খেলাঘরখেলাঘর


নরমে গরমে চলছিল নেহার পড়ালেখা সাথে সোশ্যালনেটওয়ার্কিং, নতুন বন্ধুত্ব আর মাধ্যমিকের প্রস্তুতি। হঠাত ফেসবুকে তার বন্ধুত্ব হল  নিমপাতার সাথে, প্রোফাইলে  নিমপাতার ছবি । মেয়ে একটা, বয়স লেখা নেই । ইমেল এড্রেসও নেই  । মেয়ে দেখে বন্ধুত্ব করে ফেলল আর রোজ কথা হতে লাগল । বেশ ভালো লাগছিল সেই মূহুর্তগুলো নেহার । রাত হলেই মা-বাবার ঘরের আলো নিবে যায় আর নেহার শুরু হয় সেই সবুজ আলোর মোম জোছনা, নতুন বন্ধুর সাথে কথা । খাওয়াদাওয়া, গল্পের ব‌ই, সিনেমা, গান কত কিছু জানে এই মেয়েটা আর নেহার ভালোলাগা গুলোর সাথে মিলেমিশে একাকার হয় ।

......
নেহা : তুমি আমার চেয়ে কি বয়সে বড় ? আমি এখন ষোলো ছুঁই ছুঁই । আর তুমি ?
নিমপাতা : কি হবে জেনে ? বেশ তো আমরা বন্ধু আছি এখানে । তোমার স্কুল কখন ?
নেহা : সকালে আটটায় আর বাড়ি ফিরি একটায়
নিমপাতা :  তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড কে?
নেহা : এতদিন আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল আমার মা । এখন আর মা আমার বন্ধু নেই গো।
নিমপাতা : ধুস্‌ মা আবার কারো প্রিয় বন্ধু হয় নাকি ? মা তো খালি শাসন করে, বকুনি দেয়, মারধোর করে
নেহা : না গো, আমার মা তেমন ছিল না । ইদানিং আমার মাধ্যমিক যত এগিয়ে আসছে মা তত যেন আমার সাথে কেমন করছে আর আমার এই কম্পিউটার খোলার ব্যাপারে মায়ের সাথে রোজ রোজ অশান্তি ; এখন মা আমার সাথে কথা বলছে না । আমিও বলিনা, শুধু দরকার ছাড়া । 
নিমপাতা : তুমি এখন বুঝবে না । যখন তুমি মা হবে তখন বুঝবে ।
নেহা : তুমি তাহলে আমার চেয়ে অনেক বড় । এমন বড়দের মত কথা বলছ যখন
নিমপাতা : যাকগে ওসব কথা, তোমার কি খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে? আমার যেমন চাইনিজ ।
নেহাঃ আমার তন্দুরি খেতে বেষ্ট লাগে। জানো ? মা আমায় এত ভালোবাসে আমি তন্দুরী খেতে চাই বলে ব‌ই পড়ে, টিভি দেখে মা সব তন্দুরী রান্না বানায় আমার জন্যে ।

নিমপাতা : বাবা! তুমি কি লাকি গো ! আমাদের মা কিন্তু এমন না । আমরা  অনেক ভাইবোন । মা কার কথা রাখবে বলো? এ বলে মাছের ঝোল, ও বলে ঝাল, ও বলে মাছ খাব না ...কিন্তু আমরা খুব মায়ের বাধ্য ছিলাম । মা যা করে দিত সেটাই হাসিমুখে খেয়ে নিতাম । আর কোনো কোনো দিন বায়না করলে মা বলত তোমরা হাত লাগাও আমার সাথে আমি বানিয়ে দিচ্ছি । 

নেহা : আমার মা আমাকে খুব  প্যাম্পার করে, কোনো কাজ করতে দিতে চায় না । আমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দেয় । আমি রোজ স্কুল থেকে ফিরে ব‌ইয়ের ব্যাগ সোফায়, স্কুলড্রেস খাটে ফেলে দিয়ে টিউশানের জন্যে তৈরী হ‌ই  । মা সব জায়গায় তুলে রাখে আর আমাকে কেবল বলে তুই শুধু মন দিয়ে লেখাপড়াটা করে যা ।
নিমপাতা : আমার মা আবার ঠিক উল্টো ।মা বলতেন রোজ চা করতে হবে তোমাকে সকালে উঠে
আর বিছানাটা ঝেড়ে গুছিয়ে রেখে তারপর পড়তে বসতে হবে । আমি বলতাম , মা আমার যে বড্ড পড়ার চাপ । মা বলতেন সারাদিনে ওইটুকু কাজ করে পড়াশোনা করলে কোনো ক্ষতি হবে না । 
নেহা :  তুমি করতে সব আর তারপর পড়তে?
নিমপাতা : হ্যাঁ,মায়ের মুখের ওপর কথা বলব কি! মায়ের চোখের দিকে তাকালেই মনে হত মা ই ঠিক বলছে । যা বলছে আমার ভালর জন্যে বলছে । 
নেহা : তোমার মা তোমাকে নিয়ে সিনেমা যেত?
নিমপাতা : হ্যাঁ, আমরা মায়ের সাথে সত্যজিত রায়ের ছবি, শরতচন্দ্রের গল্প নিয়ে ছবি, কিম্বা শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বক্সী দেখতে যেতাম ।
নেহা : আমিও মায়ের সাথে সবকটা হ্যারি পটার দেখেছি । নার্নিয়াও দেখেছি । আর লর্ড অফ দ্য রিংস দেখেছি বাবার সাথে, তুমি দেখনি?
নিমপাতা : না আমার দেখা হয় নি এখনো । 
নেহাঃ অনেক রাত হল। এবার শুতে হবে । মা নয়ত কাল সকালে আবার মুখ ভার করে থাকবে ।
নিমপাতা : কাল সকালে না হয় স্কুল নাই বা গেলে, আবার তোমার সাথে চ্যাট করব আমি ।
নেহা : ওরেব্বাবা, কাল স্কুল না গেলে আমার ইউনিট টেষ্টের মার্কস জানতে পারবো না যে । আর তাহলে মা যে আরো রেগে যাবে ।
নিমপাতা : তুমি তো দেখছি মাকে খুব ভয় করো ।
নেহা : না গো, ভয় করিনা , ভালোবাসি । আমার মা খুব ভালো মানুষ। শুধু আমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করে ।
নিমপাতা : বাহ্‌, তুমি মা কে খুব ভালোবাসো..  শুনে আমার খুব ভালো লাগল । তাহলে মা কে নিয়ে কাল স্কুল থেকে আমার বাড়ি চলে এসো । আলাপ হবে তোমার সাথে, তোমার মায়ের সাথে ।
নেহা : না গো পরীক্ষার পর যাবো একদিন । এখন থেকে আমাকে বোর্ডের এক্সামের জন্য বাড়তি পড়তে হবে  । এখন আর অত বেড়ানো চলবে না ।
নিমপাতা: বেশ তাহলে গুডনাইট !
নেহা : গুড নাইট, আজকের মত ।
নেহা কম্পিউটার বন্ধ করে আলো নিবিয়ে শুতে যাবে, মনে পড়ে গেল স্কুলের ল্যাব-খাতা জমা দেওয়ার কথা । চোখে মুখে জল দিয়ে এসে হাত মুছে শুরু করে দিল লেখা ।    
রাত তখন একটা। শেষ হল খাতা লেখা । টেবিলে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ গোছতে যাবে মনে পড়ে গেল শ্রুতি মিস রেফারেন্স ব‌ই থেকে দশটা করে অঙ্ক রোজ কষে আনতে বলেছিলেন । কাল খাতা না নিয়ে স্কুলে গেলে গার্জেন কল হবে । এই নিয়ে দু দিন নেহা ভুলে গেছে । নেহার ওপর স্কুলের টিচারদের খুব আশা । মেয়েটা ইচ্ছে করলেই স্ট্যান্ড করতে পারে । নেহার মাথায় জেদ চেপে গেল । টেবিলে বসে মন দিয়ে সেদিনের আর গত দুদিনের মোট তিরিশটা অঙ্ক রেফারেন্স বুক থেকে করে ফেলল । কয়েকটা পারলনা । সেগুলো পরেরদিন বাবাকে জিগেস করে নেবে ঠিক করল । তখন বাজে রাত আড়াইটে । ঘুমে চোখ তার ঢুলে  আসছিল । পরদিন সকালে ঘুম ভাঙালেন মা ।ভাগ্যি মা ছিল। আজ তাকে না ডেকে দিলে কি হত ! স্কুল যাবার সময় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে নেহা বলল "ও মা, তুমি আমার ওপর এখনো রাগ করে আছো? , আমি তো পড়াশোনা সব করে নিচ্ছি , দেখো এবার আমি আরো ভালো করব"
মা কোনো উত্তর দিলেন না ।

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।