সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
স্বাধীনতার গল্পঃ দ্বিতীয় পর্যায়ঃ পর্ব ৪ঃ  ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পটভূমি - ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-এর নির্মাণ
প্রথম কংগ্রেস অধিবেশন

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না করলে, ব্রিটিশ শাসকের পক্ষে এই ভারতীয় ভূখণ্ড শাসন করা কঠিন হত। তাই জন্যে ইংরাজি শিক্ষার বিদ্যালয় ,বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হতে থাকে। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই- ওয়ারেং হেস্টিং কিন্তু ভারতীয় ভাষা ও সভ্যতার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি দেশীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গুলির উন্নতি সাধন করতে চেয়েছিলেন। যাই হোক ভারতবর্ষের বিরাট জন সংখ্যার তুলনায় খুব কম সংখ্যক মানুষ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে।এই সংখ্যা কে অণুবীক্ষণে দেখা যায়। কিন্তু এরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের কুফল। শিক্ষিত ভারতীয়রা উপযুক্ত হওয়া স্বত্তেও সরকারী চাকরী পাচ্ছিল না। সাধারণ মানুষ শুল্ক আইন, কার্পাস আইন, ইত্যাদি দ্বারা অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়েছিল। ভারতীয় বনিকদের আমদানি –রপ্তানী নীতির বৈষম্য, নানা রকম শুল্কের চাপে অর্থ ক্ষতি হতে থাকে। কৃষকদের পাশে না ছিল কোন আধুনিক চাষের উপযুক্ত সুযোগ, অন্যদিকে ছিল কর। ১৮৯৬ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত কৃষি ব্যবস্থার সাথে যুক্ত প্রায় ১০ লক্ষ লোক অনাহারে মারা যায়।এর ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসন্তোষ আর অশ্রদ্ধা তৈরি হয়। এই সময় বড় শহরে যেমন অনেক রাজনৈতিক সভা –সমিতি তৈরি হয় তেমনি নানান ধরণের সক্রিয় আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে স্থানীয় সমিতি গুলি সর্ব ভারতীয় সমিতি হিসাবে গড়ে ওঠার জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইন্ডিয়ান ‘মিরর’ পত্রিকায় একটি ‘জাতীয় পার্লামেন্ট’ গঠনের প্রস্থাব দেওয়া হয়। নানান সমিতি তৈরি হওয়ার রেশ নিয়েই ‘জাতীয় কংগ্রেস’ তৈরি হয়।

স্বাধীনতার গল্পঃ দ্বিতীয় পর্যায়ঃ পর্ব ৪ঃ  ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পটভূমি - ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-এর নির্মাণ অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম (বাঁদিকে); উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি (ডান দিকে)

কেন তৈরি হয়েছিল কংগ্রেস তা নিয়ে নানান আলোচনা আছে। তবে আজ সে আলোচনা নয়। লিটনের শাসন কালে ভারত সরকারের উচ্চ সচিবের পদে নিযুক্ত ছিলেন অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম। তার কাছে একটি সাত খণ্ডের গোপন নথি বা দলিল আসে । এর মধ্যে তিরিশ হাজার রিপোর্ট ছিল। হিউম জানতে পারেন যে, দরিদ্র সাধারণ মানুষ খুব ক্ষুব্ধ আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত রা হতাশাগ্রস্থ। ১৮৫৭এর বিদ্রোহ এর ভয়ানক অভিঘাতের কথা হিউম হয়তো ভেবেছিলেন। তিনি সেই সময় ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে একটা খোলা চিঠি লেখেন। দেশের কাজে , দেশের কথা বলতে একটি আবেদন। ১৮৮৫ সালে পুনায় অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল, কংগ্রেস এর প্রথম সন্মেলন। কিন্তু কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটায় বম্বে তে অনুষ্ঠান টি স্থানান্তরিত হয়। ৭২ জন যোগ দেয় এই সম্মেলনে। সাধারণ দরিদ্র শ্রেণীর কোন প্রতিনিধি ছিল না। কিন্তু আশাব্যঞ্জক ছিল যেটা তা হল এরা সকলেই ‘স্বেচ্ছাসেবী’। কলিকাতার ২য় অধিবেশনে ৫৩৫ জন যোগ দেন। আর সারা ভারত থেকে প্রতিনিধি রা এসেছিলেন।উৎসাহ আর উচ্ছাসের পরিমাণ বেড়ে চলেছিল। ডঃ বিপান চন্দ্রের মতে, ‘নতুন সামাজিক শক্তির’ প্রতিনিধি। বেনারস আর মাদ্রাজ অধিবেশনে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ১৮৮৯ সালে কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা হয় ২০০০ জন।

ভারতীয় জনমানসে ইংরেজ শাসনের প্রতি ক্ষোভ সব স্তরের মানুষের মধ্যে ছিল। সেটি মুলত ইংরেজ শাসন কে মেনে নিয়ে, সেই মাপকাঠিতে দেশের সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করা। কিন্তু কৃষক, উপজাতি, সাধারণ নানান গোষ্ঠীর সাথে ভায়ানক ঘাত –প্রতিঘাত কিন্তু ইংরেজ শাসনের সাথে সমান্তরাল ভাবে চলে আসছিল। প্রথমদিকের কংগ্রেসি আন্দোলন কে ‘নরমপন্থী’ ‘ মডারেট’ এই নামে অভিহিত করা হয়।কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেসের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই সক্রিয় রাজনীতি চাইছিলেন।

যারা আর ভিক্ষা হিসাবে কোন দাবী পেশ করতে চাইছিলেন না। তারা আন্দোলন হিংসাত্মক হলেও তাতে রাজি ছিলেন। কংগ্রেসের প্রথম দিকে তাই মডারেট আর চরমপন্থী দের মধ্যে একটা নীতি গত বিরোধ চলতে থাকে।

১৮৮৫ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের পরিচালন এর মূল ভুমিকায় ছিলেন হিউম। নরমপন্থীদের সাথে হিউমের একটা মত বিরোধ তৈরি হয়।তার কারণটির দিকে মনোযোগ দিলে অবাক হতে হয়। ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন কংগ্রেসের আবেদন নিবেদন ঠিক ‘পাত্তা’ দিচ্ছিল না। আমাদের ছোটবেলার খেলায় যেমন ‘দুধভাত’ বলে একটি নকল খেলোয়াড় নেওয়া থাকে।ইংরেজ কংগ্রেসের মতামত গুলিকেও শাসন নীতিতে সেই ভাবে গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছিল না। হিউম চাইছিলেন সাধারণ শ্রমিক,আর কৃষক দের কে কংগ্রেসের সাথে সংযোগ ঘটাতে। হিউম শুধু এই জোরদার আন্দোলনের কথা ভাবছিলেন তাই নয়। সেই সময় তিনি ‘congress catechism’ নামে একটি চটি বই লেখেন। বারোটি ভাষায় সেটি অনূদিত হয়। আর বিক্রি হয়ে ছিল হাজার হাজার।

কিন্তু শিক্ষিত, ধনী, উঁচুজাতের নরম পন্থী ভারতীয় নেতারা তাদের শাসকের কোন সমস্যা করতে রাজি ছিল না। অথচ দাদাভাই নৌরজি ভারত বর্ষের বিপুল পরমানে সম্পদ নিষ্ক্রমণ ঘটছে তা নিয়ে সরব ছিলেন। সাধারন কৃষক শ্রমিক, সকলের আর্থিক কষ্টের কারণ যে এই শাসন তা তিনি প্রমান করে দিয়েছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত, রানাডে তৎকালীন লবণ কর, ভারতীয় শ্রমিক দের বিদেশে নিয়োগ ও তাদের কষ্ট, অরন্য আইন, চা বাগানের শ্রমিকদের প্রবল দুরাবস্থা নিয়ে লিখেছেন। শিক্ষিত সমাজ সে গুলো জানতো। অথচ কেন কৃষক সমাজ কে আন্দোলনে গ্রহণ করা হয়নি। সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক, অপরিমাণদর্শিতার জন্যে। এই মত বিরোধের জন্যে হিউম অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। ১৮৯২ সালে ‘দেশ’ ছেড়ে হিউম ‘দেশে’ ফিরে যান। ১৮৯২ সালের পর কংগ্রেস একটু ঝিমিয়ে যায়। আর ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে দাদাভাই নৌরজি হেরে যান। মোদ্দাকথা দেশের কল্যানের জন্যে, শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্যে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে, উদ্দিপনা একটু কমে গেল।

হিউম এর চলে যাওয়া ,ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাদাভাই নৌরজি হেরে যান এই দুটো কারণে নিয়ম মেনে আন্দোলনের গতি কমে গেল ।

এ ছাড়াও কংগ্রেস নেতাদের নরমপন্থী মনোভাব কেও অনেক টা দায় নিতে হয়। ১৮৯০ এর দশকে নরমপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা সুবিনস্ত সমালোচনা গড়ে উঠেছিল।যার প্রভাবে অতি সক্রিয় রাজনীতি ধীরে ধীরে সন্ত্রাসবাদ গড়ে তুলেছিল। এই সময়

স্বাধীনতার গল্পঃ দ্বিতীয় পর্যায়ঃ পর্ব ৪ঃ  ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পটভূমি - ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-এর নির্মাণ
বাঁদিক থেকে - বাল গঙ্গাধর তিলক, দাদাভাই নওরোজি, অরবিন্দ ঘোষ

ভারতবর্ষের তিনটে অঞ্চল, বাংলা, পাঞ্জাব, আর মহারাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসন কে অগ্রাহ্য করবার চেষ্টা করেছিল। ১৮৯০ এর প্রথম দিকে অরবিন্দ ঘোষ তার প্রবন্ধগুচ্ছ "পুরোনোর বদলে নতুন বাতি" তে একটি অন্য দিশার কথা বলছেন।– "কংগ্রেস যে মধ্যশ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করে তার সঙ্গে ‘সর্বহারা’র যোগসূত্র গড়ে তোলা দরকার। এটায় একমাত্র নীতি,যার সাফল্যের সম্ভবনা আছে।" পরবর্তীকালের একজন স্পিরিচুয়াল গুরু দেশের বিপ্লব আনতে কেমন বামপন্থী চিন্তা ভাবনা করছে সেটা দেখে অবাক লাগে। পাঞ্জাবে এই সময় হরকিষন লাল একটি পাঞ্জাব জাতীয় ব্যাঙ্ক গঠন করেন।যা দিয়ে স্বাধীন আর্থিক ক্ষমতা তৈরির চেষ্টা হতে থাকে। আর বাল গঙ্গাধর তিলক মহারাষ্ট্রে চরমপন্থার দিক নির্দেশ দিতে থাকেন। ১৯০২ সালের বক্তৃতায় তিনি বলছেন, ‘নিপীড়িত ও অবহেলিত হলেও ইচ্ছা করলে আমরা প্রশাসন কে অকেজো করার ক্ষমতা রাখি’ । আর বাংলায় চরমপন্থার বারুদ জমা হচ্ছিল। ১৯০৫ সালের কার্জনের বঙ্গভঙ্গের আদেশে তা জ্বলে উঠল।

ভারতীয়রা প্রতিস্থাঙ্গত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যে ব্রিটিশ অহমিকা কে ধাক্কা দিয়েছেন সেটা জানা যায় লর্ড কার্জনের চিঠিতে। ১৯০০ সালের ভারত সচিব হ্যামিল্টন কে লেখা একটা চিঠিতে কার্জন তাঁর দুর্ভাবনা প্রকাশ করেন। "......অনেক উঁচু পদ, যে গুলো একান্তই ও নির্দিষ্ট ভাবে ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত হওয়া উচিৎ ছিল ... সেগুলি নেটিভদের (ভারতীয়দের) উন্নততর বুদ্ধির জন্যে হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।" শিক্ষিত ভারতীয়রা স্বাভাবিক ভাবে এই বৈর মনোভাব বুঝতে পারছিলেন। তিনটি কারণে কার্জনের সাথে ‘বাঙালী’র সংঘাত প্রকাশ্য হয়েছিল।

- ১৮৯৯ কলিকাতা পৌরসভার পরিবর্তন

- ১৯০৪ বিশ্ববিদ্যালয় আইন

- ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ

বাংলার প্রশাসনিক বিভাজন, হিন্দু মুসলমান বিরোধিতায় উস্কানি দেওয়া এবং ‘বাঙালী জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠার জন্যে যে ঐক্যের প্রয়োজন’ তাকে নষ্ট করার চেষ্টা ইত্যাদির জন্যে বঙ্গভঙ্গ আইন টি বিখ্যাত। এটির ফলে আন্দোলন শুরু হয়।

- ১৩ই জুলাই ১৯০৫ কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঞ্জীবনী পত্রিকার প্রস্তাব নেওয়া হয় ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন।

- ৭ই অগাস্ট টাউন হলে সুরেন্দ্রেনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর উপস্থিতি তে গৃহীত হয় – রাখী বন্ধন ও অরন্ধন কর্মসূচী ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ দিবসের জন্য গ্রহণ করা হয়।

- ছাত্রদের ধর্না।

আসলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই রকম আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে বার করে আনতে হবে তার চেষ্টা হতে থাকে। জাতীয়তাবোধের একটা নিরাকার রূপ থেকে ধীরে ধীরে সাকার রূপে পরিণত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে।

ছবিঃ উইকিপিডিয়া

খুব ছোট থেকে পড়তে ভালবাসেন। তার থেকেই লেখা শুরু। ছোটদের জন্যে কিছু লেখা সব চেয়ে কঠিন। একটু চেষ্টা করছেন লিখতে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা