সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
উলের

ক্লেমেন্তিনা দিদিমার উল বুনতে দারুণ ভাল লাগত। এমনকি আলেলি ভিলার সব শীতকাতুরে মানুষজনের জন্য মোটা মোটা মাফলার বুনে দিত। ঝলমলে সুতো দিয়ে, পরীদের জন্য নরম সুতো দিয়ে তৈরী পোশাক, জলের সুতো দিয়ে পোশাক বানিয়ে দিত যাতে রাজকুমারীরা তা পরে পার্টিতে যেতে পারে।

এক গ্রীষ্মের সকালে গ্রামে এক চারণ কবি এলেন। এলেন আর ঝড়ের ঝাপটের মত চলেও গেলেন। তিনি বললেন কখনই তিনি সেখানে আসতেন না যদি না সে পাড়ার ব্যাঙ্কে একটা কাজ থাকত। সেসময় তিনি একটা নীল বাক্স ফেলে রেখে গেলেন।

ফেরত দেবার ব্যাপারটা ক্রমে সবার মন থেকে আবছা হয়ে গেল। কিন্তু বাক্সটা নিয়ে কি করা যায় সে কথা সবাই সবাইকে ওদিকে জিজ্ঞেস করতে লাগল।

-    ভাল হয় কেউ যদি ওটা যত্ন করে রেখে দেয় যতদিন না ওটার মালিক ওটা খুঁজতে আসে। - মেয়র পাবলো কথাটা বললেন।
-    কে রাখবে এটা?
-    আমি যেখানে থাকি সেখানে আর একটা জিনিষ রাখারও জায়গা নেই- পেপে কারণ দেখাল।
-     আমার বাড়িতেও জায়গা নেই- দ্যোনিয়া নোনা তড়িঘড়ি বলল এ কথা। - কারণ আমার নাতিরা যা দেখে তাই ই ভেঙে ফেলে।
সত্যিটা হল কেউই চাইছিল না, কারণ কেউ তো জানে না তাকে কি আগলে রাখতে হবে? ওটার ভেতরে কি আছে? কোন মাকড়সা? কোন সাংঘাতিক দৃশ্য? ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন?
-    আমি রাখব’খন ওটা- শেষমেশ ক্লেমেন্তিনা দিদিমা যে কিনা কিচ্ছু ভয় পেত না- বিছে না, ভূত না, দুঃস্বপ্ন নয় কিচ্ছু না, সেই দিদিমা কথাটা বলল। এই বলে উলের তাকে বাক্সটা রেখে দিল।
 
অনেকদিন কেটে গেছে। শীত গেল গ্রীষ্ম গেল, চারণ কবি আর এলেন না। একদিন বিকেলে পাজি পিলু ওটা চাইল, বলল- ক্লেমেন্তিনা, আজ রাতে বসন্তের নাচের আসরে প্লিনিয়াকে জিজ্ঞেস করব সে আমার গার্ল ফ্রেন্ড হতে রাজি কি না। আমার ইচ্ছে ওর জন্য একটা খুব বিশেষ উপহার নিয়ে যাই। আমাকে কিছু বুনে দেবে?
দিদিমা বলল- নিশ্চয়ই! বিকেলে আসিস দিয়ে দেবো।   

কিন্তু একটা বিরাট বড়, সুন্দর আরামপ্রদ বিছানার চাদর বানানোর পরে ভুলেই গেছিল নতুন গোলা কিনতে। যখন উলের তাকের কাছে গেল দেখল আর উল নেই! আলোর সুতোও নেই, সমুদ্রের সুতোও না, কিছু দিয়ে সে পিলুর উপহারটা বুনবে তেমন কিছুই ছিল না।

তাকের এক কোনে বন্ধ বাক্সটা পড়েছিল। কৌতূহল হল ভেতরে কী আছে ওটার? একটা নাছোড় মশার মত ছিল কৌতূহলটা। যদি কেউ দেখে ফেলে? এতকিছুর পরে চারণ কবি নিশ্চয়ই আর ফিরে আসতে যাবেন না। অতি কষ্টে উঠল, খুব ধীরে ধীরে ( একটা কারণ যে দিদিমার ভয়ডর ছিল না।, আরও একটা ঢের দূরের কারণ যে দিদিমা সাহসী ছিল খুব), ওটাকে খুলে নিয়ে তাকাল। বাক্সটা অক্ষরে ভর্তি ছিল। লম্বা ছোট গভীর এসদ্রুখুলা শব্দে ভর্তি। এসদ্রুখুলা শব্দ কি জানো না? আরে বাবা স্প্যানিশ ভাষায় শব্দগুলো কোথাও না কোথাও ঝোঁক দিয়ে উচ্চারণ করতে হয়। আর তার জন্য আমরা ঝোঁকচিহ্ন দিয়েও লিখি। কিন্তু অনেক শব্দ লেখার সময় ঝোঁকচিহ্ন না দিয়েও উচ্চারণ করি ঝোঁক দিয়ে। এসদ্রুখুলা শব্দগুলোতে কিন্তু বলার সময় আবার লেখার সময়ও গুণে গুণে তিন নম্বর সিলেবলের মাথায় ঝোঁকচিহ্ন দিই। আরেব্বাস সেই এসদ্রুখুলা শব্দ কত্তগুলো! অবাক হল ক্লেমেন্তিনা। তখন আইডিয়া না এসেই পারে না।

খুব সাবধানে পাহাড়প্রমাণ সুন্দর সুন্দর শব্দ বের করে নিয়ে এল । তারপর সেগুলো দিয়ে হৃদপিণ্ডের আকারে একটা চাদর বুনল।

-    এটা দারুণ! আনন্দে লাফিয়ে উঠল পিলু।
-    তার ওপর এটা গরম । শীত পড়লে সুবিধে- বলল দিদিমা।
আর সে রাতে নাচের আসরে যখন পরী প্লিনিয়া ওটা গায়ে পরল, বলল-
-    এটা দারুণ! ধন্যবাদ। - তারপরে যোগ করল – হ্যাঁ আমি তোমার গার্ল ফ্রেন্ড হতে রাজি।
সেই দিন থেকে সব প্রতিবেশীরা ওইরকম বিশেষ বুনটে পোশাক পড়তে চাইত।

-    ক্লেমেন্তিনা সোমবার রাজ্যপাল আসবেন, এমন পোশাক পড়তে চাইছিলাম যাতে আমায় খুব ঝলমলে আভিজাত্যপূর্ণ দেখায়। আপনি যদি পারেন... মেয়র পাবলো বললেন।
-    স্থায়িত্বের দিকে যাবার শেষ উপায়গুলির ভিত্তি হল ধারণক্ষমতার ওপর- মেয়র বললেন, ক্বচিৎ কখনও চেষ্টা করেও দেখেছিলেন- ওহ্‌ আমি কিছু বুঝছি না! তবে আমি নিশ্চিত এটা শুনে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। - ধন্যবাদ ক্লেমে। - খুব খুশি হয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি।

সবারই সুন্দর, গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন, চোখ ধাঁধানো, খেলবার জন্য, শব্দছক করবার জন্য দরকারী শব্দ দিয়ে তৈরী সোয়েটার, গরম টুপি, জামা কাপড়, মাফলার ছিল।

আর উলের মধ্যে ছোটহাতা আর লম্বাহাতা জামারা বোনা হত শীতভরা রাত, বৃষ্টি ভরা দিন জুড়ে।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত গরমকালটা এসেই গেল।

এত গরম পড়ল যে সেই সঙ্গে নদীতে স্নান করবার আর চাঁদের আলোয় হেঁটে বেড়ানোর ইচ্ছেটাও চাগাড় দিয়ে উঠল।

এক আলো ঝলমলে দিন , তায় আবার সেদিন রোববার সেই চারণকবি ফিরে এলেন। উইলো গাছের ছায়ায় সবাই তখন ঠান্ডা পানীয় খাচ্ছিল উদ্বিগ্ন মুখে যুবকটি এগিয়ে এল –
-    সুপ্রভাত- শুভেচ্ছা জানাল সে। আপনাদের হঠাত করে নীল বাক্সটা কি কারো চোখে পড়ে নি। ওটা খুঁজছিলাম , জানি না কোথায় ফেলেছি।

একটা ভারী উত্তপ্ত নীরবতা নেমে এল। সবাই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল তারপর ক্লেমেন্তিনা দিদিমা হেসে উঠে বলল-ওটা আমাদের কাছেই আছে তবে...
-    কী আনন্দ! ওগুলো আমাকে ফেরত দেবেন?
-    দিচ্ছি, ওটা খুঁজে এনে দিচ্ছি – বলে দিদিমা উঠে গিয়ে বাক্সটা নিয়ে এল।
চারণ কবি বাক্সটা খুললেন বড় বড় চোখ করে বললেন- এটা ফাঁকা!
ক্লেমেন্তিনা 'ক্ষমা' দিয়ে বানানো একটা মাফলার দিতে চেয়েছিল কিন্তু যেহেতু একটাও ছিল না তার সেইজন্য সত্যিটা তাকে বলতেই হল- আসলে ব্যাপারটা হল আমরা ভেবেছিলাম আপনি আর আসবেনই না।

তারা অপেক্ষা করছিল কোন ঝাঁজ শোনবার। কিন্তু চারণ কবি রেগে ওঠার বদলে খুব দুঃখী মুখে বেঞ্চে বসে রইলেন।
-    এখন কী করব ? আমি তো গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াই , সেখান থেকে গল্প বয়ে নিয়ে আসি, কিন্তু শব্দহীন গল্প... কী করে তাহলে আমি শোনাব?

উলের গল্প

ক্লেমেন্তিনার খুব মন খারাপ হল। নিজেকে দোষী মনে হল। যা শুনল তার কী যে উপায় করবে ভেবে পেল না। যেমন সবসময়েই হয় মাথায় দুশ্চিন্তা এলেই সে রান্নাঘরে চলে যায় তেমনই চলে গেল। একটা কেক বানাতে গেল যাতে ভাল করে চিন্তা করতে পারে। ডিম আর ময়দা ফেটাল, একটা পাত্রে ফেটানো জিনিষটা ঢেলে উনুনে বসাল, তারপর অপেক্ষা করতে লাগল। ঘরটা চকোলেট আর ক্রীমের গন্ধে ভরে উঠল। স্বাদু গন্ধে তার মনে দুর্দান্ত একটা ভাবনা এল। - আইডিয়া! – তারপর গন্ধের সুতোটা ধরে সেলাই করতে শুরু করল।

সেদিন বিকেলে চারণ কবিকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠাল। - আপনার জন্য এই টুপিটা বানিয়েছি। দেখুন মাপে হয় কি না!
-    ধন্যবাদ- তরুণ কবিটি বললেন। খুব মন খারাপ থাকা সত্ত্বেও বললেণ- এটা খুব সুন্দর!

সেটাকে নিয়ে কাঁধে রাখলেন আর তক্ষুণি একটা দুর্দান্ত জন্মদিনের সুগন্ধে তাঁর নাক ভরে উঠল। যেন সদ্য সেঁকা রুটির গন্ধে ভরা, আর একটা ভয়ংকর ইচ্ছে হল রান্না করবার! কেক পেস্ট্রী বিস্কুট আর রুটি বানাতে ইচ্ছে করল।
-    ধন্যবাদ- উৎসাহে টগবগ করে বলে উঠলেন কবি।     
-    এটাই সব নয়- দিদা বলল। তারপর নতুন শব্দ দিয়ে বুনে একটা বিরাট টুপি পরিয়ে দিল। সে শব্দগুলো সদ্য বানানো, সেগুলো উৎসবের সন্ধ্যের কথা বলছিল, আর সাইকেলে করে চরকি পাক ঘুরে বেড়াবার কথাও।

চারণ কবি দিদাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন থেকে গ্রামগুলোতে নতুন শব্দ নিয়ে ঘুরে ঘুরে গল্প শোনাতেন। দুর্দান্ত দ্বাদু চকোলেট বানাতেন, দারুণ দারুণ সব খাবার বানাতেন যেগুলো আগের চেয়েও সুস্বাদু ছিল।
সেদিন থেকেই চারণ কবি এইসব স্বাদু গল্প বলে ঘুরতেন যা আমি শুনেছি আর এখানে তোমাদের  বললাম।

***

মূল গল্পঃ
Cuento con lana, The story is originally written in Spanish by eminent children's author from Argentina, Adriana Ballesteros and translated by Jaya Choudhury
লিখেছেনঃ আদ্রিয়ানা বাইয়েস্তেরোস ।আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেস শহরে জন্ম। আদ্রিয়ানা বাইয়েস্তেরোস আদ্যন্ত ছোটদের গল্প লেখক। আর্জেন্টিনা, কল্মবিয়া, মেক্সিকো ও স্পেন দেশে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা ছোটদের গল্প প্রকাশ পায়। এতাবৎ কটি গ্রন্থ প্রকাশিত- 'কুয়ান্দো এরা পেক্যেনিও' বা 'যখন ছোট ছিলাম', 'মাখিকোস মুন্দোস' বা ' ইন্দ্রজালের দুনিয়া' ইত্যাদি। নবতম উপন্যাস 'লস সাপাতোস রোখোস দে চারোল' বা 'লাল চকচকে চামড়ার জুতো'।  বর্তমানে স্বামীসহ সে দেশেই থাকেন।

 

ছবিঃপার্থ মুখার্জি

জয়া চৌধুরী মূলতঃ অনুবাদক। মূল স্প্যানিশ ভাষা থেকে বাংলায় বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত অনুবাদ করে থাকেন। অবসরে প্রবন্ধ ও কবিতা লেখেন বাংলায়। সেগুলিও নিয়মিত প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও ব্লগে। প্রিয় শখ হলো নাটক করা। স্প্যানিশ ভাষা শেখান রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল অফ ল্যাঙ্গুয়েজ এবং শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা