সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
অচিন্‌দা স্যার

অচিন্ত্য হালদার । স্কুলে আমরা তাকে ডাকতাম অচিনদা । ঐ পাড়াগেঁয়ের স্কুলে , বুড়ো হোক বা ছোকরা , সব মাস্টারমশাই আমাদের দাদা । মায় হেডস্যার অনুকূলদা পর্যন্ত । স্কুলের বাইরে অচিনদা অচিনকাকু হয়ে যেতেন – বাবার থেকে বয়সে বেশ কিছুটা ছোট ছিলেন তিনি ।

নীচু ক্লাসে পড়ার সময় বুঝতে পারতাম না অচিনদা ঠিক 'কীসের মাস্টার' । বড় হয়ে বুঝলাম তিনি আদতে গেমস টিচার । আর স্কুলে যখন যে বিষয়ে মাস্টারমশাই তে খামতি, তখন তিনি সেই ভূমিকায় হাজির । ক্লাস টু থেকে টেন – সব ক্লাসে তার আনাগোনা । আর সবার কাছে টেরর – এর আর এক নাম অচিনদা ।

অচিনদার হাতে 'অত্যাচারিত' নয় এমন শিশু সেই স্কুলে পাওয়া বিরল । ভাল – মন্দ, ফার্স্ট বয়- ফেল করা ছাত্র – সব্বাইকে কোন না কোন দিন তার রোষের মুখে পড়তে হয়েছে । তিন আঙ্গুলের মাঝে পেন্সিল দিয়ে চাপ দেওয়া , জুলফি ধরে টানা , হাঁটুতে কাঠের স্কেলের বাড়ি – এইসব নানারকমের শাস্তি , একটু মেজাজ খাপ্পা থাকলে বেতের আঘাত হাতের তালুতে বা উরুর পিছন দিকে আমাদের আট দশ বছরের স্কুল জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ বিশেষ । কখন বা আসত – মানসিক অত্যাচার – যেমন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দু ঘণ্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা । ভাল ছেলেদের ভাল শাস্তি ; নমুনা এক দিনে দশ পাতা হাতের লেখা । এই সমস্ত অচিন্ত্যনীয় টোটকা নিয়েই আমাদের বড় হয়ে উঠা । তখনকার মা বাপরা এই 'অত্যাচারের' সম্বন্ধ্যে ছিলেন নির্বিকার । যেন ছেলে পিলেদের ভালোর জন্যেই এগুলো দরকার ।

অচিনদার শরীর মেদহীন বললেও কম বলা হবে । একদম হার জিরজিরে পেটানো চেহারা । এমনকি দেহের সাথে পাল্লা দিয়ে মুখেও কোন কমনীয়তা নেই । ছুঁচালো চিবুক , গালের হাড় গুলি ঠেলে বেরানো । বড় বড় দাঁত- সারি সারি ঝকঝকে – তার মধ্যে ডান দিকে একটা গজদাঁতও । মাথার চুল পাতলা – কিন্তু নেই কোন টাক । আর কোনদিন মনে করতে পারিনা, তার কোঠরগত চোখে চশমা ঝুলতে ।

ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন । ক্লাস শুরু হওয়ার দু মাসের মাথায় ভূগোল শিক্ষক অবনীদা অবসর নিলেন । অবধারিতভাবে, অচিনদা সেই বছর 'ভূগোল স্যার' । বেড়াতে ভালবাসতেন অচিনদা – দেশের কোনায় কোনায় গরমের ছুটিতে , পূজার সময় বেড়াতে যাওয়া তার রোজনামচা । প্রবল উৎসাহে তিনি যতো না ভূগোল পড়ালেন , তার থেকে মারধর করলেন অনেক বেশি। অনান্য সাবজেক্ট গুলো চুলোয় গেল – প্রথমেই অচিনদার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই সে বছরের লক্ষ্য হয়ে উঠলো । তার পর অচিনদার প্রশ্নপত্র । সে এক বিভীষিকা । সব প্রশ্ন – অবজেকটিভ । প্রশ্নপত্র আট পাতার । আমাদের নতুন বাজারের মণি প্রেসের অখিলদা নাকি অচিনদাকে ডেকে বলেছিল – ' অচিন -এটা প্রশ্নপত্র না উত্তরপত্র ।'

একটা নমুনা দিয়ে প্রশ্নপত্রর ভয়ঙ্করতা বোঝানো যাক । শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে - হিমালয়ের বুকে কী কী ফুল জন্মায় – সেই নিয়ে ছয়টি ড্যাশ । মন্তু আমাদের ফার্স্ট বয় , ভূগোলে পোক্ত , বইয়ের ছত্র ছত্র তার মুখস্থ – সেও পাঁচটার বেশি পারেনি । জগা তিনটে পেরেছিল – বাকি তিনটে , গাঁদা , চন্দ্রমল্লিকা আর হাস্নুহানা লিখে খাতা জমা দিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসছিল । মন্তু ঘণ্টা পড়ার পর , প্রথমেই ব্যাগ থেকে বই বার করে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল – ' ছয় নাম্বারটা হবে এবং' ।

দু বছর বাদে ক্লাস নাইন । জানুয়ারী মাসেই বাংলা টিচার অমলদা – চলতি বাস থেকে নামতে গিয়ে নিজের কোমরটি ভাঙলেন – এবং তার সাথে আমাদের কপালও । উনি আমাদের গদ্য পড়াতেন। সেটি সেবার মাস তিনেকের জন্যে অচিনদার অত্যাচারে ।

সিলেবাসের প্রথম গদ্য – 'হিমালয় ভ্রমণ'। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের লেখা – এবং সেটি মোটেও হাল্কা লেখা নয়। 'ভ্রমন' মানে 'অচিনদার সিলেবাসের' মধ্যে পরে। তিনি এসেই বোর্ডে এক পর্বতশ্রেণির ছবি এঁকে ফেললেন । তারপর এক এক চূড়োয় লিখে ফেললেন – সিমলা , ধরমশালা , ডালহৌসি পাহাড়ের নাম । দেবেন্দ্রনাথের থেকে সেই হিমালয় ভ্রমন অচিন্ত্য হালদারের হাতে শেষমেশ হাইজ্যাক হয়ে যায় ।

আমাদের অবাক হবার আরও বাকি ছিল । পরের গদ্য – বঙ্কিমের ' সাগরসঙ্গমে নবকুমার' । প্রথমদিনেই আঁকা হল – গঙ্গার মোহনা । তার উপর ড্যাশ দিয়ে কোন পথ দিয়ে নবকুমারের নৌকা এসেছিল – এমন কি কোন বনে নবকুমার হারিয়ে যান – তার স্থান বর্ণনা – চিত্রসহ । অমলদা তিন মাস বাদে এসে আমাদের উদ্ধার করেন। পরে যখন তিনি অবশ্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদির 'বিদ্যাসাগর' পড়াতেন – তখন মনে হত অচিনদা যদি একদিন এসে ঘাটাল , বীরসিংহ গ্রাম, উত্তাল দামোদর আঁকতেন ব্ল্যাকবোর্ডে !

অচিনদার আরও একটি নেশা ছিল । রেফেরিং বা আম্পাইরিং করা । স্কুল ম্যাচ তো বটেই – আশেপাশের বিভিন্ন মহকুমা বা জেলাভিত্তিক যে সব খেলাধূলা হত সেখানে তিনি এই রূপে আবির্ভূত হতেন একেবারে পাক্কা ড্রেস পড়ে । এইসব বিড়ম্বনার কাজ তিনি ভালবেসেই করতেন। পোড়া বাংলাদেশে এই সব করে পয়সা পাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই । খুব বেশি হলে বিকালের টিফিন বা দুপুরের খাওয়া । তখন কলেজে পড়ি – কলকাতায় । শনিবার শনিবার বাড়ি আসতাম। সেইরকম এক শনিবারে বাড়ি আসার পথে সদরের বাস স্ট্যান্ডে নেমে – কিছুটা হেঁটে ভ্যান ধরবো বলে হাঁটছি । পাশের মাঠে একটা জটলা আর চিৎকারে চোখটা আঁটকে গেল । দেখি মাঠের এক কোণে অচিনদা দাঁড়িয়ে । সামনে জনা বিশেক উত্তেজিত জনতা । একেবারে এই মারে কি সেই মারে । অপরাধ অচিনদা তাদের এক ব্যাটসম্যানকে এল বি ডবলু আউট দিয়েছেন । সে যাত্রায় আশেপাশের লোকের বদান্যতায় তিনি মোটামুটি অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পেরেছিলেন ।

একসঙ্গে গ্রামে ফিরবার সময় সারাটি পথ চুপ করে বসে ছিলেন । বাম কনুইয়ের কাছটায় রক্ত জমাট বাঁধা ছিল – যন্ত্রণাও নিশ্চয় তাকে কাতর করেছিল। বললাম – বয়েস হয়েছে – আর এইসব করেন কেন । একটা শুষ্ক হাসি হাসলেন মাত্র – যে হাসির মানে অনেক রকম হতে পারে ।

গ্রামের পাঠ চুকিয়ে অনেক দিন চলে এসেছি । এমনকি রুজি রুটির সন্ধানে প্রবাসি জীবনে মানিয়ে নিয়েছি । অচিনদা কেন – সেই সব দিনের কারুর সাথে সেই রকম যোগাযোগ নেই । অচিনদার সাথে শেষ দেখার শুরু অজন্তা পাহাড়ের গুহার বাঁকে । পরিবার নিয়ে ঘুরতে গিয়েছি । কানে পিছন থেকে বাংলা ভাষায় অজন্তার গুহাচিত্রর ধারাবিবরণী কানে এল । তাকিয়ে দেখি অচিনকাকু – দুটি শিশুকে গুহাচিত্র বোঝানোর ভার নিয়েছেন । সেই দুটি তার নাতি নাতনি । তারপর সেই অজন্তা আউরঙ্গাবাদ বেড়ানোটা পুরো অচিনকাকু – ময় ( তখন আর সবার সামনে দাদা বলাটা বড়ো বেমানান লাগছিল )।

কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে খড়্গপুর আই আই টি -তে। বর্তমানে বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। শৈশব কেটেছে উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাটে, বর্তমানে পানভেল, মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা