সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
গারো পাহাড় জমজমাট

গভীর রাত। জমকালো অন্ধকারে চারিদিক ছেয়ে রয়েছে। আকাশে মেঘ ও বিদ্যুতের চমক। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করছিল ডেভিড। চারদিন ধরে বৃষ্টি চলছে। কদ্দিন এভাবে ঘরে বসে থাকা ‌যায়? বিরতির কোনো লক্ষণ নেই। বিকেলের দিকে বর্ষাটা একটু ধরেছিল, এখন ফের যে কে সেই। হনহন করে পা চালাচ্ছে ডেভিড। ফিনফিনে রূপ ছেড়ে ঝমঝমিয়ে শুরু করলে আর রক্ষে নেই। ভগবানের নাম জপে বেরিয়ে পড়েছিল দোকান বন্ধ করে। বাড়ির দোর খুলতে না খুলতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ধেয়ে এল। ব‌ড্ড ধকল গেছে সারাদিন। ‌যথাসময়ে নৈশভোজ সারল ডেভিড। জানলার পাল্লা বন্ধ করে শুতে ‌যাবে এমন সময় খেয়াল হল একটা ছায়াশরীর সরে ‌যাচ্ছে । আচমকা ধারালো একটা ভোজালি ওর বুকে বিঁধল এসে। জামায় হাত দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। রক্ত ছিটিকিয়ে দেওয়ালে লাগল। ছায়াশরীরটা অতি মন্থর গতিতে জঙ্গলের পথ ধরল।
ইদানীং পর্ণাদির একটা নতুন স্বভাব গজিয়েছে। খবরের কাগজখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বে । ‌যৎসামান্য খবরও ছাড়বে না। দুদিন পূর্বেও পড়ত না এমনভাবে। অবিশ্যি আমারও কলেজের চাপে এদিকে আর তেমন পা বাড়ানো হয় না। পর্ণাদির একটু পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। পুরো নাম পর্ণা সেন। সম্পর্কে মাসতুতো দিদি। ভিক্টোরিয়ার কাছে ইংরেজ আমলের নামকরা কলেজে প্রোফেসরের চাকরি করত। বছরকয়েক হল গোয়েন্দাগিরিতে প্রবেশ করেছে। কঠিন কিছু কেস সলভ করে বেশ সুনাম করেছে। খ্যাতির ফলে আজকাল মক্কেল-টক্কেলও দু একটা জুটে ‌যায়। আর আমি হলুম গে এককথায় ওর লেজুড়। এখন তেমন কোনো কাজ নেই ওর হাতে। পরীক্ষার শেষে গত সপ্তাহে এসেছি। এরকম মিনি ভ্যাকেশনে ওর বাড়ি আসা আর হইহই করে কাটানোর চেয়ে মজার কিছু আছে? প্রথমে স্থির ছিল দুদিন থাকব। মাসি অবিশ্যি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, অ্যাদ্দিন পর ‌যখন এসেছিস, তখন বেশ কিছুদিন খেয়েদেয়ে বেড়িয়েটেরিয়ে ধীরে সুস্থে ‌যাবি। অগত্যা রাজি হতেই হল। ঝকঝকে সকাল। চমৎকার রোদ উঠেছে। ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট। ‌যথারীতি পর্ণাদির হাতে দি টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকা। আমি একটা রহস্য রোমাঞ্চে ভরা গোয়েন্দা বই হুপুসহাপুস করে শেষ করছি, এমন সময় হাতে কাগজখানা ধরিয়ে দিয়ে বলল, দ্যাখ, মন দিয়ে একবার। ফার্স্ট পেজ। নিজস্ব সংবাদদাতাঃ অজানা ভয়ংকর বিপদ গারো পাহাড়ে। মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ জুড়ে গারো পাহাড়। অজানা এক ভয়ংকর বিপদ হানা দিয়েছে সেখানে। দুর্ভেদ্য অরণ্য নকরেকে ঢোকার মুখে ছোট্ট শান্তিপূর্ণ গ্রাম ‌ডারবোকগিরি। হপ্তা খানেক আগে ক্ষেতে কাজ করছিল কয়েকজন। বেলা বারোটা-একটা নাগাদ। নিশ্চিন্তে মনো‌যোগ সহকারে ধানের চারা পুঁতছিল। হঠাৎ প্রেস্টেন ও হার্ল নামক দুজন ব্যক্তির কাঁধে তির ছুটে আসে গাছের আড়াল থেকে। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ দুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই ঘটনার কিছুদিন পর পরশুদিন রাত্রে ডেভিড নামে এক দোকানি মারা ‌যায়। ধারালো একটা ভোজালি ওর বুকে আঘাত করে। সকালে অনেক ডাকাডাকির পর দরজা না খুললে গ্রামের বাসিন্দারা দরজা ভাঙতে বাধ্য হয়। তুরার পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা করে পুলিশ দেখেছে ওগুলো আসলে বিষ তির এবং হাতের কোনো ছাপ খুঁজে পায়নি। কিন্তু ভোজালির ক্ষেত্রে খুনি কাঁচা কাজ করে ফেলেছে। অপরাধী গ্লাভস না পরার জন্যে দেখা গেছে একটা আঙুল কম। পুলিশ কোনো সমাধান করতে পারছে না। তথৈবচ অব- ক্রিং ক্রিং। পুরোটা কমপ্লিট করা গেল না। বেলের আওয়াজে মেজাজাটা গেল খিঁচড়ে। এবাড়ির পুরোনো ভৃত্য রামুদা দরজা খুলল। পায়ে চপ্পল, ট্রাকসুট পরনে এক স্থূলকায় ব্যক্তি এসে সোফায় বসলেন। ইনি হচ্ছেন সি বি আই অফিসার প্রবীরনাথ স্যান্যাল। কেসের সুবাদে পর্ণাদির সাথে আলাপ।
ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে সুস্থির হয়ে বসলেন, বললেন পুরো পাড়াটা পাঁচ চক্কর মেরে আসলাম। মধ্যপ্রদেশটা ‌যে হারে বেড়ে চলেছে।
ওটাই তো আপনাদের শোভা দাদা - মুচকি হেসে পর্ণাদি বলল। তা আজকাল কি মর্ণিংওয়াকেও রিভলভার নিয়ে ‌যাচ্ছেন?
আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেল না, দেখছি,ম্যা‌ডাম। এবার মূল কথায় আসি। আজকের কাগজে গারো পাহাড়ের খবরটা পড়েছেন?
– কেন বলুন তো?
– কেস সলভের দায়িত্ব এসেছে হাতে। সেভাবে অতটা গুরুত্ব দিইনি প্রথমে। নানাভাবে ব্যস্ত ছিলাম এ কদিন। যেভাবে উপরওয়ালা অফিসাররা ঝুলোঝুলি করতে লাগল, হ্যাঁ বলতেই বাধ্য হলাম। তার উপর মোমিন বারবার ফোন করছে।
- হু ইজ মোমিন? ইংরেজি কায়দায় জানতে চাইলাম।
- বলতেই ভুলে গেছি, ‌ডারবোকগিরির গ্রামপ্রধান। পরিবার বলতে একমাত্র ছেলে ইভাই। তুরা‌র এক কারখানায় চাকরি করে। বাইশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু আমায় আবার আজ বিকেলেই ইউ পি ছুটতে হবে। ।
কাতরকন্ঠে বলে উঠলেন, একটু ‌যদি সাহা‌য্য করেন, বেটার ফিল করি। কী বলেন?
তদন্তের কথাখানা বেশ মনে ধরেছে ওর বুঝতে পারছিলুম। বহুদিন দূরে কোনো জায়গায় ‌যাওয়া হচ্ছিল না। স্রেফ ‌যাদবপুর টু সল্টলেক। নিশ্চিন্ত হলাম ওর কথা শুনে।
চলি, তাহলে। হাসিমুখে বিদায় নিলেন প্রবীরবাবু। কাগজখানা ভাঁজ করতে করতে পর্ণাদি বলল, দীপুকে একটা খবর পাঠা। আগামীকালের মধ্যেই ‌সল্টলেকে চলে আসে যেন। মনের মধ্যে তৃপ্তির স্রোত বয়ে গেল। দীপুর একটু পরিচয় দেওয়া ‌যাক। দীপু ওরফে দৃপ্তি ত্রিপুরার মেয়ে। আমারই সমবয়সী। দোহারা গড়ন, হাইট পাঁচ ফুট দুই, শর্টকাট চুল আর দুষ্টুবুদ্ধিতে ভরপুর। দিল্লির কেসে প্রথম পরিচয়। এরপর অনেক তদন্তে সঙ্গীর কাজ করেছে। ‌যাইহোক, বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে দুদিন পরেই রওনা দিলাম গারো পাহাড়ে। একদিনেই গারো পাহাড় সম্বন্ধে বেশ পড়াশোনা করে নিয়েছে পর্ণাদি।
ছটা নাগাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। প্লেন ছাড়বে নটায়। খিদে খিদে পাচ্ছিল বেশ। এয়ারপোর্টের সামনেই একটা রেস্টুরেন্ট। কেক আর কফির অর্ডার দিলাম। নটা নাগাদ প্লেন ছাড়ল। সন্তর্পণে সরু প্যাসেজের মধ্য দিয়ে প্লেনে উঠলাম। ‌যাত্রীরা মোটামুটি অর্থবান। পাশের সিটে দুজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা বসেছেন। অনর্গল কথা বলে চলেছেন। বিশ্রামের চিহ্নই নেই। অন্যান্য ‌যাত্রীরাও সামান্য বিরক্ত। সুন্দরী এয়ারহোস্টেসরা মিষ্টি হাসি বিনিময় করে প্রত্যেককে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করছেন। পর্ণাদি মুগ্ধ হয়ে শার্লক হোমস পড়ছে।
গুয়াহাটি, গোয়ালপাড়া, ধুবরি আর কৃষ্ণৈ পার হয়ে এগিয়ে পশ্চিম গারোর দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি। সাদা সাদা মেঘে ঘেরা আকাশ। ‌যতদূর চোখ ‌যায় কেবলই মেঘের রাজ্য। প্লেন ল্যান্ড করল তুরা এয়ারপোর্টে। তুরা নিঃসন্দেহে ঝাঁ - চকচকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শহর। প্রায় সব শহুরে সু‌যোগ-সুবিধাই পাওয়া ‌যায়। বাস ধরে চলে এলাম স্নিগ্ধ শ্যামলিমার গ্রাম ডারবোকগিরিতে। চোখে পড়ার মতো জায়গা। ছোটো- বড়ো পাহাড় গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে। সুপারি গাছের বন আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখার মতো। বেশিরভাগ কাঠের ঘরবাড়ি আর ছোটো ছোটো কুটির। ছবির মতো সাজানো সবুজ সুন্দর গ্রাম। প্রাকৃতিক দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে স্মার্টফোনটা দিয়ে পটাপট কতকগুলি ছবি তুলে নিলাম। বাড়ির মহিলারা যে ‌যার নিজের কাজ সারতে ব্যস্ত। কৃষকরা নিমগ্ন ধানের চারা পুঁততে। হুস করে একদল ছেলে দৌড়ে গেল। বোধহয় এখুনি স্কুল ছুটি হয়েছে। দীপুর প্রচন্ড কবিতার শখ। এহেন প্রকৃতির রূপে চমৎকৃত হয়ে খালি গলায় নিজের বানানো কবিতা ধরল-
চোখ দুখান জুড়িয়া গেল প্রকৃতির রূপ দেখিয়া
সবুজ উপত্যকাগুলো শান্ত গ্রামখানাকে বিপদমুক্ত করিয়া রেখেছে।
কবিতার আগাগোড়া কোনো মাথামুন্ডু নেই। গলাটা ‌যতটাসম্ভব নিচু করে মোলায়েম স্বরে পর্ণাদি বলল, উপত্যকার রঙ কি সবুজ হয়? শিলার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে ভ্যালি।
কিছুটা দূরে একটা ছোটো টিলার পাশে ফিকে লাল রঙের বিশাল বাংলোবাড়িটি। প্রবীরবাবু আগে থেকেই সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন। প্রবেশ করতেই উপলব্ধি করতে পারলাম পরিবেশটা থমথমে, শব্দহীন। সচরাচর কোনো টুরিস্টের ‌যাতায়া‌ত নেই এখানে। কালেভদ্রে ‌যা‌তায়াত। বড়ো বড়ো গাছগাছালি বাংলোটাকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পিচের রাস্তার গা ঘেঁষে অতিথিভবনটি। চাতালের পর লাগোয়া উঠোনে রং-বেরঙের অজস্র ফুল ফুটে আছে। দেখলেই বোঝা ‌যায় নিয়মিত পরিচ‌র্যা হয়। বাংলোর পিছন দিকে জলশূন্য অবস্থায় একটা ধুলো ময়লা জমা কুয়ো। গা ছমছমে আবহাওয়া। খুবই অবাক লাগল দেখে এত বিশাল বাংলোয় লোকসংখ্যা সাকুল্যে তিন। বয়স্ক মালি, বাবুর্চি ও কেয়ারটেকার অবিনাশ বাবু থাকেন। দক্ষিণ দিকের ঘর পেয়েছি আমরা। বাইরে থেকে বিলিতি ধাঁচের মনে হলেও অন্দরের সাজসজ্জা তেমন দেখনদার নয়। রুমের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম। এছাড়া ছোট্ট খাট, টেবিল, আলমারী ও টব বসানো লম্বা বারান্দা। তুরার সাদা চূড়ো পরিস্কার দেখা ‌যায়। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দেয়ালে কতকগুলো অয়েল পেন্টিং ঝুলছে। মোটামুটি আলো-বাতাস ঢোকে। প্লেনেই মধ্যাহ্নভোজন সারা হয়ে গিয়েছিল। খুবই সরল মেনু। পরোটা অ্যান্ড চিকেন। ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে। বড্ড ধকল গেছে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল পর্ণাদির ঠেলাঠেলিতে। তারস্বরে চিৎকার করে বলছে, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস যে বড়? এতগুলো কেস সলভ করার পরেও ইমপ্রুভমেন্ট কি হয়নি?
পরমুর্হূতেই মনে পড়ল এয়ারপোর্টে প্রবীরবাবু পর্ণাদির খুদে ‌যন্ত্রখানার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন গারো পাহাড়ে এক সাধু হিমালয়ের পাদদেশ থেকে নেমে এসেছেন। তিনি ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন পুরো গাঁ নাকি উজাড় হয়ে ‌যাবে। প্রেতাত্মা ভর করেছে এখানে। দ্রুত এই অঞ্চল ছাড়তে হবে। নইলে ভয়ংকর বিপদ ঘটবে। আজ উনি ফের দর্শন দেবেন। তাই দুপুরেই স্থির করেছিলাম আমরাও দর্শনে ‌যাব। মনে ছিল না কথাগুলো। হাত মুখ ধুয়ে বাবুর্চিকে এক কাপ কফি বানাতে বললাম। বারান্দায় এসে দেখি দীপু বেতের চেয়ারে বসে গারো পাহাড়ের ইতিহাস সম্বন্ধে একটা বইতে মগ্ন। শ্বেত পাথরের কারুকা‌র্য করা টেবিল। তার উপর চিনাপাথরের প্লেটে সিকাডো ভাজা রাখা। সিকাডো হল একধরনের রঙিন পোকা ।
খুব সুন্দর ভিউ বাইরে। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, কী ঘুম ভাঙল মিস ওয়াটসনের? ঠাট্টাটা গায়ে না মেখে বাইরের মনোমুগ্ধকর পরিবেশের প্রতি মন দিলাম। সূ‌র্যাস্তের কমলা রঙের আভা গারো পাহাড়ের আদিম দুর্গম অরণ্যের আদিগন্ত সবুজকে তার সৌন্দ‌র্য দিয়ে অপরূপ মায়াবী সাজে সজ্জিত করে তুলেছে এবং বিপদের অস্তিত্বের আগাম বার্তা দিচ্ছে। এখানকার লোক খুব শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী, অতিথিপরায়ণ। দ্রুতবেগে নৈশভোজ সেরে সাতটা নাগাদ গায়ে পুলওভার চাপিয়ে পাম শু পরে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। চার ব্যাটারীর জোরালো টর্চ, ছোটো জলের বোতল, রিভলবার ও লাঠি নিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম দীপু মোবাইলে রেকর্ডার অন করছে। অবাক হয়ে বললাম- খামোখা এসব তুই কী করছিস?
- আমি তোর মতো হাঁদারাম নই। ভন্ডটার কথাগুলো রেকর্ড না করে নিলে পরে ঝামেলার মুখে পড়তে হবে। এ শর্মাকে টেক্কা দেওয়া অত সহজ নয়। তোর মোটা মগজে এসব সূক্ষ্ম জিনিস ঢুকবে না। বুঝলি কিছু হাঁদারাম?
- না মগজে ঢোকেনি। তবে তুই কি সর্বজ্ঞানী? সবজান্তা গামছাওয়ালা শুনেছিস ত?
খুনসুটির মাঝে দরজার গোড়ায় পর্ণাদির আবির্ভাব।
নিশুতি রাত। নির্জন অরণ্য। শুনশান রাস্তা। পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। দুর্ভেদ্য অন্ধকার। দিনমানেতেও তেমন আলো প্রবেশ করে না। রাতের অনবদ্য শোভায় মুড়ে গেছে নকরেক। অজস্র রং- বেরঙের ফুল ফুটেছে। কিছু দুর্লভ ফুলও ছিল। চাঁদের মিষ্টি আলো এসে ওদের উপর পড়েছে। পাশ দিয়ে সিমসাং নদী বয়ে চলেছে। এ নদী চলবে উইলিয়ামস শহরের বাঁক প‌র্যন্ত। নকরেক শৃঙ্গ থেকে এর উৎপত্তি। কী সুন্দর ঝুপুর-ঝাপুর আওয়াজ। গাছের ঘন পাতাসুদ্ধু লম্বা ডাল সামনের পথ আটকে রেখেছে। সবচেয়ে ভালো লাগল, পিচার প্ল্যান্টের মুড়ানো সবজেটে পাতা দেখে। কিছুদূরে একটা অচেনা পাখি ক্রমাগত ডাকছে। একটা কমলা আলো চোখের সামনে ভাসল। সাধুর ছোট্ট কুটিরের সামনে জনতার ভিড়ে ভিড়াক্কার। আমজনতা ‌নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মত্ত। সম্ভবত গ্রামপ্রধান এই সভায় উপস্থিত হয়নি। ছোট্ট কুটির একেবারে। ইট – পলেস্তারা খসে পড়েছে। গা বেয়ে অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে। সামনের প্রাঙ্গনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বেশি অপেক্ষা করতে হল না। ‌যথাসময়েই পৌঁছেছি। একটুখানি বাদেই সাধু বেরিয়ে এল। বাপস্, কি দশাসই চেহারা। রক্তগরম করা খুনে দৃষ্টি ‌যা শরীরকে হিম করে দেয়। মাথায় লাল তিলক আর সর্বাঙ্গে লাল কাপড়ের থান জড়ানো। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর চুলগুলো উসকোখুসকো। প্রথম দর্শনেই শরীরের মধ্য দিয়ে কেমন একটা ভয় খাওয়া রক্তের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কর্কশ বাজখাঁই গলায় বলল, বৎসরা,আজ ঘোর অমাবস্যার রাতে ফের এসেছিস এখানে? গেল হপ্তায় বলেছিলুম না কিস্যু করার নেই। একজন নেতা গোছের লোক হাতজোড় করল, বাবা দয়া করে কৃপা করুন। এমনিতে খুব কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটে। ভিটেমাটি ছেড়ে কোনখানেতে গিয়ে উঠব? আপনার যে অসীম ক্ষমতা।
পান হতে চুন খসল। রক্তজল করা দৃষ্টিতে লোকটির দিয়ে চেয়ে বলল, এত অনুনয় করে ‌যখন কইছিস তখন ফেলি কীভাবে বল? একখানা উপায় অবিশ্যি ভেবেছি। এতেই ফল হবে। নইলে আরও কড়া দাওয়াই দিতে হবে।
কী হবে এবার? প্রেতাত্মা পালাতে বাধ্য হবে কড়া দাওয়াইয়ের জোরে? সুখ শান্তি নামবে গারো পাহাড়ে? কিংবা আরও অন্ধকার ও দু‌র্যোগ ঘনিয়ে আসবে? মিনিট কুড়ি ধরে কী সব মন্তর আওড়াতে লাগল। তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, পালা এখান থেকে। জারিজুরি সব শেষ তোর। চালাকি খাটবে না। গমগমে গলায় কে ‌যেন বলল, কারা এত জ্বালাতন করছিস র‍্যা? ঝাঁটাটা হাতে নিল সাধু, তুই বা কোন নবাব যে তোর আদেশ মান্যি করতে হবে? আমি কে এখুনি হাড়ে হাড়ে টের পাবি ব্যাটা। শুরু হল এক তান্ডব নৃত্য। এক হাত শূন্যে তোলা ও অন্য হাতে ঝাড়ু। ওপর থেকে কন্ঠস্বরটা খ্যাঁক খ্যঁক করে হাসছে আর বলছে, ‌যাব না ‌যাব না। তোদের ‌সাধ্যি নেই আমাকে তাড়ানোর। আধঘন্টাটাক ধরে চলল এই অদ্ভুত নৃত্য পরিবেশন। একসময় আওয়াজটা শূন্যে মিলিয়ে গেল। গোটা ঘটনাটার পর তান্ত্রিক অপরীসীম ক্ষমতা প্রকাশের জন্য অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। গোটা অরণ্য ‌যেন তাতে সম্মতি জানিয়ে কেঁপে উঠল। ভিড়ের মধ্যে জয়ধ্বনি চলল। দু - একজন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে নিচ্ছে। অত্যাশ্চ‌র্য ঘটনা। বাকরুদ্ধ অবস্থা। সবাই যে খুব হতবাক এতো একেবারে নিশ্চিত কথা। দীপুর মতো মেয়েও হতভম্ব। এ কি সুস্থ সবল মস্তিষ্কে বিশ্বাস‌যোগ্য? কেবলমাত্র একজনই হকচকিয়ে ‌যায়নি। আর কে, স্বয়ং পর্ণাদি। গেলেও তা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্রেফ। বড়জোর ঘন্টা দুয়েক লাগল ঘটনাগুলি ঘটতে। একরাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ। একটুক্ষণ বাদেই মেঘ গলে গেল। বৃষ্টির এত তোড় ছাতাকেও হার মানিয়ে ‌যাচ্ছে। কোনোরকমে অতিথিভবনে ফিরলাম।
হাত পা মুছতে মুছতে নির্দেশ এল, টিনা ‌যা ‌যা প‌র্যবেক্ষণ করলি সমস্ত এখুনি ‌ডাইরিতে নোটডাউন করবি। অতি ক্ষুদ্র তথ্যও ছাড়বি না। দুদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সায় দিলাম।
এ‌ ‌যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কন্ঠস্বরটা ছিল কার? রীতিমতো ভয় সৃষ্টি করে তুলেছে –কাঁদো কাঁদো গলায় দীপু বলল। একদম সঠিক বলেছে দীপু। কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে নির্ঘাত সাধুটার।
মৃদু ধমকের সুরে পর্ণাদি বলল, মাথাটার ‌যে এক্কেবারে হতদরিদ্র অবস্থা। এত কম ফান্ডা নিয়ে রহস্য সমাধান চলে না। ছোট্টো একটা টেপরেকর্ডার লাগিয়ে দেওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক নয়। সোজা সরল প্রকৃতির মানুষগুলো নাহয় অতশত বোঝে না। কিন্তু তোরা কীভাবে বুজরুকিতে বিশ্বাস করলি? তবে ঘুরেফিরে একটাই চিন্তা শতবার মাথা‌য় আসছে। সত্যই কি কোনো যোগসাজশ আছে সাধুর এই চক্রান্তের সঙ্গে? যোগসূত্র হলেও হতে পারে। চক্রান্তের পান্ডার সামান্য চর হয়তো। এবার একখানা প্রস্তাব আছে আমার। আগামীকাল মোমিনের বাড়িতে তদন্তের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে ‌যাবি দীপু আর তুই। আমার ভূমিকা পালন করতে পারবি ত?
আনন্দে লাফাচ্ছে দীপু। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, হে হে কী‌ যে বলোনা পর্ণাদি। একটা – আধটা কেস সলভ করে কিছু তো জ্ঞানগম্যি হয়েছে। কীরে টিনা, এগ্রি তো? উত্তেজনার চোটে মুখ দিয়ে ইংরেজ ইংলিশ ফুটছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ টেকসই হল না সে সুখ। ডাইরিটা সবে নেব এমন সময়ে একখানা জোরালো আর্তনাদ ভেসে এল কানে। শশব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলাম ওয়াশরুমে। দেয়ালের এক কোণে ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে দীপু। কপালে বিজবিজে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আরও থতোমতো খেলাম হাত তিনেক দূরে ইঞ্চি দুয়েকের ছুরি দেখে। রহস্য ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। রহস্য জাল বুনেছে সর্বত্র। এর হাত থেকে মুক্তির উপায় সহজে মিলবে না। জল খেয়ে ধরা ধরা গলায় বলল, উফস্ কী বীভৎস দৃশ্য। সরেছিলাম ভাগ্যিস। নাহলে পিঠে বিঁধত এসে।
- ন্যাক্যামো না করে বলবি কী ঘটেছে? – বিরক্ত হয়ে বললাম।
ভূমিকা ছাড়াই স্টার্ট করল, জানলার পাল্লার মধ্যিখান দিয়ে কালো লোমশ একটা হাত এগিয়ে ছোঁড়ে ছুরিটি।
তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়াই।

- মুখটা দেখতে পেয়েছিলিস?
- না, শুধু লোমশ হাতখানা দেখেছি। দুরুদুরু বুক কাঁপছে। গেস্ট হয়ে না গোস্ট হয়ে কলকাতায় ফিরব কিনা শেষে ভাগ্যই জানে।
- সেক্ষেত্রে ‌আগামীকাল মোমিনদের বাড়ি পারবি যেতে? দুলকি চালে বলল পর্ণাদি।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, পারব না মানে? পারতেই হবে। ফিক্সড ‌একদম ‌যে কালই ‌যাচ্ছি।
এরপর আর বলার মতো বিশেষ কিছু ঘটেনি। নিশ্চুপ কনকনে শীতের রাতে মেঘে আচ্ছন্ন চাঁদকে ক্ষণকালের জন্য ফের দেখা ‌যাচ্ছে, তার মনভোলানো সুন্দর হাসি সমগ্র গারো পাহাড়কে অভূতপূর্ব সাজে রাঙিয়ে তুলেছে, ‌যার মধ্যে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মেশানো শান্ত, স্নিগ্ধ সবুজের মিশ্রণ মনের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে এক অপূর্ব চেতনার অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছে।
পরের দিন সকাল। ইতিমধ্যে পর্ণাদির কাছ থেকে ভালভাবেই তালিম নিয়েছে দীপু। অন্য জগতে চলে গিয়েছে ও। হাঁটার ভঙ্গি আর কথা বলার ঢং পাল্টে গেছে। খানিক বাদে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের খাঁজে ছোটো ছোটো ঝরনা তিরতিরিয়ে ‌যাচ্ছে। মন জোড়ানো তার কলকল আওয়াজ। মাথার উপর স্যান্ডপাইপার আর রিভারটার্ন পাখির ঝাঁক উড়ছে। পাশে সিমসাং নদীতে মহাশের ও চিতল মাছ সার বেঁধে চলেছে। রোদমাখা জাফরি কাটা পথে চলতে বেশ লাগছিল। চমৎকৃত মুখে দীপু বলল, অপূর্ব! ফ্যান্টাস্টিক! কী মহিমা! চোখ দুটো জুড়ে ‌যায় এ মুগ্ধকর দৃশ্য দেখে। একেবারে মহাভারতের ‌যুগে প্রবেশ করেছি যেন। বাস্তবিকই মনটা কেমন নিরাসক্ত হয়ে আসে। মিনিট কুড়ি লাগল যেতে। মোমিনদের বাড়িটা গ্রামের এক প্রান্তে। ঝোপঝাড়, আগাছায় ভর্তি এলাকা। বলাবাহুল্য, এই বাড়িটিও কাঠের। সামনে বাহারি ফুল লাগানো। দেয়ালে আঁকিবুকি কেটেছে চন্দন আর কীসব দিয়ে। সিঁড়িটি তিন ধাপের। পেছন দিকে আলপথ দিয়ে ‌তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর রাস্তা। ঠকঠক করতেই বলিষ্ঠ চেহারার সুদর্শন ‌যুবক এসে দরজা খুলল। ঝাঁকড়া চুলে ভর্তি মাথা। চোখের মণি দুটো নীল, মুখের গড়ন খুব সুন্দর। সৌম্যকান্তি চেহারা। ঠোঁটে চিলতে হাসি। ব‌য়স আন্দাজ পচিঁশ – ছাব্বিশ। নরম সুরে বলল, কাকে চাই? – নমস্কার। ডিটেক্টিভ পর্ণা মিত্রের হয়ে এসেছি। তদন্তের ব্যাপারে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করব। তরুণটি আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে বলল। ঘরটিতে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। পিছনে উপরে যাবার লম্বা সিঁড়ি। লম্বা বারান্দায় তিন - চারটে ফুলগাছ লাগানো। ফায়ারপ্লেসের পরিবর্তে একপাশে কিছু কাঠ জড়ো করা। ঘড়ঘড় শব্দে পাখা চলছে। একটু পরেই ‌যুবকটি বেরিয়ে এল।
আপনিও কাজের মানুষ। আমিও কাজের মানুষ। সময় নষ্ট না করে শুরু করি। নাম কী আপনার? কে হন আপনি মোমিনের?
ইভাই রদরিগেজ। ছেলে হই সম্পর্কে।
কী করেন?
তুরার এক অফিসে কাজ করি।
কোন কোম্পানিতে?
রস এন্ড সন্স।
মোমিন আঙ্কল, বর্তমানে কী করেন?
অনেক আগে আপেল, কমলালেবুর চাষ করতেন তুরায় ফলের দোকান ছিল আমাদের। পারিবারিক ব্যবসা। মা মারা যাবার পরপরই বন্ধ হয়ে ‌যায় সেটা। বয়সের কারণে এখন ছোটোখাটো ব্যবসা করেন। তাতেই ‌যা টু পাইস আয় হয়।
খবরটা পেলেন কীভাবে?
প্রেস্টেন ও হার্লের মৃত্যুর খবরটা পাই ছুটিতে এসে। তার পরেই ডেভিডের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পাই। ‌যাই বলুন আর তাই বলুন, ওসব সাধুর নির্দেশ অন্ততপক্ষে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে বাবা ঘোর বিশ্বাসী এতে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা সহজ নয় সামনে। বোঝেনই তো।
তা কাকে এব্যাপারে সন্দেহ হয় আপনার?
নকরেকের সমস্ত অধিবাসীরাদের কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সেক্ষেত্রে কেউ এইধরনের কাজ করতে পারে এমন কথাটা ভাবা ভুল। আমার কাছে সকলেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে। কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করতে চাই না।
ইতিমধ্যে এক বৃদ্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সত্তর - আশির মধ্যে বয়স। মাথার চুল ধবধবে সাদা। চামড়া কুঁচকে গেছে। মুখে অজস্র বলিরেখা। পরনে উর্ধাঙ্গে কিছু নেই, শুধুমাত্র ধুতির মতো কোঁচকানো একটা পোশাক পরিধান করেছেন। এটা এখানকার আঞ্চলিক পোশাকগুলির মধ্যে অন্যতম। পাকানো সাদাটে গোঁফ। দীপুর জেরার চোটে জেরবার হওয়ার অবস্থা। ‌ছাড় পেয়ে ইভাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অবিশ্যি আমিও দ্রুত হাত চালিয়ে সমস্ত স্টেটমেন্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ‌ডাইরিতে নোটডাউন করছিলাম। বৃদ্ধ এসে কাঠের টুলের ওপর বসলেন।
বৃদ্ধ শুর‍ু করলেন, ইভাইয়ের মুখে সবই শুনলে। তা বাবারা, এসমস্যার মুশকিল আসান করে দাও জলদি। এ বয়সে এসব সহ্য করা ভারী কঠিন ব্যাপার। গলার স্বরটা কেমন চাপা। দুর্বলতার কারণে মিইয়ে গেছে। ভ্রুকুটি ওঠানামা করছে ক্রমাগত দুশ্চিন্তায়। জিজ্ঞাসা করলাম, এধরনের ঘটনা কবে থেকে স্টার্ট হয়েছে ?
কথায় কথায় জানা গেল, মাস দেড়েক আগে তিনটে লোক এসেছিল দেখা করতে। তিনজনেরই বেশ পুরুষ্ট চেহারা, একজনের কলপ করা চুল, সবারই দামী পোশাক পরনে ছিল। এখনো বৃদ্ধের আবছা মনে আছে যে দুজনের তুলনায় একজনের গলার স্বর বড়ই পাতলা। তবে নামধাম অতশত মনে নেই। শহুরে লোকগুলো বলেছিল তারা কীসব হোটেল-টোটেল, শপিং মল গড়বে। রাজি না হওয়াতে শাসিয়ে চলে ‌যায়। হঠাৎ ইভাই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বলল যে, ওরা বহু টাকার অফার করেছিল বাবাকে। আপাতত জিজ্ঞাসাবাদ মোটামুটি শেষের প‌র্যায়।
ওকে। লাস্ট কোশ্চেন, এবাড়িতে থাকে কয়জন?
লোক বলতে সেরকম নেই কেউ। বছর দুয়েক আগে মা গত হয়েছেন। বর্তমানে বাবা আর আমি ছাড়া এক ভৃত্য রয়েছে।
‌ জেরার চোটে জর্জরিত সকলে। সবমিলিয়ে ঘন্টাদেড়েক সময় নিল। বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গুরুগর্জন। আগর গাছগুলোয় বৃষ্টির জল পড়ে চিকচিক করছিল। এই ঝড়-বাদলের দিনে তেল-লঙ্কা দিয়ে মাখা মুড়ি, লাইট নিভিয়ে ভূতের গল্প পড়া, পলকে পলকে পেঁচার কর্কশ আওয়াজ – তোফা লাগে। কিন্তু সে উপায় নেই। তবে পেটে ছুঁচোর ডন মারছে। সেই কোন সাতসকালে একমুঠো মুখে দিয়ে বেরিয়েছি। অতিথিভবনে ফিরে দেখি, মনো‌যোগসহকারে কীসব লেখালেখি করছে পর্ণাদি। পর্ণাদি জিজ্ঞাসা করল, কী হে, সত্যসন্ধান কদ্দূর এগোল? জট কি কিছু খুলল? প্রসন্ন মুখে অ্যাসিটেন্ট নাম্বার টু বলল, হেঃ, হেঃ কী‌ ‌যে বলো না, জিজ্ঞাসাবাদ এমন কী আর কঠিন কাজ তবে মগজাস্ত্রের প্রয়োগে ইয়ে - যেই তিমিরে সেই তিমিরে। গড় গড় করে পর্ণাদিকে জেরার পুরো রিপোর্ট দিয়ে দিল।
খাওয়া দাওয়ার পর ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খে‌য়ে ধীরেসুস্থে বসে পর্ণাদি বলল একখানা লিস্ট বানিয়েছি, চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্যে এবং মোটিভও মোটামুটি ধরতে পারছি বলেই মনে হয়।
আরম্ভ হল লিস্ট পাঠ –
১. হিমালয় পাদদেশের সাধুজি - লোককে ভয় দেখিয়ে টাকা জোগাড়ের ফন্দি। ধরে নেওয়া ‌যেতে পারে এ আসলে চক্রান্তের সঙ্গে ‌যুক্ত। কিন্তু সামান্য প্রতিভূ মাত্র।
২. ফ্ল্যাট, বিল্ডিং, হোটেল বানাবার জন্য আসা লোক। সাধারণ মানুষদের ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইছে। গোটা গ্রামটাকে তুলে দিলে কাজের সুবিধা হবে। সুতরাং তাদের সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করা যায়।
৩. ইভাই রদরিগেজ। ওদের চর। এখানে আসার দুদিন আগে গোপনে প্রেস্টেন ও হার্লকে খুন করে। ‌যাতে গ্রামের লোককে ভয় পাইয়ে দেওয়া যায়। যে কোম্পানিতে চাকরি করে সেটার কি আদপে অস্তিত্ব রয়েছে?
মানে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলাম ওর দিকে। রস অ্যান্ড সন্স কোম্পানি দুবছর পূর্বে ধারদেনার দায়ে বন্ধ হয়ে যায়। ইভাই সেখানে মাত্র মাস দেড়েক কাজ করেছিল। তারপর ছেড়ে দেয়।
কীভাবে জানলে? দীপু শুধোলো।
ওটুকু না জানলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দিতে হয়ে যে দীপু ম্যা‌ডাম। ওটা বরং অজান্তেই থাক।
দরজায় টোকা। উঠে গিয়ে খুলতে এক অপরিচিত আগন্তুক ঘরে ঢুকে এল। নিজের নাম বলল এডওয়ার্ড ইয়ুং। পেশায় সাংবাদিক। বছরের অধিকাংশ সময় এশিয়া টু ইউরোপ টু ওশিয়ানিয়া টু আফ্রিকায় কাটে। এখানে ওনার পদধূলি পড়েছে স্রেফ নেচারফিচার লেখবার জন্য। পেল্লাই চেহারা, ছাঁটা চুল, ডগলাস চশমা চোখে, অদ্ভূত অভিব্যক্তি ফুটছিল চোখেমুখে বারেবারে। চেহারা দেখলেই মালুম হয় বেশ অভিজাত ঘরানার। ভদ্রলোক বললেন – সেই বিখ্যাত ফেমাস থ্রি নও কি তোমরা? আমরা তো থ! নিজেদের কানকেই বিশ্বাস করা ‌যাচ্ছিল না। জানলেন কেমন করে? দেড় বছর আগে লন্ডনে মূর্তি উদ্ঘাটনে গেছলুম। মজার জন্য ম্যাগাজিনে ফেমাস থ্রি নামকরণ করেছিল। তা সেখানে থেকেই জেনেছি। ভদ্রলোক বেশ মিশুকে ধরনের। ওনার গ্রেট অ্যাট্রাকশন হল কস্তুরীমৃগ অ্যান্ড ভারতের সাধুরা। হঠাৎ দীপুর দিকে তাকালেন, বললেন কখনও কি হাতির পিঠে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে ? ‌যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় দীপু বলল, তা হয়নি বৈকি। তবে বুঝতে পারছিলাম দীপু খেপে লাল। হাজার হোক ফেমাস থ্রি এর মেম্বার বলে কতা! আরও খানিকক্ষণ গল্প করে বিদায় নিলেন ভদ্রলোক।
খানিক বাদেই ইভাইয়ের ফোন। জানাল আমরা চলে আসার পরে পরেই ওদের কাঠের বাড়িখানার পিছন দিকে দেয়াল ঘেঁষে ইউক্যালিপ্টাস গাছের ঠিক নীচে একটা রক্তমাখা কঙ্কালের মাথা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আশেপাশে টুকরোটাকরা পাখির পালক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেখেটেখে মোমিন আরও দুশ্চিন্তা করছে। এখন আরও একদম অনড় – অটল যে প্রেতাত্মা ভর করেছে। দীপু একটু ডানপিটে গোছের, সে বলল, অবিশ্বাস্য! দুবির্পাক! দু‌র্যোগ‍! নির্ঘাত গুপ্তচর নিয়োগ করেছে ব্যাটারা। পর্ণাদি বলল, খুব একটা ভুল বলেনি দীপু। গুপ্তচর লাগানোটা ইমপসিবল নয়। চোখ টাকে নাচিয়ে দীপু বলে উঠল, মোমিনের ঘর ছাড়ার সময় কী দেখে ছিলিস মনে আছে?
দুটি লোক দামী টাইটানের‌ ঘড়ি পরে আসছিল সেই মুহূর্তে। আই থিঙ্ক, হাজার বিশের ওপর দাম।অত দামী ঘড়ি পরার সামর্থ্য নেই এদের কারোর। তাহলে পেল কীভাবে? পর্ণাদি হেসে বলল, বেড়ে বলেছিস তো। মস্তিষ্কের বিকাশ হচ্ছে তবে।
এরপর বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে ডিনারের পরে যেটা ঘটল সেটার উল্লেখ না করলে এ গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এসব পাহাড়ী গ্রামাঞ্চলে শীত মানে একদম হাড়কাপাঁনো, কনকনে ঠান্ডা। বাইরে পুরু কু‌য়াশার আস্তরণ, ঝিঁঝিঁর ‌ডাক, বড় ঘড়ির কাঁটার আওয়াজ, হুশহাশ করে দু একটা গাড়ির আওয়াজ আবহাওয়াটাকে ভৌতিক ও রহস্যময় করে তুলেছিল। ঢং ঢং করে একটার কাঁটা পড়ল। শাগরেদ দীপু নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। ‌যাকে বলে কুম্ভকর্ণ। পর্ণাদিও ঘুমে অচেতন। কেবল আমারই ঘুম আসছিল না। মনটা আনচান করছিল। অবশেষে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে পায়চারি করতে লাগলাম। শেষমেশ চোখটা বুজে এসেছে তখনই চট করে ঘুমের আমেজটা ভেঙে গেল ঠান্ডা হাওয়া আর ঠকঠক শব্দে। ফ্যাকাশে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। জানলাটা খুলে গেছে, একটা ‌কালো হাত ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। মুখটা কালো কাপড়ে ঢাকা। তারমধ্যে জ্বলজ্বল করছিল চোখগুলো। ছুঁড়ে মারল একটা গোল জিনিস সিমেন্টের সাদা কালো পাথরের মেঝের দিকে। ঘরের টিমটিমে বাল্বের আলোয় জিনিষটা দেখে রক্ত হিম হয়ে গেল। কুন্ডলী পাকানো একটা মোটা সাপ। স্নায়ুর সমস্ত শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আসছিল। সাপের হিস্ হিস্ হিস্! ঘড়ির টিক্ টিক্। আঁ আঁ আঁ – আতঙ্কে মুখখানা সাদা হয়ে গেছে দীপুর। কখন ওর ঘুম ভেঙে গেছে। ইতিমধ্যে ল্যাম্পটা জ্বেলেছে পর্ণাদি। চেয়ারে পা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে গেল। আমরাও ওর পিছু পিছু লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
কেয়ারটেকার অবিনাশ বাবুর দোতলার চিলেকোঠার ওপারে শেষ ঘরটি। দু-তিনবার নক করার পর চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে সবুজ রঙের ছোটো দরজাটা খুলল। মুখে জোরালো বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। সব শুনে টুনে ওনার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! এস পি কে ফোন করে ফরেস্ট অফিসারদের খবর পাঠানো হল। দরজা বাইরে থেকে আটকাল অবিনাশবাবু। অন্য ঘরে শুতে গেলাম। রাত্রে ভালমতো আর ঘুম হল না।
ওটা, ওটা। স্যান্ডপাইপার পাখিটাকে দ্যাখ! ফ্যন্টাসটিক! ভালো করে তুলবি। বললাম দীপুকে। নকরেক অরণ্য ছাড়ার মুখে সোজা উইলিয়ামস নগরে চলে ‌যাওয়ার পথ। সোয়া এগারোটা। দুর্দম অরণ্যে ফুটে রয়েছে অগুনতি রং বেরঙের ফুল। সু‌র্যের সঙ্গে গাছপালাগুলোর যেন চিরশত্রুতা। আলো না ঢোকার কারণে পরিবেশটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, ভিজে। মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। এবার মূল কথা আসা ‌যাক। সকাল হতে পারল না, তার আগে পর্ণাদি বলল, একটু দরকারি কাজ পড়েছে। তোরা ‌যা একটু বেড়িয়ে আয়। সত্য সন্ধানে এসে রসকসহীন হয়ে কাজ করলে মনমেজাজ খোলে না। বরং প্রকৃতিকে অনুভব করলে কাজে দেবে। গাছপালা ঘেরা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু মুডটাই নষ্ট হয়ে ‌যায় দীপুর কারবারে। সম্প্রতি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে একটা বন্ধুবৃত্ত তৈরী হয়েছে। ক্রমাগত ফটো তোলা আর আপলোড করা। নজরে পড়ল নকরেকের সবথেকে সুপ্রাচীন গুহার দিকে। প্রচুর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে আজও। দীপু বলল চল টিনা, একবার দেখে আসি। প্রবেশ করতেই একটা বাদুড় ফস করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। সোঁদা সোঁদা গন্ধ, ভিজে মাটির গন্ধ, শীতের হিমেল হাওয়া, বাদুড়ের ক্যাঁচক্যাঁচানি, মাকড়সার জালে ভর্তি দেওয়ালে মেনটেন্সের অভাব পরিষ্কার। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে ভরপুর। সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক অস্বস্তিকর অচেনা উপরন্তু আধাঁরের গ্রাসে ঢাকা পরিবেশ তৈরী করে তুলেছে। একটা বাঁক পেরোতেই ছোট্ট গলি। সন্তর্পণে পেরোলাম। এরপর বিস্তৃত জায়গা। চলেছি তো চলেছি। দীপু, চল না, ফিরে ‌যাই। উফ, দাঁড়া না। শেষ দেখে তবেই ‌যাব। ভাবলাম কোনো মানে নেই এর। বেগার খাটনি কার পোষায়? এরপর আবার একটা গলি। ঢোকার মুখে দুপাশে দুটো বিশালাকৃতি পাথরের চাঁই রাখা। চাঁইদুটো ছাড়িয়ে গলি দিয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছোলাম। দুটো খাটিয়া, আশেপাশে শালপাতা পড়ে আছে। টুকরোটাকরা খাবারও রয়েছে তাতে। একপাশে কোণে একখানা বাক্স রাখা। সেগুন কাঠের। বেশ মজবুত প্রকৃতির। উপরে কীসব আঁকা জোকা। কিন্তু খুলব কীভাবে এটা? ফাঁকফোকর নেই। অবশেষে দীপুই আওড়াল বুদ্ধিটা। নীচে অতি ক্ষুদ্র গোল জায়গা। আন্দাজ করা খুব অসম্ভব কিছুই নয়। গোল মতন জিনিস ঢোকালে হতেও পারে। পকেটে দু চারটে কাঁচের গুলি নিয়েছিলাম। দরকারে লাগতে পারে। তা সত্যিই কাজে লেগে গেল। ঢুকিয়ে টিপতেই পট করে খুলে গেল। আশ্চ‌র্য ব্যবস্থা। উল্লেখ‌যোগ্য তেমন কিছু নজরে এল না। দুটো তোয়ালে, লুঙ্গি, পেপার, ব্রাশ আর টুকিটাকি জিনিসপত্র। বন্ধ করে বাক্সখানা বাগিয়ে নিয়ে চললুম। আরও ঘন্টা আধ লাগল গুহাটা ছাড়তে।
দীপু, ভাই অনেক খাটালি। সাধ মিটেছে নিশ্চয়ই?
ওয়ান সেকেন্ড ম্যাডাম। সাধ মিটবে এবার। বলে হাতে ধরা বাক্সটাকে সোজা খাদের দিকে ছুঁড়ল। রেগে গিয়ে বললাম এটা কি করলি? হুঁ হুঁ বাবা। ওদের ঘোরালো প্যাঁচে ওদেরকেই ঘায়েল করতে হবে। নইলে শায়েস্তা হবে না ব্যাটারা।
বড়জোর ঘন্টা দুয়েক সময় লাগল আমাদের ফিরতে। ইতিমধ্যে দারুণ কান্ড ঘটে গেছে। পর্ণাদি খোঁজখবর করে ঘড়িওয়ালা লোক দুটোর খবর জানতে পেরেছে। তবে সেকথায় আসছি পরে। দীপুর কান্ডকারখানা শুনে বেশ আপ্লুত ও। বলল মগজখানা বেশ পাকাচ্ছে দেখছি। বেশ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ভাবতে শিখেছিস। চালিয়ে ‌যা।
হঠাৎ পর্ণাদির খুদে ‌যন্ত্রখানা রিংরিং আওয়াজে বেজে উঠলো। স্পিকার অন করে ফোনটা ধরতেই একটা পাতলা অথচ কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে এল, ম্যাডাম বহুত বড়িয়া চালাচ্ছেন আপনি। এর ফল কিন্তু ভালো হোবে না। ভালো কথা বলছি চলে ‌যান। ‌যা হচ্ছে হতে দিন। বেশি তড়পারি করবেন না। গুড বাই ম্যাডাম। বড়িয়া থাকবেন। ফোনটা কেটে গেল।
চট জলদি রিংব্যাক করল। কিন্তু ফের কেউ রিসিভ করল না। ক্রমাগত রিং রিং বাজতে লাগল।
নাম্বারটা নোট করে রাখ। একবার প্রবীরবাবুকে খবরটা দিতে হবে। দরকারে পুলিশের হেল্প লাগবে। মাথাটা পুরো গুলিয়ে গেল। শরীরটা ভোঁ ভোঁ করছে। পর্ণাদিকে ‌যথেষ্ট বিচলিত দেখাচ্ছে। কোন কথা না বলেই বেরিয়ে গেল। এই ফাঁকেই হাতের দামী ঘড়ি লোকগুলোর নাম দেখে নেওয়া ‌যাক। ‌যথাক্রমে – এরিক ও লেফ, দুইভাই। মাঝারি মানের মণিহারী দোকান বাজারে। তাতেই মোটামুটি সংসার চলে ‌যায়। ‌যদিও দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব সদভাব নেই। মাঝেসাঝেই ঝগড়াঝাঁটি হয়। টুকটাক কাজ সারতেই কাটল দিনটা। বেলা মরে এসেছে। এখানে দিনের বেলায় খুব বেশী গরম নয় আবার ঠান্ডাও নয়। মাঝামাঝি তাপমাত্রা। তবে সন্ধ্যে ‌যত এগোতে থাকে ততই শীতের প্রকোপ বাড়ে। দিনের আলো ক্রমশ মিলিয়ে আসছে।
খানিক বাদে পর্ণাদি ফিরে এলো। কীরে, এত দেরী করলে ‌যে বড়? পেলে নতুন কোন নিউজ? গলায় প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, দাঁড়া, ফ্রেশ হয়ে নিই। হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালেটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, ব্রেকিং নিউজ। উইলিয়ামসের কাছাকাছি বুথ থেকে কলটা করা হয়েছিল। বুথের যিনি দেখাশোনা করেন বলেছেন, গাট্টাগোট্টা, লম্বা-চওড়া একজন লোক সাইকেলে চেপে ভরদুপুরে এসে ফোনটা করেছিল। ক্লান্ত লাগছে শরীরটা ছুটোছুটিতে। সেদিন আর কিছু ঘটল না। এরপর দ্রুত নৈশভোজ সেরে বিছানায় গা টা এলিয়ে দিলাম আমরা সবাই। রাত্রে ঘুমটা সবেমাত্র এসেছে তখনি এক মিষ্টি গানের সুর কানে ভেসে এল। সুরটা আসছে এডওয়ার্ডের ঘর থেকে। সেই সুর যেন রাতের নীরব প্রকৃতির সাথে মিশে এক চমৎকার স্নিগ্ধতা ফুটিয়ে তুলছে। আজব পড়শি জুটেছে তো!
পরের দিন সকালে মিষ্টি হিমেল হাওয়া বইছে। মুখ ভার আকাশের। এতগুলো মৃত্যু! একরাশ কান্না জমিয়ে রেখেছে কিনা! এরিক এবং লেফের বাড়ির হদিশ মিলেছে। তারই ছোট্ট একটা ম্যাপ এঁকে আমাদের দিল পর্ণাদি। ওয়েট করবে আমাদের জন্য ওখানে। ও বেরিয়ে গেলে খানিক পরে আমরাও ব্রেকফাস্ট সেরে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। পিঠে রুকস্যাক চড়িয়ে রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে রওনা দিলাম।
গ্রামের সকলে যে ‌যার কাজে ব্যস্ত। এরিক ও লেফ নামক ব্যক্তি দুজন গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে নিরিবিলি প্রকৃতির এমন জায়গায় বাস করে যে ওদিকে সচরাচর লোকজন খুব একটা পা মাড়ায় না। রাত্রি হলে তো কথাই নেই। প্রচলিত আছে, গভীর রাতে কারা হেঁটে বেড়ায়। মাঝেসাঝে এক মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে কাছের এক ভাঙা মন্দির থেকে। কাকে শাপশাপান্ত করে। হরেক গাছগাছালিতে ছাওয়া এলাকা। বট, অশ্বথ, ইউক্যলিপ্টাস, পাইন কী নেই। অজস্র বাহারি ফুল। নুড়ি কাঁকর বিছানো এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পথ। মাঝেমধ্যেই হোঁচট খাচ্ছিলাম। শীর্ণ জলস্রোত বয়ে চলেছে আমাদের পাশে পাশে। বিশাল পাইন গাছের পাশে ছোট্ট টিনের বাড়ি। লাল রঙের দেয়ালের ওপর কারুকা‌র্য করা। ভগ্নদশা। বাংলো থেকে শ’খানেক হাত দূরে এই কুটির। ঘর থেকে একটু দূরে গাছের নীচে পাথরের উপরে বসে জিরোচ্ছিলাম দুজনে। হঠাৎ হালকা বৃষ্টি শুরু হল। ‌বৃষ্টির ঝুপুর-ঝাপুর শব্দ শুনতে বেশ লাগে কিন্তু। ‌যখন বৃষ্টিটা প্রায় থেমে এসেছে তখন দূরে দেখলাম এক মহিলা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে এদিকে। পিছন পিছন এক কিশোর। কাছে আসতে দেখি পর্ণাদি।
সরি, সামান্য দেরী হয়ে গেল। ওকে, মিট দিস ইয়াং ফ্রেন্ড - হাঁফাতে হাঁফাতে বলল পর্ণাদি। শ্যামলাবর্ণ ছেলেটি বছর দশ বারোর হবে। পরনে হাফহাতা জামা আর ফুলপ্যান্ট। হাতেপায়ে ছড়ে ‌যাও‌যার দাগ। এক চিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে। সব‌চেয়ে আকর্ষণীয় কোঁকড়ানো চুলগুলো। যার ফলে চেহারাটা অনেকটা আফ্রিকান ছেলেদের মত লাগছে। নাম ডুংরি। একটা বাক্স খুলল ডুংরি। তাতে বেশ কিছু সামগ্রী। একটা কাঠি মতন জিনিস বের করে মরচে পড়া তালার ভেতরে ঢুকিয়ে চাড় দিল। বাইরের হালহকিকত দেখলেই উপলব্ধি করা ‌যা‌য় অন্দরের সৌন্দ‌র্য কতখানি। তেমন কোনো আসবাব নেই ঘরে। তেপায়া, খাটিয়া, আলমারী, টুল, টেবিল। তন্নতন্ন করে গোটা ঘরটা সার্চ মারলাম। কিছুই নেই সেরকম। ‌যবনিকা পতন ঘটতে ‌যাবে সেই মুহূর্তে দীপু চাপা আতঙ্কের স্বরে ফিসফিস করল, টিনা ওই দ্যাখ। খাটের তলায় দলা পাকানো একটা ছোট্ট কাগজ। তড়িৎ বেগে ছুটেও শেষরক্ষা হল না। সচকিতে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে দীপু। উঁকি মেরে কোনো লাভ হল না। বোধগম্য হল না কিছুই। কীসব আবোল-তাবোল লেখা। হাতের লেখাটি পরিস্কার নয় বরং ঘষঘষে, অমার্জিত। ঈষৎ চিন্তিত ঠেকছে পর্ণাদিকে। দীপুও খুব একটা কথা বলছে না। ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল।
খাটে শুয়ে দীপু বলল, উফ্ মাথাটা পুরো গুলিয়ে ‌যাচ্ছে। এইচ, সি, বি, জি, এ, এ, ডি, এইচ, এইচ, এফ, এ এসবের মানেটাই বা কী?
নিতান্তই এলেবেলে লেগেছিল প্রথমটাতে। পরমুহূর্তেই মনে হয়েছিল শুধুমুধু এমনটা লিখতে ‌যাবে কেন? এটা সলভ করতে পারলে কেসটার প্রচুর সুরাহা হবে। খটকা খটকা ভাব ‌যতটাসম্ভব মুখে ফুটিয়ে বললাম, কোনো কূলকিনারা করা ‌যাচ্ছে না। তুই কিছু পেলি ভেবে? প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারের চল ছিল। এটিও সেরকম গোছের কিছু সম্ভবত। ‌যদি বেঙ্গলি লেটার্‌স্‌ দিয়ে রিঅ্যারেঞ্জ করি সেক্ষেত্রে মুশকিল আসান হচ্ছে না - চিন্তিত স্বরে দীপু বলল।
কিন্ত নাম্বার ইউজ করি তাহলে কীরকম হবে?
উল্টে মিসট্রি আরও পাজলড্ হয়ে ‌যাবে। তোর পরামর্শ অনুসারে দাঁড়াচ্ছে, ৮৩২৭১১৪৮৮৬১। আইডিয়া‌টার গুড়ে বালি!
আলোচনাসভার মধ্যিখানে খুদে ‌যন্ত্রখানার ঝংকার। খুদে না বলে বৃহৎ বলাটাই ভাল। টেলিফোনটা ধরতেই কর্কশ কঠোর কন্ঠস্বর এল, কে কথা বলছেন? পরিস্কার বাংলায় বলছে লোকটা। আপনি কে বলুন আগে? সভয়ে বলল দীপু। শুনুন, বেশি তড়পারি করবেন না। বেড়াতে এসেছেন, মামুলি টুরিস্টদের মতন থাকুন। খানাপিনা করুন, ঘুরুন, ফিরুন। এখানকার লোকেদের হালহকিকতের মধ্যে নাক গলাচ্ছেন কেন? কাল দুপুরে গ্রিনভিউ হোটেলের বিপরীত দিকের পিঙ্ক বাড়িটাতে চলে আসবেন। ফোনটা কেটে গেল। টেলিফোনটা রাখতে রাখতে গলাটা ‌যতটাসম্ভব নীচু করে বলল, কিস্যু নেই মগজে। আইডিয়া করে ‌যদি ভয়েস রেকর্ডারটা চালিয়ে দিতাম ইস্ ...।
ঝমঝমে বর্ষা। ভোরের দিকে হাল্কা কমলেও এখন আবার যে কে সেই। পথেঘাটে জল জমে লোকজনের একেবারে জবুথবু অবস্থা। স্বাভাবিকই বেরোতে দেরী হয়েছে। ব্লু অ্যাম্বাসাডর ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলেছি। নিঃশব্দে ছুটছিল গাড়িটা। দূরদূরান্ত অব্দি ঘন কুয়াশায় ‌ঢাকা উঁচু সারিবদ্ধ পাহাড় ছাড়া প্রায় কিছুই চোখে পড়ে না। পাশ দিয়ে খাদ চলে গেছে। একটু অসাবধান হলেই সোজা পপাত ধরণীতল! উইলিয়ামস নগরের গ্রিনভিউ হোটেলের ভীষণ সুখ্যাতি। ‌যার জেরে দেশ-বিদেশ থেকে ‌প্রতিনিয়ত টুরিষ্ট আসাযাওয়া করছে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে ঘন্টা দেড়েক মতন সময় লাগল। উল্টো দিকের পিঙ্ক কালারের বাড়ির দিকে এগোলাম। মুল ফটক থেকে কিছুটা দূরে অট্টালিকাখানি। ঝলমলে বাহারি ফুল ফোটা বাগান শোভা পাচ্ছে। পাশে পাথরফলকে খোদাই করা, প্রিন্স অ্যালেন, ১৯২৯। আধা পথ হেঁটে দরজা। বেল বাজাতেই কালো গুঁফোমতো একটা লোক দরজা খুলল। বিরাট এক হলঘরে নিয়ে এল আমাদের। ঘরটি প্রায় গোল। ঘরের মধ্যিখানে সোফাসেট আর মাঝখানে একটা সুন্দর কারুকা‌র্য করা শ্বেতপাথরের টেবিল। মাথার উপর ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে। লাল দেয়ালে তলোয়ার, বাঘছাল, পশুর শিং হরেকরকম জিনিস ঝুলছে। এছাড়া নামজাদা কয়েকজন আর্টিস্টের তেলচিত্র টাঙানো। আলাপ আলোচনা করার জন্য উপ‌যুক্ত ঘরখানি। দীপু খুব মনো‌যোগসহকারে লক্ষ করছিল আসবাবগুলো। বলল টিনা, সি দ্য রাউন্ড ফার্ণিচার অফ হোয়াইট মার্বেলস উইথ বিউটিফুল ডিজাইনস।
আমি আর পর্ণাদি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতে হল। সাড়ে ছ ফুট লম্বা চওড়া গাট্টগোট্টা পেশিবহুল চেহারা, মজবুত স্বাস্থ্য, ইয়া পাঁকানো গোঁফ, দামী প্যান্ট শার্ট পরা একটা লোক নামল সিঁড়ি বেয়ে।দরাজ গলায় বলল, নমস্কার ম্যাডামজি। তবিয়ত- উবিয়ত সব ভালো আছে তো? কুছু অসুবিধা হচ্ছে কি বহেনজি? কথায় কথায় উপলব্ধি করতে পারলাম, লোকটা কেতাদুরস্ত। চালাকও। সহজে ছাড়বার পাত্রটি নয়। তবে চেহারার সাথে একটা জিনিস বড়ই বেমানান বইয়ের পাতা ওলটানোর মত ফ্যাঁসফ্যাঁসে কন্ঠস্বর।
এটা ওটা কথার পর পর্ণাদি সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বসল আমাদের এখানে ডাকার কারণটা জানতে পারি কী?
অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেনো? কলকাত্তাসে আয়ে হ্যায় আপলোগ। খানা পিনা করেন, মৌজ মস্তি করেন। খামোখা ভূত – টূতকে মামলে পে কিউ নিজেকে জড়াচ্ছেন? ভালো বলছি, চলে ‌যান। নেহি তো ভালো হোবে না। হাম আপকো টাকা দেঙ্গে। ‌যতখুশি ঘুরুন, ফিরুন।
পর্ণাদি মিষ্টি করে বলল, ঘোরাফেরার টাকা আমাদের আছে। আমরা তদন্ত করতে করতেই ঘুরি।
ভূত-টূতকে ঝুটঝামেলাতে কিউ ‌যাচ্ছেন? মোমিন বহুত ধড়িবাজ লোক আছে। ওসব কোথায় মধ্যে কান দেবেন না। সোব মিথ্যা বাতচিত।
ঈষৎ রাগত স্বরে পর্ণাদি বলল, মোমিনের চরিত্রটি মোটেও সেরকম নয়। ভক্তিশ্রদ্ধা করে সকলে তাকে।
ঘষা কাগজ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছেন। - গলতি করছেন ম্যাডাম। কুছু খারাপ হো ‌যানেকে বাদ বলতে আসবেন না। এখনো ভি বলছি টুরিস্টদের মত থাকুন। বিপদ কিস্যু হোবে না। লেকিন...।
সরি, মিস্টার। আপনার প্রস্তাব মানতে পারছি না। ‌বন্ধ তো করবই না বরং কাজ চালিয়ে ‌যাব। রেডি হন পুলিশের হাতকড়া পরার জন্য। চলি, আজ তাহলে। শুধুমুধু সময় নষ্ট করলেন আমাদের। রাগে থরথর করে কাঁপছে। কাশ্মীরী লঙ্কার মতো টকটকে লাল মুখখানা। গরগর করছে ক্ষেপে। বাইরে বেরিয়ে আসার সময় কানে এল, ফল ভোগ কোরার জন্য রেডি থাকুন। গুড লাক পর্ণা ম্যা‌ডাম! একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সন্তর্পণে ছেড়ে এলাম ওই বিশাল প্রাসাদ। ভাবভঙ্গি মোটেও ভাল ঠেকছিল না ফ্যাঁসফ্যাঁসে লোকটাকে। ছয় কি সওয়া ছয় হবে। ‌যান‌যটের কারণে গাড়ি এগোতেই চায় না। পাহাড়ি রাস্তা ক্রস করে ঘন বাঁশবনে ঘেরা নুড়ি-কাঁকর ছড়ানো ছিটানো পাথুরে পথ ধরে এগোচ্ছি। শুনশান রাস্তা। দুভের্দ্য ঘন অন্ধকার। টু শব্দটি প‌র্যন্ত নেই। টিপটিপে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির কাচ বন্ধ। বাইরে প্রচন্ড শীত। পর্ণাদিকে ঈষৎ চিন্তিত ঠেকছে। দীপুটাও কেমন থম মেরে গেছে। খটর খট খট খটাস! আচমকা এরকম বিশ্রী শব্দে আঁতকে উঠলাম। চমকেছে দীপু আর পর্ণাদিও। শশব্যস্ত হয়ে পর্ণাদি বলল, কী হল সাধুলাল? গলায় প্রবল উৎকন্ঠা। তাড়াতাড়ি নেমে বাইরে গেল সাধুলাল। বলল, টায়ার পাংচার। সহজে মিটবে না এ ঝামেলা।
এই সেরেছে! ব্যস্ত হয়ে উঠলাম আমি। তা সারাতে কতক্ষণ লাগবে? ড্রাইভার জানালো আন্দাজ একঘন্টা সওয়াঘন্টা লাগতে পারে।
বিরক্তির একশেষ! - উষ্মা ঝরে পড়ল দীপুর কন্ঠস্বরে। বৃষ্টি থেমে এসেছিল প্রায়। গা গড়িয়ে টুপটাপ জলের ফোঁটা পড়ছিল। হাতে একফোঁটা লাগতেই শরীরের ভিতর কেমন শিরশিরানি ভাব জেগে উঠছিল। এদিক ওদিক পায়চারি করছিলাম। কিছুটা দূর থেকে দীপুর চিৎকার শুনলাম, আঁ আঁ আঁ! আর্তনাদ শুনে এক লহমায় দুজনেই ছুট দিলাম সেদিকে। অমন হাড়হিম করা চিৎকার করলি কেন? বুকখানা ধড়ফড় করে উঠেছে। আর একটু হলেই হার্টফেল করতাম। আঙুল দিয়ে দেখাল কিছুটা তফাতে একটা মাঝবয়সী লোক উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। চোখ দুটো বোজা। মনে হল বেশ খানিক্ষণ আগেই প্রাণ উধাও! মনের মধ্যে ভয়, উত্তেজনা, উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছিল। গলার কাছটা কেমন দলা পাকিয়ে আসছিল। ঠান্ডা একটা রক্তের স্রোত বয়ে গেল শরীরের ভেতর দিয়ে। বারদুয়েক নাড়ি টিপল পর্ণাদি। নো সাড়াশব্দ। ফুল ডেড। পরনে তেমন কিছুই নেই। অতি সাধারণ পোশাক-পরিচ্ছদ। উর্ধাঙ্গ শূন্য, নিম্নাঙ্গে ফিকে নীল-সাদা রঙের লুঙ্গি। সর্বাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত। ঘাড়ের একপাশে সরু তিনটে কালো দাগ। টিনা, ঘাড়ের কাছটা ভালো করে দেখ তো। শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছে। রক্তশুন্য ঠেকল জায়গাটা কীরকম। তুরার এস.পি সাহেব রুপকুমার সিংকে খুদে ‌যন্ত্রখানার মাধ্যমে সংক্ষিপ্তভাবে ঘটনাটার বিবরণ জানাল পর্ণাদি। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর দূর থেকে জিপের হে‌ডলাইটের আলো ভেসে এল। অন্যমনস্ক ছিলাম। জিপ নয়, বৃহৎ কালো অ্যাম্বাসাডর। সাদা শার্ট পরা এস.পি সাহেব নামলেন। দুজন কনস্টেবলও।
ম্যাডাম, দিন দিন কী হারে বেড়ে চলেছে রহস্য – হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন এস.পি। গুলিয়ে ‌যাচ্ছে সব! আবার আজ এই কান্ড! বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেব।
পর্ণাদি বলল, লোকটার ব্যাপারে খানিক সুলুকসন্ধান করতে হবে। রিপোর্ট হাতে পেলে খবর দেবেন। চলি, এস.পি সাহেব। গুড নাইট। কিছুক্ষণ আগেই আমাদের গাড়ি ঠিক হয়ে গেছিল।
ফিরলাম ‌যখন পৌনে নটা কি নটা। ডারবোকগিরিতে সেইসময় তান্ডব চলছিল। আশপাশ থেকে টুকরোটাকরা উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে। বাংলোর জানালাগুলোর পাল্লা থরথর করে কাঁপছে। কতকগুলো কুঁড়েঘরের চাল উড়ে গেছে। পথের কয়েকটা গাছ উপড়ে পড়ে ছত্রখান অবস্থা। বিদ্যুৎ সং‌যোগ বিচ্ছিন্ন। উপলব্ধি করতে পারছিলাম প্রকৃতির হাতে কতখানি নিরুপায় মানুষ। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। ক্যান্ডেলাইট নৈশভোজের জম্পেশ ব্যবস্থা। শীতও ‌হাড়কাঁপানো পড়েছে। খেতে খেতে কেসের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিল। পর্ণাদি জিজ্ঞাসা করল টিনা, ভদ্রলোকের ঘাড়ের কাছটা লক্ষ করেছিলিস?
রক্তশূন্য। উপরন্তু কালো কালো দাগ। কোনো প্রাণী কামড়েছিল কি?
চান্স থাকাটা অসম্ভব নয়। দাঁড়া রিপোর্টটা হাতে পাই। তখন দেখা ‌যা‌বে। তবে জন্তু জানোয়ার হবার চান্স কম। জাস্ট অনুমান। এটা কোনো প্রাণীর কাজ না।
নৈশভোজের পর শোওয়ার ব্যবস্থা। এরা নিঃসন্দেহে খুবই অতিথিপরায়ণ। রুমে হ্যাজাকবাতি জ্বলছে। পর্ণাদি অভ্যাসমতো কি একটা বই পড়ছে। দীপুটাও কীসব না জানি নোটবুকে হাবিজাবি আঁকিবুকি কাটছে। দীর্ঘ পরিশ্রমের ক্লান্তির চোটে আর গরম লেপের ওমে দ্রুতই ঘুম এল।
গতকালের অভি‌যানের পর ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। সাড়ে নটা কি পৌনে দশটা। ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ অন করলাম। টিভির পরির্বতে এটাই ভাল। পর্ণাদি বলল, রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ নাকি বৃষ্টি থেমেছিল। ‌যদিও ‌একঘন্টা আগে এক পশলা হয়ে তবে রেহাই দিয়েছে। ইতিমধ্যে ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট। চার ব্যাটারীর জোরালো টর্চ, রিভলবার, জলের বোতল রুকস্যাকে ভরে পিঠে চ‌ড়িয়ে রওনা হলুম। ‘নকমা’ মোমিন এক কিশোরকে পাঠিয়েছিল। আগন্তুকটি ‌যদিও ফেমাস তিন এর অপরিচিত নয়। ডুংরি। দুঃসংবাদটি এসেছিল, মোমিনের বাড়ির উল্টোদিকে খাপরা ছাওয়া ইট খসা কুঁড়েঘরটিতে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ বাস করেন। বিয়েথাওয়া করেননি। দুই চাষি কাকভোরে মাঠে ‌যাও‌য়ার পথে খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে, বৃদ্ধটি গোঙাচ্ছেন। চোখ দুটি ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়! দরদর করে ঘামছেন। লোকজন জড়ো করে দরজা ভেঙে ধরাধরি করে বদ্যির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কথাগুলো বলার সময় এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল ডুংরির চোখেমুখে। তাড়াতাড়ি স্পটে পৌঁছলাম। ঘরের মাথায় খাপরা ছাওয়া ঠিকই, তবে নষ্ট হয়ে ‌যা‌য়নি। চকরা-বকরা মাটির দেয়াল। এগুলিই এখানকার ঘরদোরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অদূরে একচিলতে জমি। তাতে কিছু হলুদ সর্ষেফুল মাথা চাগিয়ে উঁচু হয়ে জেগে রয়েছে। মিষ্টি নরম বাতাস বইলে কী সুন্দর দোলে। দেখতে ভারী লাগে। এলাকাটা বড় পরিস্কার। ‌যদিও গতকালের ঝড়-ঝঞ্জাটের পর তা আর নেই।
দীপু আঙুল তুলে একটু দুরের দিকে দেখিয়ে বলল টিনা, দ্যাখ রেস্টহাউস। টুরিস্টরা মনেহয় মাঝেমধ্যে এখানে বেড়াতে আসে।
তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। দুটো ঘর। শোবার একটি, অপরটি বৈঠকখানা। অন্দরের সাজসজ্জা তেমন দেখনদার নয়। নেহাতই সাদামাঠা। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার বুড়োর বাড়িতে ফিরে এলাম। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর এক জুলপি ও‌য়ালা বৃদ্ধ দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। সঙ্গে এক তরুণ। বৃদ্ধকে শক্তপোক্ত ভাবে ধরে আছে। আঁটোসাঁটো চেহারা। আলাখাল্লা ধরনের পোশাক আর সাদা প্যান্ট পরা। শরীর বড়ই দুর্বল। মুখে হাজারো বলিরেখা। চোয়ালটি বৃহৎ জুলপি দ্বারা ঢাকা। এক দর্শনেই সর্দারজি-সর্দারজি বলে গণ্য করাটাই স্বাভাবিক। এসে একটা বেতের মোড়ার উপর বসলেন।
ভদ্রতার হাসি বিনিময় করে পর্ণাদি স্টার্ট করল, এখন কি সুস্থ বোধ করছেন?
কিছুটা করছি বটে।
পরিচ‌য় পর্ব সারার পর পর্ণাদি বলল, মূল প্রসঙ্গে আসা ‌যাক। গতরাত্রে কী ঘটেছিল তা ‌যদি সংক্ষিপ্তভাবে বলেন সেক্ষেত্রে কেসের সুরাহা হবে।
কীভাবে শুরু করি বলুন তো? সন্ধ্যে থেকে বলি তাহলে।
‌ যেমনটি আপনার মর্জি।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কাল দ্রুত শুয়ে পড়েছিলাম। কদিন ধরেই শরীরটা ভালো ‌যাচ্ছিল না। জানালাটা ভেজানো ছিল। ঝড়বাদলের দিন এমনিতেই। ‌যদিও গাছপালা ঘেরা এলাকা বলে দাপটটা অত বেশী দেখা ‌যায়নি। ভোর চারটে কি সাড়ে চারটে হবে। বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেছিল। পাল্লাগুলো খোলা। সেইমুহূর্তে এক প্রকান্ড ছায়ামূর্তি সরে গেল। তার মধ্যেই যতটুকু দেখলাম কপাল থেকে চোয়াল শ্বেতবর্ণ। আগুন ঝলসাচ্ছে চোখ দুটো দিয়ে। দুহাত মিলিয়ে নখগুলো বড় বড়। এছাড়া আমার পক্ষে আর বর্ণণা করা অসম্ভব।
দীপু ঝানু গোয়েন্দার মতন জিজ্ঞাসা করল, ফ্যামিলিতে কেউ নেই আপনার?
অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে গলাটা ‌য‌তটাসম্ভব নীচু স্বরে নামিয়ে এনে বললেন, এক ছেলে। বলছে জমিজমা বেচে উইলিয়ামসে চলে ‌যাব। আমি এ এলাকার বহু পুরোনো বাসিন্দা, জীবনে এ ঘটনা ঘটেনি। নিরাপদ ঠেকছে না আর এ তল্লাট। শিগগির মালপত্তর গুছিয়ে রওনা দেব। আর নয়, বাপু। বহু সাধ মিটল জম্মের মতো।
‌‌ধনব্যাদ।– মিষ্টি হাসি দিল পর্ণাদি, ইনফরমেশন দিলেন প্রচুর।
পকেট থেকে কড়কড়ে হাজার টাকার নোট বার করে তরুণটির হাতে গুঁজে দিল, ওনার দেখভাল করবে ভাল করে আর সময়মতো ঔষুধপত্র খাওয়াবে ডাক্তারের পরামর্শ অনু‌যা‌য়ী। চলি, আজ তাহলে। সুস্থ থাকবেন।
ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। পনেরো মিনিটের পরিবর্তে দু ঘন্টা। মাঝরাস্তায় শখ চাড়া দিয়ে উঠেছিল দীপু ম্যা‌ডামের। অগত্যা ফের একবার ঢ়ুঁ মারতে হল উইলি‌য়ামস শহরে। ওখানকার অসাধারণ প্রকৃতি নাকি খুব টানে ওর মনপ্রাণ। টানবারই কথা অবিশ্যি। নিদেনপক্ষে এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যের মাহাত্মটা গভীরভাবে, হাড়ে মজ্জায় প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। কলেজ চত্বর পার হলেই ছোট্ট মাঠ। একদিকেতে ছোট্ট উইপোকার ঢিবি। সেখানে বহুদিনকার পুরোনো বৃহৎাকার এক বট গাছ দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব লাগছে। ক্যামেরা দিয়ে ফটাফট কতকগুলি ছবি তুলে নিল দীপু। বাংলোয় ফিরে গতকাল ও আজকে ঘটে ‌যাওয়া ঘটনাগুলো ডাইরিতে লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। পর্ণাদি শীতল জলধারায় তাজা করছে মনপ্রাণ।
খাবার টেবিলে আমরা তিনজন।
দীপুর শব্দজব্দ আর কেস সম্বন্ধীয় ‌যাবতীয় আলোচনা চলছিল।
সুঁড়ুৎ সুঁড়ুৎ - এক নিমেষের মধ্যে কফি শেষ করে ফেলে বলল, ওফ, ক্যান্ডেললাইট ডিনারের মজাই আলাদা। তুলনা হয় এর কোনো! তা ভাই টিনা, সংকেতটার কোনো হাতামাথা পেলি খুঁজে? কষ্টেসৃষ্টেও কূলকিনারা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনে দিনে কেস কেমন জটিলে পরিণত হয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে খেয়াল করেছিস?
কাঁটায় চিকেন প্রন গাঁথতে গাঁথতে বললাম, মন্দ বলিসনি। ঢিকির ঢিকির তালে কেস চললে কারই বা ভাল্লাগে বল? ক্রমাগত গলিখুঁজির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। লাস্ট ডিজিট অর্থাৎ এগারোতম নাম্বারটাকে বাদ দিলে কী ফল হচ্ছে?
মুখ বেঁকিয়ে দীপু বলল, ধুস জমল না ব্যাপারটা। শুধুমুধু অপ্রয়োজনে লিখতে ‌যাবেই বা কেন? কা‌র্যকারণ সম্পর্ক কোনো না কোনো ভাবে তো আছেই।
পর্ণাদি খুদে ‌যন্ত্রখানায় কাকে যেন মেসেজ পাঠাচ্ছিল। ঘাড় নাড়ল পর্ণাদি। অ্যাবসোলুটলি, দীনাটিপু। অনুভব করতে পারছ কা‌র্যকারণ সম্পর্কের অথচ সলভের ব্যাপ্যারে যে তিমিরে সেই তিমিরে! ভেরি ব্যাড। মগজটাকে কাজে লাগাও। খোলে ভর্তি হয়ে ভোঁতা হয়ে ‌যাচ্ছে যে বুদ্ধির পরিমাণ। হো হো করে হাসতে লাগল পর্ণাদি।
রাখো তোমার জোকস্, ক্ষোভ ঝরে পড়ল কন্ঠে, মোদ্দা কথায় এসো তো।
আসছি,বাপু, আসছি। গোমড়ামুখো হয়ে তদন্তে নামলে বুদ্ধিশুদ্ধি জমাট বেঁধে গোল্লা পাকিয়ে ‌যায়। ‌যাকগে, মূল প্রসঙ্গে আসি। শেষ নাম্বারটা ১, বাকিগুলোর সাথে অ্যাড করে দাও, দেখো কী দাঁড়াচ্ছে?
দ্রুত ক্যালকুলেশন করে উত্তর দিলাম, ৯৪৩৮২২৫৯৯৬।
হঠাৎ নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে একটানে দরজা খুলে ফেলল পর্ণাদি। কদ্দিনের পুরোনো অভ্যাস মি ইউং? কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক। আচমকা ধরা পড়ে থতমতো খেয়ে গেছেন। রীতিমতো ধমকাচ্ছে পর্ণাদি, আড়াল থেকে শুনে পেপারে ছাপার মতলব ভাঁজছিলেন? চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন, বলছি। নইলে ওসিকে ডাকতে বাধ্য হব। কথাগুলো শুনে ভারী চমকেছেন ডগলাস চশমা চোখে, সাহেবি কোট - পেন্টেলুন, বিদেশী সুইস ঘড়ি পরনে দুনিয়াময় টহলদারি করা মধ্যবয়সী লোকটি। ‌যথাসম্ভব আওয়াজটা নীচুতে নামিয়ে মিনমিন করে ধীর ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে বললেন, দুঃখিত ম্যাডাম। এমনটি হবে না কখনো।
মনে থাকে ‌যেন।
রাত আটটা কি সাড়ে আটটা। শব্দজব্দের নেশায় মেতেছে দীপু। প্রশ্নে প্রশ্নে পাগল করে দেবে। অ্যাই টিনা,জানকী নাম কার? দ্রৌপদী। উহুঁ, ঘাড় নাড়ল দীপু, সীতা। বল দিকিনি, দ‌ৃশ্যকাব্যর প্রতিশব্দ কী? ‌অক্ষরটা ‌য দিয়ে শুরু। মাথা চুলকোতে লাগলাম। বললাম এত কম ফান্ডা নিয়ে শব্দজব্দে বসিস কেন? দীপু হেসে বলল, রাগ কচ্ছিস কেন! নাটক, চলতি কথায় থিয়েটার।
পুলওভার চাপিয়ে কোমরে রিভলবার গুঁজে বুট পরছিল পর্ণাদি। কোথাও বেরোচ্ছ? জিজ্ঞাসা করলাম।
ইয়েস, বেরোচ্ছি একটু। মোমিনের বাড়ি। এত ইনফরমেশন জোগাড় করলাম, জানাতে হবে যে মোমিনকে।
পরবর্তীতে ‌ভয়াবহ যে উল্লেখ‌যোগ্য ঘটনাগুলি ঘটছিল তার অনেকটাই স্বচক্ষে দেখার সু‌যোগ মেলেনি, মুখে শুনেই কাজ চালাতে হয়েছে। কুয়াশার চাদরে মোড়া গারোর রাস্তা, মাঠঘাট। পরিস্কার দেখায় না কিছুই। কনকনে ঠান্ডা মেশানো বাতাস হাড়েগোড়ে কাঁপুনি ধরাচ্ছে ‌যথারীতি। নারকেল গাছগুলো বুরুজের মতো দন্ডায়মান। দুএকটা ঘরের বাতি নিভু নিভু করছে। টুপটুপে হিম পড়ছে পাতা থেকে গড়িয়ে। আচমকা কে ছুটে এল ‌যেন। মিটমিটে আলোয় ছায়া নজর পড়াতে দ্রুত সরে তড়িৎগতিতে লাথি চালাল পর্ণাদি আগন্তুকের পেট লক্ষ্য করে। হাত খানেক তফাতে ছিটকে পড়ল লোকটি। লাফ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সেফটি ক্যাচ তোলার। গুলি কানের পাঁজর ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে জ্ঞানহীন অবস্থায় পর্ণাদি। চোখের পাতা দুটি বোজা ।
গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের বিদঘুটে আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি, দুটো বেজে দশ। অকস্মাৎ বিদ্যুতের চমক খেলল মাথায়। ইভাই-ভিলা থেকে এখনও ফেরেনি পর্ণাদি? দীপুকে ডাকাডাকি করেও লাভ হল না। ধুস, এর জাগার নামটি নেই। গায়ে পশমের পুরু চাদর গায়ে ফেলে জুতোয় পা গলিয়ে বেরোলাম খুঁজতে। সাথে নিলাম চার ব্যাটারীর জোরালো টর্চ। বাংলো ছাড়িয়ে পুবদিকের শীর্ণ গলিখানা ধরে চলেছি। তারপর মাটি সুরকির কাঁচা পাকা রাস্তা ছাড়ালেই মোমিন ভিলা। মিনিট পনেরো পর, গলির শেষ প্রান্তের বাড়িটার কোণাকুণি কার পায়ের মড়মড় আওয়াজের শব্দ পেলাম। টর্চের জোরালো আলোতে দেখলাম, অত্যন্ত ধীর পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে পর্ণাদি। বাম হাতের আঙুলগুলো চেপে রেখেছে কপালের একপাশে। টলছে পুরো শরীরটা। এক দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। বেকুব মুখখানা প‌র্যবেক্ষণ করে মুচকি হেসে সরল কন্ঠে বলল, বারণ করেছিলি আসতে, তাও যে মরতে কেন এলাম? দ্রুত পা বাড়া। ঝটপট। নো কোশ্চেন। বাংলোয় ফিরে কৌটোর লাল ওষুধ আর আয়োডিন ভালভাবে মাখিয়ে ফেট্টি বেঁধে দিলাম। ল্যাম্প জ্বালিয়ে শুতেই সেকী ঘুম দুজনের! ভাবলে আশ্চ‌র্য হতে হয়।

গারো পাহাড় জমজমাট

ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। গতরাত্রের দুর্ঘটনায় জখম হওয়ার পরও বিরাম নেই তদন্তের কাজে। চোখ বুজে হেলান দিয়ে সোফায় বসে পর্ণাদি। খবর পেলাম, আটটা নাগাদ কল আসে, পোস্টমর্টেম হাতে এসেছে পুলিশের। ইনজেকশন দিয়ে শুষে নিয়েছে গোটা দেহের রক্ত এবং এছাড়াও গোড়ালির কাছে ইনজেকশন ফোটানোর গর্ত দুটি। ইতিমধ্যে মোমিন ভিলায় এসে হুমকি দেওয়া তিন আগন্তুকের নাম পাওয়া গেছে। অমৃতলাল পান্ডে, রণদেব সুতারিয়া ও মোহিত রায়। বিখ্যাত প্রোমোটার। সন্দেহের তালিকায় বাদ পড়বে না এরিক ও লেফ। অতি আবশ্যক দুটি নাম ইভাই ও হার্ল। অনুমান, ইভাই খুব সুবিধের লোক নয়। নিতান্ত ভালছেলেটি সেজে থাকে। এ অপারেশনে সেও ‌যুক্ত হতে পারে। নাহলে সাবলীল ভাবে সুতারিয়াদের পক্ষে অপারেশন চালানো বেজায় কঠিন। সাংকেতিক নাম্বারটা ইভাইয়ের।
ঢং ঢং ঢং। দুটোর কাঁটা পড়ল। দীপুর শোরগোলে ঘুম ভেঙে গেল। দোতলার ঘর থেকে ছুটে এসেছেন অবিনাশবাবুও। ফ্যাকাশে মার্কা মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে দীপু। স্পিকটি নট। দরজা হাট করে খোলা। পর্ণাদির খাট ফাঁকা। পর্ণাদি উধাও। ফোনটা তুলে তৎক্ষণাৎ সমস্ত ঘটনাটা বিশদে জানালাম থানার ওসিকে। জ্যাকেটটা চাপিয়ে, পর্ণাদির পিস্তলটা গুঁজে, জুতো পরে রেডি হয়ে সোজা প্যাডেলে চাপ দিলাম। বুড়ো মালির সাইকেলটা পাম্পবিহীন অবস্থায় ঠাঁই পেয়েছিল গুদামে। সকালে পাম্প দিয়ে সাফসুতরো করে কাজের উপ‌যোগ্য করে তুলেছিলুম। লেগে গেল প্রয়োজনে। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় টাটকা জিপের দাগ। বিলক্ষণ। অনুসরণ করে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বাদে সাধুবাবার গুহার কাছে এসে সাইকেলটাকে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। গুটিগুটি পায়ে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে গুহার পেছনে এসে পৌঁছলাম। যতটা সম্ভব কাছাকাছি গিয়ে একটা পাথরের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। দুই ষন্ডামার্কার একজনের হাতে চার ফুট মাপের র‌ড অন্য জনের হাতে একটা লম্বা বন্দুক। সাংবাদিক ইউংও হাজির। জমাট অন্ধকার, চিনা এল ই ডি বাতি জ্বলেছ, খাটিয়ার সাথে বাঁধা পর্ণাদি। কপালে ছড়ে ‌যাওয়া জায়গা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, হাতে পায়ে আঘাতের চিহ্ন। চাপদাড়ি কোট পরনে এক ভদ্রলোক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। ‌তিনজন ঘিরে তাকে। কেতা দুরস্ত লোক। ওজনদারও বটে। তিরিক্ষি মেজাজের অবশ্যই। কথাবার্তা হচ্ছিল এইরকম,
চুপটি করে থম মেরে রয়েছেন কেন? বুলি সরছে না একটুও? এখন আপনাকে মেরে পুঁতে দিলেও কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না। হা হা হা! বিদ্ঘুটে উদ্ভটমার্কা হাসি হাসছে চাপদাড়ি।
ওয়েল, ইউ আর ভেরি রং মি. অমৃতলাল, জোরালো গলায় বলল পর্ণাদি, অভিয়াসলি আই মাস্ট ক্যাচ ইউ অর আই উইল রিটায়ার ফ্রম মাই জব। আপনার ইভাই এখন তুরার এস পি অফিসে আপনার বিরুদ্ধে বয়ান দিচ্ছে।
চাপা অস্বস্তি হচ্ছিল। ধরা পড়লে উল্টে বিপদ বাড়বে বইকি কমবে না। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি করা ছাড়া কোন উপায় নেই। অকস্মাৎ রিংরিং করে বেজে উঠেছে খুদে অস্ত্রটা। কেটে দিলাম ঝটপট। তার মধ্যেই যা হবার হয়ে গেছে। ইউং এগোতেই গুলি চালালাম। হাত দেড়েক দূরে লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়। অমৃতলাল ও বাংলাসুরে হিন্দি মাখানো বেসুরো রণদেব সুতারিয়া আমাদের দিকে ছুটে আসতে আবার চালালাম এক রাউন্ড। টুক করে দীপু ইতিমধ্যে উল্টো দিক দিয়ে গিয়ে চটপট পর্ণাদির বাঁধন খুলে দিয়েছে। হঠাৎ গুলির শব্দে চমকালাম। ডান কবজিতে রিভলবার বাগিয়ে এগিয়ে আসছেন তুরার সাদা উর্দিধারী এস.পি। গুলি লেগেছে পান্ডেজির হাঁটুতে। সাদা উর্দিধারী চার কনস্টেবেলও ঘিরে দাঁড়িয়ে ওদের।
জারিজুরি খতম অমৃতলাল জি, ধুলো ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্ণাদি, টাইম শেষ আপনারও সুতারিয়া। রাইট টাইমে আসার জন্য থ্যাঙ্কস এস পি সাহেব।
মিচকে হাসির জোয়ার এস পি সাহেবের গোঁফের ফাঁকটিতে। ওয়েল ডান মিস সেন। বহুদিন ধরে চেষ্টা করেও এই গ্যাংটাকে পাকড়াতে পারিনি উপ‌যুক্ত প্রমাণের অভাবে।
পরের দিন সকালে এস পি সাহেব এসেছেন আমাদের অতিথি শালায়। একথা সেকথার পর পর্ণাদি বলল, হুমকি দিয়ে এরা একের পর এক গ্রামের বাসিদের উচ্ছেদা করেছে। বন অরণ্য ধ্বংস করে হোটেল শপিং মল, ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়েছে। নষ্ট করেছেন সেখানকার বৈচিত্র্য। কিছুদিন ধরে এরা মানুষ খুন করে রক্ত বার করে নিয়ে রক্তের ব্যবসা করাও ধরেছে। ইউং আসলে এদের বিদেশী এজেন্ট। সাধুবাবাটা কোথায় পালাল? এস পি সাহেব ওটাকে ছাড়বেন না। ওই সাধু সেজে সাধারণ মানুষের কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে ভয় দেখাত। এরা সর্বদা চুনোপুটিদের দিয়ে কাজ করাত আর নিজেরা গোপনে লুকিয়ে থাকত। অ্যাট ফাস্ট, মোমিনের কাছে রংচঙ আর মেকাপ দিয়ে এরিক আর লেফকে পাঠিয়েছিল, পাছে গ্রামবাসী হিসেবে চিনে ফেলে। মোমিন রাজি হননি। আরও দুজনকে পাঠায়। পরে নিজেরাই সামান্য মেকাপ নিয়ে আসেন। এমনকি ইভাইকেও হাত করে।
পালাবে কোথায় ব্যাটারা? মুঠো মোচড়ালেন এস.পি, যেখানেই যাক না কেন টুঁটি চেপে জেলে পুরব। এটাই ছিল ওদের মিটিং প্লেস। পছন্দসই স্থান, বিস্তীর্ণ জঙ্গল, আত্মগোপনের পক্ষে এরকম জায়গা পাবে কোথায়?
সেদিন রাতে খাবার পর তিনজনে বারান্দায় চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইলাম। আজই এখানে আমাদের শেষ রাত। চাঁদের আলো, অজানা পাখির কিচিমিচির, নরম হলুদ সাদাটে ফিকে‌ কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে নকরেক অরণ্য, শনশনে ঠান্ডা হাওয়া আসছে পাহাড়ের ওপার থেকে। কিছুক্ষণ বাদে উঠে সবাই মিলে শুতে গেলাম।
কলকাতা ফিরছি। একটুক্ষণ পরেই ল্যান্ড করব। ধুবড়ি ও কৃষ্ণৈ পেরিয়ে চলেছি। মেঘের খেলা থেকে সাময়িক বিরাম পেতে সিটে হেলান দিয়ে আছি। এয়ারপোর্টের স্টল থেকে দু জোড়া ট্রাভেলারের বই কিনেছে দীপু। সেগুলিই গ্রোগ্রাসে গিলছে। পর্ণাদি হাতের ডিটেকটিভ বইটা ভাঁজ করে তাকাল জানালায়। ছুটি শেষ। ল্যান্ড করছি। নকরেকের রহস্যময় জঙ্গল, মোমিনের বাড়ি, প্রাচীন গুহা, গেস্টহাউস, তুরা শৃঙ্গ সবসুদ্ধ মিলিয়ে ‌যাচ্ছে সারি সারি মেঘের রাশির পিছনে, মনটা উদাস হচ্ছিল বারেবারে। ইস, ভাল হত আর কয়েকটা দিন থাকতে পারলে!

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা