সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

তোমরা গুড্ডি, জোজো আর কপিলকে চেনো? চিনতেই পারো, তবে পছন্দ করো না ওদের সেটা আর বলে দিতে হবে না। স্কুলের কেউই ওদের খুব একটা পছন্দ করে না। তার কারণ ওরা হল যাকে ইংরেজিতে বলে 'বুলি'। সবাইকে রাগিয়ে খেপিয়ে তাদের প্রাণ অতিষ্ট করে দেয় তারা। ছোটরা সবাই ভয় পায় ওদের, সহপাঠিরা এড়িয়ে চলে। আমরা সবাই ওদের কথা শুনেছিলাম। কী ভাবে ওদের জব্দ করা যায় সেই নিয়ে ভাবতাম। তারপর একদিন হঠাৎ ওরা কেমন ভাবে জানি বদলে গেল। দেখলাম আর কাউকে বুলি করছে না ওরা, আর পাঁচটা ভালো ছেলেমেয়েদের মতন শান্ত হয়ে গেছে! কী হয়েছে জানার জন্যেই এক বিকেলে গুড্ডিকে ধরলাম, "হ্যাঁরে গুড্ডি, কী হয়েছে বল তো? তোরা, মানে তুই, জোজো আর কপিল একদম বদলে গেছিস দেখছি!"

গুড্ডির সঙ্গে আমার এমনি কিছুটা ভাব আছে। আমি ওদের চেয়ে অনেকটাই সিনিয়ার আর ওর ছোট ভাইটাকে পড়াই বলে। আমার কথা শুনে ওর চোখে ভয়ের একটা ঝিলিক খেলেই মিলিয়ে গেল।
আমি আবার বললাম, "কিরে? বলবি না?"
গুড্ডি বলল, "তোমাকে বলছি কিন্তু অন্য কাউকে বোলো না। কেউ জানে না, এমন কি মা বাবাও না!"
আমি মনে মনে ভাবলাম, "ওরে বাবা! তার মানে তো সাংঘাতিক কিছু!" মুখে বললাম, "না, না আমি আবার কাকে বলব?"
গুড্ডি বলতে শুরু করল, "সেদিন সন্ধ্যায় কাজের মাসি টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তেই জোজোর মাথায় বদমাইশি চাপল। সে নিজের খেলনা গাড়ি দুটো ব্যালকনি দিয়ে বাগানে ফেলে দিল! তারপর আমাকে বলল, 'ওগুলো আনতেই হবে নাহলে চুরি হয়ে যাবে!' আমি আর কী করব, রাজি হলাম। সত্যি বলতে কী আমারও বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। সাবধানে মাসিকে না জাগিয়ে দরজা খুলে আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখি কপিল বসে আছে! ও মনে হয় অপেক্ষা করছিল আমরা কখন আসব। জোজোর সঙ্গে ওর কী কথা হয়েছিল জানি না!"
এখানে বলে রাখা ভালো যে গুড্ডি আর জোজো ভাই বোন আর কপিল ওদের ফ্ল্যাটেই নিচের তলায় থাকে।
"অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি জোজোকে বলছিলাম তাড়াতাড়ি কর! পিছনের দিকে জলা আছে বলে ওদিকটায় কেউ যায় না। আমাদেরও ওখানে যাওয়া বারণ কখন কী হয়ে যায় বলে কিন্তু জোজো তো গাড়িগুলোকে ওইদিকেই ফেলেছিল তাই ওদিকেই যেতে হল। সেখানেই আবছা অন্ধকারে আমরা লোকটাকে দেখতে পেলাম। লোকটা এক ফুট মতন লম্বা হবে! কান আর নাকগুলো ছুঁচোলো মতন। কেমন যেন অদ্ভুত রকমের জামাকাপড় পরা! জোজোর ফেলা একটা খেলনা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটাকে দেখেই জোজো তো ঝাঁপিয়ে পরে তাকে হাতে তুলে নিল! লোকটার লম্বা কান ধরে বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, 'এই ব্যাটাকে কালকে স্কুলে নিয়ে যাব! বন্ধুদের দেখাবো, খুব মজা হবে!'  
ওর  ওই রকম ভাবে ঘোরানোর চোটে লোকটা গোঁ গোঁ করতে লাগল। হালদার দাদুর পোষা খরগোশটাকে ওই ভাবেই ঘোরানোর জন্যে ভয়ঙ্কর বকুনি খেয়েছিল জোজো। অন্যের লাগছে কিনা সেটা নিয়ে ওর কখনও হুঁশ থাকত না। সত্যি বলতে কী আমারও থাকত না কিছুদিন আগে পর্যন্ত। জোজো ঘোরানো থামাতে লোকটা পরিষ্কার বাংলায় বলল, 'তোমার গাড়ি নিয়ে খেলছিলাম বলে রাগ করেছো বুঝি? আসলে আমরা মাঝে মাঝে এই জলার ধারে আসি। তোমার গাড়িটা দেখে ভালো লেগেছিল তাই দেখছিলাম। অন্যরা কখন চলে গেছে খেয়ালই করিনি!'
জোজো সেটা শুনে বলল, 'ভালোই হয়েছে!' বলে ও আর আমি মিলে আবার লোকটাকে ধরে লোফালুফি করতে শুরে করে দি্লাম। এখন বুঝতে পারছি ভয়ঙ্কর ভুল করেছিলাম!   
কপিল অবশ্য ভয় পেয়েছিল, সে বলল, 'জোজো- গুড্ডি ওকে ছেড়ে দাও! ওরা ছোট মানুষ! মা বলেন ওরা নাকি জাদু জানে!'
জোজো কিন্তু শোনবার পাত্র নয় বলল, "একে দিয়ে কাল স্কুলে ফুটবল খেলব!'
আমি শুনে বললাম, 'থাম জোজো সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! এবার তোর গাড়ি নিয়ে চল। মাসির ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিপদ হবে। বকুনি খেতে হবে!'
লোকটা হঠাৎ বলে উঠল, 'তোমাদের বন্ধুর মা ভুল বলেননি, আমি সত্যিই জাদু জানি! তোমাদের এমন একটা জিনিস দেব যে সবার তাক লেগে যাবে!'
আমরা ভেবে দেখলাম একটা লোককে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে জাদুর কোন জিনিস নিয়ে যাওয়া সুবিধা। লোককে নিয়ে গেলে তাকে খেতে দিতে হবে, তাকে রাখবই বা কোথায়? মা-বাবা বা কাজের মাসির চোখে পড়লেই হয়েছে! জিনিস বরঞ্চ লুকিয়ে রাখা যাবে।
আমরা তখন লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী জিনিস আগে বলো!'
লোকটা হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে দেশলাই কাঠির বাক্সের মতন কী যেন একটা হাতে এনে ফেলল তারপর আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'এই নাও! এটা জাদুর কলম। এর কালি কখনও শেষ হয় না। যে রঙ চাইবে সেই রঙ্গেই লেখা হবে।'   
লোকটাকে মাটিতে নামিয়ে পেনটাকে হাতে নিল জোজো। সেই সুযোগেই লোকটা ছুটে পালিয়ে গেল! শুধু বলে গেল, 'দারুণ জিনিস কিন্তু একটু সাবধানে ব্যবহার কোরো!' বলেই চোঁ চাঁ দৌড় দিল!  
জোজো বুক ফুলিয়ে বলল, 'চল ভিতরে গিয়ে জাদুর পেনটা পরীক্ষা করে দেখি!'
ঘরে ঢুকে খাতা থেকে কয়েকটা কাগজ ছিঁড়ে জোজো বলল, 'সবাই আলাদা আলাদা রঙ দিয়ে লিখব! এক একটা অক্ষর এক একটা রঙের। লোকটা সত্যি কথা বলল না বোকা বানাল সেটা আমাদের দেখতে হবে তো!'
জোজই প্রথম পেনটাকে হাতে নিয়ে 'সবুজ' বলে সবুজ রঙ দিয়ে একটা অক্ষর লিখে পেনটা আমাকে দিল। আমি 'নীল' বলতেই পেনটা নীল কালির হয়ে গেল! আমি একটা অক্ষর লিখে কপিলকে দিলাম। সে কমলা রঙের অক্ষর লিখল। এর পর জোজো লাল, আমি গোলাপি আর কপিল হলুদ রঙের অক্ষর লিখে পেনটা জোজোকে দিতে গিয়ে দেখি জোজোকে কেমন যেন অন্য রকম দেখাচ্ছে! ওর মাথায় শিঙয়ের মতন কী বেরোচ্ছে দেখলাম। হাত পাগুলোও কেমন যেন খুরের মতন দেখাচ্ছে!  
তাই দেখে আমি লেখা টেখা ভুল গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, 'ওমা তোর কী হয়েছে রে!'
'তোদের দুজনকেও তো খুব একটা মানুষের মতন দেখাচ্ছে না!' জোজো মুখ হাঁড়ি করে বলল, সেও লেখা ভুলে গেছে তখন!
আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার হাতগুলো মাছের পাখনার মতন হয়ে গেছে! কপিলের মুখটা কেমন যেন কুঁচকে গেছে! আর ওর সারা গায়ে হাতে পায়ে বড়ো বড়ো লোম!
'বাবারে! কী হল রে! এ তো জাদুর কলম নয়! এ তো অভিশপ্ত কলম! এটা হাতে ধরলেই বিপদ!' বলে জোজো হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে পেনটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল!   
আমি আর কপিল দেখতে চেষ্টা করছিলাম কেন এই রকম হল। আমাদের লেখাগুলো পড়ে দেখতেই আমি বুঝতে পারলাম কী হয়েছে! আমি বললাম,'আমরা যা লিখছি তাই হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে!'
জোজো কিছু বুঝতে না পেরে বলল, 'মানে?'
ওর মুখটা কেমন লম্বা হয়ে যাচ্ছিল গরু ঘোড়ার মতন! মাথার সিংগুলো বেড়েই চলেছিল ক্রমাগত!
'এই দেখ! আমরা নিজেদের নামগুলো লিখছিলাম তো। এক একটা করে অক্ষর লিখতে গিয়ে কিন্তু সবার নামের দুটো করে অক্ষর লেখা হয়ে অন্য একটা মানে বেরিয়ে এসেছে!'
ওরা দুজনেই তাকিয়ে দেখল। আমার ভালো নাম মীনাক্ষি তাই আমি শুধু মীন লিখেছি! জোজো নিজের ভালো নাম মৃগাঙ্কর মৃগ লিখেছে আর কপিল লিখেছে কপি!

'সেই জন্যেই আমি মীন মানে মাছ হয়ে যাচ্ছি, তুই মৃগ মানে হরিণ হয়ে যাচ্ছিস আর কপিল তুই কপি মানে বানর হয়ে যাচ্ছিস!'
'কী সাংঘাতিক! এবার কী হবে?' বলে কপিল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল!
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, 'যা হোক করে হোক আমাদের নিজেদের পুরো নামগুলো লিখে ফেলতেই হবে, বদলটা পুরোপুরি হয়ে যাওয়ার আগে! কপিল তুই পেনটাকে তুলে নিয়ে আয়! তোরই তো একমাত্র হাত রয়েছে জোজোর খুর আর আমার তো পাখনা!'
কপিল হুপ হুপ করতে করতে গিয়ে পেনটা তুলে নিয়ে এসে জোজোর মুখে ধরাতে সে তার হরিণের মুখে দিয়ে কোন রকমে মৃগাঙ্ক নামটা লেখা শেষ করল। শুধু মৃগাঙ্ক লিখে না থেমে মৃগাঙ্ক ঘোষ লিখল। তখন আর রঙ টং নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই! আমি মুখে কলমটাকে নিয়ে মীনাক্ষি ঘোষ লিখলাম আর কপিল নিজের লোমশ হাত দিয়ে কপিল কুমার সিনহা লিখল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আবার আগের মতন হয়ে গেলাম। মা-বাবা অফিস থেকে ফিরে কিছু বুঝতে পারলেন না যে আমাদের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে। কাজের মাসিও ঘুমিয়েই ছিল কিছু জানতে পারেনি!"
এতটা বলে গুড্ডি থামল।
আমি আঁতক উঠে জিজ্ঞেস করলাম, "সেই কলম এখন কোথায়?"  
গুড্ডি বলল, "সেটাকে আমরা জলে ফেলে দিয়েছি দিদি! কে আবার ওটা দিয়ে লিখে কী বিপদে পড়ে যাবে সেই ভেবে! আর এখন কোন জন্তু দেখলেই আমাদের মনে হয় এরা হয়তো আমাদের মতন মানুষ ছিল কোনদিন কিন্তু জাদুর পেনের খপ্পরে পড়ে জন্তু হয়ে গেছে! আমার তাও ঠিক সময় মাথায় এসেছিল যে পুরো নামটা লিখতে হবে কিন্তু ওদের হয়তো মাথায় আসেনি! ওই ছোট মানুষকে কষ্ট দিয়েছিলাম বলে আমাদের কী ভয়ঙ্কর দশা হচ্ছিল! তবে এখন আমাদের খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। আমরা আর কাউকে বুলি করি না! তবে দিদি যা বলেছিলাম, কথাটা আর কাউকে বোলো না কিন্তু!'
আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে বোকার মতন মাথা নাড়লাম শুধু!

ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী

অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা