সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
শ্যাওলা

 ১

গরমের ছুটি শুরু হয়েছে সবে, এক্ষুনি দূরে বেড়াতে যাওয়া  হবে না, বাবার ছুটি নেই। তাই ঈশানের মা বাবা ঠিক করেছে্ন সপ্তাহের শেষে আশে পাশের ছোট ছোট নানা জায়গা ঘুরে ঈশানকে একটু ব্যস্ত  রাখতে  হবে প্রকৃতির কাছাকাছি; ছেলেটা গেমের নেশা ছাড়তে পারছে না। সে এক মহা চিন্তার ব্যাপার , স্কুলের টিচাররা জেরবার, মা- বাবারা গলদঘর্ম, এযুগের বাচ্চাদের কৃত্রিম জগতেই বেশী ঘোরাফেরা। খুব কড়া হাতে সব বন্ধ করে দিলেও বিপদ, সব বাবা মা তো সেটা পারছেন না, অনেকে নিজের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত, বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে এরা দিব্যি ফাঁকিও দিতে শিখেছে যে।
পরীক্ষার সময়টা ঈশানকে একটুও কম্প্যুটার গেম খেলতে দেওয়া হয়নি, কিন্তু পড়াশোনার শেষে নতুন ক্লাসে ওঠার আগে দীর্ঘ ছুটি, তখন একেবারে বাধা দিলে বাড়িতে অশান্তিময় পরিবেশ। বন্ধুগুলো যে খেলতে আসে সেও এই অলীক জগতের খেলা, কী যে করেন ঈশানের মা বাবা, এগারো বছরের ছেলেকে  বন্দী তো করে রাখা যায়না। ঈশানের মা বাবা  দুজনেই বেড়াতে ভালোবাসেন প্রকৃতির কাছাকাছি, নগর  বন্দরে না, তারই সামান্য কিছু যদি জিনের কেরামতিতে ছেলের মধ্যেও এসে পড়ে, আর তাতে যদি ছেলের মনটা গেমের জগত ছেড়ে মুক্তি পায়, সেই চেষ্টা করা আর কী।

সকাল সকাল রওয়ানা হল তারা, মধ্যরাতে বাড়ী ফেরা, তাই জিনিসপত্র কম হল না, বীচে রোদ থেকে বাঁচতে তাঁবু ও ছাতা , সাঁতারের সরঞ্জাম, খাদ্য পানীয় সব মিলিয়ে । ইশান সক্কাল সক্কাল উঠে বাবাকে হেল্প করল গাড়ি পরিষ্কার করতে ও জিনিস নিতে। কিন্তু মনটা খুব উত্তেজিত নয় , যেতে হবে তাই যাচ্ছি গোছের। রাত্তিরে একটা মাইনক্র্যাফট গেম বাবার তাড়া খেয়ে অর্ধেকে ছাড়তে হয়েছিল, মনটা শেখানেই পড়ে  আছে।  মা আবার সন্ধ্যায় এসেছিলেন গেম বুঝতে, ভাব জমানোর চেষ্টা, বলেছিলেন – সমুদ্র নিয়ে কোনো গেম নেই এটাতে? ঈশানের চোখমুখ চকচক করে উঠেছিল, সে মেরিন শিপ রেক থেকে দামী মেটাল খোঁজার গেমটা মাকে প্রচুর বোঝালো, মা কী বুঝলেন ভগবানই জানে, যাহোক মারদাঙ্গার খেলা নয় দেখে  খেলার  অনুমতি দিলেন। "রাস্তাটুকু খেলার জন্যে ট্যাবলেট নিতে পারো,  বীচে পৌঁছে কিন্তু আর নয়" বললেন মা।
     
গাড়ি যাত্রা শুরু করতেই  ঈশান খেলায় ডুব দিল, স্কুবা ডাইভিং করে সে পৌঁছালো অতলে, বিরাট  একটা জাহাজ তাতে কোরালের কলোনী , অসংখ্য মাছের বাসা। পাহারাদার  প্রানীদের এড়িয়ে সম্পদ হাতাতে হবে, ব্যাটারা টের পেলে তুমি প্রথমে শক টক খাবে, তারপর মরবে, মানে গেম হারবে।

এই বীচটা তাদের বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে, ঘণ্টা  আড়াই লাগে পৌঁছতে । অনেকদিন আগে একবার এসেছিল তারা , সামুদ্রিক প্রানীদের স্বর্গভূমি, ডলফিন ম্যানাটি প্রচুর দেখা যায় , শাঁখের ডিমের মালার মত দেখতে অংশ পড়ে থাকে বালিতে, নানা রঙের ঝিনুক আর শাঁখ অফুরন্ত।  গরমের সময়ে  কচ্ছপরা আসে ডিম পাড়তে, ছোট ছোট অগুন্তি ছানাদের মিছিল দেখা যায়, পরিবেশবন্ধু টিম থাকে তাদের নিরাপত্তার জন্যে।  এবারে তেমনি কিছু দেখার আশায় এসেছে তারা। কিন্তু বীচের পার্কিং ফাঁকা, দু একটাই গাড়ি দাঁড়িয়ে, এমনটা তো দেখা যায় না !

তারা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বালির ঢিপি পেড়িয়ে বীচে নামার আগেই টের পায় তীব্র আঁশটে গন্ধ  চারপাশে। জিনিস গাড়িতে রেখেই দৌড়ে যায় তারা । "রেড টাইড" বাবা অস্ফুটে উচ্চারণ করেন।

তারা দেখে  তিন চারজন লোক কিছু নীল বাক্স ও যন্ত্রপাতি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে বীচে, তাছাড়া আর কেউ নেই, জলেও কেউ নামেনি।  

 রেড টাইড এক ধরনের জলের শ্যাওলা যা কিছু বছর ধরে  ফ্লোরিডায় সমুদ্রের জলকে  দূষিত করে চলেছে। এই সমস্যা অনেক দিনের কিন্তু গত বছর থেকে এর বাড়াবাড়ি অসহ্য  হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের  ধারে কেউ দাঁড়াতে পারছে না চোখ থেকে জল পড়ছে, নানা রকম অসুস্থতা, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে। এ তো গেল মানুষের কথা , অন্যদের অবস্থা আরো ভয়ানক, অসংখ্য জলের জীব, ডলফিন, মাছ, কচ্ছপ  মারা  পড়েছে এই জলের শ্যাওলার জন্য।  আজকে এখানে আসার আগে ঈশান ও তার বাড়ির কেউই খেয়াল করেনি যে রেড টাইড এর ব্যাপারটা একবার ইন্টারনেটে দেখে নেয়া উচিত, কেননা তারা  কেউ জানতই না যে এই সমস্যাটা এবছরের গরমে আবার শুরু হয়ে গিয়েছে।  তাদের কাছাকাছি বীচে এটা হচ্ছিল না আর তারা এসেছে ড্রাইভ করে প্রায় আড়াই ঘন্টা দূরত্বের একটা নতুন বীচ এক্সপ্লোর করতে, আজকে সেখানে যে এই সমস্যা চলছে তার কোন ধারণা তাদের ছিল না।

এই দৃশ্য হঠাৎ তাদের খুব মন খারাপ করে দিল। তারা দেখতে পেল অসংখ্য  মাছ এবং অন্যান্য প্রানীর মৃতদেহ।ঈশানের মা বাবা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ভাবছে্ন অত মরা প্রাণীর মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে কিনা।  কিন্তু ঈশান হঠাৎ করে বীচের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। পেছনে তার বাবা মা তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন না, অগত্যা সবাই এগোল। তারা  জলের কাছাকাছি যেতে যেতে তাদের চোখ জ্বালা করতে লাগল  এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হলো । সাদা বালি এবং নীল রঙের স্বচ্ছ জল এখানের বিশেষ আকর্ষণ,  কিন্তু এখন জলের রং প্রচন্ড লাল দেখাচ্ছে। তারা দেখতে পেল গ্লাভস ও মাস্ক পড়ে মানুষগুলো সেই মাছ এবং ডলফিনদের সরিয়ে নিয়ে  যাওয়ার চেষ্টা করছে একটা গাড়ির মধ্যে। কিছু মাছ, কচ্ছপ এবং কিছু পাখি অসুস্থ মনে হচ্ছে দেখে কিন্তু মরে যায়নি। অ্যানিম্যাল রেসকিউ টিমের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ঈশান
-  "তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ ওদের?"
ওরা জানাল পশুদের হাসপাতালে , তাদের এখন অনেক যত্ন দরকার।  
ঈশান বলল- "কেন হচ্ছে এই রেড টাইড?"
তাদের মধ্যে একজন বলল –"তুমি আমাদের ওয়েবসাইটে গেলে সব জানতে পারবে,"  বলে একটা কাগজ দিল।
ঈশান দেখল একটা স্বেচ্ছাসেবী পরিবেশকর্মী দল সেটা।
হঠাত তার মনে হল স্ট্রেচারে করে তুলে নিয়ে যাওয়া ডলফিনটা তার খুব চেনা, সেটা তার দিকে চেয়ে করুন হাল্কা আর্তনাদ করল।
ঈশান ,বাবা ও মা যতটা পারল ঘুরে ঘুরে বেঁচে থাকা প্রানীদের শনাক্ত করে দলটাকে সাহায্য করতে চাইল। একটু দূরে জলের মধ্যে বিরাট একটা কিছু ভাসছে, ওরা আতঙ্কে তাকিয়ে দেখল ম্যানাটি। ঈশানের মা এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন, ম্যানাটি মায়ের খুব প্রিয় প্রানী, গাবলু গুবলু পোঁটলার মত দেখতে ভারী মিষ্টি স্বভাবের প্রাণী ওরা। ফ্লোরিডায় ওরা কড়া আইনের আওতায় প্রোটেক্টেড, সংরক্ষিত প্রাণী।  রেস্কিঊ টিম জল্পনা  করতে লাগল কীভাবে ঐ বড় ভারী প্রাণীকে সরানো হবে।  সঠিক পোষাক মাস্ক ছাড়া ঈশানরাও অসুস্থ হয়ে পড়বে,  কিছু পরে রেস্কিঊ টিম তাদের বাড়িই ফিরে যেতে বলল।
ফেরত পথে ইশান আবার গেম খুলল, খেলতে নয়, একটা খটকা জন্মেছে তার মনে-
গেমের মধ্যে তার নাম স্টিভ, স্টিভের কিছু বন্ধু ডলফিন আছে, তাদের দেখতেই সে খুলল, ওরা একদম আজকের অসুস্থ ডলফিনটার মত। ঈশানের বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল, অলীক জগতের বন্ধুদের সে বড্ড ভালোবাসে।
এমন সময় বাবা গাড়ি চালাতে চালাতে ধমক দিলেণ-" এই তুই কী মানুষ? গেমে তোর সেন্স টেন্স সব ভোঁতা করে দিয়েছে নাকি? অতগুলো সুন্দর প্রানীর কষ্ট দেখে এসে তোর এখন গেম খুলে বসতে ইচ্ছে হল?"
ঈশান কোন জবাব না দিয়ে ট্যাবটা বন্ধ করে দিল।

শ্যাওলা

রাত্রে সে স্বপ্ন দেখল সেই ভাঙ্গা জাহাজের ভিতরে ধনরাশি খুঁজছে সে , ড্রাউন্ড নামের কদাকার প্রানীগুলো তাকে বাধা দিচ্ছে, এমন সময় এল বন্ধু ডলফিনের ঝাঁক , লড়াই বাঁধল। কিন্তু ওরা হেরে যাচ্ছে, ডলফিনের রক্তে সমুদ্রের জল লাল হয়ে গেল, ঈশান আর্তনাদ করে উঠে বসল। ঘামে ভিজে গিয়েছে সর্বাঙ্গ, গেম নিয়ে স্বপ্ন সে ঘুমিয়ে ও জেগে দুভাবেই দেখে থাকে, নতুন না, তবে এমন বিটকেল স্বপ্ন সে জীবনে দেখেনি।

পরদিন ঈশান বাবার সঙ্গে বসে অনেকদিন পরে স্থির মাথায় একটা কিছু পড়ল যা গেম বিষয়ক নয়। সেই  স্বেচ্ছাসেবী দলের ওয়েবসাইট, সেখানে সে জানল অনেক কথা, কীভাবে মূলত জলাভূমির  ইকোসিস্টেমকে ধ্বংস করে ফ্লোরিডায় দেড়শ বছর ধরে গড়ে উঠেছে চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত  শিল্প ও কল কারখানা।  সেগুলি  মানুষের বুঝে ওঠার আগেই  দূষন ছড়িয়েছে  বড় বড় লেকের জলে  ও তারপর লেক থেকে সমুদ্রের জলে ।  ফ্লোরিডার বিরাট সমুদ্রতট  বরাবর শীতের মরশুম শেষ হলে একটু জল গরম হতে না হতে চলে আসছে ক্যারিনিয়া ব্রেভিস নামের শ্যাওলা, যা এখন 'ফ্লোরিডা রেড টাইড' নামেই বেশী পরিচিত। চাষের জমির সার  কীটনাশক, ও  মানুষের  রোজের ব্যবহারের ডিটারজেন্ট এদের বেড়ে ওঠাকে সাহায্য করছে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। আর যেহেতু এই সমস্যার সমাধানে যা করা দরকার তাতে বিস্তর  টাকার লোকসান, তাই অর্ধেক মানুষ শুনতেই চাইছে না বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা। কিন্তু যারা রোজগারের জন্যে জলের উপর নির্ভরশীল মানুষ অথবা অবসর যাপন করতে জলের ধারে এসেছেন জীবনের শেষ সময় কাটাতে তারা গেছেন খেপে। শুরু হয়েছে আন্দোলন,  অনেক সংগ্রামের পর কিছু আশাও মিলেছে। দূষিত জল সমুদ্রে না ফেলার সিদ্ধান্ত সবে নিয়েছে সরকার, অনেক কোটি টাকার প্রজেক্ট সেটা।  

এসব পড়ে ঈশানের হঠাৎ মনে হল তার অলীক খেলার জগতের থেকে বাস্তবের জগতটা অনেক বেশী ঘটনাবহুল, আর সে জগতে তার যোগ দেওয়ার মূল্য আছে, স্টিভ সেজে না ঈশান হয়েই। ঈশান এখন রেস্কিউ টিমের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে,  বীচের জঞ্জাল সাফাই অভিযানেও নামে তার ফ্রি টাইমে, গেম যে এক্কেবারে খেলে না তা নয়, তবে ব্যাল্যান্স রেখে।  

 

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

বহরমপুর মুরশিদাবাদে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, প্রথম দিকের পড়াশোনা বিঞ্জান নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে তুলনামূলক সাহিত্যে বিষয় বদল শুধু ভালবাসা থেকে। বর্তমানে আমেরিকার বস্টন শহরে বসবাস। কবিতা আবৃত্তি , লেখা আর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানো শখ ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা