সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

'টিন এজ'। শব্দটা চেনা লাগছে কি? বাংলায় যাকে বলে কৈশোর। মোটামুটি ক্লাস ফাইভ সিক্স থেকে শুরু হয় আমাদের কৈশোর, চলে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢোকার মুখ অব্দি, বা কলেজে ঢুকে আরো বছরখানেক। এই টিন এজ শুরু হতে না হতেই রোজকার দিনগুলোয় শুরু হয়ে যায় নানারকমের ছোটখাটো সমস্যা। তুমি যদি একজন টিনএজার হও, তাহলে দিব্যি টের পাবে যে শুনতে 'ছোটখাটো' হলেও সমস্যাগুলো যে আদৌ হাল্কা নয়।
ধরো, ক্লাসের আর পাঁচটা ছেলের গোঁফের হাল্কা রেখা দেখা দিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো, কারও কারও তো ইতিমধ্যেই ছেলেবেলার রিনরিনে কচি কণ্ঠস্বর বদলে যাচ্ছে গম্ভীর ভারিক্কি কণ্ঠস্বরে। কিন্তু তোমার মুখের কোত্থাও দাড়িগোঁফের আভাস অব্দি নেই, মুখ খুললেই সেই বরাবরের চেনা বাচ্চা ছেলেটার গলার আওয়াজই কানে আসছে। ক্লাসের বন্ধুদের মজা টিটকিরি আর কিছুতেই নেওয়া যাচ্ছে না, বিরক্ত লাগছে নিজেকেই।

আবার ধরো, তুমি একটি টিনএজার মেয়ে। তোমার জীবনে শুরু হয়েছে নতুন এক উপদ্রব, যার পোশাকি নাম 'মেনস্ট্রুয়েশন সাইকেল', চলতি কথায় 'পিরিয়ডস'। জীবনচক্রের অপরিহার্য এক অধ্যায়, কিন্তু বড্ড বিরক্তিকর! প্রতিমাসে রক্তক্ষরণ তো বটেই, তার সঙ্গে পেটব্যথা, মুড অফ ইত্যাদি।
দাড়িগোঁফ বেরনো হোক বা পিরিয়ডস, সবই যে আসলে হরমোনের কলকাঠি নাড়া, এসবই যে বড় হওয়ার দিকে আরেকধাপ এগিয়ে যাওয়া, তা হয়তো এতদিনে সিলেবাসের বইয়ে পড়ে ফেলেছ। তবু, এই 'বড় হওয়ার দিকে এগোনো' ব্যাপারটা আরও কনফিউশন এনে ফেলছে।

ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবাইকেই ঘরে বাইরে পড়তে হচ্ছে এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে। বাড়ির বড়দের আলোচনার মাঝে যদি নিজের মতামত জানাও, কিংবা বড়দের সিদ্ধান্তের উত্তরে তোমার ভিন্ন মত জানাও, তবে হয়তো তোমায় শুনতে হবে, "বড়দের কথার মধ্যে কথা বলছ, এত সাহস হয় কী করে?"
আবার যদি একদিন পড়ার সময় খেলতে ইচ্ছে করে, বা রাতে বাইরে খেতে যাওয়ার জন্য বায়না করো বাড়িতে, তখন শুনতে হবে, "তুমি কি এখনও ছোট আছ নাকি যে বাচ্চাদের মতো বায়না জুড়েছ?"

এ এক অদ্ভুত সময়। ছোটবেলা পেরিয়ে এসে আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠার সময়। আমাদের প্রত্যেককেই এই সময়টা পেরোতে হয়, আমিও পেরিয়েছি। প্রতিটি কাজেই এই বয়েসটায় দোলাচলে ভুগতে হয়, তাই না? বড়দের মতো করে সাজগোজ করতে ইচ্ছে করে, ট্রেনে-বাসে বা বিয়েবাড়িতে মনে হয় ওই ছেলেটা বা ওই মেয়েটা আরেকবার ঘুরে আমায় দেখুক না! শিশুসাহিত্য সরিয়ে রেখে পড়তে বেশি করে ইচ্ছে করে মায়ের বারণ করে দেওয়া 'বড়দের বই'গুলোই। নেট সার্ফিং-এর সময় ঢুকতে ইচ্ছে করে সেই সাইটগুলোয় যেখানে আঠারো বছরের কম বয়েসের মানুষজনের ঢোকা নিষেধ। এককথায়, যা যা করা বারণ, সবই করে দেখার ইচ্ছে হয় এই বয়সে।

আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করবে, মানে আমি আমার টিনএজে এটা অনুভব করেছি, যে, ওই বয়েসের এইসব সমস্যাগুলোর কথা ঠিক সেভাবে খুব কম বইয়ে থাকে। বাংলা কিশোরসাহিত্যে সেভাবে আমি অন্তত পাইনি। বা, থাকলেও তা আসে বড়দের লেখায় কৈশোরের স্মৃতিচারণ হিসেবে। টিনএজে যেসব কথা স্কুলের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া আর কাউকে বলা যায় না, সেসব কথা নিয়ে টিনএজারদের জন্য গল্প উপন্যাস কি একেবারেই হয় না?

এসব কথা যখন মনে ঘুরতো, আর হাতের কাছে বই পেলেই যখন পড়ে ফেলতাম সে বই ছোটদের না বড়দের সেব্যাপারে বাছবিচার না করে, সেরকম সময়েই, আনন্দমেলা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সমরেশ মজুমদারের লেখা উপন্যাস 'কেউ বোঝে না'। উপন্যাসের প্রতিটি পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। সেই প্রথমবার মনে হয়েছিল, হ্যাঁ, টিনএজের এইসব সমস্যাগুলোকে তাহলে আমাদের মতো করেই লেখায় ফুটিয়ে তোলা যায়! গতবছর হঠাৎই পেয়ে যাই উপন্যাসটিকে, বই আকারে। আমার টিনএজের অত্যন্ত ভালো লাগার একটা বইয়ের গল্প এখনকার টিনএজারদের কাছে করতে খুব ইচ্ছে করল।

কী আছে 'কেউ বোঝে না'-তে? আছে অমৃত বলে একটা ছেলের গল্প। সে ক্লাস সেভেনে পড়ে, উচ্চমানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তার বাবা মা দুজনেই অফিস যান, বাড়িতে থাকেন যমুনাদি। অমৃতরা থাকে সুরক্ষিত একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে। তার মা সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকলেও অমৃতের সারাক্ষণের গতিবিধি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন, কড়া শাসন আর বারণের গণ্ডিতে বাঁধা থাকে অমৃত। তবু, ক্লাস সেভেন, টিনএজ শুরু, কাজেই গণ্ডি ভেঙে বেরোতে ইচ্ছে তো করেই। তার চেষ্টাও চলে টুকটাক।

 ও হ্যাঁ, অমৃত কখনও ধানগাছ দেখেনি। তাই একদিন তার বাবা তাকে ধানগাছ দেখাতে নিয়ে যান কলকাতার বাইরে। সেখানে তারা পৌঁছোয় বাবার মামারবাড়িতে, আর অমৃত তার চেনা বাবার মধ্যে আরেকটা মানুষকে খুঁজে পায়। বাবার যে রূপটা রোজকার দায়িত্ব আর কর্তব্যপালনের ভারে চাপা পড়ে থাকে, সেই রূপটা হঠাৎ এক ছুটির দিনে দেখে ফেলে অমৃত।

টিনএজার অমৃত, আর ওর ক্লাসমেটরা প্রতিনিয়ত ভুগতে থাকে 'বড় হওয়ার দিকে এগোনো'র দোলাচলে। নিষেধের গণ্ডি ভাঙতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে একটা 'বড়দের' ঘটনায়। ঝামেলা কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে ওরা আবিষ্কার করে, ওদের কেউ বোঝে না ঠিকই, কিন্তু ওদের ওরা বোঝে। একরকম বলা যায়, বন্ধুত্বের একটা নতুন অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় অমৃত আর ওর বন্ধুদের গল্প 'কেউ বোঝে না'।

উপন্যাসটি অমৃতের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হলেও মেয়েদের কথাও রয়েছে এখানে। অমৃত ছাড়া গল্পে আছে ওর স্কুলের বন্ধু শোভন, ক্লাসমেট মেয়েদের মধ্যে সন্ধ্যা, যে স্যাণ্ডা নামেই বন্ধুমহলে পরিচিত, আর ইশা। এই মেয়েরা অত্যন্ত স্মার্ট, তারা ক্যারাটে শিখে সেলফ ডিফেন্সের স্কিল বাড়িয়ে নেয়, তারা বাড়িতে এম টিভি দেখে, বাড়ির লোকেরা বারণ করে না। অমৃতের মতো টিভি দেখায় বাধানিষেধ মেয়েগুলোর নেই বলে অমৃত তার বাবার কাছে অনুযোগও করে ফেলে। বাবার ব্যাখ্যা : "সমবয়সি মেয়েরা একটু বড় হয় বটে।" এই ব্যাখ্যাকেই বোধহয় আরও জোরালো ক'রে স্যাণ্ডারা অমৃতকে 'বেবি' বলে, এমনকি বাবার মামারবাড়ির গ্রামে আলাপ হওয়া রিনিও অমৃতকে মাঝেমাঝেই হ্যাটা করে নিছক মজার ছলেই। এমন টুকরো মজা, লেগপুলিং-এর মধ্যে দিয়ে যে মেসেজটা লেখকের কলমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটা হলো ছেলে-মেয়ে বা শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সমবয়সি কয়েকটা মানুষের বন্ধুত্ব, যেখানে ছেলে-মেয়ের ভাগাভাগিটা মুছে যায় আস্তে আস্তে।

তবে অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখানোর কারণে স্যাণ্ডা আর ইশাকে রাস্তাঘাটে বিপদেও পড়তে হয়। এখানে গল্পে সামনে আসে অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং বিরক্তিকর একটা অপরাধের কথা, ইভটিজিং। স্যাণ্ডারা নিছক মজা পাওয়ার জন্য রাস্তায় এক-আধবার অচেনা দুয়েকজন ছেলের সঙ্গে আলাপ জমায়, এটাও সেই একই ব্যাপার, নিয়মের গণ্ডি ভেঙে বেরোনোর দুঃসাহস, বলা যায় 'ভুল'। কিন্তু এই ভুলের ফল ভালো হয় না। দুজন ইভটিজারের সঙ্গে জড়িয়ে যায় স্যাণ্ডা আর ইশার বন্ধুদের ভালোমন্দও। বন্ধুত্বের তাগিদেই মেয়েদুটো ওদের বয়সের পক্ষে সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, গল্পের শেষে জয়ী হয় সমবয়েসি কয়েকটা ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বের অঙ্গীকার।

'কেউ বোঝে না'-র অমৃতের মনে অনেক কিছু নিয়ে অনেক প্রশ্ন। পড়তে পড়তে তোমারও মনে হবে, "আরে, এটা তো আমিও ভাবি! এরকম করলে কী হয়? ওটা করতে নেই কেন?" হবেই তো! কারণ, 'কেউ বোঝে না' তো তোমারই গল্প। বাড়ির বড়রা যখন আমাদের কোনও উপদেশ দেন, তখন সেটা জাস্ট থিওরিটিক্যাল উপদেশ বলে আমাদের খুব বিরক্ত লাগে, মনে হয় 'কথাটা না শুনলে কী হয় দেখি তো!' ব্যস, আমরা নিয়ম ভাঙি। সবসময় যে নিয়ম ভেঙে ভালো কিছু হয় তা কিন্তু নয়। বড় ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে বড়দের কথা না শুনে চললে। মুশকিল হলো, টিনএজে এই ক্ষতির আগাম আঁচটা পাওয়া যায় না কিছুতেই। মনে হয়, 'বড়রা বারণ করবে বলেই বারণ করছে, আর কিচ্ছু নয়।' ক্ষতি হওয়ার পর বোঝা যায়, বড়দের বারণ না শোনাটা কখনও কখনও কত বড় ভুল! সেরকম টুকটাক কিছু ভুলের ব্যাপারে খুব সুন্দর করে বোঝানো আছে এই উপন্যাসে। গল্প এগোয়, অমৃত আর ওর বন্ধুরা নিয়ম ভাঙার ছোট্ট ছোট্ট এক্সপেরিমেন্টগুলো করতে থাকে, বড় হওয়ার দিকে একটু একটু করে এগোয়, আবার ভুলগুলোও সুন্দর করে পাঠকের সামনে ধরা পড়ে একটু মন দিয়ে পড়লেই।

তাই সব মিলিয়ে মনে হয় তোমার বেশ মনের মতো বই হয়ে উঠতে পারে কৈশোরের গল্প কিশোরদের মতো করে লেখা উপন্যাস 'কেউ বোঝে না'।

উপন্যাস : কেউ বোঝে না
রচনা : সমরেশ মজুমদার
প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স
দাম : ১৫০ টাকা (২০১৮)

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা