সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
জাবাল সত্যকাম

জবালার সংসার

আকাশের পূব কোণে কালনাগিনীর ফণার মতো ফুঁসে উঠছে একখানা নিকষ কালো মেঘ। দিনদুপুরেই যেন সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। গায়ে-মাথায় চড়বড় করে পড়ল এসে বড় বড় কয়েকটা বৃষ্টির দানা। দ্রুত ঘরের পানে পা চালায় জবালা। মনে মনে ভাবে, “এবার বর্ষা ঝেঁপে আসার আগেই ঘরটা ছাইতে হবে"। কে বা করে এসব? ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে তো ঐ একরত্তি ছেলেটা, সারাটাদিন মায়ের সঙ্গে ঘুরঘুর করে আর হাতে হাতে মাকে সাহায্য করে। তবে ইদানীং ছেলের মতিগতি কেমনধারা ঠেকছে জবালার। ভাল করে কথা কয় না, কী যেন ভাবে উদাসপারা হয়ে, আপন মনে থাকে গুম হয়ে। মায়ের মনে মেঘের গুরুগুরু। সারা পৃথিবীতে ঐ ছেলেই তো তার একমাত্র ধন! হঠাৎ তার চোখদুটো চকচক করে ওঠে। ঝোপের মধ্যে মাথায় সবুজ তাজ পড়ে উঁকি মারছে নধর এক সোনার বরণ আনারস! মাথার জ্বালানি কাঠ আর শুকনো পাতা বোঝাই আঁটিটা নামিয়ে রেখে দুই হাতে মোচড় দিয়ে আনারসটা ছিঁড়ে নেয় জবালা। আকাশের পানে আরেকবার চেয়ে বনের ঘাস মাড়িয়ে আঁকাবাঁকা বনপথে অভ্যস্ত বনহরিণীর মতো চলে জবালা।

যেখানে গ্রামের শেষ আর বনের সীমানা শুরু, সেইখানে তালপাতায় ছাওয়া, মেটে উঠানে চালগুঁড়ির আলপনা আঁকা, বন্যপশুর অনধিকার প্রবেশ-রোধক বাঁখারি-বেড়ার নিরাপত্তায় সান্ত্বনা পাওয়া জবালার ছোট্ট কুঁড়েঘরখানি। সেখানে থাকে জবালা, তার নয় বছরের ছেলে সত্যকাম আর তার খেলার সাথী বাঘা-ভুলু দুই কুকুর, বেড়াল কুটুস আর কাঠবেড়ালী ছোট্টু। সকালে সূয্যি ওঠার আগে উঠে পড়ে জবালা। মুনিবাঁশের দুয়ার ঠেলে বাইরে এলেই ভুলু এসে পায়ের কাছে লেজ নাড়ে, বাঘাটা অলস, শুয়ে শুয়ে চোখ পিটপিট করে দেখে তাকে, গলায় অস্পষ্ট শব্দ তুলে বুঝি জানতে চায়, তার মনিব উঠেছে কি না। দশদিকের দশদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে দুয়ারে জলের ছিটে দেয় সে, রাতের ভিজিয়ে রাখা অল্প আতপ চাল বেটে উঠোনে আলপনা আঁকে। সত্যকাম ঘুম থেকে উঠলে দুজনে মুড়ি-নারকেল খায়। তারপর সে বনে কাঠ কুড়াতে যায়, সত্যকাম কুয়ো থেকে জল তোলে, পোষ্যগুলোকে খেতে দেয়। বেলা হলে মায়েপোয়ে মিলে কাঠকুটো জ্বেলে সামান্য রান্নার তোড়জোড় করে। বন থেকে সংগ্রহ করে আনা মেটে আলু সিদ্ধ, আলো চালের ভাত, কোন কোন দিন ডুমুরের চচ্চড়ি বা বকফুল ভাজা। বাঘা, ভুলু, কুটুস, ছোট্টু, সত্যকাম, জবালা সবার খাওয়া হলে সব গুছিয়ে, ঘর নিকিয়ে কাজ সারতে দিনের আলো নিভে আসে। সন্ধ্যের আকাশে ফুটে ওঠে অজস্র তারার ফুল। দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে জবালা, সত্যকাম তার কোলে মাথা রেখে বলে, “মা, গল্প বল্"। সত্যকামের জন্মের আগে জবালা এক সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে দাসীর কাজ করত। গিন্নিমা তাঁর ছেলেপুলেদের যখন গল্প বলতেন, সে দুয়ারে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শুনত। সেইসব গল্পই এখন সে শোনায় তার ছেলেকে। সত্যকামকে।

জবালার ছেলে সত্যকাম। সারা পৃথিবীতে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। শিশুসুলভ চাপল্য তার মধ্যে নেই। শান্ত তার স্বভাব, ধীর তার চলন, গভীর দুই চোখের তারায় অজানাকে জানবার এক অনুসন্ধিৎসা, সে যত না বলে, শোনে তার চেয়ে অনেক বেশী। যত বড় হয়, ততই সে অন্তর্মুখ হতে থাকে। অরণ্যের প্রান্তে তার বাস। অরণ্যসম্পদ অবলম্বন করেই তার বেঁচে থাকা। তাই অরণ্য তার আরেক মা। সেই নীরব জননীর কাছ থেকে শেখে সে অনেক কিছু। আর যা কিছু দেখে-শোনে, তাই নিয়ে ভাবে চুপ করে। পুকুরের জলে মাছের খেলা দেখে সে ভাবে, প্রতিদিন সূর্য ওঠা তাকে ভাবায়, যখন বৃষ্টি পড়ে অঝোরে, জঙ্গলের গাছপালা কেমন করে বৃষ্টি শুষে নেয়—সে দেখে মন দিয়ে। মাটির অন্ধকার ফুঁড়ে কেমন করে ছোট্ট সবুজ প্রাণ এই বিরাট পৃথিবীতে নির্ভীক মাথা তোলে, তিল তিল করে ক্ষুদে ক্ষুদে মৌমাছি কিভাবে গড়ে তোলে এক পেল্লাই মৌচাক—এসবই সে পরম বিস্ময়ে লক্ষ্য করে। তার ভিতরটা শুধু জানতে চায়, এই জগতের পিছনে কী যেন এক রহস্য লুকিয়ে আছে, যাকে সে ধরতে ছুঁতে পারে না—সেই রহস্য তার মনকে দিবারাত্রি আকর্ষণ করে দুর্নিবার। বনে কাঠ কুড়ানোর সময় সে কতবার দেখেছে তারই বয়সী ছোট ছেলের দল চলেছে বনের পথে, ওরা কেউ কাঠ কাটে, কেউ বা গরু চড়ায়, কেউ বা নদী থেকে জল তোলে। কিন্তু ওরা সত্যকামের মতো নয়। ওরা আলাদা। ওদের কথার ঢং আলাদা। ওদের পরনে সাদা ধুতি, মাথার উপরে চুল চুড়ো করে বাঁধা, ওরা মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য ভাষায় সুর করে কিছু বলে—সত্যকামের বুকের ভিতরে উথালপাথাল করে সেই সুরের ঢেউ। সত্যকাম জানে, ওরা ব্রহ্মচারী। ওরা ঋষি গৌতমের গুরুকুলে থাকে। মাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সে কতবার গিয়েছে সেই ছায়া নিবিড় তপোবনে, শ্যামল তরুছায়ার মতো নীরবে দূরে দাঁড়িয়ে সে দেখেছে দেবতার মতো জ্যোতির্ময় সেই ঋষিকে। তার কিশোর প্রাণের মুগ্ধতা নিভৃত প্রণাম হয়ে লুটিয়ে পড়েছে ঋষি গৌতমের চরণে। সে শুনেছে অজানা ভাষার সেই সুরেলা ছন্দ সমস্বরে ব্রহ্মচারীদের উচ্চারণ করতে—“ওং শং নো মিত্রঃ শং বরুণঃ শং নো ভবত্বর্যমা শং নো ইন্দ্র বৃহস্পতিঃ শং নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ।" ছায়ার মতো তার শরীর দাঁড়িয়ে থাকে গৌতমের আশ্রমের সুদূর প্রান্তে, তার আত্মা শরীর থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যোগ দেয় ওই পাঠরত ছেলেদের সঙ্গে। যত দিন যায়, তার বিদ্যালাভের আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। শয়নে-স্বপনে-মননে সে গৌতম ঋষির আশ্রমে বাস করতে শুরু করে।

জবালা দূর থেকে দেখে, ঘরের দাওয়ায় বসে আছে সত্যকাম, গভীর চিন্তামগ্ন। সে জানে, তার ছেলেটা আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। সে বালকোচিত উৎপাত করে মাকে বিব্রত করে না, এটা সেটা খাওয়ার জন্য বায়নাও করে না, সে শুধু দেখে, শোনে, আর চুপ করে ভাবে। নিজের পেটের ছেলে, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, এই ছেলেকে সে চেনে না। অজানা আশংকায় তার বুক কাঁপে। তার মনে পড়ে যায় ছেলের জন্মের আগেকার জীবনের কথা। দাসী মায়ের গর্ভে জন্ম তার। মা মারা গেলে মায়ের মনিবের বাড়িতেই আরও কয়েকজন আশ্রিতার সঙ্গে কিশোরী জবালা যুবতী হয়। মনিবের অতিথিদের সেবাশুশ্রূষার ভার ছিল তার উপর। তার মনিব ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। দূরদূরান্ত থেকে জ্ঞানিগুণী মানুষজন আসতেন তাঁর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করতে। মনিবের নির্দেশে জবালা তাঁদের সবরকম ভাবে পরিচর্যা করত। নম্র, ধীরস্বভাবা এই দাসীর সেবায় সন্তুষ্ট হতেন সবাই। মনিবও জবালাকে মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন। নাম না জানা বুনোফুলের মতই সহজ ভাবে, সুন্দর হয়ে ফুটে উঠছিল দাসী জবালার যৌবন। এই সময় দূর দেশ থেকে আগত এক বিদ্যোৎসুক তরুণের সঙ্গে সকলের অলক্ষ্যে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে জবালা। জ্ঞানচর্চা অবসানে ব্রাহ্মণ যুবক ফিরে যায় স্বগৃহে। জবালার দিনরাত্রি আবর্তিত হতে থাকে পুরনো ছন্দে। একদিন নিজের গর্ভে অনুভব করে মাতৃত্বের স্পন্দন। বুঝতে পারে, দূর দেশের সেই বিদ্বান তরুণই তার ভাবী সন্তানের পিতা। কিন্তু তার নাম-গোত্র কিছুই তো জিজ্ঞাসা করেনি জবালা! হয়তো জিজ্ঞাসা করবার সময় পায়নি, কিম্বা সেকথা সেসময় তার মনেও ওঠেনি। তখনই স্থির করে ফেলে, “দাসীবৃত্তি করে নয়, ভাবী সন্তানকে বড় করে তুলব স্বাধীন ভাবে।" গিন্নিমা তাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করেছিলেন। সে চলে এসেছিল একাকী থাকবে বলে। চলে এসেছিল অনাগত সন্তানকে এক পবিত্র স্বাধীন জীবন দেবে বলে। চলে এসেছিল নিজের জীবনযুদ্ধ একলা লড়বে বলে। তাই গ্রামের যেখানে শেষ, বনের যেখানে আরম্ভ, সেইখানে চলে এসেছিল একলা যুবতী সন্তানসম্ভবা জবালা। সেখানে শুরু হল তার নতুন আরণ্যক জীবন। এক পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে বড় করে তোলার নতুন সংগ্রাম। কিন্তু তা নিয়ে তার মনে কোনও গ্লানি নেই। তার বিশ্বাস, সত্যবানের পিতা নিশ্চয় উচ্চকুলজাত ব্রাহ্মণ। কিন্তু সত্যবান জবালার ছেলে। একান্তই জবালার। মাতাপুত্রের পরিচয়ে কোনও আড়াল নেই, কোনও সংশয় নেই, কোনও রহস্য নেই। আকাশে সূয্যি ওঠার মতোই অমোঘ সেই সত্য। জবালা মা, আর সত্যকাম তার ছেলে। জাবাল-সত্যকাম। ঠিক যেমন রাধাপুত্র রাধেয়, কিম্বা কুন্তী পুত্র কৌন্তেয়।

রোজকার মতো রাঁধে জবালা, খাওয়া হয়, কাজ সারা হয়। কিন্তু আজ মায়েপোয়ে কথা হয় না তেমন। থম মেরে আছে নিকষ কালো আকাশও। জবালা আড়ে আড়ে চায় ছেলের পানে, বুঝে নিতে তার কিশোর প্রাণের নবীন বাসনা। বুঝেও বোঝে না, কী যেন অধরা রয়ে যায়! অবশেষে নেভে দিনের আলো। বাঘা ঝিমায়, ভুলু ঝিমায় কুণ্ডলী পাকিয়ে দরজার কাছে। কুটুস দাওয়ার উপর চটের বিছানায় আলগোছ সুখে, ছোট্টুও সামনের পেয়ারা গাছের কোটরে চুপচাপ। জবালা দাওয়ায় বসে পা ছড়িয়ে। অন্ধকারে ছায়ার মতো সত্যকাম বসে মায়ের মুখোমুখি। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি পুঁথি পড়ব মা। আমি গৌতম ঋষির তপোবনে যাব। তুই আমায় যেতে দিবি নে?" জবালার বুকের ভিতর নদীর পাড় ভাঙার শব্দ। ঢেউয়ের মতো রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। উতলা মনের ছবি-আঁকা মুখ আড়াল করেছে রাতের কালো পর্দা। এই দিনটার কথা সে জানত, মনের অনেক গভীরে জানত, সত্যবানের জন্মের পর থেকেই জানত। দশ বছরের অতীত পিছনে ঠেলে তার মনের আয়নায় উঁকি দেয় এক গভীর চোখের মায়া, যে চোখে ছিল অফুরান জ্ঞানের তৃষ্ণা! ইদানীং এই ভাষাই সে পড়তে চেষ্টা করে সত্যবানের চোখে। বাপের ধারা পেয়েছে সত্যকাম। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর তরুণী জননী সস্নেহ চুম্বনে কাছে টেনে নেয় ছেলেকে, কণ্ঠে প্রত্যয় জাগিয়ে বলে, “নিশ্চয় যাবি বাছা, পুঁথি পড়বি, অনেক বড় হবি।" এরপরই আসে সেই অমোঘ প্রশ্ন, “গুরু যে আমার পিতার নাম-গোত্র জিজ্ঞাসা করবেন? কে আমার পিতা? কী আমার গোত্র? আমায় বলে দে মা।" এক অবাধ্য শ্বাস বুকের মধ্যে আটকে রেখে দৃঢ় কণ্ঠে জবালা বলে, “গুরুমশাই যদি তোমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন, তাঁকে বলবে, তুমি জবালার ছেলে। এছাড়া আমি আর কিছু জানি না!"

অরণ্যে সাড়া জাগিয়ে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। অশান্ত হাওয়ার প্রবল দাপট, বৃষ্টির ঝাপটা, বাজের কড়কড় শব্দ সব যেন একযোগে এসে জবালা আর সত্যকামের ছোট্ট মাটির কুটিরে কড়া নাড়ে। অশান্ত ঝড় জবালাকে প্রশ্ন করে—“ভয় করে? ভয় করে? সত্যকে ধরে পারবি তো টিঁকে থাকতে?" বিনিদ্র রজনীতে স্থির প্রতিমা জবালার হৃদয়ে ধ্বনি ওঠে, “আমার কোনও পাপ নেই, আমি পবিত্র, সত্য আমার ব্রত, সত্যকাম আমার ব্রতের পুরস্কার, সব ঝড় আমি সামাল দেব সত্যকে আশ্রয় করে, আমার সত্যকাম জয়ী হবেই।"
শয্যায় বন্ধ চোখে জাগ্রত সত্যকাম পুলকিত, রোমাঞ্চিত, নতুন জীবনে প্রবেশের হরষে। ঝড় তার মনের দুয়ারেও কড়া নাড়ে—“ভয় করে? ভয় করে? যথেষ্ট কি এই পরিচয়? গুরু কি স্বীকার করবেন?" সত্যকামের হৃদয়ের গভীর থেকে উত্তর আসে, “পবিত্র আমার জননী, সত্য তাঁর বাক্য, সত্য আমার পরিচয়, তার চেয়েও বড় সত্য, আমার জ্ঞানপিপাসা, জয় আমার হবেই!"

ঋষি গৌতমের আশ্রম

চাঁদ ডুবছে পশ্চিমে। শেষবেলার দান—অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া জোছনা নদীর জলে ঝলমলিয়ে উঠে বিস্তার করেছে এক নয়নমনোহর সুবর্ণজাল। অবগাহন স্নান সম্পন্ন করে সিক্তবস্ত্রে কমণ্ডলু পূর্ণ করে তপোবনের দিকে চলেছেন গৌতম। শৈশব থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে নদীতে অবগাহন স্নানের এই অভ্যেস। নিয়মের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর। সত্যনিষ্ঠা তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয়। এর আগে তাঁর আশ্রম ছিল মিথিলায়। এখন তিনি মিথিলা থেকে দূরে গোদাবরী তীরে তাঁর বিদ্যার্থী আশ্রম তৈরি করেছেন। তপোবনে পৌঁছে বালক বিদ্যার্থীদের ঘুমন্ত মুখগুলো দেখেন তপঃক্লিষ্ট বৃদ্ধ গৌতম, তারপর ঘণ্টাধ্বনি করে জাগিয়ে তোলেন ছেলেদের। কঠোর সংযমে গড়ে তুলতে হবে এদের জীবন। পিতামাতা অনেক আশা নিয়ে এদের রেখে গেছেন গৌতমের আশ্রমে। স্নেহে, শাসনে, শৃঙ্খলায়, জ্ঞানে পূর্ণ মানব হবে এরা। তারপর ছড়িয়ে পড়বে নানা দিকে, সমাজের বুকে হবে এরা আশীর্বাদ স্বরূপ। তবেই তাঁর পরিশ্রম সার্থক হবে।

সমস্ত রাত্রি অঝোর বর্ষণ ক্ষান্ত আকাশের পূব কোণে ফুটে উঠেছে নতুন দিনের অরুণিমা। জবালার ছোট্ট কুটিরে আজ ভোর হতে না হতেই শুরু হয়েছে চঞ্চলতা, যার খানিকটা জবালার ছুটন্ত চরণে, দ্রুত রান্নার তোড়জোড় করা হাত দুটিতে, খানিকটা সত্যকামের মনে, আরও খানিকটা ওর পোষ্যদের কিছুটা আঁচ করতে পেরেও মুখ ফুটে বলতে না পারা নখের আঁচড়ে প্রকাশ পাচ্ছে। সত্যকাম আদর করে ভুলুকে, বাঘাকে। বলে, “মা-কে দেখিস।" সত্যকাম কোলে তুলে নেয় ছোটুকে আর কুটুসকে, গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, আর বলে, “মা-র কথা শুনিস।" অবোলা বন্ধুরা কালো টানা টানা চোখে চেয়ে থাকে, ঘরর-ম্যাও-ক্রিচিক শব্দে জানতে চায়—“তুমি আসবে না আর ফিরে? কোথায় যাবে? কতদিন পরে আসবে? যাওয়ার দরকারটাই বা কি?" জবালা পুত্রের কাঁধের লাঠির ডগায় পুঁটলিতে বেঁধে দেয় সামান্য কিছু বনের ফল-মূল। ভেজা হাত আঁচলে মুছে সত্যকামের মাথায় রাখে, স্বর্গের সব দেবতাদের প্রণাম জানায় বিড়বিড় করে আর অপলকে চেয়ে থাকে নির্ভীক পুত্রের সত্যলাভের যাত্রাপথের দিকে।

বনের পথ সত্যকামের মুখস্থ। বহুবার গিয়েছে সে ঋষির তপোবনে, আড়াল থেকে দেখেছে তার ভাবী আচার্যকে, সহপাঠীদের। কেউ টের পায়নি। তবে আজ সে যাচ্ছে ঋষি গৌতমের সাক্ষাৎ সমীপে।

ঋষি সকালবেলার স্তোত্রপাঠের অধিবেশন সমাপ্ত করে বিশ্রাম করছিলেন। বিদ্যার্থীরা কেউ কেউ যজ্ঞ-সমিধ সংগ্রহে নিকটস্থ বনে গিয়েছে, কেউ নদী থেকে পানীয় জল আনতে গিয়েছে, কেউ বা পাকশালায় ভোজন-প্রস্তুতিতে সহায়তা করছে। এ সময় গৌতম নিরিবিলিতে শাস্ত্রপাঠ করেন। কিছুক্ষণ বিরতির পর মধ্যাহ্নের আহারের পূর্বে ঘণ্টাখানেক আবার চলবে ব্যাকরণ, বেদপাঠ ও গণিত অধ্যয়ন। মধ্যাহ্ন-ভোজনের পর সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবার পূর্ব পর্যন্ত আরও নানা শাস্ত্রাধ্যয়ন করবে তারা। তারপর যৎকিঞ্চিত আহার করে সান্ধ্য উপাসনা ও ধ্যানের পর শয্যাগ্রহণ। পরদিন অতি প্রত্যূষে শয্যাত্যাগ, সূর্যবন্দনা ও দৈনন্দিন পাঠাভ্যাস। এইপ্রকারই আশ্রমের জীবন। বিদ্যার্থীদের পরিবারের প্রদত্ত অনুদানে আশ্রমের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ হয়, রন্ধন ও গোশালার ভারপ্রাপ্ত বয়স্ক কর্মীদের ভরণপোষণও হয় ঐ অর্থের একাংশে।

নিবিষ্ট মনে শাস্ত্রপাঠ করতে করতে অকস্মাৎ বকুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোর আগন্তুকের প্রতি গৌতমের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ছেলেটি তাঁকেই দেখছে একদৃষ্টে। তিনি ঈশারায় ডাকেন সেই বালককে। এগিয়ে আসছে ছেলেটি। ঋজু তাঁর শরীর এক পেলব শাল তরুর চারার মতো। চলনে নেই কোনও সংকোচ। স্নিগ্ধ সুকোমল মুখশ্রীতে লাবণ্য ও তেজের অপরূপ সমাহার। “কে তুমি? এই তপোবনে কি উদ্দেশ্যে আগমন?"
অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে প্রণাম জানায় বালক, নম্রস্বরে বলে, “আমি আপনার কাছে বিদ্যা শিক্ষা করতে এসেছি। কৃপা করে আপনার শিষ্য হিসেবে আমাকে গ্রহণ করুন!"
গৌতম পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন এই অজ্ঞাত বালককে। তাঁর কণ্ঠদেশে নেই কোনও যজ্ঞোপবীত। স্কন্ধে মৃগচর্মও অনুপস্থিত। কটিদেশে মুঞ্জতৃণ বল্কল নেই। হাতে নেই সমিধ। অথচ সে বিদ্যার্থী হয়ে এসেছে। তিনি বললেন, “তোমার দেহে সুলক্ষণ লক্ষ্য করছি। মনে হচ্ছে তুমি কোনও ব্রাহ্মণ-সন্তান। আচার্য সমীপে এসেছ, অথচ সমিধপানি হয়ে উপস্থিত হওনি। তোমার পিতা কে? কী তোমার গোত্র?"
সত্যকাম ধীর স্বরে বলে, “আমি সত্যকাম। আমি মাতা জবালার পুত্র। আর কোনও পরিচয় জানা নেই আমার। আপনি কি আমাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করবেন না?"
এই বালকের প্রত্যয়ী ঘোষণায় বিস্মিত হন গৌতম। তবুও বলেন, “শোন বৎস, পিতার পরিচয় ও গোত্র জেনেই আশ্রমে আবাসিক হয়ে থাকার অনুমতি দেওয়ার প্রথা। তুমি মাতার কাছ থেকে জেনে এসে কাল আমায় বলবে। আমি অবশ্যই তোমাকে আমার আশ্রমে বিদ্যালাভের সুযোগ দেব।"

এরপর বিদ্যার্থীদের পাঠের দ্বিতীয় অধিবেশন আরম্ভ হল। গৌতম আর সত্যকামের দিকে মনযোগ দেননি। মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় হলে তিনি দেখলেন দূরে, বকুলের ছায়ায় সেই ছেলেটি অপেক্ষমান! তবে কি ও আজই মায়ের কাছ থেকে অসম্পূর্ণ পরিচয় সম্পূর্ণ জেনে আবার ফিরে এসেছে? তিনি ডাকলেন, “সত্যকাম, এস।"

সত্যকাম দাঁড়ালো এসে সমবেত বিদ্যার্থীদের সামনে। গৌতম বললেন, “বলো বাছা! কী তোমার গোত্র?" সত্যকাম ধীর স্বরে বলল, “আচার্যদেব, আমি তো তা জানি না!" ছাত্রদের মধ্যে একটা গুঞ্জন ধ্বনি জেগে উঠল। গৌতম অবাক হলেন, “তোমার মায়ের কাছ থেকে জেনে এসে আমাকে কাল বলতে হবে সেকথা। এটাই নিয়ম।" সত্যকাম ধীর স্বরে জানায়, “আমার মা বলেছেন, তিনি যখন একজন ধনীর গৃহে দাসী বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় আমাকে তাঁর গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সেই মনিবের গৃহে তিনি বহু অতিথি-অভ্যাগতের সেবা করতেন। তাই আমি কার পুত্র, তা তিনিও জানেন না। তিনি কেবল এইমাত্র বলেছেন, ‘দাসীপুত্র জাবাল-সত্যকাম’, এই আমার পরিচয়"—সত্যকামের ম্লান মুখ দেখে গৌতম অন্তরে বিচলিত হয়ে ওঠেন। যাদের পাঠ সমাপ্তির মুখে, সেই অপেক্ষাকৃত পরিণত ব্রহ্মচারীদের মধ্যে কেউ কেউ মহর্ষিকে মৃদুস্বরে তাদের আপত্তি জানায়, “আচার্যদেব, অজ্ঞাত গোত্র ও অজ্ঞাত কুলশীল বিদ্যার্থীকে আশ্রমে রাখলে গ্রামে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, সেটি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।" গৌতম গভীর ভাবে চিন্তা করলেন। বললেন, “সত্যকাম, আমাকে আরও চিন্তা করতে হবে। তুমি ক্ষুধার্ত। আপাতত আমার আশ্রমিকদের সঙ্গে তুমিও মধ্যাহ্ন-ভোজন করো। আমি যথাসময়ে আমার সিদ্ধান্ত জানাবো।"

অতএব সত্যকাম অন্যান্য বিদ্যার্থীদের সঙ্গে আহার গ্রহণে উপবেশন করল। কিন্তু তার সঙ্গে তারা কেউ কথা বলল না। এক প্রান্তে নতমুখে বসে সে আহার গ্রহণ করল। গৌতম তাকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে ঐ বালকের ধীর গম্ভীর সংযত আচরণ তাঁকে মুগ্ধ করেছে।

সমাপ্ত হল বিদ্যানুশীলন। সূর্যদেব পশ্চিম গগনে যাত্রার তোড়জোড় করছেন। বকুল গাছের মূলে উপবিষ্ট সত্যকাম আচার্যের বিধান শোনার প্রতীক্ষায়। গৌতম ডাকলেন, “এস সত্যকাম। আমি তোমার বিষয়ে অনেক চিন্তা করে স্থির করেছি, শিষ্য হিসাবে তোমাকে আমি গ্রহণ করব।" অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জনের সূত্রপাত হতে তিনি সেদিকে ফিরে বললেন, “এই বালকের নাম সত্যকাম। এ যথার্থ সত্যভাষণ করেছে। এর সততাই ব্রাহ্মণত্যের পরিচায়ক। এর মধ্যে রয়েছে যথার্থ জ্ঞানানুসন্ধিৎসা। সেদিক থেকেও এ কুলশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের মর্যাদা লাভ করেছে। এর ধৈর্য, নির্ভীক সত্যভাষণ, মাতৃভক্তি ও বিনয় শিষ্যত্বের যোগ্য সম্পদ। তাই আমি একে শিষ্য স্বীকার করলাম।" ঋষির এই ঘোষণার পর আর কেউ টুঁ শব্দও করল না। গৌতম সত্যকামকে সস্নেহে বললেন, “আজ শয়ন করো। আগামীকাল প্রত্যূষে তোমাকে আমি যথাবিধি যজ্ঞোপবীত দ্বারা পবিত্র করে আমার শিষ্য রূপে গ্রহণ করব।"

রাত্রি হল। সমস্ত তপোবন নিদ্রিত। ঋষি গৌতম ধ্যানে বসলেন। গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন। নবাগত বালক পিতৃপরিচয়হীন। কিন্তু তার জ্ঞানতৃষ্ণা খাঁটি ও ঐকান্তিক। তিনি আচার্য। তাঁর সিদ্ধান্তের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। কেবল ঐ একটি বালকের জ্ঞান লাভেচ্ছা দেখলেই চলবে না, তাকে গুরুকুলে প্রবেশাধিকার দিতে হলে পূর্ববর্তী নিয়মকে লঙ্ঘন করা চলবে না। তা অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কিন্তু ব্যতিক্রম নামে একটি শব্দ আছে, অনন্যসাধারণের ক্ষেত্রে সেটি প্রয়োগ করা কর্তব্য। তা না হলে ইতিহাস কলঙ্কিত হবে। সহস্র বছরের ব্যবধানে একটি বিশেষ মুহূর্ত আসে, সহস্র গড্ডালিকা প্রবাহের মাঝে একটি অনন্যসাধারণ প্রতিভা আসে। তাকে সমাদর না করলে, সুযোগ না দিলে, আলোর পথে আসতে বাধা দিলে যে বড় অন্যায় হবে। প্রতিভার আগুনের স্ফুলিঙ্গ যে তিনি দেখেছেন ঐ তেজস্বী সত্যবাদী বালকের চোখে! অতএব একটি উপায় বের করতে হবে তাঁকেই যাতে ঐ বালকের প্রতি অন্যায় না করা হয়, আবার ধনী ছাত্রদের উষ্মার কারণ হয়ে তাঁদের পরিবারের গুরুকুলের জন্য প্রদেয় অর্থানুকূল্য থেকে বঞ্চিত না হতে হয়। সমস্ত রাত্রি বিনিদ্র গৌতম ভাবতে থাকেন। একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সহজ নয়। তিনি এও জানেন, গুরু কেবল শলাকা। তিনি শিষ্যের অন্তঃস্থিত জ্ঞানকে কেবল উসকে দিতে পারেন। জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে হয় স্বয়ং ধীর যত্নশীল অধ্যবসায় সহায়ে। সত্যকামের মধ্যে আছে সেই অনন্য তীব্র ইচ্ছা, যা তাকে প্রাণিত করবে সত্যলাভের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর অনুশীলনে, পরীক্ষায় ও আজ্ঞাবহতায়। গৌতম নিশ্চিত। সত্যলাভের পথে অগ্রসর হবে সত্যকাম স্বয়ং।

সকাল হয়েছে। আশ্রমের প্রাত্যহিক কর্ম আরম্ভ হয়েছে। নিত্যকর্মাদির পরে, সকালের বিদ্যানুশীলনের প্রথম অধিবেশনে সমবেত ছাত্রদের সামনেই গৌতম সত্যকামকে ডাকলেন। আগে থেকে গোশালায় নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। সেইমত চারশত রুগ্ন গরু-বাছুর পৃথক ভাবে রাখা হয়েছে। গৌতম সত্যকামকে বললেন, “বাছা! আমার আশ্রমের প্রধান সম্পদ গোধন। বর্তমানে আমার এই গাভীদের পরিচর্যার মত যথেষ্ট সামর্থ্য নেই। দেখ, এই চারশত গোধন দুর্বল, কৃশ। এরা দুধ দিতে পারে না যথোপযুক্ত পরিমাণে কারণ অপুষ্টিতে ভুগছে। আমি এদের না পারছি বিক্রয় করতে, না পারছি পালন করতে। তুমি যদি আমার এই গোধনের পরিচর্যা ও যোগ্য শুশ্রূষা করে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে সহস্রসংখ্যক করতে পার, সেই হবে তোমার যথাযোগ্য গুরুদক্ষিণা!"

সত্যকাম অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে গৌতমের চরণে লুটিয়ে পড়ে বলে, “এ আর এমন বেশি কথা কী আচার্যদেব? আমি আমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করব গো-সেবায়। নিশ্চয় এদের সংখ্যা সহস্র করতে সক্ষম হব! কেবল আপনি আমাকে শিষ্য রূপে গ্রহণ করুন!"

“তোমাকে আমি শিষ্যরূপে গ্রহণ করেছি মানসভাবে ইতিমধ্যেই। তোমার মত অনুগত, সত্যবাদী ও নির্ভীক শিষ্য সকল গুরুর প্রার্থিত," সস্মিত মুখে বলেন গৌতম। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “খানিকটা সমিধ সংগ্রহ করে আনো, তোমার যজ্ঞোপবীত ধারণের আয়োজন করি।" তাঁর কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায় এক অব্যক্ত বেদনা, তারপর বলেন, “উৎফুল্ল হওয়ার আগে আরও কিছু বলবার আছে। তোমার বিদ্যারম্ভ হবে গো-ধন বৃদ্ধি হওয়ার পরেই। তুমি তাতে সম্মত আমি জানি। কিন্তু এই আশ্রমে থেকে তা সম্ভব নয়। চারশত রুগ্ন গরু নিয়ে তোমাকে এখান থেকে দূরে, দূর বনান্তে চলে যেতে হবে। সেখানেই গোচারণ ভূমি খুঁজে নিয়ে তাদের আহার করাবে, যতদিন না তারা সংখ্যায় সহস্র হয়, ততদিন এই আশ্রম অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করবে না, এই আমার আদেশ!"

সত্যলাভের পথে সত্যকাম

সত্যকাম বিস্মিত হয় না। অসন্তোষের ছায়াও খেলে না তার কোমল বদনে। প্রসন্ন মনে সে নতমস্তকে গুরুর আজ্ঞা শিরোধার্য করে যাত্রা করে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের পানে, অজানা পথে। আপাত অসম্ভব এই আদেশও তার অন্তরের দুর্দমনীয় জ্ঞানতৃষ্ণার কাছে সহজসাধ্য বলেই বোধ হয়। অদ্য কিম্বা সহস্রাব্দ অন্তে, আচার্য তাঁকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করবেন, এই আশ্বাসটুকুই তার উৎফুল্ল হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ। যজ্ঞোপবীত ধারণ করে সত্যকাম। তার কটিতে মুঞ্জ ঘাসের শিস দিয়ে তৈরি বেড়ি পরিয়ে দিয়ে গৌতম তাঁকে দ্বিজত্ব দান করলেন, দ্বিতীয় জন্ম হল সত্যকামের, নবীন জন্মের পিতা ঋষি গৌতম। সে এখন থেকে পরিচিত হবে জাবাল সত্যকাম নামে। এই প্রথম কোন ঋষির গুরুকুলে কেবল মাতৃ-পরিচয়ে যজ্ঞোপবীত লাভ করল কোনও বিদ্যার্থী। নিশ্চয় এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনা হয়েছিল সেই দিনটিতে। চারশত রুগ্ন গরু নিয়ে অজানা বনের পথে যাত্রা করেছে সত্যকাম। তার প্রাণে একমাত্র সঙ্কল্প, ব্রহ্মবিদ্যা লাভ, পরম সত্যের জ্ঞান লাভ।

কত বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে সত্যকাম তার সংবাদ রাখে না। সে এখন বলিষ্ঠ এক যুবক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তাকে। বন থেকে বনান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-জনপদে নানা স্থানে তাকে ক্রমাগত ঘুরে বেড়াতে হয় গোচারণ যোগ্য ভূমির সন্ধানে। এক স্থানে দীর্ঘদিন থাকলে গো-ধনের খাদ্যাভাব দেখা দেয়, জমিরও ক্ষতি হয়। তাই স্থান পরিবর্তন করতে হয়। স্থান পরিবর্তনের সময় অবোলা প্রাণিদের জলপানের কথা খেয়াল রেখে নদীতীর সংলগ্ন স্থান নির্বাচন করতে হয়। গাভী ও গোবৎসদের রাত্রিকালীন বিশ্রামের প্রয়োজনে নির্মাণ করতে হয় অস্থায়ী গোশালা। গোশালা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ও গো-শুশ্রূষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয় করতে গঞ্জে ও নগরে যেতে হয়। এই গোধনের সুরক্ষার কোনপ্রকার অভাব যাতে না হয়, তার জন্য দিনে রাত্রে অতন্দ্র প্রহরায় রাখতে হয়। কারণ এই গোধন তার আচার্যদেবের। তাঁর সেই ধন বৃদ্ধি করে তাঁকে প্রত্যার্পণ করতে হবে। সেকথা সত্যকাম বিস্মৃত হবে কী করে? তাই তার নিদ্রাও পরিণত হয়েছে যোগনিদ্রায়। শয়নে স্বপনে তার এক ধ্যান জ্ঞান, গুরুর প্রসন্নতা অর্জন করে ব্রহ্মবিদ্যা লাভ। সত্যকামের মাথার অবহেলিত কেশরাশি এখন জটায় পরিণত। শ্মশ্রু-গুম্ফ শোভিত মুখমণ্ডলে এক অপরূপ দিব্য বিভা। আপন মনে সে ব্রহ্মের স্বরূপ চিন্তনে নিমগ্ন। ‘সত্য’ সম্বন্ধে দিবারাত্রি গভীর মনন ও চিন্তন যেন চকমকি পাথর ঠুকে ঠুকে তার অন্তরের সহজাত প্রজ্ঞার আলোকশিখাটি জ্বলে ওঠবার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে তুলেছে। যে জ্ঞান আলো-হাওয়া-জল-মাটির মত স্বাভাবিক, যে জ্ঞানে আমাদের সহজাত অধিকার, তা জেনেছি বলে বুদ্ধিতে ঘটে তার উদ্ভাস। তখনই জ্ঞানালোকে পূর্ণ হয়ে ওঠে অন্তর, দূর হয় যুগান্ত সঞ্চিত অজ্ঞান অন্ধকার রাশি, যেভাবে তুলোর পাহাড়ে একটি আগুনের ফুলকি ঝরে পড়ে নিমেষেই পুড়িয়ে খাক করে ফেলে পুঞ্জীভূত তুলোর স্তুপ। সেভাবেই একদিন অতি স্বাভাবিক ভাবে, গ্রীষ্মের দাবদাহের অবসানে বর্ষার ধারার মত, কিম্বা রুক্ষ শীতের অবসানে বসন্তের রঙিন প্রাচুর্যের মত সত্যকাম লাভ করল ‘সত্য’। কিন্তু তার এই স্বোপার্জন সম্বন্ধে তার নিজের বোধ জাগ্রত হয়নি। যখনই কেউ একমনা হয়ে, তন্ময় হয়ে একটি ভাব সাধনে একাগ্র হয়, নিবিষ্ট চিত্তে সর্বদা কেবল সেই বিষয়ে ধ্যান করতে থাকে, তখন সমস্ত প্রকৃতি একজোট হয়ে তার বিরোধিতায় লেগে পড়ে, কিন্তু সাধক বা শিল্পী বা বিজ্ঞানী যদি তাতে নিরুদ্যম না হয়ে প্রবল নিষ্ঠা সহকারে সাধনা চালিয়ে যায়, সেই প্রকৃতিই আবার মায়ের মত তার সহায়তায় এগিয়ে আসে। সত্যকামের ক্ষেত্রেও তাই হল। গুরু গৌতম তাকে ঠেলে দিয়েছিলেন কঠোরতার পথে। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধায় সেই কঠিন জীবন হয়ে উঠল সত্যকামের তপশ্চর্যাময় সাধনা। একদিকে কায়িক শ্রম, অপরদিকে জ্ঞানানুসন্ধিৎসু চিত্তে নিরন্তর ধ্যান ও মনন। সত্যকামের অন্তর শুদ্ধ হল, বুদ্ধি বিকশিত হল, জ্ঞানালোক প্রকাশের উপযুক্ত সময় হল সমাসন্ন। তার অজান্তেই কিন্তু গোধন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে সহস্রাধিক। সত্যকামের শ্রদ্ধায় ও তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে অনুগ্রহ করবার উদ্দেশ্যে একদিন ভোরের আলো ফোটার শুভলগ্নে দশ দিকের অধিপতি বায়ুদেবতা একটি বৃহৎ আকৃতির ঋষভ-এর (ষাঁড়) দেহে প্রবিষ্ট হয়ে তার মাধ্যমে সত্যকামকে জানালেন, “আমাদের সংখ্যা সহস্র পূর্ণ হয়েছে!" সত্যকাম বিস্মিত ও আনন্দিত হল। চিত্তে শ্রদ্ধার উদয় হওয়ায় সে সেই বৃষকে শ্রদ্ধাসহকারে প্রণাম জানালো। বৃষ তখন বলল, “তোমাকে আমি ব্রহ্মের (সত্যের) একপাদ বলব!" সত্যকাম বিনীত ভাবে বলল, “বলুন ভগবান!" তখন বৃষ বলল, “হে সৌম্য! পূর্বদিক এক অংশ, পশ্চিম দিক এক অংশ, উত্তর দিক এক অংশ, দক্ষিণ দিক এক অংশ—এই হল ব্রহ্মের ‘প্রকাশবান’ নামে চতুষ্কলাবিশিষ্ট একটি পাদ। যে কেউ ব্রহ্মের এই চতুষ্কল একপাদকে এইভাবে জেনে তাঁকে প্রকাশশীল বলে উপাসনা করেন, তিনি ইহলোকে প্রখ্যাত হন ও পরলোকে প্রকাশবান লোকসমূহ জয় করেন। আমি তোমাকে ব্রহ্মের একপাদ বললাম। আরেক পাদ বলবেন অগ্নিদেব। তুমি এখন গুরুগৃহে যাত্রা কর।" এই বলে বায়ুদেবতা বিদায় নিলেন। সত্যকাম যা শুনল, মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গোধন নিয়ে রওনা হল গৌতম ঋষির আশ্রম অভিমুখে।

জাবাল সত্যকাম

পথে চলতে চলতে সারাটি দিন সে বৃষ রূপধারী বায়ুদেবতার উপদেশ ধ্যান করতে লাগলো। ব্রহ্মের প্রকাশবান স্বরূপ ক্রমে তার হৃদয়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠল। অনেকদূরের পথ। যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এল। বনের প্রান্তে গাভীদের বেঁধে কাঠকুটো সংগ্রহ করে অগ্নি প্রজ্বলিত করে অগ্নির সামনে পূর্বমুখী হয়ে বসল সত্যকাম। নিস্তব্ধ অরণ্যের গভীর অন্ধকারে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল অগ্নি, সেই লেলিহান শিখার সামনে নিঃশব্দ গম্ভীর সত্যবান চিন্তামগ্ন। তার চিন্তারাশি ছিন্ন করে উঠে এল একটি গম্ভীর স্বর—“হে সৌম্য!" সত্যকাম বুঝল, অগ্নিদেবতা তার সঙ্গে ভাব বিনিময় করছেন। সে শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রতিসম্ভাষণ করে বলল, “বলুন ভগবান!" অগ্নিদেব প্রীত হয়ে বললেন, “আমি তোমাকে ব্রহ্মের এক পাদ বলব। পৃথিবী এক অংশ, অন্তরীক্ষ এক অংশ, দ্যুলোক এক অংশ, সমুদ্র এক অংশ। হে সৌম্য, এই হল ব্রহ্মের ‘অনন্তবান’ নামক চতুষ্কল এক পাদ। যে কেউ ব্রহ্মের চতুষ্কল এই পাদকে এইভাবে জেনে তাঁকে ‘অনন্তবান’ বলে উপাসনা করেন, তিনি ইহলোকে অনন্তবান হন এবং পরলোকে অন্তহীন (অক্ষয়) লোকসমূহ জয় করেন।" অগ্নিদেব আরও বললেন, “এটুকুই ব্রহ্মের সম্পূর্ণ জ্ঞান নয়, তোমাকে হংস আরও কিছু বলবেন। তার জন্য প্রতীক্ষা কর।"

প্রতীক্ষা তো সত্যকামের পরম প্রিয় সখা। জন্মের পর থেকেই যে সে প্রতীক্ষা করেছে, অজানাকে জানবার। এই সংসারের অপার রহস্য ও সংসারের পারেও অপরিসীম রহস্যময়তা সদাই তার মনে বাজিয়েছে সন্মোহনী বাঁশি। সেই জানার প্রবল তৃষাই যে তাকে ঘরছাড়া করেছে। তার দুখিনী মায়ের কুটির ছেড়ে, গৌতম ঋষির তপোবন ছেড়ে পথে-প্রান্তরে ছুটিয়েছে। রাত্রিদেবীকে প্রণাম জানায় সত্যকাম। অরণ্য জননীকে প্রণাম জানায়। দশদিকের অধিষ্ঠাতা বায়ুদেবতা, যিনি ঋষভ রূপে এসে তাকে দিয়ে গিয়েছেন ব্রহ্মের এক পাদ জ্ঞান, তাঁর উদ্দেশ্যে, অগ্নিদেবতার উদ্দেশ্যে, গুরু গৌতমের উদ্দেশ্যে এবং তার সত্যাশ্রয়ী বীর-জননী জবালার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সত্যকাম।

পরদিন ভোরে আরম্ভ হয় আবার পথচলা। সারিবদ্ধ সহস্রাধিক গাভীর পুরোভাগে দীর্ঘ যষ্টি হাতে ধীর, সংযত সত্যকাম। আপন অস্তিত্ব সম্বন্ধে সে উদাসীন। তাই সে জানে না, ব্রহ্মের দুটি পাদ সম্পর্কিত জ্ঞানের উন্মেষে তার অন্তরলোক আলোকিত, আর সেই আলোরই ছটা তার চোখেমুখে বিম্বিত। সারাদিন পথ চলে শ্রান্ত পশুদের সঙ্গে শ্রান্ত পশুপালকও। অতঃপর রাত্রির বিশ্রামের জন্য আবার গাভীদের সযত্নে অবরুদ্ধ করে বনের প্রান্তে স্থিত হয় সত্যকাম। সান্ধ্যবন্দনার প্রস্তুতিতে প্রজ্বলিত করে অগ্নি। শান্ত মনে অগ্নিকুণ্ডের পিছনে পূর্বমুখে উপবেশন করে সে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা তার বিস্তীর্ণ পাখা বিস্তার করে অরণ্যকে ঢেকে দিচ্ছে তার ছায়ায়। দূর আকাশের দিকচক্রবালে উড়ে যাচ্ছে হংসশ্রেণি। সেদিকে তাকিয়ে সত্যকাম অগ্নিদেবের কথা স্মরণ করে। দেখতে দেখতেই একটি শুভ্র হংস তীর বেগে নেমে আসে সত্যকামের চোখের সমান্তরালে। সত্যকাম একমনা হয়, নতুন ভাব গ্রহণের জন্য তন্ময় হয়, সমগ্র সত্তা দিয়ে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে হংসরূপী কোনও দেবতার কাছ থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত হবে জেনে। সে উপলব্ধি করে, হংস শুভ্র ও গতিময়, তাই সে জ্যোতির্ময় আদিত্য দেবতার প্রতীক। হংস সত্যকামের বোধে উদ্ভাসিত করে ব্রহ্মের এক পাদ-এর জ্ঞান। হংসরূপী আদিত্য দেব বলেন, “অগ্নি এক অংশ, সূর্য এক অংশ, চন্দ্র এক অংশ, বিদ্যুৎ এক অংশ। এই হল ব্রহ্মের ‘জ্যোতিষ্মান’ নামক চতুষ্কল এক পাদ। যে-কেউ ব্রহ্মের এই চতুষ্কল পাদকে এই ভাবে জেনে তাঁকে ‘জ্যোতিষ্মান’ বলে উপাসনা করেন, তিনি ইহলোকে জ্যোতিষ্মান (দীপ্তিমান) হন এবং পরলোকে ‘জ্যোতিষ্মান’ (সূর্য-চন্দ্রাদি) লোকসকল প্রাপ্ত হন।" সত্যকাম হংসরূপী ভগবানকে প্রণাম জানায়। এই জ্ঞান দান করার পর “মদগু ব্রহ্মের আরেক পাদ বলবেন" একথা বলে হংস উড়ে গেলেন। সত্যকাম হংস কথিত উপদেশ ধ্যান করতে লাগল।

পরদিন ভোর হতেই আবার পথচলা আরম্ভ। গুরুগৃহ খুব বেশি দূর নয় আর। পূর্ব সন্ধ্যার মতই বিশ্রামের উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে সন্ধ্যাবেলা যথারীতি গোবৃন্দ অবরুদ্ধ করে একটি জলাশয়ের কিনারে স্থিত হয়ে অগ্নি প্রজ্বলিত করে সত্যকাম। যখন তার মন পূর্ণ একাগ্র, জলের ভিতর থেকে একটি মদগু (পানকৌড়ি জাতীয় জলচর পাখি) উড়ে আসে সত্যকামের কাছে। সত্যকাম মননে উদ্ভাসিত হয়, জলের অপর নাম জীবন। জল বিনা প্রাণধারণ অসম্ভব। ইহজগতে জলই সকল প্রাণির জীবনস্বরূপ। অতএব জল থেকে আসা এই পাখি অবশ্যই প্রাণের অধিষ্ঠাতা দেবতার প্রতীক হবেন। সে শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রণাম জানালে সেই মদগু বলল, “আমি তোমায় ব্রহ্মের এক পাদ বলব। প্রাণ এক অংশ, চক্ষু এক অংশ, শ্রোত্র এক অংশ, মন এক অংশ—এই হল ব্রহ্মের ‘আয়তনবান’ নামক চতুষ্কল একটি পাদ। কারণ সকল ইন্দ্রিয় দ্বারা যত ভোগ আহৃত হয়, মনই সেইসমস্ত ভোগের আয়তন বা অধিষ্ঠান। তাই মনোরূপ আয়তন যে পাদের কলা, তা আয়তনবান। যে-কেউ ব্রহ্মের এই চতুষ্কল পাদকে এই ভাবে জেনে তাঁকে ‘আয়তনবান’ বলে উপাসনা করেন, তিনি ইহলোকে ‘আয়তনবান’ অর্থাৎ উপযুক্ত আশ্রয়বিশিষ্ট হন এবং পরলোকে বহু পরিসরযুক্ত বা আয়তনযুক্ত লোকসকল জয় করেন।" একথা বলে মদগু পাখিটি উড়ে গেল।

গুরুগৃহে প্রত্যাবর্তন

সত্যকাম সম্পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেন। কিন্তু সেই প্রাপ্ত জ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর অধিকার জন্মায়নি। তাই ‘আমি জেনেছি’ এই বোধে সে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের দীপ্তিতে তার সমস্ত শরীর অনিন্দ্যকান্তিতে ভরে উঠেছে। পরদিন ভোরে যখন সে গো-বৃন্দ নিয়ে গুরুগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে, পথে তাকে দেখে পথচারীরা সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়ে ভাবছে, “এ ব্যক্তি কে? এমন অপরূপ কান্তিময় চেহারা, অপূর্ব সারল্য, যেন এই পৃথিবীর মানুষ না, কোন দেবতা!" দীর্ঘকাল পরে সত্যকাম পৌঁছাল আচার্য গৌতমের তপোবনে। দূর থেকে তাকে দেখেই সমস্ত বিদ্যার্থীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হল। কারণ সেই ছোট্ট ভীরু বালক সত্যকাম, রুগ্ন গাভীগুলি নিয়ে যে আশ্রম থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, সে নয়, ফিরে এসেছে এক তেজস্বী যুবক, সঙ্গে তার সহস্রাধিক পুষ্ট গোধন।

আর জবালার কী হল? তার একমাত্র ছেলে, নয়নের মণি সত্যকাম চলে গেল, তার তো সংসার বলতে আর কিছুই রইল না। একলা ঘরে তার রান্না করতেও ইচ্ছা করে না। খেতেও ভাল লাগে না। কথা বলবারও কেউ নেই। জবালা কী করে? কী নিয়ে থাকে? তাই সে একদিন গুটি গুটি পায়ে ভীতা ত্রস্তা হরিণীর মত এসে দাঁড়ালো গৌতম ঋষির তপোবনের ধারে। সে এসেছে তার সত্যকামের খবর নিতে। এমন আসা যে বেনিয়ম, তা নয়। তবে ছেলে গুরুগৃহে থাকাকালীন বাড়ির লোক খুব দরকার না পড়লে সচরাচর আসে না। তাতে বিদ্যার্থীদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হতে পারে, অভিভাবককে গুরুগৃহের অভাব অসুবিধা সম্পর্কিত নানা অভিযোগ জানানোর কুভাব আসতে পারে। তাই কোন আচার্যই গুরুগৃহে অভিভাবক আসা পছন্দ করেন না। প্রয়োজনে তাঁরা নিজেরাই গিয়ে ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আসেন কিম্বা গৃহে বিশেষ অনুষ্ঠান থাকলে পিতা গুরুর অনুমতি নিয়ে ছেলেকে কিছুদিনের জন্য স্বগৃহে নিয়ে যেতে পারেন। জবালার তো সেসমস্ত বালাই নেই। সে কেবল তার ছেলেটাকে একবারটি দেখে যেতে চায়। ঋষির তপোবনে তার স্থান হয়েছে তো? মায়ের পরিচয়ে সে বিদ্যালাভের সুযোগ পেয়েছে তো? গৌতম জবালাকে ডাকিয়ে এনেছেন নিজের কাছে। সত্যকামের সংগ্রামী মাতাকে দেখবার তাঁরও ইচ্ছা ছিল। শিষ্যকে তিনি সত্যলাভের কঠোর পথে চালিত করেছেন। কিন্তু জবালার প্রতি তিনি এতদূর কঠোর হতে পারেন না। তাই তাকে জানালেন সব কথা। হ্যাঁ, তাঁর মনে হয়েছিল, এই বাস্তববাদী নির্ভীক নারী তাঁর অসুবিধার কথাটি উপলব্ধি করতে পারবে। জবালা সত্যিই বুঝেছে ঋষির সমস্যা। তার স্থির বিশ্বাস, তার সত্যকাম সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফিরে আসবে। ছেলের সংবাদ জেনে নিশ্চিন্তে গমনোদ্যতা জবালাকে গৌতম বলেন, “তুমি আর কোথায় যাবে? এই আশ্রমেই থেকে যাও। এই বিদ্যার্থীদের তোমার সত্যকামের মতই মমতা ও পরিচর্যা দাও আর প্রতীক্ষা কর ব্রহ্মজ্ঞানী পুত্রের দর্শন পাওয়ার।" সেই থেকে জবালা গৌতমের আশ্রমেই তার দৈহিক শ্রম ও মানসিক সাহস ও স্নেহ দিয়ে অগুন্তি জ্ঞানপিপাসু বিদ্যার্থীর সেবা করে চলেছে।

আজ সত্যকাম গুরু গৌতমের সম্মুখে দণ্ডায়মান। চমকিত হলেন গৌতম, “সত্যকাম! বৎস! তোমার মুখে এক ব্রহ্মজ্ঞ-র মতই দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছে! এ কী করে সম্ভব? তুমি কি অন্য গুরু গ্রহণ করেছ?"
সত্যকাম বিনীত ভাবে বলে, “আমি আপনার শিষ্য। অন্য গুরুর কী প্রয়োজন? আমাকে মনুষ্যেতর প্রাণিরা ব্রহ্মের চার পাদ জ্ঞান দান করেছেন;" এই বলে সে কোন কিছু গোপন না করে গুরুদেবকে আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা জানায়। তারপর হাতজোড় করে শ্রদ্ধানত হয়ে প্রার্থনা জানায়, “আমি শুনেছি, গুরুমুখে না শুনলে জ্ঞান অধিগত হয় না। তাই, আমি যাই লাভ করে থাকি না কেন, আপনার কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে চাই!"
সত্যকামের শ্রদ্ধা ও বিনয় গৌতমকে অত্যন্ত প্রসন্ন করে। তিনি পরম প্রীত হয়ে বলেন, “তুমি যা জেনেছ, তা সঠিকই। তবুও আমি তোমাকে সেসমস্ত পুনরায় বলব।" এই বলে গৌতম তাকে ষোল কলা ও চার পাদ সমন্বিত ব্রহ্মবিদ্যা ও তার ফল পুনরায় বর্ণনা করলেন। তখন সত্যকামের ব্রহ্মজ্ঞান সম্পূর্ণ হল। পরে সত্যকাম সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। আচার্যের পরম্পরা অব্যাহত রেখে তিনিও বিদ্যার্থী আশ্রম পরিচালনা করতেন এবং মা জবালা আশ্রমবাসী হয়ে, কৃতি পুত্রের সেবা গ্রহণ করলেন অনেকদিন, তারপর একদিন শান্তিতে প্রাণত্যাগ করলেন। সত্যকাম রচিত উপনিষদ ‘জাবাল উপনিষদ’ নামে প্রসিদ্ধ হল। ভাগবত পুরাণে আমরা ধ্রুব-র উপাখ্যান পাই। মাতা সুনীতির উপদেশে শ্রীহরির আরাধনা করে বালক ধ্রুব নারায়ণের দর্শন পেয়েছিল ও বর লাভ করেছিল। দীর্ঘকাল রাজত্ব করবার পর প্রজাপালক রাজা ধ্রুব অক্ষয় ধ্রুবলোক প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাঁর অনুরোধে তাঁর মা সুনীতিও সেই ধ্রুবলোকে স্থান পেয়েছেন। ধ্রুবতারার পাশে একটি ছোট্ট তারা দেখা যায়, লোকে বলে মা সুনীতি ছেলে ধ্রুবর কাছেই বসে আছেন। জবালার ছেলে সত্যকামও তেজস্বিনী মায়ের শিক্ষায় সাহসী ও সত্যাশ্রয়ী হয়ে গুরুর আশীর্বাদ লাভ করেছিল, প্রাপ্ত হয়েছিল যোগীজনদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান। জাবাল-সত্যকাম নামের সঙ্গে বীরজননী জবালার নামও চিরস্মরণীয়, অমর হয়ে আছে।

(কাহিনী উৎস- ছান্দোগ্য উপনিষদ, চতুর্থ অধ্যায়)

প্রাণীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা; শিক্ষিকা হিসেবে কাজ বিভিন্ন স্কুলে। বর্তমানে একমাত্র নেশা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা। 'উদ্বোধন' (রামকৃষ্ণ মিশনের একমাত্র সাংস্কৃতিক বাংলা মাসিক পত্রিকা) পত্রিকার 'চিরন্তনী' বিভাগের পুরাণ-কাহিনীর নিয়মিত লেখিকা । এছাড়াও রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন এবং বই অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা