সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পিউটারের ফুলদানি

তুমি বড় হয়ে জানবে অনেক ধাতু নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে ধাতুসংকর বা অ্যালয় তৈরী করা হয়। মূল ধাতুগুলির চরিত্র বদল হলেও নতুন এই ধাতুটিতে খুব সুন্দর রূপ আসে। মরচে পড়া বা খারাপ হওয়া এসবের হাত থেকে ধাতুর তৈরী জিনিষটিকে অনায়াসে বছরের পর বছর রক্ষে করা যায়। গুণমান বেড়ে যাওয়ায় ধাতুসংকর খুব মূল্যবান হয়ে যায়। তিব্বতে এমন সব ধাতুর অত্যন্ত ভালো বাসনকোসন, গয়নাগাটি আর ঘর সাজানোর হরেকরকমের সুন্দর সুন্দর জিনিষ পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে কৈলাস-মানস সরোবরের পথে পথে ঘুরতে গিয়ে এ বিষয়ে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

তা যা বলছিলাম পিউটার হল তামা, টিন আর সীসা দিয়ে তৈরী এক ধাতুসংকর। তিব্বতের মালভূমি অঞ্চলে কোনও ধনী লোকের বাড়িতে পিউটারের তৈরী ফুলদানি থাকাও আশ্চর্যের কিছু নয়।

এই তিব্বতের মালভূমির পাহাড়ে দুই বন্ধু বেড়াতে বেড়াতে পাহাড়ের পাদদেশে কী একটা জিনিষ চকচক করছে দেখতে পেল। কাছে গিয়ে দেখে এক কারুকার্য করা ফুলদানি। সেই মহার্ঘ্য ফুলদানিটিকে হাতে করে তারা কৌতূহল ভরে দেখতে থাকল। একবার এ হাতে নিয়ে দেখে তো আরেকবার অন্যজন পরখ করে।গায়ে টোকা মেরে কানের কাছে শব্দ শোনে। কিসের তৈরী সেটি ভাবতে বসে তারা। তিব্বতে রোজ রোদ ওঠেনা। বেশীরভাগ সময় মেঘলা। তাই অন্যজন বলে রোদের আলো পড়লে বোঝা যাবে কিসের তৈরী সেটি। এই দুই বন্ধুর একজনের নাম পেকং আর অন্যজনের নাম রিকজিং।

পেকং আর রিকজিং হল অনেকদিনের খুব প্রিয় বন্ধু। কিন্তু সেই ফুলদানিটি সেই মুহূর্তে দুজনের কাছে বন্ধুত্বের চেয়েও যেন আরও বেশী প্রিয় হয়ে উঠেছে । দুজনেই ভাবলো চিরকালের মত কীভাবে সেটিকে সম্পূর্ণ নিজের কাছে রাখা যায়। দুজনের মধ্যে রিকজিং ছিল খুব দয়ালু স্বভাবের। তার হঠাৎ মনে হল এটি তো তাদের কারোর জিনিষ নয়। অতএব সে পেকং কে বলল, চলো, আমরা এটি কোনও গুম্ফায় দরিদ্র লামাদের কাছে রেখে আসি। প্রতিদিন ঈশ্বরের পুজোয় কাজে লাগবে এই ফুলদানি। ফুল নিবেদন করবে তারা। কাজের কাজ হবে। আরেকবার ভাবলো যদি তারা বাজারে গিয়ে এটিকে বেচে আসে তাহলে যা পয়সা পাবে তা দান করে আসবে কোনও মনাস্ট্রিতে । তাদেরও কাজে আসবে।

রিকজিং বলল, তবে আমরাও মুক্ত হব একটা উপযুক্ত জায়গায়, ভালো কাজে দান করে।

পেকং সেই শুনে একটা বুদ্ধি ফাঁদলো। সে বলল, আমার তো মনে হয় এটি এমন কিছু দামী কোনও জিনিষই নয়। তুমি কষ্ট করে বয়ে বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচলে কোনও দাম পাবে বলে মনে হয় না। দামী জিনিষ হলে কেউ এমন প্রত্যন্ত জায়গায় ফেলে দিত না।
রিকজিং বলল, এমনও তো হতে পারে কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে গিয়ে পড়ে গেছে ফুলদানিটি।
পেকং বলল, সব তোমার মনের ভুল।
আসলে তিব্বতীরা খুব ঈশ্বরবিশ্বাসী। তাই কথায় কথায় ঈশ্বর কে তারা টেনে আনে নিজেদের মধ্যে। পথ চলতে চলতে স্পিনিং হুইল ঘুরিয়ে জপতপ করতে অভ্যস্ত তারা।
রিকজিং বলল তার মানে তুমি বলছ এটি দামী কিছু নয়? সব আমার মনের ভুল?
পেকং বলল, মানুষের জীবন তো একটা মায়ার খেলা।আর তুমি কী না ভাবছো এই ফুলদানি বেচে অনেক পয়সা পাবে! এটা একটা পাতি সস্তার জিনিষ। তা নিয়ে কত ভাবনা তোমার! দরিদ্র সাধুদের দান করলে তারা ছুঁড়ে ফেলে দেবে এটি। বাজারে বিক্রি করেও দাম পাবেনা তুমি।
রিকজিং বলল, তাই? তুমি সঠিক জানো? এই ফুলদানি কোনও দামী ধাতু দিয়ে তৈরী নয়?
পেকং অমনি বলল, তুমিই বল না। যদি সোনার হত তাহলে চকচক করত হলুদ রঙে। রূপোর হলে ধবধবে রূপোলী রঙের আভা বেরুতো এর গা থেকে। তামার হলে গোলাপি রঙের ছটা লেগে থাকত গায়ে। কী না কী! একটা টিন কিম্বা পাতি লোহার তৈরী জিনিষ তাই নিয়ে ফালতু মাতামাতি করছ তুমি।
রিকজিং ফুলদানিটি হাতে নিয়ে বলল, দেখ, দেখ, এর গায়ে কিন্তু ধূসর নীলচে আভা। খুব একটা সস্তার জিনিষ হবেনা এটা।
পেকং তার হাত থেকে ফুলদানি টি নিয়ে বলল, আরে! শোনো। যে কোনো বস্তুর পয় অপয় বলে একটা কথা আছে। কেনই বা এটিকে আমরা হাতে পেলাম। এটার জন্য আমাদের ক্ষতিও তো হতে পারে। কী করতে গিয়ে আবার কী হয়ে যাবে। দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি আমরা। তার চেয়ে চলো আমরা এবার বাড়ির দিকে রওনা দিই। অন্ধকার হয়ে আসছে। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে কিন্তু। বাড়ি ফিরে আমরা আধাআধি ভাগ করে নেব ঠিক। তাড়াতাড়ি পা চালাও বন্ধু। অন্ধকার রাস্তায় ধুলোঝড়, তুষারপাত কতকিছু বিপদ আসতে পারে। জন্তু জানোয়ার তাড়া করতে পারে। একটা সামান্য জিনিষের জন্য বৃথা সময় নষ্ট করছি আমরা।
রিকজিং এর মনে ভয় হল। সে ভাবলো এতদিনের পুরনো বন্ধু ঠিকই বলছে। তার কথা শোনাই মঙ্গল।
পথ হাঁটতে হাঁটতে থকে গেল দুজনেই। প্রথমে পেকং এর বাড়ি পড়ল। রিকজিং কে সে বলল, আমার কাছে রেখে এবার ঘরে যাও। পরে আমরা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেব আবার।
রিকজিং বেচারা বন্ধুকে এতটাই বিশ্বাস করত যে বন্ধুর কথামত বাড়ির দিকে পা বাড়াল। পিউটারের সেই ফুলদানি তখন পেকং এর জিম্মায় ।

তিন-চার দিন পরে রিকজিং এল পেকং এর বাড়িতে। পেকং তাকে দেখামাত্রই বলে উঠল,
জানো বন্ধু? ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই। ফুলদানিটা একটা সাদামাটা ধাতুর তৈরী সস্তা জিনিষ। একটা অশুভ বস্তু। এটা আমার বাড়িতে আনামাত্রই সেই রাত থেকে আমার শরীর জ্বরে পুড়ে গেছে। এই আজ আমি সবেমাত্র একটু ভালো আছি। উফ! কী কষ্টটাই না পেলাম আমি এই কটা দিন!
রিকজিং বলল, ও বাবা! কী বিচক্ষণ তুমি! কতদূর দেখতে পাও। যাক গে ! এখন তুমি সুস্থ আছো সেটাই বড় কথা বন্ধু।
পেকং বলল, বন্ধু দাঁড়াও এই অশুভ বস্তুটিকে আমাদের চোখের আড়ালে রেখে আসি। তবে আমার শান্তি।

পিউটারের ফুলদানি

রিকজিং সেদিন বন্ধুর সঙ্গে অনেক গল্পগাছা করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় বলল, "তোমার এই জায়গাটা বড় বাতাসীয়া। এই পাহাড়ী এলাকা খুব মনোরমও নয়। ঠান্ডা এবং স্যাঁতসেঁতে। ভেজা জায়গা শরীরের জন্য মোটেও ভালো নয়।আমার বাড়ির আশেপাশ সবুজ এবং উষ্ণ।প্রচুর ঘাস রয়েছে সেখানে আর আছে গবাদি পশু এবং প্রচুর তাজা ফলপাকড়। তোমার দুই ছেলে আমার গবাদি পশুদের সঙ্গে দিনভর খেলা করবে ।
আমি বরং আমার বাড়িতে ওদের নিয়ে যাই আর কিছুদিন থাকুক ওরা আমার কাছে। ওদের একটু হাওয়াবদল হবে।
পেকং রাজি হয়ে বলল বাহ! অতি উত্তম প্রস্তাব। আমার ছেলেদের জন্য বেড়ানোর পক্ষে একটি সুন্দর জায়গা হবে তবে। ঠিক আছে। ওরা যাক তোমার সঙ্গে।

রিকজিং এর সঙ্গে রাস্তায় যেতে যেতে পেকং এর ছেলেরা দুটি বানর দেখতে পেল।

রিকজিং পথেই বানরদের নানারকম কৌশল শেখাতে শুরু করল। বানররা তার কথামত গান গাইতে আর নাচতে শিখল। পেকং এর ছেলেদুটি তখন তাই দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে আত্মহারা একেবারে। এত কাছ থেকে এমন বাঁদরের খেলা ওরা জীবনে দেখেনি।

রিকজিং এর কাছে থেকে পেকং এর ছেলে দুটি কিছুতেই আর বাড়ি ফিরতে চায়না। সেদিন রিকজিং তার সঙ্গে বাঁদরগুলিও নিয়ে এসেছে তার বাড়িতে। দিন যায়। প্রায় মাস খানেক হতে চলে। বড় ভালো লেগেছে ছেলেদুটির রিকজিং এর সান্নিধ্য। রিকজিং আদর করে বাঁদরদের নামে পেকং এর ছেলে দুজনের নাম দিল সুই আর সাই।

দু' মাস পর বন্ধুর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছে রিকজিং। পেকং আসছে তার বাড়িতে। ছেলেদের নিয়ে যেতে। কিন্তু বন্ধুর বাড়ি পৌঁছে পেকং দেখল রিকজিং তার বুক চাপড়ে প্রচণ্ড কাঁদছে। ভয় পেল পেকং। তবে কী তার ছেলেদের কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেল?

রিকজিং তার বন্ধুর আগমনের ঠিক আগে সুই আর সাই কে নিয়ে পাহাড়ের মধ্যে এক গুহার মধ্যে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল।
পেকং তা দেখে বলল, "কি ব্যাপার?"
রিকজিং বলল, সে কথা তোমাকে বলার সাহস নেই আমার। বলেই কাঁদতে শুরু করল সে।
পেকং বলল, কী হয়েছে আগে বল? আমি তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
রিকজিং বলল "জানো বন্ধু? তোমার ওই দুই ছেলে দুটি বাঁদরে পরিণত হয়েছে। বিশ্বাস না হলে, তাদের ডাকো এবং নিজের চোখে দেখো।"
পেকং তো হতবাক। সে বলল, তার মানে?
রিকজিং সেদিনের আসার সময় দুটি বাঁদর কে তার ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে আসা থেকে সব খুলে বলল তার বন্ধুকে।

কথা শেষ করেই রিকজিং সুই আর সাই বলে জোরে ডাক দিতেই আসল বাঁদর দুটি সঙ্গেসঙ্গে সেখানে এসে উপস্থিত হল।
পেকং একবার তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকায় তো আরেকবার তার বন্ধু রিকজিং এর দিকে তাকায়। অবশেষে সে বুঝতে পারলো নিজের থেকেও আরও চতুর তার গোবেচারা বন্ধু রিকজিং।
অবশেষে সে বলেই ফেলল,
"আচ্ছা,বন্ধু তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশী চালাকচতুর আর বুদ্ধিমান মানুষ। এবার সেই ফুলদানির প্রসঙ্গে আসি। সেটি সত্যিই দামী এক ধাতুসংকর পিউটারের তৈরী ফুলদানি । আমি তোমার সঙ্গে সেই ফুলদানি এবার ভাগ করে নেব। এবার আমার ছেলেদের ফিরিয়ে দাও বন্ধু। আমি ওদের একবার দেখতে চাই স্বচক্ষে"।

( এ এল শেলটন এর টিবেটান ফোকলোর অবলম্বনে)

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা