সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

খোশমেজাজে গান ধরল পতিতপাবন। হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাতার উপরের রাংতা মোড়া অংশটায় মিষ্টি আওয়াজ হচ্ছে। মোটকথা আজকের ভোরবেলাটা পতিতপাবনের একার জন‍্য।

পতিতপাবন প্রতিদিন ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ঘুম ভেঙে যেতেই তার প্রথম কাজ হল মিহিসুতোর চুনো-পুঁটি ধরবার জাল আর মাছ রাখবার খালুইটা হাতে ঝুলিয়ে পুটিয়ারি ড্যামের দিকে রওনা হওয়া। সেখানে দেশাহা গ্রামের ভগীরথ ডিঙিনৌকো নিয়ে হাজির থাকে।

আজ ভোরবেলা পতিত ঘুম থেকে উঠেই দেখল চারদিক কুয়াশায় ঢেকে গেছে। দশ হাত দূরের কিছু জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। মাথায গামছা বেঁধে চাদরটা ভালো করে ঘাড়ের কাছে বেঁধে নিল সে। তারপর বেরিয়ে পড়ল।
    
বাইরে বেরোতেই বুঝতে পারল কুয়াশা এতটাই ঘন যে সেটা বৃষ্টির আকার নিয়ে বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ছে। পুরো রাস্তা যেতে যেতে মাথার গামছা ভিজে যাবে মনে হয়।
    
পতিতপাবন গরিব জেলে। তার ঘরে কোনকালেই কোন ছাতা ছিল না, এখনো নেই। তাই কী ভগবান দয়া পরবশ হয়ে একখানা ছাতা ঠিক তার পায়ের কাছে এনে রেখে দিয়েছে ?
    
পতিতপাবন যখন ভাবছিল কুয়াশা-বৃষ্টিটা যদি বেড়ে যায় তাহলে তো সে ভোরবেলাতেই ভিজে স্নান করে যাবে। ঠিক তখনই পায়ে ঠেকল ছাতাটা। কোন ভবঘুরে রাস্তায় ছাতাটা ফেলে রেখেই চলে গেছে। অবশ্য ভালই হল। পতিত জাল আর খালুই কাঁধে ঝুলিয়ে শরীরটা একদিকে কাত করে ঝটিতে ছাতা মেলে ধরল। নাহ্ ভাঙা ছাতা নয়। দিব্যি কুয়াশা-বৃষ্টি আটকানো যাবে। শুধু মাথার উপরটায় দু-একটা ফুটো দেখা যাচ্ছে এই যা।
        
রাস্তা পুরো শুনশান। সেই নির্জন পায়ে চলা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একবার কি ঘুমিয়ে পড়ল পতিতপাবন ? না সেটা আবার হয় নাকি ? অবশ্য ঘুমিয়েও অনেকে হাঁটতে পারে বলে সে শুনেছে। তবে তার তো হাঁটতে হাঁটতে কোনদিন ঘুম পায় না। আজ হঠাৎ সে হাঁটতে হাঁটতে একটা বিদঘুটে স্বপ্নও দেখে ফেলল। দেখল সে আর ভগীরথ ডিঙিনৌকো চেপে জলের মধ্যে জাল ফেলে চুনো-পুঁটি ধরছে। একটা বোট তর তর করে ভেসে ঠিক তাদের পাশটিতে চলে এল। এই শীতের সময় পুটিযারি ড্যামের পাড়ে অনেকেই পিকনিক করতে আসে। সেই সব পিকনিক পার্টির দল বোট ভাড়া নিয়ে নরম রোদ গায়ে মেখে জলে ভেসে বেড়ায় আর আনন্দ করে। সেরকমই একটি বোটের মধ্যে দু-তিনটি অল্পবয়েসী ডাকাবুকো ছেলে জলের গভীরে চলে এসেছে।
    
সে আর ভগীরথ মাছ ধরা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তখনই বোটটা বেসামাল হয়ে উলটে পড়ল। তারপর ঠিক কী হল সেটা পতিতপাবন দেখতে পেলনা। তার স্বপ্নটা ভেঙে গেল। নিশ্চয়ই তার পেটে বায়ু হয়েছে। হরেন ডাক্তারের কাছে একবারটি যেতে হবে।
    
ড্যামের পৌঁছাতেই দেখতে পেল ভগীরথ ডিঙি তৈরি করে বসে রয়েছে। পতিতপাবন ঘাটের একপাশে ছাতাটা সযতনে গুটিয়ে রাখল। গায়ের চাদরটাও খুলে ফেলল। তারপর ভগীরথকে নিযে ডিঙিতে চড়ে জলে ভেসে পড়ল।
    
ভোর থেকে সকাল আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত মাছ ধরা চলে। চুনো-পুঁটি তো আছেই মাঝে মধ্যে রুই-কাতলা-মিড়িকও জালে ধরা পড়ে।
    
পতিতপাবন বলল, "বুঝলি ভগীরথ ভোরবেলা কুয়াশা-বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে আসছি এমন সময় মনে হল যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই একখানা ছোট-খাটো স্বপ্নও দেখে ফেললাম।"
    
ভগীরথ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, "ওসব বুলানো ভূতের কাণ্ড। তেনাদের হাওয়া গায়ে লাগলে ওরকম হয়। গত বছর মাধাই ভোরবেলা মাঠে কী একটা ঘাসে পা দিয়েছে আর অমনি সে সারামাঠ চক্কর দিতে লেগেছে। কোথায় যাবে, কোনদিকে রাস্তা কিছুই মনে পড়ে না। শুধু ঘুরে ঘুরে মরে। শেষকালে ভামি পিসি এসে মাধাইকে উদ্ধার করল বলে মাধাইটা বেঁচে গেল।"
    
এরপর দুজনেই মাছ ধরার কাজে মশগুল হয়ে পড়ল। জলের পাড়ে এই সাতসকালেই কখন একটা পিকনিক পার্টি এসে হাজির হয়েছে।
    
পতিতপাবন বলল, "আজ কুয়াশা কেটে সূর্য উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে।"
ভগীরথ বলল, "এই কুয়াশার মধ্যেও পিকিনিকের দল ঠিক এসে পড়েছে ঐ দ্যাখ।"

বেলা তখন আটটা-সাড়ে আটটা হবে। পতিতপাবন আর ভগীরথ মাছ ধরা শেষ করে ডিঙি ঘুরিয়ে পাড়ের দিকে ফিরছিল। তারা দেখল তিনটি এগারো বারো বছরের দুরন্ত ছেলে একখানা বোট নিজেরাই খুলে নিয়ে জলে ভেসে পড়েছে। ছেলেগুলো পা দিযে বেশ জোরেই বোট চালাচ্ছে কিন্তু দিশা ঠিক রাখতে পারছে না। কখনো বাঁ দিকে যাচ্ছে কখনো ডানদিকে। তাছাড়া একটি ছেলে আবার বোটের উপর দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বীরদর্পে সামনে তাকিয়ে রয়েছে। ওদিকে পাড় থেকে তাদের অভিভাবকরা ততক্ষণে ব্যাপারটা জানতে পেরে চি‌ৎকার শুরু করেছে।

পতিতপাবন একটু চমকে উঠল যেন। আরে হলুদ কালো ডোরাকাটা জামা গায়ে যে ছেলেটা বোটের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকেই তো সে আজ ভোরবেলা স্বপ্নে দেখতে পেয়েছে। হ্যাঁ, ঐ ছেলেটাকেই।এ তো বেশ ভূতুড়ে কাণ্ড। স্বপ্নে তো সে দেখেছে একটা বোট বেসামাল হয়ে.....।

ভগীরথরা বোটটার খুব কাছে চলে এসেছিল। পতিতপাবন যেন তৈরি হয়েই ছিল যে এবার একটা কিছু ঘটতে চলেছে। ডাকাবুকো ছেলেটি ভাবল অনেকক্ষণ তো দাঁড়িয়ে থাকলাম। এবার একটু নাচ করলে কেমন হয়। তার বিদঘুটে নাচের তালে হালকা বোটটা আর তাল রাখতে পারল না। একপাশে কাত হতে হতে তিনজনকেই জলে ফেলে দিল।
    
পতিতপাবন নিমেষে জলে ঝাঁপ দিয়ে দুটো ছেলের মাথার চুল সজোরে চেপে ধরল।

ভগীরথ ডিঙি থেকে না নেমেই ডিঙি চালানোর লম্বা বাঁশটা বাড়িয়ে দিল বাকি ছেলেটার দিকে। অবশ্য ততক্ষণে ঐ ছেলেটিও জল খেয়ে পেট অনেকখানি ফুলিয়ে ফেলেছে।
    
ছেলেটি বাঁশটা শক্ত করে ধরে আছে আর ভগীরথ তাকে ডিঙির দিকে একটু একটু টেনে আনছে আর বকাঝকা করছে, "সাঁতার না শিখেই মা গঙ্গার সঙ্গে রসিকতা ? আজ খুব জোর বেঁচে গেলি। নাহলে এই দু'তাল গাছ সমান গভীর জলে এতক্ষণে সলিল সমাধি ঘটে যেত।"
    
পতিতপাবন বলল, "এবার এই দুটোকে টেনে তোল। আমি আর কতক্ষণ এই ঠাণ্ডা জলে সাঁতার কাটব।"
    
তিনটি ছেলে যখন ডিঙিতে উঠে এল তখন তাদের ডেঁপোগিরি একেবারে চুপসে গেছে। পেট বুক জলে টইটম্বুর। ঠাণ্ডা লেগে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লেগেছে।
    
ভগীরথ সমানে বকে যাচ্ছে ছেলেগুলোকে। কিন্তু পতিতপাবন একেবারে নীরব। সে শুকনো গামছা দিয়ে মাথা গা মুঝতে লাগল আর ভাবতে লাগল - "ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় কথাটা আজ তার বিশ্বাস হল। তবে ভোরবেলায় সে যে স্বপ্নটা দেখেছে তা বাস্তবে একেবারে সিনেমার মত মিলে গেল। ঠিক যেন একটা সিনেমাই দু-বার দেখল সে। তাকে কী সত্যিই বুলানো ভূতে পেয়েছিল আজ ? "
    
পতিতপাবনের খুব সকাল সকাল স্নানটা হয়ে গেল। ঠাণ্ডা জল মাথায় প্রবেশ করতেই মস্তিষ্কও চনমনে হয়ে গেল। তাই হয়তো ঝট্ করে মনে পড়ে গেল রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া বিদঘুটে ছাতাটার কথা। সত্যিই তো, ছাতাটার কথা সে এতক্ষণ একবারও ভেবে দেখেনি। ওটাই একটা ভূতুড়ে ছাতা নয়তো ?

দ্রুত ডিঙি পাড়ে এনে ছেলে তিনটিকে তাদের মা বাবার হাতে তুলেই পতিতপাবন ছুটল তার রেখে যাওয়া ছাতাটার কাছে। কিন্তু কোথায় তার কুড়িয়ে পাওয়া ছাতা। গায়ের চাদরটা পড়ে রয়েছে যথাস্থানেই শুধু ভূতুড়ে ছাতাটা একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কোন চিহ্নই পাওয়া গেলনা সেটার।

ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী

পুরুলিয়ার বাসিন্দা তরুণ কুমার সরখেল জেলার প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করেন। পাশাপাশি ছোটদের জন্য নিয়মিত লেখালিখি করেন, এবং ছোটদের জন্য একটি মুদ্রিত পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা