সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ম্যাজিক পাউডার

অনেকদিন আগে বর্মা মানে এখনকার ছোট্ট মায়ানমার নামক দেশটিতে ইরাবতী নদীর তীরে পরমাসুন্দরী এক মেয়ে ছিল থুজা নামে। তার বিয়ে হয়েছিল স্থানীয় এক সুদর্শন যুবক থেঙ্গির সঙ্গে। খুব সুখে ঘরকন্না করত থুজা আর থেঙ্গি। কিন্তু সবকিছু পেয়েও থুজার মনে যেন শান্তি ছিলনা। থেঙ্গি সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকত তার কাজ নিয়ে। সে ছিল একজন অ্যালকেমিস্ট। কেমিস্ট হলেন প্রকৃত রসায়নবিদ । যারা ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কিছু না কিছু আবিষ্কার করে চলেন। যা সমাজের পক্ষে মঙ্গলকর কিন্তু অ্যালকেমিস্টরা হল অপরসায়নবিদ মানে তাদের রসায়নাগারে নিভৃতে এমন কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে যা সবসময় হয়ত মানুষের জন্য হিতকর হয়না। তা এই থেঙ্গির ল্যাবরেটরি তে অহোরাত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়েই থুজার মানসিক অশান্তি ছিল। সে বুঝত যে তার স্বামী নেশার মত লোভের বশে এমন কিছু করছে যা হয়ত তাকে একদিন কোনও বিপদের মুখে ঠেলে দেবে।

থেঙ্গির দিন শুরু হত রসায়নাগারে। দিন শেষও হত সেখানে। সে যেন যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার করছে এমনই হাবভাব তার। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেই থুজা এমন দেখতে অভ্যস্ত ছিল। অথচ সেই গবেষণার ফলে সংসারে আয় তেমন কিছু ছিলনা। প্রথম দিকে তাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল। কিন্তু এই আবিষ্কারের নেশায় একের পর এক রাসায়নিক দ্রব্য কিনতে কিনতে একদিন এমন অবস্থা হল তাদের যে নুন আনতে পান্তা ফুরায় যেন। সামান্য কিছু খাবার কিনে আনতেও থেঙ্গি কে চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হতে হল। সেইসঙ্গে থুজারও সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা হল। সে তার স্বামীকে সৎ উপদেশ দিয়ে বলল
—"আমার মনে হয় তোমার কিন্তু এবার একটা চাকরীর খোঁজ করা উচিত। এভাবে চললে আমাদের এবার কিন্তু উপোস করে মরতে হবে।"

কিন্তু থেঙ্গি নারাজ। সে কোনোও কথা শুনল না। সে বলল
—" একদম আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। আমি একটি সাড়া জাগানো আবিষ্কার করতে চলেছি। আমার কাজ খোঁজার ও কাজে যাবার মত সময় নেই । তুমি ভাবতে পারছো? এই আবিষ্কার সফল হলে আমরা কত বড় ধনী হব? তুমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না এই সব ধুলো থেকে সোনা বেরুবে যখন তখন আমাদের অনেক টাকা হবে” — এই কথা বলে তার ল্যাবরেটরির এক কাচের বাটিতে রাখা এক মুঠো ধুলো দেখালো সে থুজা কে।

থুজার বাবা থেট ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ, বরিষ্ঠ ব্যক্তি। থুজা তাকে গিয়ে সব বলল। থেট বললেন, অতি সত্বর তিনি থেঙ্গির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সব জানবেন। এই বলে থুজা কে তিনি ঘরে পাঠালেন। থুজার বিশ্বাস, তার অভিজ্ঞ বাবা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তাদের সাহায্য করতে পারবেন। সাময়িকভাবে সে নিশ্চিন্ত হল।

পরদিন থেঙ্গি বকুনি খাবার আশঙ্কায় বেশ ভয়ে ভয়েই শ্বশুরের কাছে গেল। থেট বললেন,
"কনগ্র্যাচ্যুলেশন্স থেঙ্গি ! জানো? অল্পবয়সে একসময় আমিও তোমার মত একজন একনিষ্ঠ অ্যালকেমিষ্ট ছিলাম। ঠিক এমন সব এক্সপেরিমেন্ট করে আমিও সেই বয়সে বিরাট কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছিলাম। তোমার কাজ তো হয়েই এসেছে। তবে একটা ব্যাপারে তোমার কোথাও একটু ভুল হচ্ছে। এই ধুলো থেকে সোনা করার ব্যাপারটায় যদি আমার পরামর্শ নাও তবে তুমি অবশ্যই সফল হবে।আমি পরে এই ট্রিক্স জেনেছি। তখন আমি এতটাই বৃদ্ধ যে সেই বুদ্ধিটা কাজে লাগানোর মত শারীরিক ক্ষমতা আর আমার নেই। সেই বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারলে ধুলো থেকে সোনা করার ব্যাপারটা খুব সহজ হবে"
শ্বশুরের মুখে এসব শুনে থেঙ্গির চোখ চকচক করে উঠল। সে বলল, "বেশ বাবা। আমাকে তবে বলুন কী সেই উপকরণ? কী আপনার সেই ট্রিক্স? যার দ্বারা শেষপর্যন্ত আমি সফল হব। "
—" বাহ! খুব ভালো তবে। বলছি শোনো এবার। তুমি তো ধুলো থেকে সোনার ম্যাজিক পাউডার আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। ঐ যে বাগানের কলাগাছ গুলো দেখতে পাচ্ছো সেইসব কলাগাছের পাতার ওপরে রূপোর গুঁড়ো থাকে । সেটা জানো কী?"
থেঙ্গি বলল, "না তো"
বুড়ো থেট বলল, " তোমার ঐ ধুলো থেকে সোনার গুঁড়ো পাবার গোপন রহস্য হল ঐ রূপোর গুঁড়ো। সেটা আগে তোমাকে পেতে হবে। তবে হ্যাঁ। তার আগে তোমায় নিজের হাতে কলাগাছ পুঁততে হবে। সেই গাছের পাতায় রূপো জমবে। তারপর এক ম্যাজিক মন্ত্র সেই গাছের ওপর প্রয়োগ করতে হবে। আর সেই মন্ত্রবলে ঐ রূপোর গুঁড়োয় এক অভাবনীয় যাদুশক্তি আসবে। বুঝলে?"
থেঙ্গি বলল
" তা কতটার মত রূপোর গুঁড়ো হলে তবে তার মধ্যে সেই যাদু শক্তি সঞ্চারিত হবে?"
থেট বলল "তা প্রায় কিলোখানেক"
থেঙ্গি বলল, "ওরেবাবা! এক কিলো? তবে তো প্রচুর কলাগাছ পুঁততে হবে আমাকে"
থেট বলল "তা তো হবেই আর সেই কারণেই না আমার দ্বারা এই কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। তুমি যদি এই কাজ শেষ করতে পারো তবে তার চাইতে বেশী খুশি আর কেউ হবেনা"
থেঙ্গি বলল, "আমার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখব না বাবা। আমি যেমন করেই হোক আপনার অসমাপ্ত গবেষণা আমি শেষ করবই"
বুড়ো থেট খুশি হয়ে তার জামাইয়ের কানে কানে সেই যাদুমন্ত্র বলে দিলেন আর তার হাতে দিলেন একফালি জমি আর একশোটি কলাগাছ কেনার টাকা।

থেঙ্গি উত্তেজিত হয়ে পরেরদিন সকালেই একফালি জমি কিনে ফেলে সেখানে একশোটি কলাগাছ লাগিয়ে ফেলল। প্রতিটি গাছের চারা রোপণের সময় মনে করে সে তার শ্বশুরের কথামত সেই যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করল গাছের ওপরে। প্রতিদিন ভোরে উঠে থেঙ্গি বাগানে যায় আর গাছের পরিচর্যা করতে লাগল। তরতর করে বেড়ে ওঠা কলাগাছের ভরভরন্ত রূপ দেখে আনন্দিত হয় সে। এভাবে একদিন কলাগাছে ফুল এল। তারপর সেই ফুল থেকে ফল ধরল। থেঙ্গি মনের আনন্দে সেই গাছের পাতা থেকে সযত্নে ম্যাজিক রূপোর গুঁড়ো সংগ্রহ করতে থাকে মনের আনন্দে আর তা সন্তর্পণে ভরে রাখে একটি কৌটোর মধ্যে। কিন্তু কিছুতেই যেন কৌটো আর ভরে না। এভাবে কেমন করে কিলোখানেক রূপোর গুঁড়ো জমবে? সেই ভাবনায় থেঙ্গি আবারও খানিক জমি কিনে সেখানে আরও আরও কলাগাছ লাগালো বুক বেঁধে। এভাবে অনেক বছর কেটে গেল। থেঙ্গি একদিন দেখল বেশ অনেকটাই ম্যাজিক পাউডার জমেছে কৌটোর মধ্যে। সে শ্বশুরের কাছে গেল।
—" বাবা, এই দেখুন, এতটা ম্যাজিক পাউডার কী যথেষ্ট? সোনার গুঁড়ো পাবার জন্য?"
তা দেখে উল্লসিত থেট বললেন,
—" এই তো কী ভালো কাজ করেছও তুমি। এবার তোমায় শিখিয়ে দেব কেমন করে ঐ ম্যাজিক পাউডার থেকে সোনার গুঁড়ো পাওয়া যায়। কিন্তু তার আগে আমার মেয়ে থুজা কে একবার ডাকো। তার সাহায্য ছাড়া এই শেষটুকু কিছুতেই উতরনো যাবে না" এই বলে থেট চিৎকার করে মেয়েকে ডাক দিলেন। "থুজা? তা থেঙ্গি যখন কলাপাতা থেকে এই ম্যাজিক পাউডার সংগ্রহ করছিল, তুমি তখন কী করছিলে শুনি?"

ম্যাজিক পাউডার

থুজা বলল "বাবা আমি তখন সব কলাগুলো নিয়ে বাজারে বিক্রি করেছি। আমাকে তো সংসারে রান্নাবান্না করে সকলকে খেতে দিতে হবে। টাকা না থাকলে আমি কোথা থেকে দোকান বাজার করব?"
" তার মানে কিছু অর্থ সেখান থেকে তুমি জমিয়েও রেখেছ ? " থেট বলল
থুজা বলল, " হ্যাঁ, বাবা অবশ্যই, সে আর বলতে? "
তারা তিনজনে মিলে তখন থেঙ্গি ও থুজার বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বাড়িতে ঢুকেই থুজা একে একে ঘরের তাকের ওপর থেকে সযত্নে তুলে রাখা ব্যাগগুলো নামাতে থাকল।
—"এই দেখ বাবা, কলা বিক্রি করে আমি পেয়েছি এসব আর যত্ন করে নিরাপদ স্থানে রেখে ও দিয়েছি। এসব তোমার কাছেই শেখা আমার" থুজা বলল।
খুশি হয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে "জানিতো রে মেয়ে" এই বলে থেট আনন্দে জামাই থেঙ্গির হাত থেকে এক বাটি সেই ধুলো নিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢেলে দিলেন আর ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন টেবিলের ওপর।
এবার থেঙ্গি যা দেখল তা সত্যিই সে ভাবেনি কোনোদিনও। ব্যাগভর্তি স্বর্ণমুদ্রা! চিৎকার করে থেঙ্গি বলে উঠল" ওরে বাবা! এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা? আমি ভাবতেই পারছিনা তো। বাবা, আপনি যে কত বড় মাপের অ্যালকেমিস্ট তা আগে জানতাম না আমি"
থেট মুচকি হেসে বলল, "যাও। বাকী সব ব্যাগ গুলোর মধ্যে এবার তোমার সংগৃহীত ম্যাজিক পাউডার মিশিয়ে উপুড় করে দাও দেখি"
থেঙ্গি বলল, " কিন্তু বাবা এগুলো তো আসলে কলাপাতায় জমে থাকা এতবছরের ধুলো, এই দেখুন "
থেট বলল, " ঐ যে বললাম। আমার মত অ্যালকেমিস্টের মন্ত্র বলে অমন হয়েছে। নোংরা ধুলো এখন মন্ত্রপূত রূপোর পাউডার। নয়ত তোমার মত অলস জামাই কে দিয়ে আমি ঐ এত কলা ফলাতে পারি?"
থেঙ্গি তখন মনের সুখে টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত স্বর্ণমুদ্রা গুণতে ব্যস্ত । দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থুজা হাসতে লাগল।

(Grey Stroke এর লেখা থাইল্যান্ডের লোকগাথা অবলম্বনে । )

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা