খেলাঘরখেলাঘর

ছবি

বসন্তের হাওয়া গায়ে মাখতে কি যে আরাম, আজ দিনটা দারুন ঝকঝকে, সামনে মা গঙ্গা বেশ শান্ত মেয়েটির মত বয়ে চলেছেন, কত রূপ দেখলাম তার নানা ঋতুতে। আমি এই বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছি তা শতখানেক বছর তো হবেই, নদীর ধারেই এই অঞ্চলের সবথেকে পুরনো কলেজ, তার এক সাহেব প্রিন্সিপাল আমাকে লাগিয়েছিলেন কলেজের কোন এক উৎসবের দিনে।বাঁধের রসাল মাটিতে শিকড় চালিয়ে চালিয়ে বেশ শক্তপক্তো হয়ে উঠলাম কয়েক বছরেই, একাত্তরের বন্যা সে শিকর টলাতে পারেনি, কিন্তু দুহাজারে ভালই ধাক্কা খেলাম,শুধু আমি না, ধাক্কা খেল এই গঙ্গাপারের শহরটাও, কখনো জলে ডোবেনি বলে খুব গুমর ছিল যার।ঐ যে এসে গেছে ছন্নছাড়ার দল, সকালের আড্ডাতে, আজ পুজো, কাল রক্তদান শিবির, পরশু পাড়ার নাটক করে কাটে এদের।কিন্তু সেই ভয়ানক বন্যার সময় আমি ও আমার গাছতলার বেকার ছেলের দল একটা শহরের কয়েক লক্ষ প্রাণ বাঁচিয়েছি, সে কথা কজন মনে রেখেছে?

মাত্র তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে ভেসে গেল চারপাশ, গঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে দেখছি ওপারের নিচু জমি সব ভেসে যাচ্ছে,আর দুদিনের মধ্যে দলে দলে লোক আশপাশের গ্রাম থেকে এসে উঠতে লাগল কলেজ এর অস্থায়ী ঠীকানায়। আমি আছি বেশ নিরাপদ স্থানে, উঁচু বাঁধের** উপরে, তবু দেখি কদিনেই জল আমার হাত দুই নিচে এসে গেছে, যেটা এমনি সময় ৩০ টা সিঁড়ি নিচে থাকে।এবার শুরু হল আর এক বিপদ, দলে দলে শহরের লোক দেখতে আসছেন জল কতটা বাড়ল, তাদের পায়ের চাপে যে বাঁধের মাটি আরো আলগা হয়ে নদীর জলের দিকে চলেছে সে বোধ নেই কারো। ব্যস পরদিন পরলাম হেলে জলের দিকে,আমার শিকরে টান লেগে ফাটল ধরল মাটিতে।প্রথম টনক নড়ল আড্ডাবাজ ছেলের দলের, আমার ভাগ্য বলতে হবে তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বেশ তাড়াতাড়ি বুঝতে পারল। কিন্তু মাননীয় রাজা ঊজীর, যারা এই ছেলেদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি , শিক্ষা ও যোগ্যতায় বড় বলে আমার ধারনা ছিল তাদের বোঝাতে কেন জানিনা এদের অনেক কষ্ট করতে হল। পরিস্থিতি খতিযে দেখতে বড়সড় দল এল, একজন বললেন গাছটাই যত নষ্টের গোড়া, ওটাকে কাট, ছেলের দল আঁতকে উঠে বলল, তা হলে বাঁধ আর টিকবে না ওর শিকর ই মাটি ধরে আছে যে। আর একজন বললেন তবে ওটার ডালপালা ছেঁটে হাল্কা কর যাতে ও ভারি হয়ে জলে না পরে। ছেলেরা বলল তাহলে যেভাবে গাছটা আছে তাতে কাওকে উঠে হাতে যন্ত্রনিয়ে কাটতে হয়,সেটা করলে ও কি আরও ঝুঁকে যাবেনা জলের দিকে? তবে গাছ কাটার মেশিন গাড়ী আসুক, ছেলেরা বললে, আজ্ঞে হুজুর গাড়ী তো দুরের কথা এই বাঁধের কাছাকাছি মানুষের আসাই এক্ষুনি বন্ধ হওয়া দরকার।

সারাদিন কেটে গেল মীমাংসা হলোনা কিছুই। আমি তো বেশ বুঝতে পারছি জল আমার শিকর আলগা করছে আমি উপড়ে পরলেই গোল একটা গর্ত সৃষ্টি হবে বাঁধে, মহানন্দে ঢুকে পরবে মা গঙ্গা শহর ভাসিয়ে।ছেলেরা বলছে কিছু পুলিশ দিন লোক আটকাতে, নদীর পারে আসা এখুনি বন্ধ করুন,গাছের ব্যবস্থা আমাদের ছেড়ে দিন, কিন্তু কতগুলো বাউণ্ডলের ওপর নিরভর করলে মানীর মান বাঁচে না।শেষকালে এক স্থানীয় নেতা যিনি পাড়ার বারমাসে তের পারবণে এদের ডাকে মঞ্চ আলো করেন, তিনি ছেলেদের কাজে সাথ দিলেন, উঁচুতলার মানুষদেরও মান বাঁচল। বালির বস্তা দিয়ে হেলে যাওয়া দিকটাতে ঠেকা দিয়ে অন্য দিকে মোটা দড়ি দিয়ে টেনে বাঁধা হল আমাকে ল্যাম্পপোস্টের সাথে, দিবারাত্রি পাহারা দিল তারা পালা করে,যাতে আমার হাল আর একটুও খারাপ দিকে না যায়। নদীর ধারে মানুষের আসা বন্ধ করা হল পুলিশের সাহায্যে।আরও অনেক ছেলের দলও জুটল ওদের ডাকে, তারা পুরো শহরের বাঁধের দিকে নজর রাখবার ভার নিল।দিন কয়েক যাকে বলে যমে মানুষে টানাটানি গেল আমার, বলা বা‍‍‍‌‌হুল্য নিজেকে কী মূল্যবান যে মনে হচ্ছিল তখন, শহরের সব লোক জানতে চায় আমি কেমন আছি,আমিই আশা ভরসা।

ধীরে ধীরে জল নামল, চারপাশে হাহাকার, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিরাট এলাকা জুড়ে। আমি বেঁচে আছি ,আর বাঁচিয়ে দিয়েছি একটা পুরো শহরকে।মানুষ বলে "একটি গাছ একটি প্রাণ" কিন্তু আমার গল্প বলে "একটি গাছ লক্ষ প্রাণ",তাই না কি? আর তারা? তারা আছে আজও বাউণ্ডলে,আজও তাদের আড্ডা বসে আমার ছায়ায়, কেউ পেয়েছে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো সংসার,কেউ আছে বুড়ো মা বাবার সংসারে,ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর গজ্ঞনা প্রতিদিনের গা সওয়া।শুধু আমি তাদের যে চোখে দেখতাম সেটা বদলে গেছে, মানুষদের বদলেছে কিনা জানিনা। তাই আমার ঠাণ্ডা ছায়া তাদের মাথায় ধরে ঋণশোধ এর চেষ্টা করি আর কী।



** ছোটদের জানাই এই বাঁধ মানুষের তৈরী নয়, নদীর দুপাশে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী উঁচু পার,ভূগোল বই এ পরে থাকবে।

লেখাঃরূপসা মন্ডল দাসগুপ্ত
কলম্বাস, জরজিয়া,
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র

ছবিঃ
সুদীপা কুজুর
ষষ্ঠ শ্রেণী , বি ডি এম ইন্টারন্যাশ্‌নাল স্কুল, কলকাতা

বহরমপুর মুরশিদাবাদে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, প্রথম দিকের পড়াশোনা বিঞ্জান নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে তুলনামূলক সাহিত্যে বিষয় বদল শুধু ভালবাসা থেকে। বর্তমানে আমেরিকার বস্টন শহরে বসবাস। কবিতা আবৃত্তি , লেখা আর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানো শখ ।