।

ঋষি বিশ্বামিত্রের জীবনেও অনেক ঘটনা। তবে সে গল্প আরেকদিনের জন্য থাক।


উৎসঃ রামায়ণ

ছবিঃঅনুভব সোম

শুক্তি দত্ত ভালবেসে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রূপকথা, প্রাচীন সাহিত্য, দেশবিদেশের লোকসাহিত্য, গল্পকথা পড়তে ভালবাসেন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা শিশুদের সেই গল্প শোনাতেও ভালবাসেন। প্রধানতঃ শিশুমনস্তত্ত্ব ও তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। সেটা শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে তাদের মূল্যবোধ বিকাশে কাজে লাগাতে চান।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা