সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
আঁধার পেরিয়ে

ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠতে সবাই একসুরেই বলে উঠলো, "দেশের বাড়ি যাবো।"
দেশের বাড়ি কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, নিজেদের ছোটবেলার কথা, মাটির স্কুল, বাবার সঙ্গে জমিতে যাওয়া, বাবার সঙ্গে ছোট ছোট হাতে ধান রোওয়া, সবুজ ধানক্ষেত, বড় বড় পুকুর, সেই পরিষ্কার টলোমলো জলে সাঁতার কাটা, নিজেদের ঘরের গরুর তাজা দুধ সকাল, বিকাল খাওয়া, খেজুর গাছ থেকে পেড়ে খাওয়া তাজা রস, যখন তখন পাওয়া আম-জাম-কলা-পেয়ারা, সন্ধেবেলা দাওয়ায় বসে মায়ের কোলের সঙ্গে সিঁটিয়ে থেকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্না দেখা, অন্ধকারে লুকোচুরি, সকালে ছোঁয়াছুঁয়ি, পিট্টু, আব্দুল গাদি খেলা সবই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শহুরে জীবনে এই নির্ভেজাল, স্নিগ্ধ খুশিগুলো যেন এখন না পাওয়ার লিস্টে আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
তাই কালক্ষেপ না করে এবারে উইকেন্ড পড়তেই রজত, সজল দুই ভাই এবং তাদের পরিবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

তিনঘন্টার পথ, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আসা ডাব্বু, তিন্নি, গুনগুন পথে ঘুমিয়েই পড়লো। চারজনের মধ্যে ঋজু সবচেয়ে বড়, তাই সে বড় হওয়ার তীব্র ইচ্ছাতে হোক বা পথের দুধারের সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় জেগে রইলো ঠায়। বাবার পাশেই বসতে দিতে হয়েছে তাকে, আর মাঝে মাঝেই তার কৌতূহলী মন নানা প্রশ্ন করছে। রজতও গাড়ি চালাতে চালাতে হাসিমুখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। বাকি সজল-নীলিমা আর অনন্যাও পিছনে বসে টুকটাক স্মৃতিচারণা করছে। রাস্তা ফাঁকা থাকায় তিনঘন্টার আগেই পৌঁছে গেল ওরা। ওদের দেশের বাড়ি আহামরি কিছু বড় না হলেও সবার থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘর এখনও রয়েছে। বাবা-মা বেঁচে থাকাকালীনই ওরা দুই ভাই শহরে পাড়ি দিয়েছিল। তাই বাবা-মা গত হওয়ার পর থেকে এই বাড়িতে শুধু ওদের বিধবা পিসিমা আর একজন সর্বক্ষণের কাজের দিদি থাকে। এই যমুনা দিদির নিজেদের বাড়িও এই গ্রামে। দিনের মধ্যে মাঝেমাঝে বাড়ি থেকে ঘুরে আসে। তবে পিসিমার বড় ভরসা এই যমুনা দিদি, তাই পিসিমা বেশিক্ষণ কাছছাড়া করতে চায় না। পরিপাটি ঘরদোর দেখে বোঝা যায়, যমুনা দিদি কত যত্নে রাখে সবটা। দুজনে বেশ ভালোবেসে নিজেদের মতো থাকে সবসময়। কিন্তু এবারে বাড়ি এসেই রজতের মনে হলো কোথাও যেন একটা তাল কেটেছে। দুজনে বেশ ভালোভাবে ওদের সবার সঙ্গে কথা বললেও, আপ্যায়ন করলেও দুজনের মধ্যে যেন সেই সহজ ভাবটা নেই, বরং কোথাও একটা অবিশ্বাসের হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই নিয়ে রজত বেশি ভাবতে চাইলো না এখনই।

রেস্ট নিয়ে, দুপুরের খাওয়া সেরে, ঘুমিয়ে যখন ওরা ফ্রেশ হয়ে উঠলো তখন প্রায় সন্ধে। নিকোনো উঠোন সেই আগের মতোই আছে, নিশ্চয়ই যমুনা দিদিই রেখেছে। বাড়ি, ঘরদোর, আশপাশের জায়গা জমি, পুকুর ছোটবেলার থেকে বেশ কিছুটা পাল্টে গেলেও এইটুকু উঠোন একই রয়ে গেছে। দাওয়া থেকে একটা মোড়া নিয়ে এসে উঠোনে বসলো রজত। উঠোনে বসে সামনে বহুদূর অব্দি দেখা যায়, উঠোনের পরেই পুকুর, তারপর গ্রামের রাস্তা, তারপর আবার একটি পুকুর, আর পুকুরের ওপারে বিস্তীর্ণ সবুজ জমি, বহুদূরে লম্বা তাল-নারকেল গাছের সারি। পশ্চিম আকাশে গোধূলির ছোঁয়া, পুকুরের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের কিছু অংশ। মনের শান্তি ঠিক এভাবেই ছুঁতে পারে জীবনকে। রজতের মনটা পরিপূর্ণ হয়। এইসময় যমুনা দিদি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, রজতকে দেখে দাঁড়ায়।
"ভাই, চা খাবি?"
ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হওয়াতে ওদের সম্পর্কটাও সেরকম নিখাদ।
রজত না-সূচক ঘাড় নাড়ে। "বাড়িতে যাচ্ছিস? জামাইবাবু এখানে আছে এখন?"
"না, সে তো এখন শিলিগুড়িতে।"
রজত সৌজন্যের হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, "কী ব্যাপার, শিউলিকে দেখছি না? অন্যবারে তো সবসময় এখানেই থাকতো। অবশ্য আমরা বেশ কয়েক বছর পর এলাম এবারে।"
যমুনাদি চুপ থাকে। রজতের মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। "ঠিক করে বল, বিয়ে দিয়ে দিসনি তো এর মধ্যে?"
যমুনাদি তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলে, "নারে, এই তো সবে মাধ্যমিক পাশ করলো। আমি ওসব ভাবি না রে, ও একটা চাকরি পাক, নিজের ইচ্ছে হলে তারপর দেখা যাবে।"
"দারুণ। এরকমই চাই। নিয়ে আয় তাহলে ওকে, লজ্জা পাচ্ছে নাকি আমাদের? একটু তো বড় হয়েছে, হতে পারে। তবে বাচ্চাদের দেখলে খুব খুশি হবে, বাচ্চারাও খুশি হবে ওর সঙ্গ পেয়ে।"
যমুনাদি একটু যেন ইতস্তত করতে লাগলো। কী যেন বলতে চাইলো, কিন্তু বলতে পারলো না। সংকুচিত পা ফেলে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। রজত দেখলো সবটা। ঠিক করলো পরে সুযোগ সময়মতো জিজ্ঞেস করবে।

"কোথায় গেল সবাই? এইজন্য আমার লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগে না, চোর হলে শুধু খুঁজে বেড়াতে হয়, কাউকে পাওয়া যায় না।" বলে হাত পা ছুঁড়তে লাগলো ডাব্বু। রজত-অনন্যা, সজল-নীলিমা, যমুনা দেখে হাসতে লাগলো। পিসিমা ভেতরে। জ্যোৎস্নামাখা রাতে লুকোচুরি খেলার মজা আলাদা। সবার হয়তো নিজেদের ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। ডাব্বু ছাড়া বাকি তিনজন বাচ্চা আর শিউলি লুকিয়েছে। শিউলি এবারও নিজে থেকে চোর হতে চাইছিল, কিন্তু বারবার ও চোর হয়ে ইচ্ছে করে ধাপ্পা হয়ে যাচ্ছিল, তাই রজত বারণ করে ঠিকভাবে খেলতে বলেছে। খেলার মজা নেই, যদি না তা ঠিক করে খেলা যায়। তবে কাছেপিঠেই সবাই লুকিয়েছে, ডাব্বু একটু ধৈর্য নিয়ে খুঁজলেই পেয়ে যাবে। বড়রা মোটামুটি জানেও কে কোথায় আছে।
"ডাব্বু, কাছেই আছে সবাই, একটু খোঁজো।" তার এই ভাইপোটা ভীষণ কাছের। রজত ইশারায় দেখিয়ে দিল একটা দিকে।
"দাদা, এটা ঠিক নয়।" সজল দেখে বললো।
ডাব্বু জেঠুর দেখানো পথে গিয়ে ঠিক খুঁজে পেয়ে গেল ঋজুকে। "দাদাভাই, হুশ।"
অগত্যা ঋজু বেরিয়ে এলো। মুখটাও ঝুলে গেল একটু ঋজুর। এবারে মনে হয় তাকে চোর হতে হবে।
ডাব্বু আবার জেঠুর দিকে তাকালো। রজত ঘাড় নেড়ে জানালো আর দেখাবে না। একটু খুঁজেই তিন্নিকে পেয়ে গেল ডাব্বু। তিন্নি বেরিয়ে আসার সময়ই একটি মেয়ের চাপা গোঙানির স্বর শোনা গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই আর একটি মেয়েরও ভয়ার্ত কন্ঠস্বর শোনা গেল। সবাই হুড়মুড় করে উঠে উঠোন পেরিয়ে বামদিকে ঘুরতেই দেখতে পেলো গুনগুন মাটিতে লুটিয়ে। আর একদম কাছে দাঁড়িয়েই শিউলি ভয়ে কাঁপছে। বুঝতে বাকি রইলো না গোঙানিটা গুনগুনের ছিল। অনন্যা তার মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। উঠোনের দিকে ইলেক্ট্রিসিটি আলোর কাছে এনে দাওয়ায় থাকা বিছানায় শুইয়ে দিলো গুনগুনকে। পিসিমাও বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় উদ্বেগের চেয়ে যেন রাগ ঠিকরে বেরোচ্ছে। গুনগুনের চোখে মুখে জল দিতে অল্প সময়ের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে এল। সে মায়ের বুকে মুখ লুকালো, যেন খুব ক্লান্ত। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই নিস্তব্ধতা ভেঙে শিউলি ভীষণ চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "গুনগুন ঠিক আছে কাকাবাবু?"
রজত উত্তর দেওয়ার আগেই একটি সজোরে থাপ্পড় পড়লো শিউলির গালে।
এতটাই আচমকা ঘটলো ব্যাপারটা, যে কেউ কিছু বলা বা করার অবস্থায় রইলো না। পিসিমার এই আচরণে ওরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। যমুনাদি মাথা নিচু করে রইলো, মনে হলো এই আচরণ তার কাছে পরিচিত, যেন মেনেও নিয়েছে।
"যমুনা, আমার এই দুই ছেলে হয়তো জানে না, হয়তো মানবেও না, কিন্তু তুই সবটা জেনেও এই ডাইনিকে আনলি এই বাড়িতে? আমার নাতি-নাতনিদের মেরে ফেলতে চাস? তোর তো মেয়ে, তোর ভালোবাসা থাকবেই, তুই মানতেও চাইবি না গ্রামের সবার কথা। কিন্তু আজকের পরও তুই আর কিছু প্রমাণ চাস?"
এটা শুনে কী যে হলো যমুনাদির, এগিয়ে এসে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো শিউলিকে। চড়-চাপড়, অভিশাপ দেওয়া, চুল ধরে টানা, ধাক্কা দেওয়া কিছু বাকি থাকলো না। খুব কষ্ট করে কান্না চেপে গোঙাতে লাগলো শিউলি। সবার সামনে এরকম হবে ও আশা করেনি নিশ্চয়ই। দেখেই খুব মায়া লাগলো, খুব কষ্ট পাচ্ছে। রজত নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে যমুনাদির রণমূর্তি দেখে তাকে সরিয়ে আনলো শিউলির থেকে।
শত অভিশাপের মাঝে রজতের কানে বাজলো, "তুই মরে যা এবার।"
রজত সত্যিই এই পিসিমা, এই যমুনাদিকে চেনে না।
"তোমরা কি পাগল হয়ে গেছো? এটুকু একটা মেয়ের ওপর এত অত্যাচার করলে? ও তো কিছুই করেনি। কেন এরকম করছো?"
"তুই জানিস না রোপু, এই মেয়েই দায়ী আমার নাতনির শরীর খারাপের পেছনে। ও কালো জাদু করেছে। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়ের ওপর ও এটা করে থাকে, তারপর তারা… "
"পিসিমা, থাক। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ের সামনে এসব নাই বা বললে।"
রজত থামিয়ে দিলো পিসিমাকে তখনের মতো। কিন্তু ব্যাপারটা থেকে সরে এলো না। শিউলি ততক্ষণে বাড়ি চলে গিয়েছিল। রাতে খাওয়ার পর পিসিমার থেকে সবটা শুনলো ও। শুনে পিসিমাকে বললো,
"পিসি, তুমি গ্রামের কমিটির সভ্যদের সঙ্গে মিটিং করার ব্যবস্থা করো কাল বিকেলে।"
পিসির চোখ জুলজুল করে উঠলো, "দিবি তাড়িয়ে মেয়েটাকে এই গ্রাম থেকে? বড় ভালো হয় রে, সবাই বেঁচে যায়।"

পরেরদিন সকালেও একবার গুনগুন কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল। তবে মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আবার ঠিকও হয়ে গেল। নীলিমা, অনন্যা তাড়াতাড়ি শহরে ফিরে যেতে চাইলো। রজতও তাড়াতাড়ি ফেরার গুরুত্বটা বুঝেছে, কিন্তু আজকের দিনটা যে ওকে এখানে থাকতেই হবে। বাকিদেরও সেটা বোঝালো।
অন্যদিনের থেকে একটু বেলার দিকে যমুনাদি এলো। তবে যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটেই এলো। রজতকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। মুখে ভীষণ চিন্তার ছাপ, একদিনে যেন বয়স ভীষণ বেড়ে গেছে। রাতে ঘুমাতে পেরেছে কিনা কে জানে। রজত বসতে বলায় যমুনাদি থেমে থেমে বললো, "ভাই, গ্রামের মিটিং ডেকেছে পিসিমা, শুনলাম। মোড়লের ছেলে এসে জানিয়ে গেল তুই চেয়েছিস। আমার মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিবি গ্রাম থেকে? আমি জানি ওর ওপর কিছু অশুভ শক্তি ভর করেছে, একটু সময় দে, কোনও ভালো গুনিন ডেকে আমি ব্যবস্থা করবো। কিন্তু মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিলে আমাকেও ওর সঙ্গে যেতে হবে, ওর যে আমি ছাড়া কেউ নেই। আর এই বাড়িটুকু ছাড়া আমাদের আর কোনও যাওয়ার জায়গা নেই। আমি তো সবসময় এই বাড়ির, তোদের ভালো করার চেষ্টা করেছি, সেটুকু ভেবে ক্ষমা করে দে… "
যমুনাদি আর পারলো না। দুই গাল বেয়ে নেমে এলো জল, অঝোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রজতের ভীষণ কষ্ট হলো, হাত ধরে বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো ও। কী ভীষণ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যমুনাদি!
"আমায় সবটা বলবি দিদি?"

বিকেলে গ্রামের দুর্গামন্দিরের পাশে বটগাছের সামনে বিশাল ফাঁকা জায়গায় মানুষজন জড়ো হলো। কিছু বয়স্ক আর একদুজন যুবক বসে, বাকিরা সবাই দাঁড়িয়ে। সামনে গ্রামের ছোট ছেলেরা, মেয়েরাও বসেছে। রজতই বলেছে, গ্রামের যত অল্পবয়সী, স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে, শিউলির যারা বন্ধু , সমবয়সী তারা যেন সবাই আসে । শিউলিও এসেছে। মোড়লের অল্প বয়সী ছেলে সবার প্রথম মুখ খুললো, "দাদা, ঠিক করেছেন আপনি এতদিনে। আমরা চেষ্টা করেও পারিনি। কিন্তু আপনি এগিয়ে আসাতে আমরাও ভরসা পাচ্ছি। এবার এই আপদকে বিদায় করতে পারবো। কেউ আর পুলিশের ভয় দেখাবে না।"
রজত শুনলো, তাকিয়ে দেখলো গ্রামের মানুষের মুখের দিকে। সবাই যেন বেশ খুশি, যেন প্রতীক্ষা করছে কখন শাস্তির নিদান দেওয়া হয়। সবার কাছে এই বাচ্চা মেয়েটির কষ্ট খুব আনন্দের ব্যাপার!
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এরপর বললেন, "তাড়িয়ে তো দেওয়া হবেই, কিন্তু এত সহজে ছেড়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে? এই গ্রামের বাইরে কোথাও বন্দি করে রাখলে হতো না?"
আরেকজন এটা শুনে বললেন, "হ্যাঁ, অন্য কোথাও গিয়ে একই অশনি ডেকে আনবে অন্যদের জন্য। আমার মতে তো শত্রুর জড় রাখতে নেই। "
রজত, সজল, যমুনাদি শিউরে উঠলো শুনে। মোড়লমশাই এই কথার প্রতিবাদ করে বললেন, "ওদের পরিবার গ্রামের অনেক সেবা করেছে দীর্ঘকাল ধরে, এখন এই অশুভ কাজগুলোর জন্য এরকম চরম শাস্তি দিতে পারি না আমরা। আজ মিটিং ডাকা হয়েছে, এখানে ঠিকঠাক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।"

রজত উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সেটা দেখিয়ে বললো, "এটা কী জিনিস নিশ্চয়ই জানেন আপনারা, সামান্য এই ছোট জিনিসের মাধ্যমে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে থাকা অন্য আরেকজনের সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারি। এটা কিভাবে সম্ভব?"
মোড়লের ছেলেটি ফিক করে হেসে বললো,"বিজ্ঞান।"
"ঠিক, এককালে যে ঘটনাগুলোকে অসম্ভব বলে মনে হতো, বিজ্ঞান এখন সেগুলোকে সম্ভব করেছে। আর ভবিষ্যতেও করবে। আর কেউ যদি বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করে সে তো…"
রজত একবার শিউলির দিকে তাকালো। মেয়েটি মুখ তুলেছে, ওর কথা শুনছে।
"কিছু বলার আগে আপনাদের জিজ্ঞেস করি, আমি যা বলবো, তা কি আপনারা বিশ্বাস করবেন?"
প্রায় সবাই একসুরে বলে উঠলো, "নিশ্চয়ই।"
মোড়লমশাই বলে উঠলেন, "তোমার বাবা-মা আর তারপর তোমরা দুই ভাই সবসময় এই গ্রামের কল্যাণের জন্য যা করেছ, আর তো কেউই অতটা পারেনি। গ্রামের স্কুল, মন্দির এমনকী চিকিৎসালয় সবটা তোমাদের পরিবারের হাতেই বানানো। অত ভেবো না, তোমাদের পরিবারের সবার উপরই আমাদের অগাধ বিশ্বাস। তোমার কিছু বলার থাকলে নিঃসংকোচে বলো।"

রজত আরও আত্মবিশ্বাস পেল। ও শুরু করলো, "ধন্যবাদ। প্রথমেই আপনাদের একটি সত্য ঘটনা সম্পর্কে বলি, আজ থেকে প্রায় ৩৩০ বছর আগে ১৬৯২ সালের শীতকালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের (Massachusetts) সেলেম (Salem) প্রদেশে দুই বোন ৯ বছরের বেটি প্যারিস (Betty Paris) এবং ১১ বছর বয়সের অবিগেল উইলিয়ামস (Abigail Williams) হঠাৎই অদ্ভুত ব্যবহার শুরু করেছিল। মাঝে মাঝেই তারা চিৎকার করতো, অজ্ঞান হয়ে যেত, হিংস্র হয়ে যেত। ডাক্তার প্রাথমিক পরীক্ষা করে জানিয়েছিল কোনও শারীরিক সমস্যা নেই। কিছুদিনের মধ্যেই সারা প্রদেশে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রদেশের নানা জায়গায় সবমিলিয়ে মোট বারো জন বাচ্চা ছেলেমেয়ে একইসময় একইরকম রোগে ভুগছিল। গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী ওখানকার মানুষজন আর কোনও কারণ না খুঁজেই মনে করলো বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর শয়তানের প্রভাব পড়েছে। তারা মনে করতো, কোনও ডাইনি বা তান্ত্রিকের মাধ্যমে শয়তান এই কাজ করছে। বাচ্চাদের এবং তাদের পরিবারের অভিযোগ শুনে অচিরেই তারা সারা গুড (Sarah Good), সারা অসবর্ন (Sarah Osbourne), টিটুবা (Tituba) নামের তিনজন অসহায় এবং গরিব মহিলাদের গ্রেপ্তার করলো। তিনজনই নিজেদের নির্দোষ বলে প্রথমে দাবি করলেও জেলের মধ্যে অকথ্য অত্যাচারে ভেঙে গিয়ে এবং নিজেকে বাঁচাতে টিটুবা মিথ্যে স্বীকারোক্তি করলো যে সে কালো জাদু করতো এবং এই কাজে তাকে বাধ্য করেছিল গ্রেপ্তার হওয়া অন্য দুজন। সারা অসবর্ন কিছুদিনের মধ্যেই জেলে থাকাকালীন মারা গিয়েছিল। কিন্তু সারা গুড সবসময়ই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছিল। তাই তার বিরুদ্ধে প্রথমে তার স্বামীর সাক্ষ্য নেওয়া হলো। স্বামী বলেছিল, তার বউ সারা ডাইনি হতে পারে। আর তারপর সারার চার বছরের ছোট মেয়েকে একপ্রকার বাধ্য করা হলো তার মায়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। গ্রেপ্তারের সময় সারা গুড গর্ভবতী ছিল। জেলে থাকাকালীন একটি সন্তানের জন্মও দেয় সে, এবং বাচ্চাটি জেলেই মারা যায়। আর এর কিছুদিনের মধ্যে সারা গুডকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়।"

আঁধার পেরিয়ে
শিল্পীর কল্পনায় টিটুবা

রজতের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। কারোর মুখে কোনও কথা ফুটছে না। রজত বলে চললো,
"টিটুবাকে সেই বছর মে মাস অব্দি জেলে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই তিনজন যাদের ডাইনি অপরাধে ধরা হয়েছিল, যারা হয় জেলে মারা গেল বা ফাঁসি দেওয়া হলো, শাস্তি দেওয়া হলো এরা তিনজনই সমাজের চোখে কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ছিল। সারা অসবর্ন দীর্ঘকাল চার্চমুখী হয়নি, এমনকী যারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল তাদের মধ্যে একটি পরিবারের সঙ্গে তার একটি কেস চলছিল। টিটুবা আক্রান্ত বেটি প্যারিসের পরিবারের ক্রীতদাস ছিল এবং সারা গুড ছিল একজন গরিব এবং অসহায় মহিলা। তো এই তিনজনই ছিল সহজ টার্গেট। এই সেলেম প্রদেশে এরপর বহু মহিলা এবং পুরুষদের বিরুদ্ধে কালো জাদু করার অভিযোগ তুলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ফাঁসিও দেওয়া হয়েছিল বেশ কিছুজনকে। যাদের এইভাবে গ্রেপ্তার করা হতো তাদের মধ্যে কিছুজন নিজেরা বাঁচার জন্য অন্যদের ফাঁসিয়ে মিথ্যে স্বীকারোক্তি দিতো টিটুবার মতো। বাকিদের চয়েস দেওয়া হতো, হয় তোমরা স্বীকার করো তোমরা ডাইনি আর ছাড়া পেয়ে যাও নাহলে তোমাদের ফাঁসি দেওয়া হবে। এই ভয়ে অনেকেই দোষস্বীকার করে নিত, আর যেহেতু তারা দোষস্বীকার করে নিয়েছে তাই তাদের ফাঁসিও দিয়ে দেওয়া হতো। এমনই নির্মম আচরণ ছিল কর্তৃপক্ষের। আসলে কোনও কর্তৃপক্ষই অভিযোগ বা কেসগুলোর ভালো করে ইনভেস্টিগেশন করতে চাইতো না, বরং তারা জোর দিত যাতে দোষীরা নিজেরাই স্বীকার করে নেয় তাদের অপরাধ। তার জন্য অকথ্য অত্যাচার, মানসিক চাপ, খাবার না দেওয়া কোনোকিছু বাকি রাখা হতো না। এমনকী এও দেখা গিয়েছিল যারা শাস্তি দিচ্ছে সেই কর্তৃপক্ষের কিছু মানুষ সেইসব পরিবারের ঘনিষ্ঠ যারা এইরকম অভিযোগ তুলছে কোনও গরিব, অসহায় পুরুষ বা মহিলার বিরুদ্ধে।

কিন্তু এরকম অভিযোগ তুলতে তুলতে যখনই অভিযোগের তীর ম্যাসাচুসেটসের গভর্নরের বউয়ের বিরুদ্ধে উঠলো, তখনই গভর্নর কালো জাদু, তন্ত্র এসবের ব্যাপারে সমস্তরকম ট্রায়াল, কেস নেওয়া বন্ধ করে দিল।

১৪০০ শতাব্দী থেকে ১৮০০ শতাব্দী অব্দি ইউরোপ, আমেরিকায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষদের শাস্তি, এমনকী মৃত্যুর বিধান দেওয়া হয়েছিল ডাইনি হওয়ার অভিযোগ তুলে। কোনওবারই কিন্তু কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, শুধু মানুষের মিথ্যে কথার ভিত্তিতে, ভয়ের সুযোগ নিয়ে এই শাস্তিগুলো দেওয়া হয়েছিল। শাস্তির ভয়াবহতাও কিছু কম ছিল না। কখনও ফাঁসি দেওয়া হতো, কখনও জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হতো, কখনও শূলে চড়িয়ে দেওয়া হতো। এই সমস্ত শাস্তি দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ দিত, তাই সাধারণ মানুষের বাঁচার কোনও রাস্তা ছিল না। আর সেইসব মানুষদেরই শাস্তি দেওয়া হতো যারা সমাজে অসহায়, গরিব, একা বা যারা আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করে সমাজের ভয়, কুসংস্কারগুলোকে ভাঙতে চেষ্টা করেছিল, সমাজের উঁচু মাথাগুলোর বিরুদ্ধে গিয়েছিল কোনোভাবে। আমাদের দেশেও যদি দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে, ঠিক একইরকম ব্যাপার। এখানেও সেইসব মানুষদেরই ডাইনি অপবাদ দেওয়া হয় যারা অসহায়, গরিব, একা বা কোনওভাবে সমাজের কিছু বড় মাথাকে রাগিয়ে দিয়েছে।"

আঁধার পেরিয়ে
ডাইনি অপবাদে নিহত অসহায় মানুষদের উদ্দেশ্যে সালেম গ্রামে নির্মিত ফলক

হঠাৎই মোড়লের ছেলে উঠে দাঁড়ালো। "কী বলতে চাইছেন আপনি?"

রজত শান্ত হয়েই উত্তর দিল, " আমি এখনও কথা শেষ করিনি। আপনি প্লিজ বসুন।"

ছেলেটি বসলো। রজত আবার শুরু করলো, "আমাদের সবার মনেই প্রশ্ন আসা উচিত কীভাবে একটি মিথ্যে ভয় একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে সবার মনে থেকে যায়। কারণ হিসাবে বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের সীমিত জ্ঞান এবং যুক্তিহীনতাই দায়ী। এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা সেই সৃষ্টির আদি থেকে ঘটে চলেছে যার সহজ কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। কিন্তু যতদিন গেছে আমরা দেখেছি বিজ্ঞান অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। সে বিদ্যুৎ চমকানো হোক, ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, আজ এগুলোর কারণ জানি। বিভিন্ন রোগ কেন হয় তার কারণ জানি। কিন্তু যেখানেই মানুষের মন উত্তর পায় না সেখানে তারা কুসংস্কারকে সহজে স্থান দেয়, কারণ মানুষের মন সবসময় এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যে সবকিছু ঘটনা ঘটার পেছনেই কিছু কারণ আছে, কেউ দায়ী। আর এই অবিশ্বাসের সুযোগ নিয়েই একদল ফেঁদে বসে মিথ্যে গল্পের ঝুলি, যা ধীরে ধীরে প্রায় সবাইকে যুক্তিহীন, ভয়ার্ত করে তোলে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকে হেইনরিক ক্র্যামার (Heinrich Kraemer) তার বই 'ম্যালিয়াস ম্যালাফিকারাম' (Malleus Maleficarum) বা 'হ্যামার অফ উইচেস' (Hammer of Witches) বইতে এরকমই এমন মিথ্যের গল্পের জাল বুনে দেখিয়েছিল কীভাবে ঈশ্বরের বিরোধী স্যাটান (Satan) কিছু দুর্বল মানুষদের তার জালে ফেলে তাদেরকে ডাইনি বা কালো জাদুর তান্ত্রিক বানিয়ে ধর্মাবলম্বীদের ক্ষতিসাধন করতো। হেইনরিক দাবি করেছিল সে যা লিখেছে তা সব সত্যি, কিন্তু কোনও প্রমাণও সে পেশ করেনি, শুধু গাঁজাখুরি গল্প লিখে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। মানুষ নিজের সমস্ত দুর্ভাগ্যের জন্য অন্য কাউকে দোষ দিতে ভালোবাসে। সে ফসলের ক্ষতি হোক, ক্ষণজন্মা শিশুর মৃত্যু বা নিজেদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, সবকিছুর দায়ী কে? অসহায়, দুর্বল, গরিব মানুষ বা কেউ যদি যুক্তি দিয়ে সমাজের অন্ধকারকে ভাঙার চেষ্টা করে সে। তাকে ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করে তার উপর সমস্ত দোষ দিয়ে দিত। সমস্যা হলো যখন চার্চও এই বইকে প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে দাবি করা শুরু করেছিল। ধর্মান্ধ মানুষ সবাই দলে দলে এই বই পড়া শুরু করেছিল, এমন অবস্থা হয়েছিল কয়েক শতাব্দী জুড়ে এই বই সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছিল ঠিক বাইবেলের পরেই। কিন্তু যখন যুক্তির দ্বার মানুষের চোখ খুলে দিল, তখন চার্চই এই বইকে বাতিল ঘোষণা করেছিল। তাই আমি শুধু এটুকুই বলছি আমরা যেটাকে আজ সত্যি বলে বিশ্বাস করে বসছি যুক্তি বা প্রমাণের অভাবে সেটা একদিন ভেঙে যাবে, মিথ্যে বলে প্রমাণিত হবেই।"

রজত শিউলিকে কাছে ডাকলো। শিউলির চোখে জল তখন। রজত শিউলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মোড়লের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলো, "আমি যে যে ঘটনার কথা বললাম তা আজ প্রমাণিত সত্য। জানি আমাদের কাছে দুর্গাপুজো কত কাছের একটি উৎসব, ধর্মীয় আচার। গত দুর্গাপুজোয় সন্ধিপুজোর একশো আট প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্ব শিউলির ছিল। কিন্তু ক্লান্তির জন্য হোক বা ওর শরীর-মনের কোনও অবসাদের জন্য, সেদিন ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওকে মা দুর্গা ত্যাগ করেছে বা ওর উপর শয়তান ভর করেছে। সেই ঘটনার পরেপরেই গ্রামেও কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল। যেমন কিছু শিশু মারা যায় হঠাৎ করেই, এর মানে এই নয় যে এর আগে শিশুরা পুষ্টির অভাবে বা রোগে ভুগে মারা যায়নি এই গ্রামে, কিন্তু পুজোর দিনে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে, এই গ্রামের সব শিশুমৃত্যুকেই, সব দুর্ঘটনাকেই, সব দুর্ভাগ্যকেই শিউলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শুরু হলো। আপনারা ভাবতে পারেন একটি কিশোরীর কাছে এই মিথ্যের ভার কতখানি? যে সম্পূর্ণ নির্দোষ, যার সঙ্গে কোনও ঘটনার কোনও সামান্য যোগ নেই, যে সহজ, সরল একটি কিশোরী তার উপর মৃত্যুর দায়ভার চাপালে তার কী অবস্থা হয় ভাবতে পারেন আপনারা? কেন দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য অপরাধ আপনারা সবাই মিলে করেছেন?"

মোড়লের ছেলে আবার উঠে দাঁড়িয়ে তুতলিয়ে বলে উঠলো, "কে...কে...কে বলেছে যোগ নেই? এই যে আপনার মেয়ে কাল অসুস্থ হয়ে পড়ে গেল, শুনলাম তখন এই শিউলি... এই শিউলি ওখানেই ছিল, যোগ নেই? নাহলে কেন ওরকম হলো?"

রজত হেসে উঠলো, "জানি না আপনারা জানেন কী না, আমি একজন মনোবিদ, ডাক্তারও বলতে পারেন চলতি ভাষায়। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে বলছি কালকের ঘটনায় শিউলির কোনও যোগ নেই, দায় নেই। গুনগুন কাল ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিল, এটি বিভিন্ন কারণেই হতে পারে, মানসিক, শারীরিক। মানসিক বা শারীরিক ধকল বা স্ট্রেস, খেলতে খেলতে হঠাৎ করে হাঁপিয়ে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে বা স্নায়ুর কোনো রোগের জন্যও হতে পারে, খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঠিক কেন হয়েছিল তা হয়তো আরও পরীক্ষা করে জানা যাবে। আমি ফিরে গিয়ে সেই সবের ব্যবস্থা করব। তবে আপনি কেন শিউলিকে শাস্তি দিতে তৎপর তাও জানি, আপনি ওর পড়াশোনা বন্ধ করে ওকে বিয়ে করে গৃহিণী করতে চেয়েছিলেন এই বয়সেই, ও বা যমুনাদি রাজি হয়নি বলে রাগ, আর আপনিই ওর বিরুদ্ধে সবার মনে এই বিষ ঢোকানোর কাজ শুরু করেছিলেন। কী ঠিক কি না?"

আঁধার পেরিয়ে
শিল্পীর কল্পনায় হাইপেশিয়া

মোড়লের ছেলে আমতা আমতা করতে থাকে। রজত বলে যায়, " আপনারা সবাই একটু যুক্তি দিয়ে ভাবুন, দেখবেন কোনওকিছুতেই এই বাচ্চা মেয়েটির কোনও দোষ পাবেন না, বরং ও এই গ্রামকে, এই গ্রামের মানুষদের, অসহায়, আর্তদের ভালোবেসে এসেছে ঠিক ওর মায়ের মতো। আমার পিসি কিছুদিনের জন্য ভুলে গেলেও আমরা ভুলিনি। আপনারাও ঘৃণার পর্দা সরিয়ে দেখলে একই জিনিস দেখতে পাবেন। শিউলি এখনও মায়ের আশীর্বাদধন্যাই। মা দুর্গা ওকে ত্যাগ করলে ও মাধ্যমিকে সারা জেলার মধ্যে অন্যতম একজন কৃতী হয়ে উঠতো না, তাই না? আপনাদের বিশ্বাস তো তাই বলে, তারাই পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে যাদের উপর মায়ের আশীর্বাদ আছে। তাই মেয়েটিকে আর কষ্ট দেবেন না, আমি হাতজোড় করে বলছি। মেয়েটিকে ভালোবাসুন, ওর গুণের কদর করুন। ওর গুণের জন্য ওকে হিংসে করে ওর ক্ষতি চাইবেন না। 'হাইপেশিয়া অফ আলেকজান্দ্রিয়া'কেও (Hypatia of Alexandria) ঘৃণা সহ্য করতে হয়েছিল, কারণ ৪১৫ খ্রিস্টপূর্বের (415 CE) সময় আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি একজন বিখ্যাত স্কলার ছিলেন, কারণ তিনি সমাজের সবাইকে বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী করতে চেয়েছিলেন, তিনি একজন মেয়ে হয়েও ভীষণ জ্ঞানী ছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার গোঁড়া ধর্মান্ধ মানুষ এটা মেনে নিতে পারেনি, তারা হাইপেশিয়াকে (Hypatia) ডাইনি অপবাদ দিয়ে অভিযুক্ত করে খোলা রাস্তায় মারতে মারতে খুন করে। ঠিক এই কারণেই আলেকজান্দ্রিয়া শিক্ষা, বিজ্ঞান, আধুনিকতায় কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে যায় আবার। যে আলেকজান্দ্রিয়াকে তখনকার মানুষ শিক্ষার পীঠস্থান বলে চিনতো তাকে সবাই এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল এই নৃশংস ঘটনার পর। এই শিউলিও সেই হাইপেশিয়ারই রূপ। শুধু হাইপেশিয়ার মতো দুর্ভাগ্য যেন শিউলির না হয় তা দেখবেন। ওকে এই গ্রামের, জেলার, রাজ্য বা দেশের একজন উজ্জ্বল সম্ভাবনা হিসাবে গড়ে তোলার কাজে আপনারাও সাহায্য করুন। আর একান্তই না পারলে প্লিজ কোনও ক্ষতিও করবেন না। যে সময় আমরা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এত সাহায্য নিয়ে বাঁচি, সেই সময়ে অন্তত কুসংস্কারকে আর মনে বাড়তে দেবেন না। এগুলো বলবো বলেই আজ মিটিংটা হোক চেয়েছিলাম। যাতে শুধু আমার পিসিমা নয় সারা গ্রাম শিউলির পবিত্রতা, ওর জ্ঞান, শিক্ষা, স্নিগ্ধতা টের পায়। সবাই ওকে যাতে আপন করে নেয়। এরপর বাকিটা আপনাদের উপরই।"

রজত চুপ করে। শিউলি কখন ওকে জড়িয়ে ধরেছে, বুঝতে পারেনি ও। খুব কাঁদছে মেয়েটি। কত তীব্র যন্ত্রণাই না সহ্য করতে হয়েছে মেয়েটিকে! যমুনাদি, এমনকী পিসির চোখেও জল। পিসিমা এগিয়ে আসেন। রজতের চিবুকে হাত দিয়ে ধরে আদর করে শিউলিকে জড়িয়ে ধরেন উনি।
"ক্ষমা করিস মা আমায়। তুই এবার সবসময় আমার কাছেই থাকবি। তুইই তো মা দুর্গার রূপ। "

গ্রামের কিছুজন কোনও কথা না বলে উঠে চলে যায়। কিন্তু মোড়লমশাই এগিয়ে এসে শিউলির মাথায় হাত রাখেন, "ভালো থাকিস মা, গ্রামের সবার তরফ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি। তুই শুধু খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করতে থাক। আমার ছেলে বা যে কেউ তোকে জ্বালালে আমায় জানাস।"

শিউলি চট করে একটা প্রণাম করে নেয় মোড়লমশাইকে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা