সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে

দেশের পুরো নাম হল দ্য রিপাব্‌লিক অফ পোল্যান্ড (The Republic of Poland)। আমরা সংক্ষেপে বলি পোল্যান্ড। ভাষা হল পোলস্কি (Polski)। কারেন্সি হল Zloty। রাজধানী হল ওয়ারস'( Warswa)। মধ্য ইউরোপের একদম মধ্যিখানে অবস্থিত এই পোল্যান্ডের উত্তরসীমায় বাল্টিক সাগর, দক্ষিণে কার্পাথিয়ান মাউন্টেন, চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া। পূর্বে লিথুয়ানিয়া, বেলারুস এবং ইউক্রেন, যেগুলি আগে রাশিয়ার মধ্যে ছিল আর পশ্চিমে জার্মানি। গরমের ছুটিতে ইউরোপ সফরে পোল্যান্ড-ও ছিল আমাদের লম্বা গন্তব্য তালিকায়।

কিংবদন্তীর দেশ পোল্যান্ড খুব সুন্দর, ঝকঝকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ঐতিহাসিক পটভূমি। বার্লিন থেকে পোল্যান্ড পৌঁছতে আমাদের প্রায় চারঘন্টা লাগল। মে মাসেও বাতাসে শীতের হাল্কা আমেজ। বাসে যেতে যেতে আমাদের ট্যুর গাইডের মুখে কিংবদন্তীর গল্প শুনতে শুনতে নেমে পড়লাম পজনান শহরের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
পজনান শহরের টাউন স্কোয়ার

এটি পোল্যান্ডের পুরোনো রাজধানী ছিল। প্রাচীন পোল্যান্ডের গথিক স্থাপত্য বেশ নজর কেড়ে নিল। টাউন স্কোয়ারে সবকিছুতেই দেখি ছাগলের আইকন। আর পজনানকে বলা হয় The city of head butting goats! কেন জান?

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
চার্চের ঘন্টা বাজার সাথে বেরিয়ে আসে দুটি ছাগল

কিংবদন্তী অনুসারে, শহরের ওল্ড টাউন হলের এক শেফ হরিণের মাংস রান্না করছিল। আগুনের আঁচে সেই হরিণের মাংস এতটাই বেশি পুড়ে গেল যে শেফ তখন তাড়াতাড়ি পাশের একটি মাঠ থেকে দুটো চরে খাওয়া ছাগল ধরে এনে পোড়াতে গেল। হরিণের মাংসের বদলে ছাগলের মাংস‌ই রান্না হবে সেদিন। কিন্তু ছাগলদুটি বুঝতে পেরেই রান্নাঘর থেকে পালিয়ে ওল্ড টাউন হলের চার্চের মাথায় উঠে গেল। সেই থেকে স্থানীয় মানুষের মনে এক অদ্ভূত বিশ্বাস দানা বাঁধে।( ওরা ভাবতে শুরু করে যে এই ছাগল দুটি নিশ্চয়ই খুব শুভ বা পয়া তাই হেডবাটিং গোট্‌স্‌ এর আইকনটিও মুছে ফেলতে নারাজ। ) চার্চের ঘড়িতে ঠিক দুপুর বরোটায় ঘন্টাধ্বনি হয় আর দুটি যান্ত্রিক ছাগল বেলের মাথা থেকে একটি জানলা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়াবে। শিঙে শিঙে গুঁতো গুঁতি করে আবার কিছুপরেই ভেতরে প্রবেশ করবে। ছোটছোট স্কুলপড়ুয়ারা এই দৃশ্য দেখবে বলে সেখানে বসে থাকে আবার দেখেই লাইন করে টিচারের সাথে চলে যায়।

পজনান হয়ে নতুন রাজধানী ওয়ার'স ( Warszawa) যাবার পথে ঘন সবুজ জঙ্গল চলল আমাদের সাথে। পথে পড়ল ওডার (Oder)নদী। পোলিশ ভাষায় Odra. চেক রিপাবলিকে এই নদীর উৎস। সেখান থেকে এই নদী পোল্যান্ড ও জার্মানির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

ওয়ার'স নগরীর নামের উৎস নিয়ে অনেকগুলি গল্প আছে।

একটি গল্প অনুযায়ী, অনেকদিন আগে নদীর তীরে বাস করত এক জেলের পরিবার। ভিস্‌টুলা নদীর তীরের ঐ জেলে আর তার স্ত্রীয়ের নামেই শহরের ঐ নাম। জেলে, নদী আর মাছ অনুষঙ্গগুলি থেকেই উঠে আসে এক মিষ্টি জলের মৎসকন্যার গল্প। পোল্যান্ডে পা দিলেই অলিতেগলিতে এখনো সেই গল্প শোনা যায়। আর শহরের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের মধ্যিখানে ঢাল তরোয়াল হাতে মারমুখী সেই মারমেইডের স্থাপত্যটি আজও দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তাই ওয়ার'স কে বলা হয় 'দ্য সিটি অফ মারমেইড'। মারমেইড কেন জানবার জন্য সকলেই আমরা আগ্রহ নিয়ে বসেছিলাম। প্রশ্ন করার আগেই আমাদের ট্যুর গাইড বলল, প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, এক মৎসকন্যা সমুদ্র সাঁতরাতে সাঁতরাতে হাঁফিয়ে গিয়ে পুরনো পোল্যান্ডে ভিস্‌টুলা নদীর তীরে এসে বিশ্রাম নিল। অপরূপা এই মৎসকন্যা পোলিশ ভাষায় পরিচিত Syrenka Warszawska নামে।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
সাইরেঙ্কা

আবার আরেক গল্পে যাই।

স্থানীয় মৎস্যজীবিরা মাছ ধরতে গিয়ে তাদের জালের আশেপাশে ঘাই তোলা কোনো একটা জলজ জীব দেখে যতবার তাকে জাল দিয়ে আঘাত করে সরাতে গেল ততবার‌ই সে তাদের ঘায়েল করল। সুন্দর স্বরে হালকা গলায় সে গান গাইতে শুরু করল। আসলে জেলেদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে ফাঁদে ফেলা। সে যাত্রায় গান শুনিয়ে জেলেদের জালে ধরা না পড়েও রেহাই মিলল না সুন্দরী মৎস্যকন্যার। একদিন এক বণিক কায়দা করে তাকে একটা কাঠের খোঁয়াড়ে বন্দী করে যেই না নিয়ে পালাবে, সেই সময়ে এক তরুণ জেলে তার করুণ কান্না শুনতে পেয়ে তাকে সেই ফাঁদ থেকে উদ্ধার করল। তাই পোল্যান্ডের মানুষের কাছে ঐ সাইরেঙ্কা বা মৎসকন্যা আজন্ম ঋণী হয়ে র‌ইল। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য তার সদা আকুলিবিকুলি প্রাণ । তাকে যেমন পোল্যান্ড আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে, বিপাদে আপদে সাইরেঙ্কাও তাদের আগলে রেখে দিল... এই হল স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস। আর সেই কারণেই পোল্যান্ডের আকাশে বাতাসে সেই মৎস্যকন্যার চিহ্ন আর লোকের মুখে মুখে এর গল্প আজও শোনা যায়। এবার ঢাল তরোয়াল হাতে ঐ মৎস্যকন্যার স্ট্যাচুটির দিকে তাকিয়ে থেকে ঐ গল্পটি গিলে ফেলার পালা। ভিস্‌টুলা নদীর তীরেও রয়েছে এর মূর্তি। কেউ আবার বলে বাল্টিক সাগরে এই সাইরেঙ্কার সঙ্গে ছিল তার যমজ বোন । তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় মাঝ দরিয়ায় এবং সাইরেঙ্কা পোল্যান্ডের দিকে গিয়ে ভিস্‌টুলা নদীতে এসে ওঠে আর তার বোনটি হল কোপেনহেগেনের বিখ্যাত "লিটল মারমেইড'।

কেউ বলে ওয়ারস (Wars) এবং সাওয়া (Sawa) নামে এক দয়ালু দম্পতি বাস করত এখানে। তাই শহরের অমন নাম।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
হোটেলের বারান্দা থেকে তোলা শহরের এই ছবিটিতে ট্রামের ক্রিসক্রস নেটওয়ার্কটিও চোখে পড়ে।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
রাজকীয় এক ঘোড়ার গাড়ী; রাস্তায় হামেশাই চোখে পড়ে এমন

কেউ আবার বলে, পোল্যান্ডের তদানীন্তন রাজা ক্যাসিমির, ক্র্যাকুফ থেকে ওয়ার'স আসার পথে ভিস্‌টুলা নদীর ধারে এক দরিদ্র জেলের কুটির দেখতে পেলেন । সেই কুটিরের আশপাশ তখন ধোঁয়া ও টাটকা রান্না খাবারের গন্ধে ম ম করছে। জেলে তখন রাজাকে দেখে তার আগের দিন রাতের ধরা কিছু মাছ ও রান্না করা খাবার দিয়ে রাজার উদরপূর্তি করাল। পথশ্রমে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত রাজা প্রীত হলেন। রাজা তাঁদের সোনার উপহার দিতে চাইলেন কিন্তু ঐ পোলিশ দম্পতি তা নিতে নারাজ। তারা বলল, পোল্যান্ডের আতিথেয়তাই তাদের দেশের ঐতিহ্য। এর বিনিময়ে কোনো জিনিষ তারা নিতে পারবেনা। জেলেটি রাজাকে জানালো তাদের সংসারে একজোড়া যমজ সন্তান এসে তাদের দারিদ্র্য সবেমাত্র ঘুচতে চলেছে। জেলের স্ত্রী বলল, কিন্তু ঐ যমজ ছেলেমেয়েদুটিকে কোথায় যে ব্যাপ্টাইজ করবে তারা,কাছেপিঠে কোনো গীর্জা নেই যে! রাজা ক্যাসিমির তখন বললেন, ঠিক আছে, তিনি‌ই হবেন ঐ যমজ শিশুদের ধর্মপিতা আর আয়োজন করবেন তাদের ব্যাপ্টিজম অনুষ্ঠানের । তিনি‌ই দাঁড়িয়ে থেকে ওদের খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষার সাক্ষী থাকবেন।তিনি একটি টিলার ওপরে বেদী স্থাপন করে ধর্মযাজকের সামনে ঘোষণা করলেন জেলের ছেলেমেয়েদুটির নাম যথাক্রমে, ওয়ারস এবং সাওয়া। এবং রাজা জানালেন, একদিন এই অঞ্চল যখন ধীরে ধীরে মানুষের বসতিতে ছেয়ে যাবে তখন এই ছেলেমেয়েদুটির নামেই হবে এই অঞ্চলের নাম। তাই থেকেই বুঝি নাম হল ওয়ারস'।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
শোপ্যাঁর প্রতিমূর্তি

ওয়ার'স এর নাম করলেই যাঁর কথা সর্বাগ্রে মনে পড়ে তিনি হলেন বিখ্যাত সুরস্রষ্টা এবং পিয়ানোশিল্পী শোপ্যাঁ (Chopin)(১৮১০-১৮৪৯)। আকাশে বাতাসে এখনো যেন তাঁর সুরের অনুরণন শুনতে পায় স্থানীয় মানুষ। বিশাল একটি সবুজ পার্ক এর মধ্যে শোপ্যাঁ-র প্রতিমূর্তিটি অনবদ্য লাগল।

ওয়ার'স থেকে এবার পরের দিন ক্র্যকুফ (Krakow)শহরে যাবার পথে প্রথম হল্ট চেষ্টচোয়া (Czestochowa) । চেষ্টচোয়ার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় গন্তব্য হল ব্ল্যাক ম্যাডোনার অধিষ্ঠানক্ষেত্র জাস্না গোরা মনাস্ট্রি ( Jasna Gora)। এটি চতুর্দশ শতাব্দীর অন্যতম এক তীর্থস্থান এবং পোল্যান্ডের জাতীয় ঐতিহাসিক মনুমেন্টগুলির মধ্যে একটি। ব্ল্যাক ম্যাডোনার গল্প শুনলাম। ব্ল্যাক ম্যাডোনার বৈশিষ্ট হল, এই ছবিতে কুমারী মেরী এবং তাঁর কোলের যীশু - দু'জনেই কৃষ্ণাঙ্গ। হিন্দু ধর্মের মানুষেরা অনেকে যেমনভাবে দেবী কালীকে ভক্তি করেন, পোলিশরা এই ব্ল্যাক ম্যাডোনাকে ঠিক তেমনই মেনে চলেন। তাঁদের মতে, ব্ল্যাক ম্যাডোনা নাকি অসাধ্য সাধন ঙ্করতে পারেন। সম্মান করে ব্ল্যাক ম্যাডোনাকে পোল্যান্ডের মানুষেরা ডাকেন 'Our lady of Czestochowa' ।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
বাঁদিকে জাস্না গোরা'র প্রবেশপথ; ডান দিকে ব্ল্যাক ম্যাডোনা

গল্প শুনেই নেমে পড়ি জাসনা গোরা মনাস্ট্রিতে। অসাধারণ সুন্দর স্থাপত্য সেই চার্চের। প্রবেশ করি অন্দরমহলে। সেদিন শনিবার। কোনো মাস চলছিল। একপাল স্কুলপড়ুয়া ব্যাসিলিকার ভেতরে সুসংবদ্ধ লাইনে প্রবেশ করছিল। তাদের সামনে ও পেছনে একজন করে সন্ন্যাসিনী ছিলেন। আমরা ইশারায় সেই লাইনেই ঢুকলাম সন্ন্যাসিনীদের অনুমতিতে । তারপর ছবি তুলতে তুলতে সোজা পৌঁছে গেলাম ব্ল্যাক ম্যাডোনার প্রতিকৃতির সামনে। তারপর দিব্যি পুরোটা ঘুরে ফেললাম ঐ খুদে স্কুল পড়ুয়াদের পেছন পেছন। এখানে ছবি তোলার কোনো বিধিনিষেধ নেই ।

এর পরে শুনলাম আরেক গল্প।

পোলিশ কিংবদন্তী বলে বহুযুগ আগে পোল্যান্ডে ওয়াওয়েল পাহাড়ের নীচে এক ভয়ানক ড্রাগন বাস করত। ক্র্যাকুফ শহরের কেউ তাকে মারতে পারছিলনা। সারা শহরের লোকজন সেই ড্রাগনের ভয়ে থরহরিকম্প। লোকজন প্রায়শঃই তার তর্জন গর্জন শুনত । একদিন রাজা ক্রাক শহরবাসীকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করলেন যে পারবে একে মারতে তার সাথে তিনি রাজকন্যার বিয়ে দেবেন।

"He who once and for all puts this dragon
Shall recieve my sceptre and my royal crown,
So come and defeat this most horrid beast
And win my daughter's hand and a wedding feast"

বহু দূর থেকে রাজপুত্র, সাহসী যোদ্ধারা সব পোল্যান্ডে এসে সেই ড্রাগনকে হত্যা করে রাজা ক্র্যাকের কন্যার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতে চাইল। সারা শহর তীরধনুকে ছয়লাপ হল কিন্তু কেউ ড্রাগনকে মারতে পারলনা। অবশেষে একজন অল্পবয়সী মুচি সেই শহরে এসে জানাল সে ঐ ড্রাগনকে হত্যা করতে সক্ষম। তার যুদ্ধের কোনো সাজসরঞ্জাম ছিলনা। কেবল ছিল প্রখর বুদ্ধি, ছুঁচ ও সূতো। সে রাজপুরীতে প্রবেশ করেই রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। রাজা ক্রাক তো হতবাক! ঐটুকুনি এক বালক মুচি কিনা ঐ বিশাল ড্রাগনকে মারবে? ছেলেটি বলল, আমার চাই ভেড়ার চামড়া, একটু গন্ধক আর একটু সর্ষেদানা। রাজা বলল, বেশ তাই হবে। স্থানীয় মানুষেরা জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল সেই ড্রাগন নিধন যজ্ঞ। সেই বিস্ময়কর মুচিবালকটি সেই ভেড়ার চামড়ার মধ্যে গন্ধক গুঁড়ো আর সর্ষে ভর্তি করে সেটিকে কায়দা করে সেলাই করে দিল ছুঁচ-সুতো দিয়ে। ভোরবেলায় সূর্যোদয় হতেই সে ঐ গন্ধক আর সর্ষে ভর্তি বস্তা নিয়ে ড্রাগনের কাছে যাবার আয়োজন করল। ড্রাগন জেগেই ছিল। সে খিদের তাড়নায় পাহাড়ের নীচে কিছুদূর এগোতেই দেখল একটি ভেড়ার মৃতদেহ। ভেড়া ভেবে সে সেই চামড়া ভরা গন্ধক সব খেয়ে ফেলল। খেয়ে ফেলা মাত্রই তার প্রবল জল তৃষ্ণা পেল। সে ভিস্‌টুলা নদীর জল খেতে শুরু করল। করতে করতে নদীর অর্ধেক জল শেষ হয়ে গেল। এদিকে অত জল খেয়ে ড্রাগনের পেট ফেটে মৃত্যু হল। রাজ্যের সব লোক তখন সেই ড্রাগন দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করল পাহাড়ের নীচে ভিসটুলা নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই।বিস্ফোরণ হয়ে নদীর জল প্রায় শেষ।

এই রোমাঞ্চকর পোলিশ কিংবদন্তী শুনতে শুনতেই পথে পড়ল ভিস্‌টুলা নদী।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
ভিস্‌টুলা নদী

বাস থেকে ক্লিক ক্লিক। আবারও চলা।

ড্রাগনের গল্প শুনে এবার নেমে পড়া ক্র্যাকুফ মেইন টাউন স্কোয়ারে।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
ক্র্যাকুফ মেইন টাউন স্কোয়ার

একর্ডিয়ানের সুর বাজছে কোথাও। কোথাও করুণ সুরে ভায়োলিন। পুরণো শহরের অলিগলি হাঁটতে গিয়ে কেবলি মনে পড়ে নিজের শহরটাকে। কোথাও আবারো রাজকীয় সাজপোষাকে টুংটাং ঘোড়ারগাড়ির আওয়াজ। ক্র্যাকুফে পথের ধারে ঘন্টি বাজিয়ে সেখানেও অনবরত রংবেরঙয়ের ঝকঝকে ট্রাম চলে যায় নিঃশব্দে। কত দূষণ কম তাই। ব্যস্ত রাস্তায় অনামা চিত্রশিল্পীর সুন্দর চিত্র প্রদর্শনী হয়। রাস্তার মোড়ে মোবাইল পোষ্ট-অফিস ভ্যান।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
ক্র্যাকুফ শহরের বিভিন্ন মূহুর্ত

পথের ধারে রেস্তোঁরায় সামান্য দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নেওয়া হল। দেখি প্রকান্ড কাঠকয়লার আঁচে মাংস ঝলসানোর পর্ব চলছে অহোরাত্র।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
পথের ধারে খাবারের দোকান

পরদিন ক্র্যাকুফ থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়া হল পৃথিবীর অন্যতম নুনের খনি দেখতে। যার নাম উইলিক্‌‌ঝ্‌‌কা (Wieliczka) সল্ট মাইন। প্রবেশ করে বুঝলাম এ শুধুই খনি নয়, আশ্চর্য্যতম এক লবণ স্থাপত্যের চরম নিদর্শন। এতো দেখি দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য এক লবণদুর্গ! এর সঙ্গে রয়েছে ভূগর্ভস্থ ক্যাথিড্রাল। এই বিশাল রাজকীয়তার জন্য উইলিজ্‌ঝ্‌কা সল্টমাইনকে বলা হয় "the Underground Salt Cathedral of Poland."চোখে না দেখলে যা অবিশ্বাস্য। সরকারীভাবে এই লবণখনি একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ ।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
ভূগর্ভস্থ ক্যাথিড্রাল এবং লবণের ঝাড়লন্ঠন
কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
রকসল্ট দিয়ে তৈরি সেন্ট কিংগার মূর্তি

এখানে রয়েছে জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাসের প্রতিমূর্তি, কারণ তিনি স্বয়ং এসেছিলেন এই খনি পরিদর্শনে। কোথাও সেন্ট কিংগা, কোথাও আবার পোপ জন পল টু...এদের সকলের অসাধারণ 'সল্ট স্কাল্পচার'গুলি সময়ের স্রোতেও অমলিন। অপূর্ব সেই রকসল্ট কুঁদে মূর্তি তৈরীর শৈলী। সিঁড়ি দিয়ে আরো নেমে গেলে দেখা গেল খনির অভ্যন্তরে বিশাল গীর্জা। সেখানে দেওয়ালে আরো আরো ভাস্কর্য্। লিওনার্দো দা ভিন্সির লাস্ট সাপার, খ্রীষ্টধর্মের অনেক গল্পগাথা অমন দক্ষতার সাথে স্থাপত্যে রূপ দেওয়া রয়েছে আজও। সবকিছুই নুনের তৈরী। পায়ের তলায় মেঝেটিও রকসল্টের। মাথার ওপরে ঝুলন্ত ঝাড়লন্ঠনগুলিও সল্ট ক্রিষ্টালের।

হাঁটতে গিয়ে লক্ষ্য করি গুহার ছাদ থেকে ঝুলন্ত স্ফটিক স্বচ্ছ সোডিয়াম ক্লোরাইডের স্ট্যালাগটাইট্‌স্‌। কোথাও আবার সে সদ্য ক্রিষ্টালাইজ করে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাখিয়ে রেখেছে সারাটা দেওয়ালে । আর হবেনাই বা কেন? পাশেই যার সোডিয়াম ক্লোরাইডের সম্পৃক্ত দ্রবণের লেক । অদ্ভূত অনুভূতি হল । লেকের জল নীলাভ আর তাতে হলদে আলো পড়ে যেন সবুজ জ্যোৎস্না সৃষ্টি হয়েছে।

কিংবদন্তীর পোল্যান্ডে
সোডিয়াম ক্লোরাইডের সম্পৃক্ত দ্রবণের লেক

ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ মনে পড়ল, কেমিস্ট্রি বইয়ের সেই পাতাটির কথা। অপর্যাপ্ত সোডিয়াম ক্লোরাইডের আকরিকের ভাণ্ডার রূপে পোল্যান্ডের নাম পড়েছিলাম বটে! সাথেসাথে তুলে ফেললাম অনেক ছবি, পরে বন্ধুদের দেখাব বলে।

ছবিঃ লেখক

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা