সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বুড়োবাবার ত্রিশূল

গোগ্রাসে ভাত খেয়ে কোনোমতে হাতমুখ ধুয়ে "মা আমি রিকাইদের বাড়ি যাচ্ছি" বলে প্রায় দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল মাম্পি। পথে সৃষ্টির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
"রিকাই সবাইকে এরকম জরুরী তলব কেন করলো বলতো ?" মাম্পিকে দেখে সৃষ্টি জিজ্ঞাসা করলো।
"কী জানি নিশ্চয়ই কিছু গণ্ডগোল হয়েছে।" মাম্পি বলল।
দুজনে রিকাইয়ের বাড়ি পৌঁছে দেখল, দরজার বাইরে আরও অনেকগুলো চটিজোড়া রয়েছে। তার মানে বাকিরাও এসে গেছে। ওরা বেল বাজাতে কাকিমা মানে রিকাইয়ের মা দরজা খুলে দিলেন। ওরা ভেতরে ঢুকে সোজা ছাদের চিলেকোঠা ঘরটায় চলে গেল। এই ঘরটাই এদের আস্তানা। সৃষ্টি আর মাম্পি ঘরটায় ঢুকে দেখল, বুল্টি ছোট টুলটায় বসে আছে, ঝন্টু আর সানি রিকাইয়ের দিকে চেয়ে আছে, আর রিকাই ঘরেতে পায়চারি করে যাচ্ছে। ওরা ঢুকতেই রিকাই বলে উঠল, "তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বোস তোরা।"
ওরা বসলে, রিকাই বলতে শুরু করলো, "আজ সকাল থেকে সদানন্দ কাকাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। মা মন্দিরে গিয়ে দেখেন যে, পুরোহিত দাদু খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছেন, মা কি হয়েছে জানতে চাইলে, কথাটা মা কে বলেন। এই হচ্ছে ব্যাপার।"

ওদের গ্রামের এক প্রান্তে এক প্রাচীন শিব মন্দির আছে। জায়গাটা 'বুড়োবাবার ঠান' নামে পরিচিত। এই মন্দিরটি এই এলাকায় খুবই বিখ্যাত একটা মন্দির। তাই এখানে প্রতিদিনই ভক্তের সমাগম ঘটে। দূর থেকেও লোকজন এখানে আসে। তবে, সোমবার আর কোনো বিশেষ দিনে যেমন শিবরাত্রির দিনে, চড়কের দিনে প্রভৃতি দিনে এখানে রীতিমতো ভিড় হয়। সদানন্দ কাকা শিব মন্দিরের পুরোহিত দাদুর ভাগ্নে। সদাকাকার নামের সঙ্গে মানানসই তার স্বভাবটাও। সর্বদা হাসি তার মুখে লেগেই আছে। বাবা-মা হারানো ভাগ্নে ছাড়া পুরোহিত দাদুরও আর কেউ নেই। মন্দিরের কাজে সদানন্দ কাকা তার মামাকে সাহায্য করে।
"এ তো বড় গোলমেলে ব্যাপার" গালে হাত দিয়ে বিজ্ঞের মত ঝন্টু বলল।
"চল আমরা পুরোহিত দাদুর কাছে যাই। দাদু তো এখন মন্দিরেই থাকবেন। এই দুপুরবেলায় মন্দির মোটামুটি ফাঁকাই থাকবে। পুরো ব্যাপারটা দাদুর কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে।" সৃষ্টি বলল।
"হ্যাঁ, তাই চ" বলে সবাই চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে এসে চটিজুতো পরে নিল।
"মা আমরা মন্দিরে যাচ্ছি।" এই বলে রিকাই বাকি সবার সঙ্গে মন্দিরের দিকে চলে গেল।

মন্দিরে গিয়ে সবাই দেখল পুরোহিত দাদু মন্দিরের চাতালে বসে আছেন। ওরা কাছে গিয়ে জানতে চাইল সদানন্দ বাড়ি ফিরেছে কিনা। পুরোহিত দাদু বললেন যে, সদানন্দ বাড়ি ফেরেনি, কিন্তু তার খোঁজ পাওয়া গেছে। পাশের গ্রামের সদাকাকার বন্ধু গোপাল কাকা এসে খবর দিয়ে গেছে যে, সদাকাকা তার এক বন্ধুর বাড়ি গেছে। সেই বন্ধু নাকি কোলকাতায় থাকে। এখন সে কয়েকদিনের জন্য গ্রামে এসেছে, তাই তার বাড়িতে কিছুদিন থেকে তারপরে সে ফিরবে। যাবার পথে গোপাল কাকার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হতে, দাদুকে খবরটা জানিয়ে দিতে বলেছে। সেই বন্ধুকে গোপাল কাকা চেনেনা, তার বাড়ি কোন গ্রামে সেটাও সে জানেনা।

দাদু বললেন, "তোরা বুঝলি, সদা কখনো আমাকে না জানিয়ে কোথাও যায়না, এবারে কি হোল ঠিক বুঝতে পারছিনা। গতকাল মন্দিরের পূজোর যোগাড় ঠিক মতো হয়নি বলে, খুব বকাবকি করেছিলাম, তাই মনে হয়, রাগ করে চলে গেছে। রাগ কমলে ঠিক ফিরে আসবে। তবে এবার মনে হচ্ছে শিবরাত্রির সব যোগাড় আমাকে একা হাতেই করতে হবে।"

দাদুর কথাই ঠিক ছিল, পুরোহিত দাদুকেই এবারের পূজোর সব আয়োজন একা হাতে করতে হয়েছে। তিনদিন হয়ে গেছে, সদাকাকা এখনও ফেরেনি। কালকে শিবরাত্রি। প্রচুর ভিড় হয়। পুলিশও মোতায়েন থাকে মূলতঃ ত্রিশূলকে পাহারা দেবার জন্য। শিবরাত্রির দিন মন্দিরের লোহার ত্রিশূল সরিয়ে সোনার ত্রিশূল রাখা হয়। আবার পরের দিন সোনার ত্রিশূল সরিয়ে লোহারটা রেখে দেওয়া হয়। প্রায় দু'শো বছর আগে এখানকার যিনি জমিদার ছিলেন, উনি খুব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন, ওনার স্ত্রী এই মন্দিরে মানত করেছিলেন যে, জমিদার সুস্থ হয়ে গেলে, মন্দিরে সোনার ত্রিশূল দান করবেন। পরবর্তীকালে, জমিদার সুস্থ হলে, জমিদারগিন্নি নিজে এসে সোনার ত্রিশূলটি মন্দিরে দিয়ে যান। বেশ কয়েকবার ত্রিশূলটা চুরি করার চেষ্টা করা হয়, তাই এখন ত্রিশূলটা ব্যাঙ্কের লকারে থাকে, আর লকারের চাবি মন্দিরের পরিচালন কমিটির প্রধানের ব্যাঙ্কের পার্সোনাল লকারে থাকে। শিবরাত্রির সময় লকার থেকে ত্রিশূলটা বার করে আনা হয়।

প্রতিবছরের মতো এবছরেও সোনার ত্রিশূল স্থাপনের অনুষ্ঠান দেখার জন্য মাম্পি, ঝন্টু, রিকাই, সৃষ্টি, সানি ও বুল্টি কাকভোরে উঠে স্নান করে সোজা মাঠে বটগাছটার তলায় গিয়ে জড়ো হয়েছে।
"এবারে তিথি অনুযায়ী সকাল আটটায় ত্রিশূল রাখা হবে, আর আধঘণ্টা বাকি আছে। চল, তাড়াতাড়ি মন্দিরে যাই, নাহলে ভিড় বেড়ে যাবে।" সানি বলল।
সবাই মিলে মন্দিরের দিকে যেতে লাগলো।
"এবারে সবাই আছে, খালি সদাকাকাই নেই, কবে যে ফিরবে কে জানে !" বুল্টি বলল।
"আমার একটা খটকা আছে, সদাকাকা তার বন্ধুর বাড়ি যাবার জন্য অত তাড়াহুড়ো করে ভোরবেলায় বেরিয়ে গেল কেন, আর সে কোন্ বন্ধু যাকে গোপাল কাকাও চেনেনা!" রিকাই বলল।
"আমিও ভেবে এটার কূলকিনারা করে উঠতে পারিনি জানিস।" মাম্পি বলল।
"সদাকাকা ফিরলে তোরা জেনে নিস, এখন শিগগির চল, নাহলে ভিড়ে কিছুই দেখতে পাবোনা।" ঝন্টু বলল।

অত সকালেও মন্দিরে লোকজন গিজগিজ করছে। সবাই সোনার ত্রিশূল স্থাপনের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। মন্দিরে বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে যাতে সবাই লাইন ধরে যেতে পারে। পুরোহিত দাদু সাদা ধবধবে ধুতি পরে, গায়ে নামাবলি চাপিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে পূজোর ব্যবস্থা তদারকি করছেন। যেহেতু এবারে সদাকাকা নেই, তাই আজকে গোপাল কাকা পুরোহিত দাদুর সহচর হয়েছে। ৮ টা বাজতে এখনও ১৫ মিনিট বাকি। ওরা সবাইকে প্রায় ঠেলেঠুলে একেবারে গর্ভগৃহের সামনে চলে গেছে।
"কী রে তোরা এত দেরী করে এলি কেন ? নে, এবার আমাদের কে একটু সাহায্য কর ভিড় সামলাতে।" পাড়ার বিকিদাদা বলে উঠলো।
সত্যিই সূর্যদা, বিকিদা, রিভুদা সবাই ভিড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। তাই ওরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।
"কাকিমা একটু ধৈর্য ধরুন, ঠিক সময়ে পূজো দিতে পারবেন।" সানির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
"আরে দাদা অত ঠেলবেন না, লাইন ধরে আসুন, সবাই দর্শন পাবেন।" সৃষ্টি চেঁচিয়ে বলল।

এমন সময়ে ঢাকের বাদ্যি বেজে উঠলো, পাড়ার কাকিমা-জেঠিমারা উলু আর শঙ্খধ্বনিতে চারদিক ভরিয়ে তুললেন। বুল্টি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, মন্দিরের পরিচালন কমিটির প্রধান আদিনাথ বাবু সোনার ত্রিশূল নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছেন। সঙ্গে আছেন, সানির বাবা স্থানীয় পুলিশ ইনস্পেক্টর অর্জুন রায়, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাম্পির জ্যেঠু বিদ্যুৎ গাঙ্গুলি, স্থানীয় বিধায়ক তারাপদ গুছাইত আর দুজন কনস্টেবল। হঠাৎ করে, আদিনাথ বাবু ও ইনস্পেক্টর রায় অনুভব করলেন তাদের পিঠে কিছু একটা ঠেকছে। সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, "নড়বার চেষ্টা করবেন না। আমার লোকেদের হাতে বন্দুক আছে।"

এবার সেই লোকটা আকাশের দিকে বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে দিল। গুলির আওয়াজে, সবাই চমকে উঠলো। ভিড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। তখন আরেকটা শূন্যে গুলি ছুঁড়ে ঐ লোকটা চাতালের ওপর উঠে দাঁড়াল। লোকটা একটা ভূতের মুখোশ পরে আছে। সে চেঁচিয়ে বলল, "সবাই একদম চুপ করে যে যেখানে আছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। নইলে আমরা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে বাধ্য হব।"

দেখা গেল, আরও দুজন লোক বন্দুক তাক করে আছে সবার দিকে। ওদের সবার মুখেই ভূতের মুখোশ আছে। এসব দেখে শুনে ভয়েতে সবাই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভূতের মুখোশ পরা সর্দার গোছের লোকটা সোনার ত্রিশূলটা আদিনাথ বাবুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপরে আদিনাথ বাবুকে বন্দুক দেখিয়ে বন্দি করে ওদের দলটা আস্তে আস্তে মন্দিরের গেটের দিকে এগোতে লাগলো। হঠাৎ করে কে একজন মন্দিরের গেট বন্ধ করে দিল। তক্ষুনি, যে লোকটা আদিনাথ বাবুকে বন্দুক তাক করে ছিল, দেখা গেল সে "বাবাগো" বলে হাত থেকে বন্দুক ফেলে দিয়ে হাত নাড়াতে লাগলো। রিকাই চিরকালই গুলতি মারতে পারদর্শী। ও সব সময় গুলতি ওর পকেটে রাখে। ওর এই বিদ্যাটা আজ কাজে এসে গেল। এই সুযোগে দুজন কনস্টেবল আর ভিড়ের মধ্যে থেকে আরও দুজন যারা সাদা পোষাকে পুলিশ ছিল, তারা বাকিদের কে কাবু করে ফেলল। ওদিকে যার হাতে সোনার ত্রিশূল ছিল, সে গেটের কাছে এসেও বেরোতে পারলো না বলে অন্য দিকে যাবার চেষ্টা করতেই পলকের মধ্যে কোথা থেকে একজন শিববেশী লোক এসে ওর মাথায় তার হাতের ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করলো। সর্দার গোছের লোকটা মাথা ধরে বসে পরলো। সেই মুহূর্তে ঐ শিবরূপী লোকটা ওর হাত থেকে সোনার ত্রিশূলটা কেড়ে নিল। সেই সময় ওখানে ইনস্পেক্টর রায় এসে ভূতের মুখোশ টা টেনে খুলে দিলেন। সবাই দেখল, কুখ্যাত রাঘব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তারপর পুলিশ, রাঘব ও তার দলবলকে মাঠের ধারে রাখা পুলিশের জিপে তুলে দিল। কনস্টেবল সমেত সেই জিপটা থানায় পাঠিয়ে দিয়ে মন্দিরে ঢুকে পুরোহিত দাদুকে ইনস্পেক্টর রায় ত্রিশূল স্থাপনের অনুষ্ঠানটা সেরে নিতে বললেন। মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে বিকিদাদা মাইকে সবার উদ্দেশ্যে বলল, "এখন ত্রিশূল স্থাপনের অনুষ্ঠানটা হয়ে গেলে, প্রতি বছরের মতো এবারও এই মন্দিরের রীতি অনুযায়ী মহাদেবের বিশ্রামের জন্য একঘণ্টার জন্য এই মন্দিরটি সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হবে। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কাম্য।"

সেই শিবরূপী ব্যক্তি এগিয়ে গিয়ে সোনার ত্রিশূলটা সোজা পুরোহিত দাদুর হাতে দিয়ে দিল। পুরোহিত দাদুও ত্রিশূল টা নিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে চলে গেলেন। আবার ঢাকের আওয়াজ আর উলু-শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। সোনার ত্রিশূলের স্থাপনা সম্পন্ন হল।

ধীরে ধীরে মন্দির প্রাঙ্গণ ফাঁকা হয়ে গেল। আবার একঘণ্টা বাদে যেহেতু মন্দিরের দরজা সবার জন্য খুলবে, তাই সবাই যে যার বাড়ি চলে গেল। যাদের বাড়ি দূরে তারা সামনের মাঠের ধারের গাছগুলোর ছায়ায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। মন্দিরের ফাঁকা চত্বরে পরিচালন কমিটির প্রধান আদিনাথ বাবু ও বাকি সদস্যরা, ইনস্পেক্টর রায়, বিধায়ক তারাপদ বাবু, বিদ্যুৎ স্যার, পুরোহিত দাদু, গোপাল কাকা আর ঐ শিব সেজে থাকা লোকটা চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসল। পাড়ার ক্লাবের বিকিদা, রিভুদা, সূর্যদা, মাম্পি-রিকাইদের দলটা মধ্যিখানে বড় শতরঞ্চি পেতে তাতে বসল।

"বাবা বাইরের লোক আর কেউ নেই এখানে, এবার তো বলো।" সানি অধৈর্য হয়ে বলল।

ইনস্পেক্টর রায় বলতে শুরু করলেন, "চারদিন আগে মাঝরাতে আমার ফোনে একটা মিস্ড কল আসে। আমি ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, সদা মিস্ড কল দিয়েছে, সঙ্গে একটা এস এম এসও আছে। মেসেজে লেখা ছিল, ওর খুব বিপদ, ও মাঠের বটগাছের মাথায় চড়ে বসে আছে, ওকে বাঁচাতে হবে। ওটা পড়ে, রাত পোষাকেই আমার রিভলবারটা নিয়ে আমি বেরিয়ে পরলাম। পাশের বাড়িতে গিয়ে হাবিলদার বলরামকে ডেকে সঙ্গে নিলাম। তারপরে দুজনে মিলে মাঠে গিয়ে মোবাইলের আলোতে কাউকে দেখতে পেলাম না। বটগাছটার তলায় গিয়ে সদা বলে ডাকতে, প্রথমে কোনো সাড়া না পেলেও আমি অর্জুন বলে পরিচয় দিতে, ও নীচে নেমে এল। তারপর ওকে নিয়ে বলরামের বাড়ি গেছিলাম। বলরামের বউ ওর ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। তাই বলরাম একা বাড়িতে ছিল। ওখানে গিয়ে সদা আমাদের যা জানিয়েছিল, সেটা ওর মুখেই শোনা যাক।"
"সদা এখানে আছে!" পুরোহিত দাদু খুব অবাক হয়ে বললেন।
"ঐ যে শিবের বেশে সদা বসে আছে।" আদিনাথ বাবু জবাব দিলেন।

সবাই এবার সদানন্দের দিকে তাকাল। সদা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো, "আমাদের বাড়িতে বাথরুম পেছনের উঠোনের দিকে আছে। সেদিন মাঝরাতে আমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকের উঠোনের পাঁচিলের বাইরে কাদের যেন পায়ের আওয়াজ পেলাম, টর্চের আলোও দেখতে পেলাম। মনে সন্দেহ হতে, আমি চুপি চুপি পেছনের দিকের দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেলাম। মামা যেহেতু ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন, তাই কিছু টের পেলেন না। আমার সঙ্গে মোবাইলটাও ছিল ভাগ্যক্রমে। আসলে পেছনের দিকের উঠোনের দিকটা খুব অন্ধকার থাকে, তার ওপরে বাথরুমের আলোটাও খারাপ হয়ে গেছে, তাই রাতবিরেতে মোবাইলের আলোই ভরসা, নাহলে হোঁচট খেয়ে পরে যেতেও পারি।"

"ওহে ছোকরা, তোমার বাথরুমের আলো নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই, তুমি আসল ঘটনাটা বলো দেখি, আমার সময়ের খুব দাম, বুঝেছ ?" বিধায়ক তারাপদ নিজের হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে বললেন।

"আজ্ঞে, বলছি" মাথা চুলকে সদানন্দ বলতে শুরু করলো, "তারপর ওদেরকে অনুসরণ করে আমি মাঠের শেষে যে বাঁশবনটা আছে, সেখানে পৌঁছে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম, চার-পাঁচ জন মিলে মাঠের ওপর বটগাছটার কাছে একটা জায়গায় গিয়ে বসল। প্রত্যেকের হাতের মোবাইলের আলো জ্বলছিল। একটু এগিয়ে গিয়ে আমি ঐ বটগাছটার আড়াল থেকে শুনতে পেলাম, ওরা শিবরাত্রির দিন সোনার ত্রিশূলটা চুরি করার পরিকল্পনা করছিল। হঠাৎ করে একটা শুকনো পাতায় পা পরে যেতে ওরা সবাই বটগাছের দিকে একসঙ্গে মোবাইলের আলো ফেলল। আমি ভয় পেয়ে গিয়ে কি করবো বুঝতে না পেরে বটগাছেই উঠে বসলাম। তাতে আরও পাতা আর ডালের শব্দ হোল, কিন্তু আমি বুদ্ধি করে বেড়ালের মতো, মিঁয়াও ডেকে উঠলাম। আর ওরাও সত্যি বেড়াল ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল।" এই বলে সদানন্দ হাসতে লাগলো।

বুড়োবাবার ত্রিশূল

"আমরা সদাকে বলরামের বাড়িতে রেখে দিলাম, কয়েক দিনের জন্য। যদি ওদের মধ্যে কেউ সদাকে দেখে ফেলে থাকে, তাই রিস্ক আর নিলাম না। ঐদিন বেলার দিকে গোপালের মাধ্যমে পুরোহিত মশাইকে সদার বন্ধুর বাড়ি যাবার খবর পাঠালাম। এরপরে, আদিনাথ বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে সোনার ত্রিশূলের একটা রেপ্লিকা এই তিনদিনে বানিয়ে নিলাম। আদিনাথ বাবুর বক্তব্য ছিলো যে, যদি চুরি যায়ও যেন আসলটা সুরক্ষিত থাকে। পুরোহিত মশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ রেপ্লিকাটা আপনি অজান্তে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু সোনার ত্রিশূলটা রক্ষা করতে হলে, ওটা ব্যাঙ্কের লকারে থাকাই ভালো।" ইনস্পেক্টর রায় পুরোহিতের দিকে তাকালেন।
"আদিনাথ বাবু ও পরিচালন কমিটির সদস্যরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন ভেবে চিন্তেই নিয়েছেন, আমার কোনো সমস্যা নেই।" পুরোহিত মশাই বললেন।
"ব্যাস, তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। যেটা বলছিলাম, আমরা এই ক'দিনে পরিকল্পনা করে নিলাম কি করে এই চুরিকে আটকানো যায়। আজকে সেই মতো রাঘব আর ওর দলকে ধরে ফেললাম। সদাকে পুলিশের তরফ থেকে পুরস্কৃত করার প্ল্যান করছি। তারাপদ বাবুও সুপারিশ করবেন বলে কথা দিয়েছেন। ও শুধু পুলিশকে খবর-ই দেয়নি, একদম ঠিক সময়ে মন্দিরের গেটটাও বন্ধ করেছে, তার ওপর সাহস করে রাঘবের মাথায় তখন মারলো বলেই আমরা অত সহজে ওদেরকে ধরতে পারলাম। তবে এত কিছু সম্ভবই হতোনা, যদি রিকাই সঠিক সময়ে উপস্থিত বুদ্ধি করে গুলতিটা না মারতো বা ওর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। তাই রিকাইকে একটা বড় ধন্যবাদ।" ইনস্পেক্টর রায় বললেন।
"রিকাইকেও ওর সাহসিকতার জন্য আমি পুরস্কৃত করবো।" বিধায়ক বললেন।
সবাই সদানন্দ ও রিকাইয়ের জন্য হাততালি দিল। ওরা দুজনেই লাজুক হাসি হাসল।
দুজন কনস্টেবল এসে ইনস্পেক্টর রায়কে স্যালুট করলো। তাদেরকে মন্দিরের দায়িত্ব দিয়ে ইনস্পেক্টর থানায় ফিরে গেলেন। যাবার পথে বিধায়ককেও ওনার অফিসে নামিয়ে দেবেন বললেন। বাকিরাও যে যার কাজে ফিরে গেলেন। বাচ্ছারাও নিজেদের বাড়ি চলে গেল। একঘণ্টা হয়ে যাবার পর লোকজন আবার মন্দিরে আসতে শুরু করলো। মহাদেবের কৃপায় শিবরাত্রির পূজো বেশ নির্বিঘ্নে কেটে গেল সবার।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা