সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

উত্তর আটলাণ্টিক মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ হলো অ্যাজোরেস। পর্তুগালের অন্তর্গত এই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানান উপকথা, লোককথা, তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য। এখানকার কিছু লোককথায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টির কাহিনি পাওয়া যায়।

অ্যাজোরীয় লোককথায় বলা হয়, আটলাণ্টিস পর্বত সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার আগে অ্যাজোরেস দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত ছিল এই পর্বতের ওপরেই। এই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দ্বীপ সাও মিগুয়েলের পাশাপাশি দুটি হ্রদ 'লেগুন অফ দ্য সেভেন সিটিজ' কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, এবং আটলাণ্টিস কীভাবে ধ্বংস হয়েছিল, সেই নিয়ে রয়েছে একটি লোককথা। চলো আজ সেই গল্পই শুনি।

অনেক অনেকদিন আগে আটলাণ্টিস নামে এক রাজ্যে বারিদবরণ  নামে এক রাজা ছিলেন, আর কুন্দশুভ্রা  নামে এক রানি। তাঁরা দুজনেই ভারি ভালো মানুষ, রাজামশাইকে যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই বীর তিনি, সেইসঙ্গে রাজ্যের প্রজাদেরও খুব ভালোবাসতেন। রানিমাও রূপে গুণে অতুলনীয়া, তেমনি মিষ্টি তাঁর স্বভাব। দয়ামায়া দিয়ে প্রজাদের ভরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এমন সুন্দর রাজ্যের এমন ভালো রাজা রানি, তাঁদের অমন চোখজুড়োনো রাজপ্রাসাদ, কিন্তু হলে হবে কি, রাজারানির মনে একটুকু সুখ নেই। তাঁদের যে অত্ত বড় সাজানো গোছানো রাজপ্রাসাদ, সেখানে কোনও ছোট্ট বাচ্চার হাসির আওয়াজ শোনা যায় না, রাজবাড়ির বাগানে কেউ হুটোপাটি করে খেলে না। রাজারানির কোনও ছেলেমেয়ে নেই যে! এইটে তাঁদের মস্ত এক দুঃখের কারণ। রাজামশাই ভেবে অস্থির হন, তাঁর পরে রাজ্যের সিংহাসনে কে বসবে, সেই দুশ্চিন্তায় তাঁর অমন সুন্দর চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়ে তাঁকে কেমন খিটখিটে ধরনের দেখতে হয়ে যেতে লাগলো। স্বভাবেও হয়ে উঠলেন বেজায় খিটখিটে, বদমেজাজি। প্রজাদের ওপর নানান অত্যাচার করতে লাগলেন। প্রজারা অবশ্য তাঁকে খুব ভালবাসতো, তাই তাঁরা রাজামশাইয়ের জন্য প্রার্থনা শুরু করলেন। কিন্তু কোনও লাভ হলো না। ছেলেপুলে নেই বলে সেই দুঃখে রানিমাও দিনে দিনে আরও বিষণ্ণ হয়ে যেতে লাগলেন। দিনরাত কেবল কাঁদেন আর মন খারাপ করেন।

রাজবাড়ির বাগানটা ছিল খুব সুন্দর। গাছে গাছে হরেকরকম ফুল ফুটে আছে, পাখিরা এসে গান গাইছে, সব মিলিয়ে ভারি আরাম হয় সেখানে গেলে। রাজামশাই আর রানিমার মন খুব খারাপ থাকলে তাঁরা মাঝেমধ্যে সেই বাগানে গিয়ে বসতেন। এরকমই একদিন, দুজনে বাগানে বসে আছেন, এমন সময় আকাশে একটা তারা অন্যগুলোর তুলনায় উজ্জ্বল হয়ে ঝিকমিক করতে করতে আস্তে আস্তে তাঁদের কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। তাঁরা তো এসব দেখে হকচকিয়ে গিয়ে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে রইলেন।
"ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। আমি 'জ্যোতি', তোমাদের আর রাজ্যের প্রজাদের প্রার্থনা শুনে তোমাদের কষ্ট দূর করতে এসেছি। যদি তোমরা আমার কথা শুনে চলো, তবে তোমাদের কোলে একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে আসবে।"

একথা শুনে তো রাজামশাই আর রানিমা খুব খুশি! 'জ্যোতি' বলে চললেন,
"রাজা, তুমি তোমার প্রজাদের ওপর অন্যায় অত্যাচার করছো, তাদের প্রতি অবিচার করছো, তাই তোমায় তার শাস্তি হিসেবে কিছু পরীক্ষা দিতে হবে। তোমাদের মেয়ের জন্মের কয়েকদিন পরে আমি এসে তোমাদের মেয়েকে নিয়ে চলে যাবো। ওর জন্য আটলাণ্টিসের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় সাতটি নগর তৈরি করব। মহামূল্যবান রত্ন আর ধাতু দিয়ে গড়া সেই সাতটি নগরে থেকে আমার কাছে খুব যত্নে বড় হবে তোমাদের মেয়ে। সেই সাতনগর ঘেরা থাকবে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে। ওর যেদিন কুড়ি বছর বয়স হবে, সেদিন সেই প্রাচীর খসে পড়বে, তোমরা সেদিন সাতনগরে প্রবেশ করে তোমাদের মেয়েকে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু মনে রেখো, তার আগে জোর করে সেখানে ঢোকার চেষ্টা করলে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়, তোমাদের প্রিয় রাজ্য আটলাণ্টিস ধ্বংস হয়ে যাবে, ডুবে যাবে সমুদ্রের তলায়। ভেবে বলো কী করবে? যদি তোমরা আমার প্রস্তাবে রাজি থাকো, তবে আমার কাছে শপথ নাও এই বলে যে তোমরা সব শর্ত বুঝতে পেরেছ।

রাজামশাই আর রানিমা জানালেন তাঁরা সব শর্ত মেনে চলবেন। তাঁরা শপথ নেওয়ার পরে উজ্জ্বল আলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।

এর কিছুদিন পর রানিমার কোল আলো করে জন্ম নিলো এক ছোট্ট মেয়ে, রাজকন্যা নীলশাঁওলি । সারা রাজ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। তার জন্মের কয়েকদিন পরেই 'জ্যোতি' এসে রাজকন্যাকে নিয়ে চলে গেলেন তাঁর গড়া সেই সাতনগরের রাজপুরীতে। রাজামশাই আর রানিমার তো বেজায় মন খারাপ হলো, কিন্তু কিছু করার নেই, শর্ত মানতেই হবে।

'জ্যোতি' মাঝেমধ্যে এসে নীলশাঁওলির গল্প শুনিয়ে যান। একদিন তিনি বললেন রাজকন্যা নাকি একটা নীল জুতো আর সবুজ ছাতা সঙ্গে নিয়ে দারুণ খোশমেজাজে রয়েছেন। সেই শুনে রাজারানির আনন্দ হলো খুব। রাজকন্যার এরকম ছোট্ট ছোট্ট গল্প শুনে তাঁদের দিন কাটে, কিন্তু মন ভরে না। কেবলই তাঁদের মনে হয়, কুড়ি বছর হতে এখনও অনেক দেরি। তাঁদের যে বয়স বাড়ছে! কত দেরি আর তাঁদের মেয়ের সঙ্গে দেখা হতে? বিশেষ করে রাজামশাই বেশি অস্থির হন। তাঁর যত বয়স বাড়ে, তিনি চিন্তায় চিন্তায় আরও বদমেজাজি, আরও অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। রানিমা তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করতে পারেন না কিছুতেই।

দেখতে দেখতে রাজকন্যার আঠেরো বছরের জন্মদিন চলে এলো। রাজামশাই আরও অস্থির হয়ে উঠলেন।
"আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না রানি। আর কবে আমাদের মেয়েটাকে কাছে পাবো? আমি আজই যাবো, নিয়ে আসব ওকে।"
"না মহারাজ, একাজ কোরো না, এ অন্যায়। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলা অপরাধ। আর তো মাত্র দুটো বছর, চোখের নিমেষে কেটে যাবে। তারপরেই আমরা আমাদের মেয়েকে কাছে পাবো!"
"শেষ দু'বছরই যে কাটতে চাইবে না রানি! আমি আর পারছি না। ও আমার মেয়ে, ওকে আমার থেকে কেউ আলাদা করে রাখতে পারবে না। আমি এক্ষুনি যাবো, নিয়ে আসব ওকে।"

রানিমার বারণ না শুনে রাজামশাই তাঁর সেনাপতিদের ডেকে যুদ্ধযাত্রার জন্য তৈরি হতে নির্দেশ দিলেন। সেনাপতিরাও তাঁকে বোঝালেন এই আক্রমণ অন্যায়, অন্যায্য। কিন্তু রাজামশাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যাবেনই। অগত্যা সৈন্যদল প্রস্তুত হলো, রাজার নেতৃত্বে সেনাবাহিনী রওনা হলো সাতনগরের উদ্দেশ্যে। পথে নানান বাধাবিপত্তি আসতে লাগলো, যেন তাঁদের যাত্রায় বাধা দেবে বলেই! রাজার সেনাদল সেসব বাধা সরিয়ে অবশেষে এসে দাঁড়ালো সাতনগরের সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সামনে। আকাশে তখন মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, মুহুর্মুহু বজ্রপাত, প্রকৃতিতে যেন কোনও এক অঘটনের পূর্বাভাস।

রাজা তাঁর সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন সাতনগরের প্রবেশদ্বারে আঘাত হানতে। পায়ের নিচে মাটি কাঁপতে লাগলো, রাজার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। রাজকন্যা নীলশাঁওলির চিন্তায় তিনি বিভোর তখন। নিজের মেয়েকে দেখতে পাওয়ার ইচ্ছে তখন তাঁর এতটাই প্রবল, তিনি নিজেই খোলা তরোয়াল নিয়ে এগিয়ে গেলেন প্রবেশদ্বারের দিকে, বন্ধ দরজায় আঘাত করলেন সর্বশক্তি দিয়ে। যে মুহূর্তে তরোয়াল দরজা ছুঁলো, ভয়ানক বজ্রপাত ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল, সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল রাজা আর তাঁর সেনাবাহিনীর ওপরে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের নিচে ডুবে গেল সাজানো রাজ্য আটলাণ্টিস। 'জ্যোতি'র কাছে করা প্রতিজ্ঞা রাজা ভেঙেছেন, এই অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ নিজের প্রজা আর সেনাবাহিনীসহ নিহত হলেন রাজা বারিদবরণ। সবশেষে সমুদ্র শান্ত হলো, প্রকৃতি শান্ত হলো।

অ্যাজোরীয় লোককথা অনুযায়ী, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে আটলাণ্টিস সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার পর, জলের ওপরে জেগে ছিল কেবল নয়টি দ্বীপ। সেগুলোকেই একসঙ্গে অ্যাজোরেস নাম দেওয়া হয়েছে। সাও মিগুয়েল দ্বীপে একটা অদ্ভুত সুন্দর জায়গা রয়েছে, সাতনগরের হ্রদ (Lagoa das Sete Cidades, or The Lagoon of the Seven Cities)। পাশাপাশি দুটি হ্রদ, একটির জলের রং নীল, আরেকটির রং সবুজ। কিংবদন্তী অনুসারে, রাজকন্যা নীলশাঁওলি যেখানে তার নীল জুতো খুলে রেখেছিল সেই হ্রদের রং নীল, আর যেখানে সে তার সবুজ ছাতা রেখেছিল, সেই হ্রদের রং হয়েছে সবুজ।

অ্যাজোরেসের বাসিন্দারা মনে করেন আজও নাকি কোনও কোনও দিন দেখা যায়, হ্রদের ওপরে রাজকন্যা নীলশাঁওলি তাঁর নীল জুতো পায়ে, আর সবুজ ছাতা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ছবিঃ দেবিকা সারাওগি

ভৌগলিক তথ্যঃ Lagoa das Sete Cidades/Lagoon of the Seven Cities/ সাতনগরের হ্রদ, আসলে একটা বড় হ্রদ। এই হ্রদের মাঝখানে রয়েছে একটা ছোট জলপ্রণালী,যেটাকে আজকের দিনে একটা সেতুর মাধ্যমে পারাপার করা যায়। এই হ্রদের মধ্যে বড়টি হ্রদটি অনেক বেশি গভীর , এবং আকাশের নীল রঙকে প্রতিফলিত করে, তাই এর জলের রঙ দেখায় নীল। অন্য হ্রদটি তুলনামূলকভাবে অনেক অগভীর, তার এর জলে আশেপাশের বনভূমি এবং জলের নীচে জমে থাকা জলদ উদ্ভদ,অ্যাল্‌গি ইত্যাদির রংপ্রতিফলিত হয়ে সবুজ রঙ দেখায়।এই জোড়া হ্রদ দুটি একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে জল জমে তৈরি। এই জোড়া হ্রদ অ্যাজোরেসের সবথেকে বড় মিঠে জলের আধার। তোমার জন্য রইল নীল হ্রদ আর সবুজ হ্রদ নিয়ে একটি ভিডিও, দেখো তো রাজকন্যা নীলশাঁওলিরকে দেখতে পাও কি না !

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা