সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ক্যানভাস

ভিড়টা দেখেই এগিয়ে গেলাম, এমন নয় আমি সবসময় ভিড় দেখলেই এগিয়ে যাই, কিন্তু এই ভিড়টা যেন কিছু আলাদা। ভিড় থেকেই কিছু শব্দ আমার কানে ভেসে আসছিল, যেমন 'আঁকা','লেখা', 'চলবে না' ইত্যাদি। ভিড় ঠেলে আমি সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম, একজন মানুষ মাথায় হাত দিয়ে বসে আর তার পাশে একটি রঙের বালতি আর কিছু রঙের কৌটো রাখা। পাশে আমার মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, "কী হয়েছে দাদা?"

সেই দাদা খুব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, " আর কী বলবেন দাদা? এসব লোক শুধু ঝামেলা বাড়াতে ব্যস্ত, এ নাকি কোন রঙের মিস্ত্রি। কোনো বাড়িতে রঙ করতে গিয়ে কিছুটা বেঁচে গেলে ও সেগুলো চেয়ে নিয়ে জড়ো করে রঙের কৌটোতে। তারপর নাকি সেগুলো নিয়ে শহরের নোংরা, শ্যাওলা ধরা দেওয়ালগুলোতে সুন্দর করে আঁকার চেষ্টা করে, আর্টিস বুঝলেন, আর্টিস। আর্টিস হবার শখ। হেঁঃ।"

আমার খারাপই লাগলো, আমি কোনো পাল্টা কথা বললাম না, লাভ নেই, তবে যিনি এমন ভালো কাজ করতে চান, তাঁর মুখটা একবার দেখতে ইচ্ছে হলো। পাড়ার মোড়ের ভেতরের দেওয়ালগুলো দেখলাম, সত্যিই পানের পিক ফেলায় লাল হয়ে গেছে বা যেটুকু জায়গা ফাঁকা তাতে রাজনৈতিক স্লোগান লেখা আর নাহলে শ্যাওলা ধরে গেছে। কিছু দেওয়ালের বাইরের দিকের অবস্থাও সত্যি ভালো নয়। ভিড়ের মধ্যে দুয়েকটা কথা শুনে সবার এত রেগে যাওয়ার কারণ বুঝে গেলাম, এরা কোনোকিছুই আসলে পাল্টাতে চায় না। আর তার চেয়েও বড় কথা, এটা একটি বড় নেতার পাড়া, তার দলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাবে না - দেওয়ালে রাজনৈতিক স্লোগান থাকবে কিন্তু ভালো সুন্দর দৃশ্য নয়। আর যদি সত্যিই কিছু করার ইচ্ছে হয় তবে পাড়ার অনেক মানুষের অনুমতি নিতে হবে। বুঝতে পারলাম, মানুষটি আর বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকলে মারধোরও খেয়ে যেতে পারেন ।

এবার আমিই এগিয়ে মানুষটির কাঁধে হাত রাখলাম, তিনি মুখ তুলে চাইলেন, মুখটি দেখতেই খুব অবাক হয়ে গেলাম। এ তো বিষ্ণু মাজি। আমাদেরই মফস্বলের স্কুলে পড়তো, মুখ এবং শরীরে ক্লান্তির ছাপ পড়েছে তবু চিনতে পারলাম, কারণ বিষ্ণুকে ভোলা যায় না। স্কুলের সমস্ত অনুষ্ঠানে আল্পনা দেওয়া, ফুল দিয়ে সাজানো, হাতের কাজের ক্লাসে মাটির পুতুল তৈরি করা, সেলাই করা, আঁকা সবেতে ওর কাজ শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। মোটামুটি সবাই জানতাম যে বিষ্ণু আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে ঠিক রাজ্যের বা দেশের আর্টিস্টদের মধ্যে সেরা একজন হয়ে উঠবে। কিন্তু সেই বিষ্ণু আজ আঁকতে গিয়ে রাস্তার মাঝে লোকের হাতে আরেকটু হলে মার খাবে! খুব খারাপ লাগলো। হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম।

বিষ্ণু আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো, ওর মুখ দেখে মনে হলো ও আমায় চিনতে পেরেছে, যেন মনে একটু সাহসও পেয়েছে, "আরে রাজিবুল না?"
আমি ঘাড় নাড়লাম। ওর গলার স্বর তেমন স্বাভাবিক হয়নি, এখনও কিছুটা ভয় পেয়ে আছে। হয়তো সবাই খুব খারাপ কথা বলেছে! আমি বাকিদের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললাম, "আপনারা প্লিজ চলে যান। ও এখানে কোনো দেওয়ালে আঁকবে না, এই ঝামেলা এখানেই শেষ করুন প্লিজ।"
বিষ্ণু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো, তবে কিছু বললো না। লোকগুলোও দেখলাম আর তেমন কিছু বললো না বিষ্ণুকে, এক দুজন যেন রেগে তাকালো, কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই চলে যেতে শুরু করলো। ভিড় পাতলা হয়ে একদম ফাঁকাই হয়ে গেল। বুঝলাম আমার ভালো পোশাকের জন্যই হোক বা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলাতে, সবাই আমার কথা শুনেছে।

সবাই চলে যেতে বিষ্ণু অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, "তোকে মিথ্যে বলতে হলো আমার জন্য।"
আমি অবাক হলাম, "আমি কী মিথ্যে বললাম আবার?"
"ঐ যে বললি আমি আঁকবো না। আমি তো এই রং, ব্রাশ দিয়ে এই দেওয়ালগুলোতে আঁকবোই, দেওয়ালগুলোর অবস্থা দেখেছিস? খারাপ লাগছে না তোর? এগুলোকে কেন থাকতে দেব এরকম?"
"এত ঝামেলার পরেও তুই আঁকবি এখানে? লোকগুলো কিন্তু ভালো নয়। ঝামেলায় জড়াস না।"
কিছুক্ষণ যেন কিছু ভাবলো ও। তারপর বললো, "হ্যাঁ, ভয় আছে একটু, তবে সেই কারণে না আঁকলে আমার খুব অস্বস্তি হবে। জানিস, একদিন ভালোমতো না আঁকতে পারলে, কিছু বানাতে না পারলে ঘুমাতে পারি না। মজদুরের ছেলে হয়ে নানা কারণে আর্ট স্কুলে ঢুকতে পারিনি, পড়াশোনাও শেষ হয়নি, রং নিয়েই থাকতাম, তাই রঙের মিস্ত্রি হলাম। খারাপ লাগে না বুঝলি, নিজেদের সংসার চলে যায়, তবে সৃষ্টির সেই আনন্দটা পাই না। তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম পুরো পৃথিবীটা আমার ক্যানভাস হবে, যেখানে সেখানে আঁকবো। লোকে জানেই না, শহরের অনেক দেওয়ালে, মন্দিরের চাতালে, কবরের বেদির উপর আমার কাজ আছে। কেউ কিন্তু সেই কাজ দেখে থুতু দেয়নি, রেগে যায়নি। বরং আড়ালে থেকে কখনো কখনো দেখতে পেয়েছি, আমার কাজগুলো দেখে মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এটাই এই পরিশ্রমের পাওনা, এইভাবেই চলছে, চলবে, যতদিন না এরকম লোকের কাছে মার খেয়ে মরে যাই। হাহাহাহা।"
আমি কী বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা এরকমও হয়!
বিষ্ণুই আবার বলে উঠলো, " ছাড়, আমায় নিয়ে ভাবিস না, তবে তুই এরকম স্যুট বুট পরে এই পথে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাচ্ছিস?"
আমি নিজের দিকে তাকালাম। হেসে বললাম, "অফিস থেকে ফেরার পথে বাড়ির কাছে এসে গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হলো, তাই এই পাশের এক কার সার্ভিসিংয়ের দোকানে রেখে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছি। এর পরের পাড়াতেই আমার বাড়ি। তুই চল, কিছু খাবি, রেস্ট নিবি, অনেক কথা হবে, সেই স্কুলের পর তো…"
"হ্যাঁ, অনেকদিন, সত্যিই। তুই অফিস যাচ্ছিস, গাড়ি কিনেছিস, ভালো আছিস শুনে ভালো লাগলো। তবে আমি এখন তোর বাড়ি যেতে পারবো না, কিছু মনে করিস না। আজ সত্যিই একটা কাজ আছে, তার জন্য তৈরি হতে হবে। কাজটা শেষ করে কাল ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবো। তবে তোর বাড়ি অন্য একদিন ঠিক যাবো। ভাবিস না।"
ভালো করে সব কৌটো বন্ধ করে মাটি থেকে তুলে নিলো বিষ্ণু। চলে যাবে মনে হয়। আমার অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করলো কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না।
শুধু জিজ্ঞেস করলাম, "আবার কবে… ?"
বিষ্ণু হাসলো, মিথ্যে হাসি নয়, মনের হাসি, আশার হাসি। "শোন, গাড়িটাকে আর দু-একদিন সার্ভিসিংয়ে রেস্ট নিতে দে। তাহলেই আমায় ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবি।"

আমি বুঝলাম না ও কী বলতে চাইলো, তবে বিষ্ণু আর দাঁড়ালো না। মনে মনে শুধু একটা প্রার্থনা করলাম, 'বিষ্ণুর খুব ভালো হোক'।

*****

ক্যানভাস

গাড়ির আরেকটু কাজ বাকি, সময় নিয়ে ভালো করে করুক, অসুবিধা নেই। আমি হাতে একটা চুরমুরের প্যাকেট নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই আগের দিনের পাড়ার সামনে এসে পড়লাম। আজকেও কালকের মতো অনেক লোক ভিড় করে আছে, তবে কারণটা জানার জন্য আমায় আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হলো না। পাড়াটির মধ্যে যতদূর দেখা যায়, ততদূর দেখে ভীষণ অবাক হয়ে যাই। এরকমও হয়? প্রতিটা দেওয়ালে এত সুন্দর ছবি, এত সুন্দর রং, তুলির কাজ যে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়। কখন হলো এসব? রাতের অন্ধকারে? কাল বিকেলেও তো কিছু ছিল না। অন্ধকারে, কম আলোতে এরকম আঁকা যায়!!! সবটা অবিশ্বাস্য লাগলো আমার। ছবিগুলোও সব আলাদা। কোনো দেওয়ালে হকি খেলা তো কোনো দেওয়ালে ফুলের বাগিচা, কোনো দেওয়ালে নন্টে-ফন্টে, কোনো দেওয়ালে গ্রামবাংলায় সন্ধে দেওয়ার ছবি, কতক্ষণ ধরে যে দেখে চলেছি, বুঝতে পারিনি। হঠাৎই মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিলো, তাহলে কি বিষ্ণু?

ঘোরের ভাবটা কেটে গেল জোর একটা চিৎকার শুনে। যে লোকটা চেঁচালো তাকে চিনতে পারলাম সহজেই। এলাকার বড় নেতা বীরেন দাস তার চ্যালাদের লক্ষ্য করে হুঙ্কার দিলো, "একদম চুপ। বোকা হতচ্ছাড়ার দল! কেউ কোনো দেওয়ালে হাত দিবি না। মুছে ফেলার কথা তো তারপরে। "

বীরেন দাসের বাড়ির দেওয়াল দেখে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। দেওয়ালে মিঠুনদার ছবি আঁকা। আর পেছনে দুটো ছোট ছোট ছেলে। সেই দুটো ছেলের মধ্যে একটা আমি আর একটি বিষ্ণু নিজেই, সেই ছোটবেলার আমরা। বিষ্ণু নিখুঁতভাবে মনে রেখেছে ছোটবেলায় আমরা ঠিক কেমন দেখতে ছিলাম! আর ও ঠিক এটাও জেনে নিয়েছে, বীরেন দাস মিঠুন চক্রবর্তীর ভীষণ বড় ফ্যান। তাই কাল বীরেন দাসের চ্যালারা বিষ্ণুকে আঁকতে বারণ করে হুমকি দিলেও আজ কোনো আঁকাতেই যেন কোনো আঁচড় না লাগে, তার দায়িত্ব বীরেন দাস নিজে নিয়ে নিয়েছে।

আমার মাথায় তখন একটা জিনিসই ঘুরপাক খেতে লাগলো, দিনের বেলায় এত অপমান, এত বাধা, এত খারাপ কথা, হুমকি দেওয়ার পরেও বিষ্ণু একা রাতের অন্ধকারে পুরো পাড়া রং করে ফেললো! কোন ইচ্ছের জোরে, কোন ভালোবাসায় এই অসম্ভবকে সম্ভব করলো ও? সৃষ্টির প্রতি অকল্পনীয় টান?

সঠিক কারণটা না জানলেও বিষ্ণুর এই কাজ আমায় কিছু জিনিস বুঝিয়ে দিলো। মনে হলো 'ভালো কিছু করতে গেলে অত ভাবতে নেই, করে ফেলতে হয়,' বা এই যে 'ভালো কাজ করতে যত আটকানোর চেষ্টা করে মানুষজন, ঠিক কেউ এসে তার ইচ্ছের জোরে বারবার সেই বেড়া ভেঙে দেয়।'

বিষ্ণু ঠিক পেরেছে, ও রাতের অন্ধকারে ফুটিয়ে তুলেছে রং, সকালের রোদে সেগুলো আরও পাকা হয়েছে এবং সেই আঁকাগুলো দেখে শেষ অবধি চরম বিরোধিতা করা মানুষজনও আজ ওর কাজের প্রেমে পড়ে গেছে। এর থেকে বেশি সাফল্য আর কীভাবে মানুষ পায়? আমার লজ্জা হলো যে একমুহূর্তের জন্য হলেও আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে বিষ্ণু সফল নয়।

আমার পকেটে একটি কাগজ তখন উঁকিঝুঁকি মারছে - দক্ষিণ কলকাতার একটি আর্ট গ্যালারিতে একজিবিশন করার অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম। ভেবেছিলাম, বিষ্ণুকে দেব, ওকে একটা সুযোগ করে দেব বড় কিছু করার। কিন্তু সারা পৃথিবীর যেকোনো অংশ যার ক্যানভাস, তাকে কিছু দেওয়ার মতো ক্ষমতা হয়তো তৈরি হয়নি আমার। আমি চুপচাপ ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এগোতে থাকলাম নিজের বাড়ির দিকে।

আজ বিষ্ণুকে দেখতে পেলে ঠিক বাড়ি নিয়ে যেতাম, ও নিজেও হয়তো আজ আমার সঙ্গে হইহই করে বাড়ি যেত। মনে হলো যেন খুব শিগগিরই বিষ্ণুর সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা