সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা

"চলো না বাবা কোথাও বেড়াতে যাই অনেক দিন কোথাও যাই নি" বুবুর কথায় সায় দিলেন মা" ও—"সত্যিই আর ভালো লাগছে না বাড়িতে ..."। "ভালো তো আমার ও লাগছে না, লকডাউনে একটানা কাজ করে ভীষন ক্লান্ত লাগছে, মনে হচ্ছে ক"দিন কোথাও গিয়ে বিশ্রাম নিই।সেজন্য ই তো ঠিক করেছি পনেরো দিন ছুটি নেবো"। —
—তাহলে তো দারুণ হবে বাবা...।
বুবুর কথা শেষ না হতে ই মা বললেন —দারুণ তো হবেই যদি কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায়।
মা, মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন ডাঃ অভয় শংকর চৌধুরী, করোনার অতিমারীতে যিনি রাত দিন পরিশ্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বহু রোগীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন আরও অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে। তিনি জানেন এইবার ছুটির কথা বললে কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করবেই কারণ এই একটা বছর তিনি কোন ছুটি নেননি। বহুবছর তিনি প্রিয় জায়গাটাতে যেতে পারেননি নানা কাজে ব্যস্ত থাকায়। এইবার সেখানে যেতে হবে।
"বাবা তুমি চুপ করে আছো কেন, বলো কোথায় যাবে? "
মেয়ের কথায় সম্বিত ফেরে বাবার—"ও হ! হ্যাঁ, বেড়াতেই যাবো তবে কোথায় এখন বলবো না—সারপ্রাইজ। "কথা টা বলেই অভয়শংকর নিজের পড়ার ঘরে ঢুকে গেলেন। বাবার কথা শুনে মা মেয়ে দুজনেই অবাক।
"মা কোথায় যাওয়া হবে বলোতো?"বাবা পড়ার ঘরে ঢুকে গেলে বুবু জিজ্ঞেস করল।
মেয়ের কথা শুনে মা বললেন—"বুঝতে পারছি না তোর বাবা সমুদ্র ভালোবাসেন ,তবে কি পুরী যাওয়া হবে? " —
পুরী যাওয়া হলে খারাপ হবে না,ভালোই লাগে। —পুরী বারবার গেলে ও যেতে ইচ্ছে করে। —মা সমুদ্র আমার খারাপ লাগে না ভালোই লাগে তবে পাহাড় ও খুব ভালো লাগে। মনে আছে মা একবার আমরা দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি,খুব আনন্দ হয়েছিল। টাইগার হিলের সান রাইজ এর দৃশ্যটা আমার এখনও মনে আছে ...। —ওই ছবি গুলো সেদিন দেখছিলাম সত্যি দারুণ —বারবার দেখতে ইচ্ছে করে ...।

ওরা কলকাতা থেকে ভোরবেলায় গাড়িতে যাত্রা শুরু করে উত্তর চব্বিশ পরগনা,নদীয়া পার হয়ে মুর্শিদাবাদের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে যখন এসে হাজির হল তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। আসার পথে কত পুকুর, ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত,নারকেল, সুপুরি গাছের সারি,আম,জাম,লিচু কত রকমের গাছ চোখে পড়লো তার ঠিক নেই। আসতে আসতে গাড়ীর ভিতর থেকেই বাবা বুবুকে দেখালেন এইসব গাছ পালা, পুকুর, খাল,বিল। নদী ও দেখালেন বাবা—এই দেখ চূর্ণী নদী,এই দেখ জলঙ্গী নদী। বুবু বুঝতে না পারলেও মা বুঝতে পেরেছেন কোথায় যাওয়া হচ্ছে যখন গাড়িটা চৌত্রিশ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে পলাশী পার হয়ে এগিয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদ জেলার দিকে। এই মুর্শিদাবাদ জেলার এক গ্রামেই জন্মস্থান বুবুর বাবার। মায়ের কাছে বুবু শুনেছে এই গ্রামের জমিদার চৌধুরী পরিবারে বাবার জন্ম। সেই ছোট বেলা থেকেই বাবা খুব জেদি। মা এজন্য মাঝে মাঝেই বলেন —ঠিক বাপের মতো জেদি হয়েছ, যা মনে করবে তাই করেই ছাড়বে।

কথাটা মা ভুল বলেননি। সে যা করবে বলে ঠিক করে, সেই কাজটা না হওয়া পরযন্ত শান্তি নেই, অবিরাম চেষ্টা করে যায়।

গাড়ি জাতীয় সড়ক দিয়ে বেলডাঙা ,সারগাছি পেরিয়ে বহরমপুরের দিকে এগোলে বাবা বললেন —আমার মামার বাড়ি ছিলো বহরমপুর। —বাবা মুর্শিদাবাদ তো হিস্টরিকাল প্লেস? —হ্যাঁ ,এখানেই আছে বিখ্যাত হাজার দুয়ারী,কাটরা মসজিদ,নবাবের সমাধির মতো অনেক দেখবার জিনিস। —বাবা আমরা একদিন মুর্শিদাবাদ যাবো ঐ বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখতে। —নিশ্চয়ই যাবো। "—আমি ও কোনদিন দেখিনি মুর্শিদাবাদ" মায়ের কথায় অবাক হলো বুবু। তাই দেখে বাবা বললেন —ঠিকই বলছেন মা। আসলে বহু বছর বাদে আমি যাচ্ছি আমাদের বাড়িতে ...।সেই যে বাড়িয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম তারপর আর ফিরিনি আজ ফিরছি ...।

বুবু দেখে কথাটা বলার পর বাবা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ।

একটু পরেই আবার বলতে শুরু করলেন —ছোটোবেলা থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু আমার বাবা চাইতেন আমি যেন অ্যাডভোকেট হই। আসলে আমাদের প্রচুর জমি কেসের ফলে বেদখল হয়ে যায়। কেসের জন্য প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যায়। বাবার ইচ্ছের কারণ ছিলো এটাই। কিন্তু ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মায়ের হঠাৎ মৃত্যু আমার টার্গেট স্থির করে দিল—আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। কারণ আমার মা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এখানে কোন ভালো ডাক্তার ছিল না, সদরে নিয়ে যাওয়ার পথে মায়ের মৃত্যু আমি কোনদিন ভুলতে পারি না।

বুবু এতো বড় বাড়ি বাইরে থেকে দেখলেও ভিতরে কোনোদিন ঢোকে নি। তাদের ফ্ল্যাট-এর তো মাত্র তিনটে ঘর যদি ও হাউজিং কমপ্লেক্সটা বেশ বড়ই।কিন্তু এই বাড়িটার ঘরগুলো কী বড় বড়! বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে রাস্তা, দুপাশে ফুলের বাগান, বাড়ির পিছনে আমবাগান যেখানে আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, লিচু কত যে গাছ আছে। এতো রকমের গাছ বুবু আগে কোন দিন দেখেনি। বড়দাদু তাকে সব দেখিয়েছেন —দিদিভাই এই দেখ এইটা হল সবেদা গাছ, এই ফুলটার নাম জানো? গন্ধরাজ আর এইটা হলো হাস্নুহানা...।

এই ক'দিন যেমন প্রচুর গাছ পালার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তেমন তারই বয়সী কিছু ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে । বিল্টু, মনা, রতন, সুমি, টিয়া, তপু, রবি, বিনু এরা সবাই তার বন্ধু হয়ে গেছে। "চল বুবু নদীর ধারে যাই" টিয়া এসে বললে সেদিন বিকেলে। সঙ্গে সুমি আর মনা।এর আগে বুবু এদের সঙ্গে কালীমন্দির এ গিয়েছিল। আর একদিন গিয়েছিল পার্কে। এই দিন যেতে যেতে পথে তাদের সঙ্গে যোগ দিল বিল্টু। "ঐ দ্যাখ পদ্মা নদী "সুমির কথায় বুবু বললে—"জানিস আসার পথে আমি চূর্ণী নদী আর জলঙ্গী নদী দেখেছি।" বাব্বা!কী বিরাট নদী এই পদ্মা। বুবু অবাক হয়ে দ্যাখে—কী স্রোত এই নদীতে!
"ঐ পাড়ে বাংলাদেশ " আঙুল দিয়ে দ্যাখায় মনা।

বাংলাদেশের কথা বুবু শুনেছে মায়ের কাছে। মায়ের মামার বাড়ি ঢাকায়। মায়ের জন্ম অবশ্য কলকাতায়। দেশ ভাগের পর পরই মায়ের দিদারা কলকাতায় চলে আসেন। শুধু মায়ের এক মামা এখনও ওখানে থাকেন। মায়ের খুব ইচ্ছে বাংলাদেশটা কেমন তা দেখার। বুবুরও খুব ইচ্ছে করে দেখতে। সে পদ্মা নদীর কথা শুনেছে।সেই পদ্মা নদীই আজ দেখলো। মাকে দেখাতে হবে তো বিরাট নদীটা,খুব খুশী হবেন মা।

হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা

একটা বড় শিউলি গাছ আছে মেন দরজা থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বুবু দেখে বাবা শিউলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রাশ করতে করতে বুবু এসে দাঁড়ায় বাবার পাশে। শরত এসেছে, শিউলি ফুল ফুটতে শুরু করেছে। দাদুর কাছে শুনেছে ক'দিন পরেই সারা উঠোন বিছিয়ে থাকবে শিউলি ফুলে । বাবা এতো সকালে এখানে কী করছেন?
—বাবা
—হুঁ,কিছু বলবি?
—তুমি এতো সকালে এখানে দাঁড়িয়ে আছ চুপচাপ?
—জানিস বুবু শিউলি গাছটা আমার মা লাগিয়ে ছিলেন আজ থেকে কত দিন আগে,গাছটার নীচে দাঁড়ালেই মায়ের কথা মনে পড়ে ...।
—তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু খুঁজছ?
—হা,খুঁজছিই তো।
—কী?
—আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা।

বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে বুবু সে দুটো জলে ভরা। কিছু খনের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেন অভয়শংকর
— বুবু জায়গাটা তোর কেমন লাগছে?
—বাবা,খুব সুন্দর যত দেখছিল তত ভালো লাগছে। অভয়শংকর হেসে বললেন
—আমি ভাবছি এ বাড়িতে একটা চেম্বার করব ।প্রত্যেক মাসে একবার এসে দুদিন থেকে গরিবমানুষদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করব ।

খুশিতে হাত তালি দিয়ে ওঠে বুবু
—বাবা,তবে তো দারুণ হবে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা