সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পরিবেশে লকডাউনের প্রভাব

কোভিড ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বব্যাপী যে অতিমারী শুরু হয়েছে গত বছরের শুরু থেকে, তার জেরে বিশ্ব জুড়ে সবাই কেমন ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে ফেললাম একটা গোটা বছর, দেখলে তো! আক্রান্ত প্রায় প্রতিটি দেশেই অনেকটা সময় জুড়ে চলেছে লকডাউন, মানুষজন হাজারো অসুবিধা সত্ত্বেও ঘরবন্দী হয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন বা এখনও হচ্ছেন। বেশ কিছু দেশে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হওয়ার পরেও আবার কোভিড সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ফলে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও তিনমাসের ওপর লকডাউন চলার পর পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিল করে স্বাভাবিক কাজকর্মে গতি আনার চেষ্টা চলেছে। যথাযথ সাবধানতা নিয়ে মানুষজন বাইরে বেরোচ্ছেন, স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছেন সবাই। অন্যান্য দেশেরও একই অবস্থা। প্রতিষেধক টীকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে, হয়তো শীঘ্রই এই অতিমারির প্রকোপ কমে আসবে অনেকটাই। তবে, আমরা কেউই জানি না ঠিক কতদিন পর আমরা কোভিড সংক্রমণের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হবো। মোটকথা সব মিলিয়ে এখনও কিছুটা অনিশ্চিত অবস্থা চারপাশে।

কিন্তু একটা কথা জানো কি? যত খারাপ পরিস্থিতিই হোক না কেন, প্রতিটি ঘটনারই একটা আশাবাদী দিকও থাকে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এই অতিমারীরও তেমনই একটা আশাবাদী দিক এই লকডাউনের সময় আমাদের নজরে এসেছিল। বেশ অনেকদিন ধরে কলকারখানা বন্ধ, রাস্তায় গাড়িঘোড়া কিচ্ছু চলছে না, দিনভর মানুষের ভিড় নেই চারপাশে, এর ফলে সারা বিশ্বেই পরিবেশ দূষণ বেশ অনেকটা কমে গিয়েছিল গত বছরের মাঝের কয়েকটা মাসে। আমরাও খেয়াল করেছি না ব্যাপারটা? সকালে যেন বাড়ির আশেপাশে পাখির ডাক একটু বেশি শোনা যাচ্ছিল, রাতের আকাশে এক নজরেই বেশ অনেকগুলো তারা দেখা যাচ্ছিল, শহরাঞ্চলে বিকেলের মুখে যে একটা ধোঁয়াঘেরা ঘোলাটে ভাব দেখা যায়, সেটাও কদিন এক্কেবারে ছিল না।

ধীরে ধীরে অবশ্য কলকারখানা অফিস ব্যবসা সবই আবার পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে সব জায়গায়, সেইসঙ্গে শুরু হয়ে গেছে রাস্তায় গাড়ির লাইন, মানুষের ভিড়, হর্নের আওয়াজ, কালো ধোঁয়া। লকডাউনের সময় একটু সেরে ওঠা পরিবেশ আবার দূষিত হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।

তবে লকডাউনে প্রকৃতির সেরে ওঠার কী কী উপহার আমরা পেয়েছি গত একবছরে , কোন কোন বিরল দৃশ্যের ছবি আমরা পেয়েছি, তার একখানা সালতামামি তৈরি করার চেষ্টা করল ইচ্ছামতী।

পরিবেশে লকডাউনের প্রভাব

১। ইতালিতে লকডাউন শুরু হয় মার্চের ১০ তারিখে। তৃতীয় সপ্তাহে ভেনিসের ক্যানালে তোলা ছবি এটি। যান চলাচল বন্ধ থাকায় জল এতটাই স্বচ্ছ যে জলজ উদ্ভিদের ছবি পাওয়া গেছে অনায়াসে।
২। গ্র্যান্ড ক্যানাল, ভেনিস। প্রথম ছবিটি তোলা ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয় ছবিটি তোলা ২০২০ র এপ্রিলে।
৩। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রকাশিত স্যাটেলাইট ইমেজ : প্রথম ছবিটি ২০২০র জানুয়ারি মাসের, এবং দ্বিতীয় ছবিটি মার্চ মাসের। বায়ুদূষণ কমার কারণে বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রার পার্থক্য চোখে পড়ছে দুটো ছবিতে?
৪। মিলান : প্রথম ছবি ২০২০ জানুয়ারি, দ্বিতীয় ছবি ২০২০ এপ্রিল।
ওপরের সব ছবিগুলি দেখতে পাওয়া যাবে এই লিংকে

৫। ইস্তানবুলের বসফোরাস বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্রপথগুলোর মধ্যে একটা। পণ্যবাহী জাহাজ, যাত্রীবাহী জলযানের সারাক্ষণ যাতায়াত চলে এখানে। লকডাউন পর্বে সেসবের চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ায় ডলফিনদের দেখা পাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
৬। ইজরায়েলে বুনো শুয়োররা শহরে এসেছে খাদ্যের খোঁজে।
৭। আলবেনিয়ার পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে উড়ে আসতে দেখা গেছে ফ্ল্যামিংগোদের।
৮। আলবেনিয়ার Divjaka National Park এ বাসা বাঁধতে দেখা গেছে প্রায় পঁচাশি জোড়া ডালমেশিয়ান বা কার্লি পেলিকানকে।
৯। থাইল্যান্ডের Hat Chao Mai National Park এ সম্প্রতি খোঁজ পাওয়া গেছে ডুগং বা সি কাউয়ের একটি ঝাঁকের। এরা এমনিতে মাছধরা জাল এবং জলদূষণের সহজ শিকার। কাজেই একসঙ্গে এতজনের দেখা পাওয়া বেশ আশার কথা।
১০। চিলির সান্তিয়াগো শহরে কয়েকবার দেখা গেছে কুগার (Cougar, wild cat) দের। তাদের উদ্ধার করে নিজেদের বাসস্থানে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়।
ওপরের সব ছবিগুলি দেখতে পাওয়া যাবে এই লিংকে

ভারতেরও বিভিন্ন অঞ্চলে শহরাঞ্চলে দেখা গেছে বন্যপ্রাণীদের, বিভিন্ন সূত্রে তাদের ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে।
১১। নয়ডায় একটি নীলগাইকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে লকডাউন শুরু হওয়ার পরপরই।
ছবি এইখানে
১২। কোজিকোডের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল একটি স্মল ইন্ডিয়ান সিভেট ক্যাটকে। সেটি সম্ভবত অসুস্থ ছিল।
ছবি এইখানে

১৩। অসমের গুয়াহাটির রাস্তায় দেখা গেছে একটি হরিণকে, স্থানীয় মানুষ হরিণকে খেতে দিচ্ছেন, এমন দৃশ্যও দেখা গেছে। ছবি এইখানে
১৪। তিরুপতির রাস্তায় খেলে বেড়ানো হরিণ। টুইটারে শেয়ার হওয়া ছবি এইখানে

এতক্ষণ তো দেখছিলাম লকডাউনের ফলে জনহীন রাস্তাঘাটে কেমন অবাধে বিচরণ করছে বন্যপ্রাণীরা, দূষণ কমার ফলে কী কী উপকার হয়েছে সেসবের ছবি। এবার একটু মন্দের দিকে দেখা যাক।

পরিবেশে লকডাউনের প্রভাব

লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতীয় উদ্যান এবং অভয়ারণ্যে চোরাশিকারীদের উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিল। দর্শক সমাগম বন্ধ হওয়ার সুযোগ নিয়েছিল চোরাশিকারীরা, নির্বিচারে হত্যা করেছে বিলুপ্তপ্রায় এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের।

১. বোৎসোয়ানার ওক্যাভাঙ্গো অঞ্চলে ব্ল্যাক রাইনোদের চোরাশিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে। রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্চমাসে ওই অঞ্চলে চোরাশিকারীদের হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ছয়টি গণ্ডার। খবর এইখানে

পরিবেশে লকডাউনের প্রভাব

২. কলম্বিয়াতে চোরাশিকারীদের হাতে মারা পড়ছে জাগুয়ার, পুমা, ওসেলোটদের মতো প্রাণীরা। খবর এইখানে

৩. ভারতেও শুরু হয়েছে একইরকম ঘটনা। মাংসের জন্য এবং স্থানীয় চোরাচালান ব্যবসার অঙ্গ হিসেবে লকডাউন শুরু হওয়ার পর মাসদেড়েকের মধ্যে ৮৮ টি বন্যপ্রাণী হত্যার খবর জানা গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে খরগোশ, সজারু, প্যাঙ্গোলিন, সিভেট ক্যাট, জায়ান্ট স্কুইরেলদের মতো ছোট প্রাণীরা, তেমনই রয়েছে লেপার্ড, ভালুক, চিঙ্কারা, চিতল হরিণ, কাকর হরিণ এসব বড় প্রাণীরাও। রয়েছে ময়ূর, সারস এবং অনেক বিরল প্রজাতির হিমালয়ান বার্ডসও। এই বিষয়ে আমরা বিশদে জানতে পারব এই রিপোর্ট পড়লে

পরিবেশে লকডাউনের প্রভাব

এবার আসা যাক পরিবেশ দূষণের প্রসঙ্গে। কোভিড-১৯ অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অন্যতম হাতিয়ার হল ফেস মাস্ক, জানোই তো! কিন্তু ডিসপোজেবল মাস্কগুলোকে ব্যবহারের পর যথাযথভাবে ফেলা বা ধ্বংস করার ব্যবস্থা না করে যদি রাস্তাঘাটে নদীসমুদ্রের ধারে ছড়িয়ে ফেলে দেওয়া হয়, তার ফল কীরকম হতে পারে, দেখা যাচ্ছে এই ছবিটিতে

বুঝতে পারছ তো, মানুষ ঘরবন্দী থাকার ফলে বন্যপ্রাণরা এদিক ওদিক নির্ভীকভাবে ঘুরে বেড়াতে পেরেছে ঠিকই, বায়ুদূষণ কমেছে ঠিকই, কিন্তু আমরা মানুষরা যদি নিজেদের না বদলাই, পরিচ্ছন্নতার কথা, পরিবেশ রক্ষার কথা একেবারেই না ভাবি, তাহলে কিন্তু লকডাউনে একটু একটু করে সেরে ওঠা প্রকৃতি আমাদের বিরুদ্ধেই আঘাত হানবে।

এই সালতামামি শেষ করি একেবার অন্যরকমের একটা খবর দিয়ে। প্রায় তিন মাসের ওপর বন্ধ থাকার পরে, স্পেনের বার্সেলোনার একটি অপেরা হাউস যখন আবার খোলে গতবছরের জুন মাসের শেষে, সেই সময়ে প্রথম অনুষ্ঠানের শ্রোতা কারা ছিল জানো? স্থানীয় বিভিন্ন নার্সারি থেকে আনা দুহাজারেরও বেশি গাছ। রোমাঞ্চকর ঘটনা না? প্রকৃতির কাছাকাছি যে আমাদের ফিরতেই হবে নিজেদের ভালোর জন্য, পৃথিবীর ভালোর জন্য, পশুপাখি-গাছপালা সবার ভালোর জন্য, সেই বার্তা সবাইকে জানানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কীই বা হতে পারে!

ছবিঃ পিক্সাবে

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা