সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
  শিক্ষিকা ভগিনী নিবেদিতা – একটু ফিরে দেখা

সবাই সেই শিক্ষিকার নাম জানে। আয়ারল্যান্ডের মেয়েটি কে লন্ডন শহরের বহু মানুষ চেনে। নাম  মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল । নিজের স্কুল চালান। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। মার্গারেট কেবল শিশু শিক্ষা নয়, তৎকালীন সাহিত্য, বিজ্ঞান, বিশ্ব রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। আধুনিক শিল্পচর্চা এবং সৌন্দর্যবিদ্যাতেও গভীর জ্ঞান রাখতেন। একদিকে শিক্ষা দান অন্যদিকে গরিব মানুষের জন্যে কাজ করে যেতেন। খুব উদ্যমের সাথে অরেক্সহুম এলাকায় একটি খনিতে গরীবদের জন্যে কাজ করতেন।

প্রবল পরিশ্রমী মার্গারেট কিন্তু তাঁর শিক্ষা দানের পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। সুইস শিক্ষাবিদ পেস্তালোৎজি( Pestalozzi) আর জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্রয়েবেল এর আধুনিক শিক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা তিনি পড়েন। তাঁরা যে pre-school / বিদ্যালয়-পূর্ববর্তী স্তরে খেলা, দেখা, তৈরি করা,ব্যায়াম ইত্যাদির কথা বলছিলেন –মার্গারেট সেই গুলির বাস্তব প্রয়োগ করেছিলেন। একদল উদ্যমী শিক্ষক এই নতুন পদ্ধতি  প্রয়োগ করে সাফল্য পেলেন। মার্গারেট কে তাঁর কাজের জন্যে অনেকে জেনে গেল। এই সময় লন্ডনে 'সান ডে' ক্লাব বলে একটি ক্লাব চালু ছিল। সেখানে মার্গারেট এর বক্তব্য খুব প্রশংসা পেল। ১৮৯২ সালে মার্গারেট নিজের স্কুল খুললেন। ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে তাঁর দেখা হল।স্বামিজির কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলে এলেন আমাদের দেশে। তিনি স্বামিজির দর্শন, ব্যক্তিত্ব আর আধ্যাত্মিকতাতে এক নতুন দিশা খুঁজে পেলেন।  ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতবর্ষে তিনি যখন এসে দাঁড়ালেন তখন দেশ পরাধীন আর শোষিত। স্বামিজির মনের ইচ্ছা ভারতের জন্যে মিস নোবেল কিছু করুন।  মার্গারেট কাজ করতে মন প্রাণ নিয়োজিত করলেন।

আমাদের দেশের সাধারন মহিলাদের জীবন যাপনের সাথে একাত্ম হবার জন্যে মার্গারেট বাগবাজারের মায়ের বাড়িতে বেশ কিছু দিন ছিলেন। সারদাদেবী বিশেষ ভাবে স্নেহ  করতেন, 'নরেনের মেয়ে' কে। স্বামীজী তাকে দীক্ষা দিলেন। তিনি নতুন নামে সম্বোধিত হলেন ' নিবেদিতা' । ইংরেজিতে যাকে বলা যায় 'ডেডিকেটেড'। নিবেদিতা অর্থাৎ যাকে নিবেদন করা হয়েছে।স্বামীজীর মনের ইচ্ছা অনুযায়ী এই 'ডেডিকেটেড' শিক্ষিকা আজীবন আমাদের এই পোড়া দেশের জন্যে করে গেছেন। তিনি ভারতকে এতো ভালবাসতেন যে তার কোন ত্রুটি তিনি দেখতে পেতেন না।

আবার তিনি এটাও বুঝেছিলেন বাঙালি সমাজে অনেক কুসংস্কারের বাঁধন আর স্থবিরতা আছে। আরোও উদ্যমী আর দক্ষ হতে গেলে সঠিক শিক্ষার প্রয়োজন। স্কুলের দরকার। মেয়েদের স্কুল ব্যাপারটি খুব জনপ্রিয় ছিল না। ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি পূর্ণ মাত্রায় বিষয়টি নিয়ে নানান মিটিং ও আলোচনা করতে শুরু করলেন। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকে একটি মিটিঙের বিবরন পাওয়া যায়।

দিনটি ১২ নভেম্বর ১৮৯৮ সাল। বলরাম বোসের বাড়িতে সন্ধ্যায় স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী সারদানন্দ , কথামৃত প্রণেতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সুরেশ দত্ত, হরমোহন বাবু, প্রভৃতি অনেক ভক্ত উপস্থিত। নিবেদিতা তাঁদের সামনে ইংরাজিতে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছেন। তিনি একটি স্কুল স্থাপন করতে চান যেখানে তিনি মেয়েদের দেশীয় শিক্ষা , ও দেশপ্রেমের শিক্ষা দেবেন। সেই মিটিং এ কখন স্বামী বিবেকানন্দ এসে বসেছেন কেউ দেখেন নি। স্বামীজী ফিসফিস করে ভদ্রলোক দের বলছেন " বলুন আপনারা আপনাদের মেয়েদের পাঠাবেন"। যখন কেউ উঠে দাঁড়ালেন না। তখন স্বামীজী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, " Well, Miss Noble, this gentleman offers his girl to you." ।এইকথা বলে তিনি হরমোহন বাবু'র দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। পরের দিন ১৩ নভেম্বর কালীপূজার দিন ১৬ নম্বর বোস পাড়া লেন-এ স্কুলটির সূচনা হল। সারদা দেবীর আশীর্বাদ পুষ্ট এই স্কুলটি এখন একটি অনন্য বিদ্যালয় হিসাবে সমাদৃত।

ভগিনী নিবেদিতা পেশায় একজন দক্ষ ও উদ্ভাবক শিক্ষিকা ছিলেন। এই স্কুলটি গড়ে তোলার পেছনে বহুদিনের অভিজ্ঞতা ছিল। নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা আর মানবিক যুক্তি দিয়েই এর পরিকাঠামো তিনি ভেবেছিলেন। উনি শিক্ষা দানের পদ্ধতি হিসাবে যেটা ভেবেছিলেন সেটা হল-"qualitatively true and universally applicable to the work of modern education of Indian women"। এ দেশের অনেক কিছু তাঁর জানা নেই। তিনি নতুন পরিবেশ আর তৎকালীন পরিস্থিতির উপযুক্ত হবার জন্যে খুব স্বতঃস্ফুত ভাবে চেষ্টা করছিলেন।   যদি সাধারন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়ে ওঠেন তাহলে মেয়েদের জন্যে কিছু করা সম্ভব হবে না। কী অপূর্ব ভাবে এই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। ভাষা আর সংস্কৃতির দেওয়াল ভেঙে গিয়েছিল। রক্ষণশীল ঘরের  মহিলাদের বন্ধু বানিয়ে ফেললেন। শিশুরা তাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলত। যে মায়েরা তাঁর কাছে মেয়েদের পাঠাতো স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম দিকে তাঁদের একটি দোলাচল থাকতো। মেমসাহেবের কাছে মেয়েকে পাঠাচ্ছি। এমন কিছু আবার না হয় যে শ্বশুরবাড়িতে কোন নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়। নিবেদিতা সেই মায়েদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলেন। কারণ 'শ্রদ্ধাশীল হওয়া' তাঁর দেওয়া শিক্ষার মধ্যে অন্যতম ছিল।সেই সব বাঙালি গৃহবধূরা আবার তাঁকে সাহায্য করতে পেয়ে খুব খুশি হতেন। কখনো দুধ, কখনো ফল পাঠিয়ে দি্তেন তাঁরা। ভগিনী নিবেদিতা আবার সেই প্রাপ্তি গুলিকে উপযুক্ত সন্মান দিতেন। এতে   ঘোমটা আবৃত গৃহবধূরা খুব আনন্দ পেতেন।

'হিন্দু পল্লীর জীবন' শীর্ষক প্রবন্ধতে তিনি তৎকালীন সমাজ জীবনের কী সুন্দর ছবি লিখে রেখে গেছেন।' ...... পুরনো দাসী অনেক সময় পরিবার ভুক্ত হয়ে ঠাকুমা দিদিমার স্থান অধিকার করে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাড়ির মনিবদের তিরস্কার এবং ছেলে মেয়েদের আদর দিয়ে নষ্ট করবার দাবী করা তাঁদের পক্ষে সাধারণ ব্যাপার।' আবার এক জায়গায় লিখছেন ' হিন্দু পরিবারের বালিকারা এতো শীঘ্র পিতৃ গৃহ ত্যাগ করে যায় বলে তাদের প্রতি অত্যাধিক স্নেহ বিদ্যালয়ের বিশেষ অসুবিধার কারণ হয়ে ওঠে।' সেই সময় সাধারণ বাঙালি পরিবারে মেয়েদের বিয়ের বয়স ছিল ১২ বছর। আর তারা ১৪ বছরে  শ্বশুরবাড়িতে চলে যেত। এটা তাঁর স্কুলের পক্ষে অসুবিধার কারণ ছিল। সমাজে বিধবা মেয়েদের অবস্থাও তিনি জানতেন। তাঁর 'রামকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা'   নামক প্রবন্ধে লিখেছেন , "আঠারো থেকে বিশ বৎসর-এর বিধবাগণ যে প্রকৃত হিন্দু পরিবেশ এবং আদর্শ পারিবারিক জীবন দেখাতে পারেন তাই নয় কিন্তু তাঁদের সাহায্যে আমরা দুইতিন টি শিল্প ব্যাবসা সংগঠন করবার ও আশা রাখি। এর দ্বারা ইংল্যান্ড , ভারতবর্ষ ও আমেরিকার বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার সৃষ্টি করা যেতে পারে। দেশীয় আচার ,কাসুন্দি ও চাটনি এই সকলের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।"  এটি অনেক বড় আর সুদূরপ্রসারী চিন্তা ছিল। কিংবা বলা যায় যারা অন্যের কষ্ট লাঘবের কথা ভাবেন তারা এভাবেই ভাবেন।

আমাদের এই দেশ ভারতবর্ষ্ররকে নিয়ে ভেবেছেন আর অজস্র কাজ করে গেছেন। ভারতীয় সভ্যতা কে তিনি এতো ভালবাসতেন লিখে গেছেন 'ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম', 'ফুটফলস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি',' মাতৃরূপা কালী ' ইত্যাদি বই। তাঁর মতো স্ফুলিংগের পাশে থেকে আলোকিত হয়েছেন বহু মানুষ।

আমাদের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং সমাজ মননে যেখানে দেশ ছেড়ে কোন বর্ধিষ্ণু দেশে গিয়ে ঝকঝকে কোন জীবন যাপন করাকে শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করা হয় সেখানে নিজের দেশের অপেক্ষাকৃত সুখী জীবন যাপন ত্যাগ করে আমাদের দেশের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন সারাজীবন। তাঁর জপমালায় ভারতবর্ষ জপ করে যেতেন। আরেক স্বামীজী অনুরাগিনী মিসেস ম্যাকলাউড কে লিখেছিলেন, ' ভারতের জন্যে আমি কিছু করছি না। আমি কেবল শিখছি'।

তাঁর মত একই ভাবনা রেখে আমরা নিজেদের শিক্ষিত এবং জীবনকে পরিচালিত করতে পারলে তবেই সার্থক হবে আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি আগে শুরু করা তাঁর কর্মকান্ড।

 

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

খুব ছোট থেকে পড়তে ভালবাসেন। তার থেকেই লেখা শুরু। ছোটদের জন্যে কিছু লেখা সব চেয়ে কঠিন। একটু চেষ্টা করছেন লিখতে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা