সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বটেশ্বর পণ্ডিতের মোহর

ভুবন পাণ্ডে এত ভারী মোহর এ জন্মে চোখে পর্যন্ত দেখেনি। তাই সে মোহরখানা হাতে নিয়ে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

এক্কেবারে খাঁটি নিরেট সোনার গিনির উপর আঁকাবাঁকা অক্ষেরে কী যেন লেখা রয়েছে। ভুবন পাণ্ডের চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম। নিমেষে মুঠোর মধ্যে মোহরটাকে চেপে রেখে সরু চোখে দেখতে লাগল ননীগোপালকে। তারপর প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, "এটা তুই কোথায় পেয়েছিস ননী?"  

ননীগোপাল মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। সুদখোর ভুবনকে এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। সেই কবে পাঁচশো টাকা ধার করে ছিল ননী ভুবনের কাছে। তারপর বেশ কয়েকবার একশো টাকা করে শোধ দিয়েছে সে। কিন্তু ভুবনের খাতায় সুদে-আসলে এখন যা দেনা পড়েছিল তাতে 'চৌখুপির' ভেতরে ঢোকা ছাড়া তার আর কোন উপায়ই ছিল না। বটেশ্বর পণ্ডিতের কাছে হাত না পাতলে এ যাত্রা বোধহয় ভুবন পাণ্ডের কাছে বাপ-ঠাকুরদার এই ভিটেখানাই বন্ধক রাখতে হত।

ভুবন চারপাশটা একবার দেখে আরো ফিসফিস করে বলে উঠল, "মানে বলছিলাম ঘরে কি কোন গুপ্তধন-টন খুঁজে পেয়েছিস? আর দু-এক পিস আছে নাকি    এরকম জিনিস !"

ননী এবার সতর্ক হয়ে গেল। লোভ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ভুবনের। ভুবন মোহরখানা হাতে নিয়ে ওজন মাপার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কত গ্রাম হবে ? দশ গ্রাম ? উঁহু, তারচেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই হবে মনে হচ্ছে।

ননীগোপাল বলল, "অতসব জানবার কী আছে পাণ্ডেদা, ঐ একখানাই পড়েছিল লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে। কবে কোনকালে ঠাকুরদা রেখে গিয়েছিল কে জানে। ওটা দিয়েই আপনার সব দেনা শোধ করে দিলাম। এবার আমায় ছাড়ুন দেখি।"

বিগলিত ভুবন ননীর হাতটা ধরে বলল, "ছাড়ুন বললেই কী ছাড়া যায় রে। এক গ্রামে চিরটা কাল ভাই-দাদার মতো বাস করে আসছি। দু-একবার না হয় দেনাটার তাগাদা দিয়েছি। তা বলে তুই কী আমার পর?"

ননী ঘরে ফিরে এসে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। ভুবন পাণ্ডে তাকে সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয়না। ননীর মতো এরকম একটা এলেবেলের ঘরে মোহর এল কোত্থেকে? ভুবন এবার থেকে তার সঙ্গে আঠার মতো চিটিয়ে থাকবে এটা ননী বেশ বুঝতে পারল।

ননীর বাবা ননীকে হাতে ধরে বলে গিয়েছিল, "দেখিস বাবাষ চৌখুপিতে যিনি রয়েছেন তিনি কুপিত হল এরকম কোন কাজ করিস না।!"

চুন-সুরকি দেওয়া মোটা দেওয়ালের ঘর ননীদের। একসময় ভালো অবস্থা ছিল ওদের। গ্রামে অনেক ভূ-সম্পত্তিও ছিল। গ্রামের কেউ এসে বাবার কাছে হাত পাতলে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতেন না। এসব কথা অনেক আগের। ননী তখন অনেক ছোট।

ননীদের ঘরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে ঐ অন্ধকার আর শীতল চৌখুপি। যেখানে দিনের বেলা আর রাতের বেলার কোন তফাৎ পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র দেওয়ালের অনেক উপরে একটা ঘুলঘুলি রয়েছে তার ফাঁক দিয়ে একটা আলোর রেখা আসে ঘরের মধ্যে ঠিক মধ্যাহ্নের সময়। আট-দশখানা চামচিকে চৌখুপির দেওয়ালে সবসময় ঝুলে থাকে। ঐ চৌখুপির মধ্যেই বটেশ্বর পণ্ডিতের বাস। ননী তার বাবার কাছে এসব গল্প শুনেছে। কিন্তু বাবার কঠোর নিষেধ থাকায় এসব কথা গ্রামের কাউকেই কোনদিন বলেনি সে।

সেদিন পুকুরঘাটে অতগুলো লোকের সামনে ভুবন যখন তাকে কয়েকটা টাকার জন্য অপমান করল তখন আর ননী স্থির থাকতে পারল না। অনেক ভেবে চিন্তে স্নান থেকে ফিরে ভিজে কাপড়েই ঢুকে পড়ল চৌখুপির অন্দরে। করজোড়ে বলল, "পণ্ডিত মশাই আপনি আমার প্রণাম জানবেন। আপনি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন! আমি জানি আপনি সূক্ষ্ম দেহে ঘরে বিশ্রাম করছেন। আপনার বিশ্রাম ভঙ্গ করার জন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আপনি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই যাকে আমার দুঃখের কথা, অপমানের কথা বলি। তাই আপনার কাছেই ছুটে এসেছি। আপনি একটি বিহিত করুন।"

ভিজে কাপড় থেকে টপ টপ করে জল ঝরছে ননীর। সেই জল চৌখুপির ধুলোমাখা মেঝেতেও পড়ল। অনেক উপরে যে ঘুলঘুলিটা রয়েছে সেখান থেকে একটা আলোর রেখা সোজা এসে পড়ছে সেই মেঝের উপর। সেই আলোতেই ননী হঠা‌ আবিস্কার করল জিনিসটা। জল পেয়ে ধুলো সরে গিয়ে চকচক করছে একটা আস্ত মোহর।

সেইদিন সন্ধ্যেবেলা ননীর দাওয়ায় সটান এসে হাজির ভুবন। তাকে দেখেই প্রমাদ গুনল ননী। সে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। ভুবন তাকে ছাড়বে না কিছুতেই। ননী বুদ্ধি করে তক্তাপোষে সটান শুয়ে পড়ে গায়ে চাদরটা টেনে নিল। তারপর সাড়া দিল, "আজ বড্ড মাথা ধরেছে ভুবনদা। কাল তোমার সঙ্গে কথা বলব।"

ভুবনের সে কথা কানে ঢুকল বলে মনে হল না। সে ভাবছে আরো দু-একটা মোহর ননীর কাছে থাকলে তা কায়দা করে হাতিয়ে নিতে হবে। ননীটা যা হাবাগোবা তারপর সব মোহর একসঙ্গে গলিয়ে...। ভুবন তার লোভী চোখ দিয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে লাগল। "না, অত তাড়াহুড়া করলে চলবে না " নিজের মনেই বলল ভুবন।

রাত তখন কত হবে কে জানে। হঠা‌ৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ভুবন পাণ্ডের। ঘুম ভেঙ্গে যেতেই চোখ চলে গেল জানালার পাশে তার কাঠের চেয়ারটার দিকে। কে বসে রয়েছে তার চেয়ারে ?

"কে ওখানে?!"

ভুবন আস্তে করে জিজ্ঞেস করল। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর পেল সে।

"আমি তোমার বাবার টোলের পণ্ডিত হে ছোকরা। তোমার বাবা মানে জগন যেমন আমার হাতে বেত খেয়েছে তবু মানুষ হতে পারেনি ঠিক তেমনি হয়েছো তুমি। বলি কী ভেবেছো ননীর দেওয়া মোহরখানা হাপিস করে ফেলবে? জানো ঐ মোহরের ঐতিহাসিক মূল্য কত ! সে বিষয়ে কোন ধারণা আছে তোমার। তাছাড়া মোহরটাতো শুধু হাতে নিচ্ছো আর ওটার ওজন যাচাই করে যাচ্ছো। একবারও কী চেষ্টা করে দেখলে কী লেখা আছে ওতে ? অবশ্য আমারই ভুল হয়েছে। টাকা ছাড়া তো কিছুই চিনলে না কোনদিন। তাই মোহরের গুরুত্ব তুমি আর কী বুঝবে !"

এসব কথা শুনে ভুবনের মাথা বন বন করে ঘুরতে লাগল। তবে এত সবের পরেও ভুবন নিজেকে সান্তনা দিল এই বলে যে, এটা একটা বিদঘুটে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে সে হঠা‌ৎ এই টোলের পণ্ডিতের স্বপ্নটা দেখতে গেল কেন সেটাই বুঝতে পারল না। পণ্ডিত মশাইয়ের নামটা যেন কী... কী যেন ঈশ্বর। হ্যাঁ মনে পড়েছে - বটেশ্বর।

বটেশ্বর পণ্ডিত হঠাৎ বাঁজখাই গলায় চিৎকার করে উঠল, "তা  ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে না থেকে বল তো হে ছোকরা আমার মোহরখানা কোথায় রেখেছো ?"

পণ্ডিতের ধমক খেয়ে ভুবন বালিশের ভেতর হাত ঢুকিয়ে টাকার থলিটা বের করল। সেটার মধ্যেই ছিল মোহরখানা। বটেশ্বর পণ্ডিত সেটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিল। তারপর ভুবনকে বলল, "তোমার বাবা জগন ননীর বাপের কাছে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই ভিটে খানা নিয়েছিল। ননীর বাপ তার জন্য কোন টাকা-কড়ি পর্যন্ত নেয়নি। আর তুমি তার ছেলে হয়ে ননীর উপর খবরদারি কর কোন সাহসে? ভালো মানুষের ভালোমানুষীর সুযোগ নেওয়া অন্যায় তা জান না ?"

বটেশ্বর পণ্ডিতের মোহর

ভুবন মিন মিন করে বলল, "কিন্তু ননী তো আমার কাছে পাঁচশো টাকা...!"

কথাটা শেষ করতে পারল না ভুবন। মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বটেশ্বর বললেন, "তোমার ওই পাঁচশো টাকাই বড় হল? এই ঘরের দান-পত্র করা দলিলে এখনো ননীর বাপের সই জ্বল জ্বল করছে। তার কোন মূল্য নেই ? ননী কোনদিন কারও সাতেও থাকেনা পাঁচেও থাকেনা। এই শেষবারের মতো বলে দিলাম তাকে ঘাঁটাতে যেও না। তা হলে ফল ভালো হবে না কিন্তু ", বলতে বলতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন বটেশ্বর পণ্ডিত।

ভুবনেরও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। কী বিদঘুটে স্বপ্নরে বাবা। এ যে পাক্কা তিনঘন্টার হিন্দি সিনেমা। স্বপ্নটা এতই বড় যে শেষ হতে হতে রাতও প্রায় শেষ হয়ে এল।

ভোরের ঠান্ডা হাওয়া লেগে ঘুমটা ফের ধরে গেছিল ভুবনের। হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে বালিশে হাত ঢুকিয়ে টাকার থলিটা বের করল সবার আগে। মোহরটা কোথায় গেল ? তাহলে রাত্রে বটেশ্বর পণ্ডিতের সাথে তার কি সত্যি সত্যিই কথা হয়েছিল ?  ভোরবেলাতেই গল গল করে ঘামতে লাগল ভুবন।

দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর জন্য সে বাবার রেখে যাওয়া টিনের তোরঙ্গ থেকে একখানা দলিল খুঁজে বের করল। সত্যি সত্যিই সেটা একটা দানপত্র করা দলিল। আর অবাক কান্ড দলিলে রয়েছে ননীল স্বর্গীয় পিতার স্বাক্ষর। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না ভুবন তার নিজের চোখকে। এও কী সম্ভব ?

ননী তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। শুয়ে শুয়েই সে শুনল ভুবন উঠোনে এসে সস্নেহে তাকে ডাকছে, "ননী ভাই ! এবার উঠে পড়ো । অনেক বেলা হল যে। "

ননী ঘুম থেকে উঠতেই ভুবন তার কাছে এসে চারটি কড়কড়ে একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিল।

ননী বেশ খুশি মনেই সেগুলো নিল আর ভাবল, সে অনেকদিন পর একটা ভালো স্বপ্ন দেখছে। ভোর হতে এখনো অনেক দেরি আছে। হাড়-কেপ্পন-সুদখোর ভুবনের এই দান করার স্বপ্নটা বড্ড বেমানান। তবু ভালো স্বপ্ন দেখতে চায় সকলেই। স্বপ্ন চলতে থাকুক... এই বলে ভুবনের টাকা হাতে নিয়ে ননী ফের বিছানায় শুয়ে ফর্.. র্ ফর্ ..র করে নাক ডাকতে লাগল।

আর ভুবন হাত জোড় করে বটেশ্বর পণ্ডিতকে উদ্দেশ্য করে বলল, "মাপ করে দিন পণ্ডিত মশাই ! আপনার মোহর আপনার কাছেই রাখুন। শুধু একটাই অনুরোধ রাত-বিরেতে আর ওরকম বাজখাঁই গলায় ধমকাবেন না। না হলে পিলে চমকে যাবে। দোহাই আপনার !"   

ঠিক তখনই ননীদের চৌখুপি থেকে একটা চামচিকে বেরিয়ে এসে ভুবনের চুল ছুঁয়ে ফের চৌখুপির ঘুলঘুলিতে ঢুকে পড়ল !

 

ছবিঃ মিতিল

পুরুলিয়ার বাসিন্দা তরুণ কুমার সরখেল জেলার প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করেন। পাশাপাশি ছোটদের জন্য নিয়মিত লেখালিখি করেন, এবং ছোটদের জন্য একটি মুদ্রিত পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা