সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পিনোকিও পুতুলের গপ্পো

-

আজ থেকে একশো একচল্লিশ বছর আগে, ১৮৮১ সালে, ইতালির Giornale dei bambini (“Children’s Magazine”) পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় Le avventure di Pinocchio: storia di un burattino (“The Adventures of Pinocchio: The Story of a Puppet”) - এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব। লেখকের নাম কার্লো কোলোদি (Carlo Collodi)। গল্পটা ছিল ' পিনোকিও' নামের এক 'ম্যারিওনেট' বা পুতুল নাচের জন্য সুতোয় নিয়ন্ত্রিত পুতুলের সম্পর্কে। ১৮৮৩ সালে পিনোকিওর নানা অভিযান গুলি এক সঙ্গে সংকলিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়।

একলা ছুতোর জেপেত্তো পাইন কাঠ কেটেকুটে একটা ছেলে পুতুল বানায়, তার নাম দেয় পিনোকিও । বানানোর ধাপেধাপে পিনোকিওর চোখ, মুখ, হাত পা সব সচল হয়ে ওঠে। দেখা গেল পিনোকিও আসলে এক বেজায় দুষ্টু পুতুল যে তার 'বাবা' জেপেত্তোর কথা শুনে চলতে একবারেই রাজি নয়। এরপরে নানা রকম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পিনোকিওর মধ্যে পরিবর্তন আসে। সে দুষ্টুমি করা, মিথ্যা কথা বলা কমিয়ে দেয়; সত্যবাদী, সাহসী এবং নিঃস্বার্থ হয়। এবং গল্পের শেষে, পিনোকিও এবং জেপেত্তোর মনের ইচ্ছা পূরণ হয়ে পিনোকিও আর পুতুল থাকে না, একটা সত্যিকারের ছেলেতে পরিণত হয়।

ছোটোদের জন্য লেখা এই ক্লাসিক গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়, ১৯৪০ সালে ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি তৈরি করে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড ছবি 'পিনোকিও'। আর ২০২২ সালে , সেই একই গল্পকে নতুন করে লাইভ-অ্যাকশন মুভি রূপে আবারও নির্মাণ করেছে ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিওজ । ১৯৪০ সালের অ্যানিমেটেড ছবিটিকে অবশ্য হুবহু নকল করা হয়নি। তার বদলে, সময়ে প্রয়োজনে কিছু কিছু সংলাপে এবং চরিত্রে বদল আনা হয়েছে, যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু চরিত্র।

'লাইভ অ্যাকশন মুভি' বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে সেই সব ছবি যেখানে অ্যানিমেটেড চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সত্যি অভিনেতারাও অভিনয় করেন। ২০২২ সালে সদ্য মুক্তি পাওয়া ডিজনির 'পিনোকিও'-তে তাই সমস্ত 'মানুষ' চরিত্রগুলিতে অভিনয় করেছেন সত্যি অভিনেতারাই —জেপেত্তো, ঘড়ির ক্রেতা, নীল পরি, স্কুলের মাস্টারমশাই, স্ত্রম্বোলি, ফ্যাবিয়ানা, ঘোড়াগাড়ির চালক , ল্যাম্পউইক নামের দুষ্টু ছেলেটার চরিত্রায়নে রয়েছেন হলিউডের নামী-দামি শিল্পীরা। আর পিনোকিও, তার 'বিবেক' জিমিনি ক্রিকেট, 'হনেস্ট জন' নামের খারাপ শেয়াল আর তার চ্যালা গিডিয়ন নামের বিড়াল, সোফিয়া নামের সীগাল ... এইসব চরিত্রগুলি অ্যানিমেটেড এবং এদের ভয়েস ওভার দিয়েছেন জনপ্রিয় শিল্পীরা। জেপেত্তোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস (Tom Hanks) । আর 'পরি' যদিও মানুষ নয় সেই অর্থে, তবুও নীল পরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিন্থিয়া এরিভো (Cynthia Erivo)। অন্যদিকে পিনোকিওর চরিত্রে ভয়েস ওভার দিয়েছেন জনপ্রিয় ব্রিটিশ কিশোর অভিনেতা বেঞ্জামিন ইভান এইন্‌স্‌ওয়ার্থ (Benjamin Ivan Ainsworth) আর জিমিনি ক্রিকেটকে জীবন দিয়েছেন জোসেফ গর্ডন লেভিট (Joseph Gordon-Levitt)।

'পিনোকিও'-এর এই সংস্করণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রখ্যাত নির্মাতা-নির্দেশক রবার্ট জেমেকিস Robert Zemeckis)। সহ নির্মা ক্রিস ওয়েইতজ্‌ (Chris Weitz) - এর সঙ্গে এই ছবির স্ক্রিপ্ট ও লিখেছেন তিনি। গত সেপ্টেম্বর মাসে ডিজনির নিজস্ব ও টি টি প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ পাওয়া এই ছবিটি দেখে কারোর কারোর ভালো লেগেছে, কারোর কারোর ভালো লাগেনি। কেউ কেউ একে ১৯৪০ এর অ্যানিমেশন ছবিটির থেকে বেশি ভালো বা বেশি খারাপ বলেছেন। আমার দেখে মনে হয়েছে, সব মিলিয়ে ছবিটি মন্দ হয়নি। ছবিটির কিছু কিছু জায়গা হয়ত আমার মনোমত হয়নি, কিন্তু বেশ কিছু জায়গা খুব মনোমত হয়েছে।

পিনোকিও পুতুলের গপ্পো

প্রথম যে বিষয়টা ভালো লেগেছে সেটা হল নীল পরির চরিত্রায়ন। এই ছবিতে নীল পরি একজন কালো মহিলা, যার মাথায় লম্বা চুল ও নেই। পুরনো অ্যানিমেশনের সঙ্গে তুলনা করে দেখলাম, সেখানে নীল পরি ছিল ফর্সা, তার নীল চোখ, মাথায় সোনালি চুল। নতুন সংস্করণে নীল পরির এই নতুন চেহারা আমার খুব ভালো লেগেছে। কোথায় বলতো লেখা আছে যে পরিরা সবসময়ে ফর্সা আর সোনালি চুলের মেয়ে হবে?

তেমনি পছন্দ হয়েছে বদমেজাজি পুতুলনাচওয়ালা স্ত্রম্বোলির সঙ্গে কাজ করা নতুন চরিত্র পঙ্গু মেয়ে ফ্যাবিয়ানাকে। সে 'সাবিনা' নামের এক সুন্দরী পুতুলকে নাচাতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় সে 'ভেন্ট্রিলোকুইজম' -এও দক্ষ। ফ্যাবিয়ানা স্ত্রম্বোলির সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু এই ছবি প্রায় শেষে এসে আমরা দেখি, সে নিজের পুতুলনাচের আলাদা ব্যবসা খুলে ফেলতে পেরেছে। অর্ধেক গাধা হয়ে যাওয়া — গাধার মত কান আর ল্যাজ যুক্ত — পিনোকিওকে সে নিজের দলের সঙ্গে নিয়েও যেতে চায়। ফ্যাবিয়ানা নামের এই জেদী, স্বাবলম্বী মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

জিমিনি ক্রিকেট, মানে জিমিনি নামের ঝিঁঝিপোকাটি নীল পরির বরে পিনোকিওর 'বিবেক' হওয়ার কাজ পায়। তবে পিনোকিও প্রথমদিকে তার কথা শুনতেই চায় না, ঠিক যেমন ছোট্ট ছেলেরা আর মেয়েরা বাবা-মায়েদের কথা শুনতে চায় না, কোনো কাজ ভুল হচ্ছে জেনেও সেটা করতে চলে যায়। কিন্তু গল্পের মাঝামাঝি এসে পিনোকিও বুঝতে পারে সে কী ভুল করেছিল। স্ত্রম্বোলির খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে পালাতে পালাতে পিনোকিও জিমিনিকে জানায় - খুব ভালো কয়েকজনের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, তারা তাকে সাহায্য ও করেছে, যদিও সেটা তারা নাও করতে পারত। জিমিনি তাকে জানায়- বন্ধুরা এমনই হয়। তারপর পিনোকিও তাকে সাবিনার কথা জানায়, যে নিজেও একজন পুতুল। এই কথা শুনে জিমিনি বলে, সাবিনা হল পিনোকিওর 'peer'। পিনোকিও জানতে চায়, peer-রা কি বন্ধু হয়? জিমিনি তাকে জানায় ... ' not all the times... you've got to be careful, because sometimes when peers get in a group, they like to pressurise...' আধুনিক জীবনে, ছোটদের মধ্যেও 'peer pressure' শব্দটা পরিচিত হয়ে গেছে। জিমিনির এই সহজভাবে নতুন বিষয়টা বোঝানো বেশ আলাদা রকমের।

'Peer pressure' ঠিক কী, সেটা বোঝার জন্যই পিনোকিওকে গিয়ে পড়তে হয় প্লেজার আইল্যান্ড বা ফূর্তির দ্বীপে। তার নতুন বন্ধু ল্যাম্পউইক তাকে জানায়, সেখানে কেউ বকার নেই, কোনো শাসন করার নেই, শুধু খাও দাও, ফূর্তি করো, যা ইচ্ছে ভেঙে চুরে ফেলো,কেউ কিছু বলবে না। চারদিকে অতি দুষ্টু সব বাচ্চাদের দেখতে দেখতে পিনোকিও থত্মত খেয়ে গেলে ল্যাম্পউইক তাকে নিয়ে মজাও করে। সত্যি কথা বলতে গেলে, এই প্লেজার আইল্যান্ড-এ গিয়ে দুষ্টু বাচ্চাদের দুষ্টুমি দেখতে দেখতে আমি নিজেই খুব বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটু পরেই বোঝা গেল, দুষ্টুমি আর শুধু ফূর্তি করার লোভের ফলে আসলে কী শাস্তি পেতে হতে পারে! সেই শাস্তি কীরকম ছিল, সেটা জানতে হলে নিজে এই ছবিটা দেখে নেওয়া দরকার।

পিনোকিওর মূল গল্প যখন লেখা হয়েছিল, তখনও এর লক্ষ্য ছিল দুষ্টু বাচ্চাদের নীতিকথা শেখানো — অবাধ্য হলে কী শাস্তি হবে, মিথ্যা কথা কেন বলা উচিত নয়, বাধ্য বাচ্চা কেন হওয়া উচিত ইত্যাদি। সেই প্রথম গল্পে এবং ১৯৪০ এর অ্যানিমেটের ছবিতে আমরা দেখি, পিনোকিও মিথ্যা কথা বললেই তার নাক লম্বা হয়ে যায়। আবার মিথ্যা বলেছে স্বীকার করে নিলে সেটা আগের অবস্থায় ফিরে আসে। নীল পরি তাকে বুঝিয়ে বলে, মিথ্যে একবার বললে, সেটাকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য আরও আরও মিথ্যা বলতে হয়। তবে প্রায় দেড়শো বছর আগের ছোটদের সঙ্গে এই সময়ের ছোটোদের তো অনেক তফাৎ। তাই ২০২২ এর পিনোকিও আর তার বিবেক জিমিনি নিজেরাই বুঝে যায় যে তার নাক লম্বা হওয়ার সঙ্গে মিথ্যা বলার সম্পর্ক আছে। জিমিনি তাকে বোঝায় — মিথ্যা কথা কিন্তু একজন মানুষকে পাল্টে দেয়... তোমার বাইরেটা কেমন সেটা নিয়ে তুমি আসলে কেমন তার বিচার হয়না।

পিনোকিও পুতুলের গপ্পো

নতুন লাইভ অ্যাকশন মুভি 'পিনোকিও'-এর শেষে পিনোকিও পুরোপুরি 'মানুষ' হল কিনা সে নিয়ে অল্প ধন্ধ থেকে যায়। যদিও একেবারে শেষ দৃশ্যে, দর্শকের দিক থেকে পেছন ফিরে হেঁটে চলা পিনোকিওর হাত-পা বদলে যেতে থাকে, তবুও জিমিনি গলায় আমরা শুনতে পাই,'... নিজেকে সাহসী, সৎ আর নিঃস্বার্থ প্রমাণ করার পরে... কেউ কেউ বলে পিনোকিও নাকি সত্যি মানুষ হয়ে গেছিল। সেটা আদৌ হয়েছিল কি না কে জানে! তবে আমি জানি, পিনোকিওর আসলে ছিল একেবারে সত্যিকারের ছেলের মত সত্যি ...in his heart Pinocchio is as real as any real boy could ever be...' । সবের শেষে যেটা মনে থেকে যায়, সেটা এই যে তুমি যদি সত্যিই ভালো মনের চরিত্র হও, সৎ ও সাহসী হও, তাহলে তুমিও নিজের প্রাপ্য ভালোবাসা এবং মর্যাদা পাবে। মাঝেমধ্যে ভুল করে মিথ্যা কথা বলে ফেললে কী হতে পারে সে তো জানাই আছে।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, 'পিনোকিও'র এই গল্পকে আমরা একটু অন্যভাবেও দেখতে পারি। এমনও তো হতে পারে, যে তার আড়ষ্ট হাত পা নিয়ে, তার সারল্য নিয়ে, কাঠের পুতুল পিনোকিও আসলে বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের প্রতীক — জেপেত্তো তাকে সৃষ্টি করে ঠিক যেমন যেকোনো মা-এবং বাবা মিলে সন্তানের জন্ম দেন। জেপেত্তো তাকে স্কুলে পাঠাতে চায়, কিন্তু পিনোকিওকে শুধুমাত্র পুতুল বলে সেই স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, ঠিক যেমন আজও আমাদের সব স্কুল বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য প্রস্তুত নয়। সে পুতুল কিন্তু নিজে নিজে চলেফিরে বেড়াতে সক্ষম — তার এই বিশেষ সক্ষমতাকে লোকের সামনে প্রদর্শন করে অন্যায়ভাবে টাকা রোজগার করতে চায় স্ত্রম্বোলি। এমন ভাবে দেখলে হয়ত 'পিনোকিও' কে আমরা আমাদের চেনা অনেক মানুষের সঙ্গে মেলাতে পারব, এবং সেইসব মানুষের বাইরেটা কেমন সেদিকে মন না দিয়ে তার মনের ভেতরের ভালোটুকু চিনতে চেষ্টা করব।

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা