সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
উড়ান
৷৷ ১ ৷৷

এতদিন যে আনন্দে মনটা বারবার আকুলিবিকুলি করছিল, যাওয়ার দিন এগিয়ে আসতেই সেই ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বদলে একটা অজানা ভয় উঁকি দিচ্ছে নাজমিনের মনে। ও জানে যে এতটা এগিয়ে ভয়, টেনশন, কষ্টের জন্য পিছিয়ে যাওয়ার ভাবনা মনে আনার প্রশ্ন হয় না, কিন্তু উত্তরোত্তর যেন চিন্তা বেড়ে চলেছে। নাজমিন পেন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়ার স্কলারশিপ পেয়েছে। ছোট থেকেই মাথার উপরে থাকা কালো চাদর আর তার মধ্যে ছোট ছোট ফুটোর মধ্যে দিয়ে ফুটে থাকা আলোর পুটকিগুলো ওকে খুব ভাবায়। ঘুমের মধ্যে ভাবায়, জেগে থাকলে ভাবায়, মহাকাশের প্রতিটি বিষয় ওকে দিনের পর দিন অস্বস্তিতে রাখে। তাই ছোট থেকেই ওর বাবা ডঃ আকাশ সিদ্দিকী ওর জন্য দিগন্ত খুলে রেখেছিলেন। ওর জানার আগ্রহকে লালন করেছেন যত্ন সহকারে। নাজমিন প্রশ্ন করলে উত্তর দিয়েছেন ধৈর্য সহকারে, আর উত্তর না জানলেও মেয়েকে থামিয়ে দেননি বরং নিজে পড়াশোনা করে বা নাজমিনকে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে উত্তর পাওয়া যায়। তবু এই মহাকাশ এত বিশাল, আর তার এতটাই অজানা যে প্রশ্ন আর কৌতূহলের শেষ হয় না। তাই আকাশবাবু উৎসাহ দিয়েছেন আর সুযোগ করে দিয়েছেন যাতে মেয়ে বেস্ট এডুকেশন আর গাইডেন্স পায়। আর নাজমিনও বাবাকে হতাশ করেনি। একের পর এক বাধা পেরিয়ে আজ সে পেন স্টেটে চান্স পেয়েছে, হয়তো একসময় ওর যোগ্যতা এবং অধ্যবসায়ের জোরে কোনোদিন নাসা বা ইসরোর বা এসার হয়ে কাজ করতে পারবে, আরো কাছ থেকে অজানাকে ছুঁতে পারবে। কিন্তু নাজমিনের সদ্য কৈশোর পেরোনো মন ভার হয়ে উঠছে ক্রমশ এই নিজের বাড়ি, ভালোবাসার পাড়া, বন্ধুদের, সর্বোপরি বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে। যাওয়ার ইচ্ছেতেও যেন ভাটা পড়ছে। এক এক সময় মনে হচ্ছে কলকাতায় থেকেই পড়াশোনা করে, কী হবে অতদূর গিয়ে, ও যদি ভালো না থাকে, তাহলে তো ঠিক করে কিছুই করতে পারবে না। সবটাই ভেস্তে যাবে।

৷৷ ২ ৷৷

মায়ের হাতে বানানো চা নিয়ে ব্যালকনিতে রেলিংয়ে হাতদুটো ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল নাজমিন। নিজেই নিজের উপর বিরক্ত, ও তো জানতোই বাইরে পড়ার সুযোগ এলে বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে হবে, এখানের সবকিছুকে ছেড়েই যেতে হবে, কিন্তু এখন যেন একদমই মানতে পারছে না। ভয় হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। আজ বাবার ফ্লাইটের টিকিট কাটার কথা, ও একপ্রকার ঠিক করেই নিয়েছে যে ও যাবে না, বাবাকে বারণ করে দেবে।
ওর হাতের চা শেষ হওয়ার আগেই অধ্যাপক ডঃ আকাশবাবু ব্যালকনিতে এলেন।
"নাজ, আমাদের ফ্ল্যাটের পেছনে নতুন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাজ প্রায় শেষ, দেখতে যাবি? অবশ্য পরে তুই ফিরে এলেও…"
নাজমিনের মন গুমোট হয়েছিলই, হঠাৎই ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আকাশবাবু এই অপ্রত্যাশিত কান্নায় ভীষণ অবাক আর অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। মেয়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে দুজনেরই চায়ের কাপ রেখে দিয়ে মেয়েকে হাত ধরে মোড়ায় বসালেন।
"কী হলো মা?"
নাজমিন কিছু বলতে পারলো না প্রথমেই।
আকাশবাবু পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আবার,
"মনখারাপ কেন মা? আমি আছি, সবসময় আছি, যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো ব্যাপারে, তুমি সব খুলে বলো। কোনো দ্বিধা রেখো না।"
"বাবা, আমি যাবো না কোথাও তোমাদের ছেড়ে। প্লিজ তোমরাও জোর কোরো না।"
এটুকুই। নাজমিন আর কিছু বললো না। ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে না দিয়ে আকাশবাবু একটু চিন্তিতই হলেন। যিনি মেয়েকে কোনোদিন কোনো ব্যাপারে জোর করেননি, তার মনেও কেন এটা এলো যে তিনি এবারে জোর করতে পারেন। চিরকাল মেয়ের মন থেকে সংশয়, ভয়, দ্বিধা কাটিয়ে দিতেই তিনি চেষ্টা করে গেছেন।
তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "আচ্ছা, যেতে হবে না। কেউ তোমায় কিছু বলবে না, তুমি যেমন চাইবে, তেমনই হবে।"

৷৷ ৩ ৷৷

ব্যাপারটা শুনতেই নাজমিনের মা জারিন বিবি ভীষণ রেগে গেলেন, এ কেমন ভীমরতি? যে বিষয়কে ভালোবেসে, জানার আগ্রহ নিয়ে এত পড়াশুনো করে এত ভালো একটা সুযোগ পেলো সেখানে পিছিয়ে আসবে? তিনিও সব আত্মীয়স্বজনকে আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন। এখন না গেলে ওঁকে সবাই মিথ্যেবাদী ভাববে, সবার কাছে কী মুখ থাকবে?
"তুমি এটা মেনে নেবে? এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মনে অনেক ভুলভাল চিন্তাভাবনা আসে, সব কি মেনে নিতে হয় না নেওয়া উচিৎ?"
স্ত্রী যে ভুল কথা বলছেন না আকাশবাবু জানেন। তিনি তবু চুপ করে রইলেন।
" তুমি সত্যি মেনে নেবে মেয়ের এই খামখেয়ালিপনা? লোকে, আত্মীয়স্বজন কী বলবে? কেউ এরকম সুযোগ পায় না। সবার কাছে ও গর্ব। সেখানে এই বোকামি করলে সবাই যে হাসাহাসি করবে!"
আকাশবাবু হাতে দূরবীন নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনেকক্ষণ থেকেই তিনি সেট করছিলেন এই জায়ান্ট দূরবীনটা।
"মেয়ের মনে মহাকাশ, বিজ্ঞান, পড়াশোনা নিয়ে তীব্র ইচ্ছের মাঝেও যে ভালোবাসায় আমাদের কথা ভেবেছে, ভেবে চলেছে, সেটা নিয়ে গর্ব করো, একদিন হয়তো এটাকেই সবচেয়ে বেশি মিস করবে। লোকে কী বলবে, কী ভাববে সেই ভেবে আমি আমার মেয়েকে কষ্ট দেব না, জোর করে কিছু চাপিয়ে দেব না, কোনোদিন করিনি, এখনও করবো না। আর তুমিও করবে না, আমি ওকে প্রমিস করেছি। আশা করি মেয়ের সামনে আমার মাথাটা উঁচু রাখবে। আর হ্যাঁ, কোনো ভুল ভাবনা মাথায় এলে সেই ভাবনা যাতে নিজে থেকেই মেঘের মতো আকাশ থেকে মিলিয়ে যায়, সেই পথটুকু দেখানোর দায়িত্ব আমাদের। বাকিটুকু শুধুমাত্র ওর, ওরই সিদ্ধান্ত।"
জারিন বিবি আর কিছু বললেন না, বুঝতে পারলেন সত্যিই তাঁর এই অনর্থক রাগ কিছু ভালো করবে না। তিনি নাজমিনের বাবাকে অগাধ বিশ্বাস করেন, উনি নিশ্চয়ই বেস্টটা করবেন মেয়ের জন্য, আর দরকার পড়লে জারিন বিবি নিজেও মেয়েকে বোঝাবেন, তবে শান্তভাবে।

উড়ান
৷৷ ৪ ৷৷

"বাবা, আজ হঠাৎ এটা বের করলে? ব্লাড মুন?"
"হ্যাঁ রে মা, দেখবি না?"
"হ্যাঁ তো!!" বলেই লাফিয়ে উঠলো নাজমিন একদম সেই ছোটবেলার মতো। আকাশের উপগ্রহ, গ্রহ, নক্ষত্র দূরবীন দিয়ে দেখার ব্যাপারে উৎসাহ আজও একইরকম মেয়ের।
"বাবা, দেখো আকাশ কিন্তু পরিষ্কার নয়।"
"হয়ে যাবে, সময় আছে অনেক, এদিকে আয় বস।"
দুজনে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লেন। তিনি মেয়ের জন্য গরম গরম সিঙ্গাড়া এনেছেন। ঠিক করে নিয়েছেন সন্ধেটা আজ ছাদেই কাটাবেন নাজমিনের ছোটবেলার রবিবারগুলোর মতো।
"নে, খাওয়া শুরু কর। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না। তোর মনে আছে তুই কোন বিষয় নিয়ে সবচেয়ে এক্সসাইটেড হয়ে যেতিস?"
নাজমিন ঘাড় নেড়ে বলে, "হ্যাঁ, আমাদের পৃথিবীর মতোই অন্য কোথাও কোনো ফর্ম অফ লাইফ, প্রাণ আছে কিনা।"
"হ্যাঁ, আর এখন কিন্তু আমাদের পৃথিবীর মানুষ সেই উত্তরের খুব কাছে দাঁড়িয়ে বলে আমার মনে হয়।"
"মার্স এক্সপ্লোরের কথা বলছো?"
"হ্যাঁ, তবে শুধু মার্স নয়, আরও কোনো ফেভারেবল উপগ্রহে থাকতে পারে কিনা, সেটাও জানার চেষ্টা চলছে। আর মঙ্গলগ্রহ নিয়ে নাসার লোকজন কী বলছে জানিস?"
নাজমিন প্রায় সবটা জানলেও বাবার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হলো, আর শেষ কিছুদিন সত্যিই এসবের দিকে ও নজর দেয়নি মনখারাপে। বাবা যবে থেকে মেনে নিয়েছে ওর এখানে থাকার কথা, তবে থেকে ওর মহাকাশ নিয়ে কেমন একটা আগ্রহের অভাব ঘটেছে, যেন এসব প্রসঙ্গই এড়িয়ে যেতে চায়।
মেয়ে চুপ করে থাকায় আকাশবাবু বললেন, " বিজ্ঞানীরা বলছে, 'ডেফিনেটলি মে বি'। মানে মঙ্গলে এখনও অব্দি পৃথিবীর মতো কোনও প্রাণের সন্ধান না পাওয়া গেলেও ওঁরা মনে করছেন, অন্য অপরিচিত কোনও ফর্ম অফ লাইফ আছে, যেমনটা পৃথিবী জন্মের শুরুর দিকে ছিল। আর এটা নিয়েও বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে মঙ্গলে বহু বছর আগে জল ছিল, তাই 'হয়তো অবশ্যই' মঙ্গলে মানুষ বাস করতে পারবে। ভাবতে পারছিস? পৃথিবী থেকে মানুষ গিয়ে মঙ্গলে বসবাস করবে, এখানের মতো ঘরবাড়ি, স্কুল কলেজ গড়ে তুলবে, হয়তো মানুষের কাছে চয়েস থাকবে মঙ্গলে থাকতে চাও না পৃথিবী। পৃথিবীও হয়তো আরও অনেক বছর মানুষের থাকার অনুকূল পরিস্থিতি ধরে রাখতে পারবে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর দূষণের মাত্রা কমায়।"
আকাশবাবু ফোনটা এগিয়ে দিলেন মেয়ের দিকে, "দেখ, অবিশ্বাস্য কিছু ফুটেজ নাসা ক্যাপচার করে সাধারণ মানুষের দেখার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে।"

উড়ান
ইন্‌জেনুইটি

নাজমিন হাতে নিয়ে দেখলো পারসিভিয়ারেন্সের মঙ্গলে ল্যান্ড করার ভিডিও। নিজের অজান্তেই সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল। এরপরে প্লে লিস্টে পারসিভিয়ারেন্সের তোলা আরও ছবির কোলাজ, ৩৬০ ভিউ। সত্যি পৃথিবী ছাড়াও আর একটি গ্রহের মাটির ছবি এত কাছ থেকে দেখতে পারছে ও। কত দূরে সেই গ্রহ, কিন্তু মানুষের পাঠানো যান সেই দূরত্ব অতিক্রম করে সেই গ্রহের মাটিতে ঘুরে বেড়াবে, সত্যিই কেমন লাগছে, তবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? মানুষের জন্মই তো হয়েছে অতিক্রম করার জন্য, একেকটা লক্ষ্য সামনে আসে, মানুষ সেটা পূরণ করে আর পরের নতুন লক্ষ্যের জন্য প্রস্তুতি নেয়।
আকাশবাবু আবার বলতে শুরু করলেন, " মঙ্গলের কোথায় কোথায় নামলে মানুষের জল পেতে খুব একটা অসুবিধা হবে না, একেবারে ধরে ধরে সেই জায়গাগুলিও বেছে ফেলেছে নাসা, জায়গাগুলির একটি মানচিত্রও বানিয়ে ফেলেছে নাসা। যা মঙ্গলের বুকে শুধুই মানুষের পা ফেলা নয়; ভবিষ্যতে পৃথিবীবাসীদের একের পর এক বসতি গড়ে তুলতেও সাহায্য করবে।"
মেয়ে চুপ আছে দেখে বাবা আরও বলে চললেন, "জানিস, এবার পারসিভের‌্যান্স-এর এই অভিযান এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? "
নাজমিন জানে, প্রাণের সন্ধানে এটি চষে ফেলবে লাল গ্রহের মাটি, তবে মুখে কিছু বলে না। ওর ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে।
অভিজ্ঞ আকাশবাবু দেখে যেন বুঝতে পারেন নিস্তব্ধতার কারণ। এখনও সময় হয়নি, আরো কিছুটা বাকি। তিনি তার বলা কথার বিষয়েই মন দেন।
" পারসিভের‌্যান্স-এর মূল লক্ষ্য হলো, মঙ্গলের মাটিতে কোথাও প্রাণের উপযোগী পরিস্থিতি বা লাইফ ফর্ম আছে কিনা সেরকম পরিবেশের খোঁজ করা। আর এবারে সবচেয়ে অভিনবত্ব হলো, এই কাজটা পারসিভের‌্যান্স ল্যান্ডার শুধু পায়ে হেঁটে করবে না, আকাশে উড়েও করবে। ল্যান্ডার থেকে মঙ্গলের আকাশে ওড়ানো হবে হেলিকপ্টার, ‘ইনজেনুইটি’ নাম। আকাশ থেকে মঙ্গলের আরও বড় এলাকাজুড়ে নজরদারি চালাবে এই হেলিকপ্টার। এই প্রথম অন্য কোনও গ্রহে হেলিকপ্টার ওড়াতে চলেছে মানব সভ্যতা। ভাবতে পারছিস? আর এই প্রথম কোনও ল্যান্ডার ও রোভারকে মঙ্গলের মাটিতে নামাতে কোনও অরবিটার প্রদক্ষিণ করবে না লাল গ্রহের কক্ষপথে। যে রকেটে চাপিয়ে এ বার পাঠানো হয়েছে মার্স ২০২০ ল্যান্ডার ও রোভার, তা পৃথিবী থেকে সরাসরি মঙ্গলে কক্ষপথে ঢুকে পড়বে। তার পর দ্রুত নামতে শুরু করবে মঙ্গলে। একটি বিশাল প্যারাশুটে করে এই ল্যান্ডার নামবে যার গতিবেগ শব্দের গতিবেগের দ্বিগুণ। মঙ্গলে পাঠানো এটিই সবচেয়ে বড় মাপের প্যারাশুট। "
আকাশবাবু দেখেন নাজমিন কালো আকাশের দিকে চেয়ে আছে, তিনিও তাকান। একটু একটু করে আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে। উনি নিজের মোবাইলে স্কাই ভিউ অ্যাপ খুলে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দেন, পুব আকাশে ছোট একটি লাল বিন্দু দেখা যাচ্ছে। মোবাইলে সেটা বড় করে দেখা যাচ্ছে। এই অ্যাপে আকাশের কোথায় কী আছে সেটা দেখা যায়।
"এই দেখ মঙ্গল, দেখতে পারছিস খালি চোখে?"
নাজমিন একবার মোবাইলে আর একবার খালি চোখে আকাশে তাকায়। মুখে হাসি ফুটে ওঠে ওর। ঐ গ্রহতেই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পারসিভের‌্যান্স।

উড়ান
বাঁ দিকে অনুভব দত্ত, ডান দিকে সৌম্য দত্ত

" জানিস যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে তা হলো পারসিভের‌্যান্স-এর সাফল্যের পেছনে চার ভারতীয় সহ দুই বাঙালির অবদান ভীষণ উল্লেখযোগ্য। একজন পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের ছেলে অনুভব দত্ত এবং অপরজন বর্ধমানের সৌম্য দত্ত। প্যারাশুট বানানোর পেছনে সৌম্যর অবদান অনস্বীকার্য, তেমনই অন্য গ্রহে হেলিকপ্টার ওড়ানো যায় আর তাহলে সহজে অনেক পথ অতিক্রম করে পর্যবেক্ষণ করা যাবে এই ভাবনা বলতে গেলে অনুভবেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই ১৯৭৫ সালে মঙ্গল গ্রহে প্রথম ল্যান্ডার পাঠিয়েছিল নাসা, ভাইকিং ওয়ান। পঁয়তাল্লিশ বছর পর আজ মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারছে যে পৃথিবী ছাড়াও অন্য এক গ্রহে পৃথিবীর মানুষ থাকতে পারবে। মানুষের ধ্বংসলীলার কারণেই হোক বা স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীতে হয়তো মানুষের থাকা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে, তখন মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে অন্য গ্রহে পাড়ি দিতে হবে। মানবসভ্যতা পৃথিবীর সঙ্গে বিলুপ্ত হবে না। "
নাজমিনের কষ্ট হলো। "আমরা পৃথিবীকে মেরে ফেলবো এইভাবে? যে নিজের ঘরেই থাকতে পারবো না! মানুষ সত্যিই এখন থেকে সাবধান হয়ে এই গ্রহকে বাঁচাবে না?"
"জানি না, ব্যক্তিগত লাভের জন্য অনেক উঁচুতলার মানুষই চায় না ক্ষতিকর শিল্পগুলি বন্ধ করতে। হয়তো একদিন বাঁচানোর চেষ্টা করবে, তবে ক্ষতি অনেকটা হয়েই যাবে, এখনই অনেকটা হয়ে গেছে। "
দুজনেই চুপ হয়ে যায়। হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর দুর্দশার কথা ভেবে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে দুজন।
আকাশবাবুই নিস্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন, "নাজ, তুমি পুরো পৃথিবীকে নিজের ঘর মানো?"
নাজমিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। একটু আগে কথাটা ওর মুখ থেকেই বেরিয়েছে। সত্যিই তো, শুধু এই বাড়ি বা এই পাড়া, পরিচিত এলাকা ওর নিজের ঘর? না পুরো পৃথিবী? ও কাছে না থাকলেও এই পৃথিবীতেই তো ওরা একসঙ্গে থাকবে, ও, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব সবাই। ইচ্ছে করলে আর একটু সুযোগ সময় বের করলেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ বা দেখা করতে পারবে, সত্যিই কেউ কখনও কি দূরে থাকে যদি মনে তারা সবসময় উপস্থিত থাকে? পৃথিবী ধ্বংসের সময় যদি কোনওদিন আসে, সেই সময় পৃথিবীতে বসবাসকারী কত মানুষ হয়তো নিজেদের প্রিয়জনদের থেকে পুরোপুরিই আলাদা হয়ে যাবে, উফফফ, ও ভাবতেই চায় না। খুব কষ্ট হচ্ছে ভাবলেই। তার থেকে এখন তো ওরা কত ভালো আছে। সবাই একসঙ্গে আছে, মনে মনে ঐ ভয়াল ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে যেন কোনোদিন দেখতে না হয়, তার প্রার্থনা করে ও। নীরবে ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

আকাশবাবু নাজমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
"মা, আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেখবি এবার দূরবীনে?"
নাজমিন মুখ তুলে কিছুটা সময় নিয়ে অস্ফুটে বলে, "বাবা আমি পেন স্টেটে পড়তে যাবো। আমি কোনও আফসোস রাখতে চাই না। আমি খুব শিগগিরই মঙ্গলে ঘটে চলা অভূতপূর্ব কান্ডের অংশ হতে চাই। চাই, সবকিছু নিজে পরখ করতে। ২০৩৫-৪০ এর মধ্যে যখন মঙ্গলে প্রথম মানুষ নামবে সেইসময় সেই অভিযানের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছোট অংশ হয়ে হলেও থাকতে চাই বা তারপর যারা যারা মঙ্গলে যাবে তার মধ্যে আমিও একজন হতে চাই। আমি আকাশ নয় বাবা মহাকাশে উড়তে চাই। আমি এই পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যে একজন লিংক হতে চাই। তবে আমি গিয়ে হারিয়ে যাবো না, আমি ফিরে আসবো, এখানে, তোমার কাছে, মায়ের কাছে বারবার ফিরে আসবো বাবা, কারণ এটাই আমার ঘর, এই পুরো পৃথিবী।"
এতদিন মনের ভীষণ তোলপাড়কে চেপে রেখে চুপ থাকার পর ভীষণ আবেগে কথাগুলো বলতে পেরে নাজমিনের হালকা লাগছে। ডঃ আকাশ সিদ্দিকী মেয়েকে হাত ধরে দাঁড় করান।
"আমি জানি, তুই যেখানেই থাকবি, আমার কাছে থাকবি। আর আমার কাছে ফিরেও আসবি। আমি সবসময় অপেক্ষা করবো মা। এখন চল, ব্লাড মুনটা দেখি কাছ থেকে।"
"বাবা, মঙ্গলগ্রহটা আগে একবার দেখি? খুব ইচ্ছে করছে। যদি পারসিভের‌্যান্সকে দেখতে পাই।"

বাবা-মেয়ে দুজনেই হেসে ফেলে। কারণ দুজনেই জানে, মন সঙ্গ দিলে যেকোনো উড়ানই অনেক সহজ হয়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা