সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ভোর

সেদিনটা উপমার সারাজীবন মনে থাকবে। মে মাসের শেষ। প্রচন্ড গরম। উপমার কোন কিছুতেই মন বসছে না। কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব সব সময়। ক্লাস টেনের রেজাল্ট যে কোন দিন বেরবে। ওদের বাড়ির কম্পিউটারটা কদিন হল বিগড়েছে তাই বাবা বলেছেন অফিসের কম্পিউটারে রেজাল্টটা দেখে জানাবেন। উপমা এমনিতে পড়াশোনায় খারাপ না কিন্তু পরীক্ষার ঠিক আগেই ওর শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল – জন্ডিস। তখন একদম ভাল করে পড়তে পারেনি তাই রেজাল্ট নিয়ে ওর বেশ ভয় আছে। ওদের স্কুলে আবার অন্তত ৬০% নম্বর না পেলে নিজেদের স্কুলের ছেলেমেয়েদেরও বারো ক্লাসে নেয় না আর কম নম্বর নিয়ে অন্য স্কুলেই বা ঢুকবে কী করে?

দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল উপমা এমন সময় বাবার ফোনটা এল। মা'র মোবাইলেই করেছেন। বাবা ওপাশ থেকে যা বললেন তা উপমা শুনতে পেল না কিন্তু সেটা মোটেই ভাল কিছু হতে পারে না কারণ মা'র মুখ আঁধার। উপমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। কী হল রে বাবা? দীর্ঘ দশ মিনিট কথা বলার পর মা ফোনটা ছাড়লেন। উপমার দিকে যখন তাকালেন তখন মা'র চোখদুটো আগুনের ভাঁটার মতন জ্বলছে!

প্রথম কথাটাই বললেন, "লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে! তুমি ছাপ্পান্ন প্রতিশত নম্বর পেয়েছো মোটে। তোমার পড়াশোনার পাট এখানেই শেষ বলে মনে হচ্ছে। কাল থেকে শ্যামার মার সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে বাসন মাজতে চলে যেও না হয়!"

ভীষণ ধাক্কা খেল উপমা। সে জন্ডিসে ভোগার জন্যে শেষের দিকে তেমন পড়তে পারেনি মাথা ব্যথা করত বলে কিন্তু তার আগে তো পড়েছিল। ছাপ্পান্ন পার্সেন্ট পাবে সে মোটেই আশা করেনি। মনের দুঃখে বেচারি কাঁদতে শুরু করে দিল। একটু পরেই বাবা অফিস থেকে চলে এলেন। বাবার অফিসের শঙ্কর কাকুর ছেলে বিরাশি পার্সেন্ট পেয়েছে। চেনাশোনা আরো অনেকে ভাল নম্বর পেয়েছে। কপাল পুড়েছে শুধু উপমার।বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মা, বাবা, উপমা সবাই গোমড়া মুখ করে বসে রয়েছে। স্বাভাবিক রয়েছে একমাত্র উপমার ছোট ভাই আর্য। সে ক্লাস টুতে পড়ে। মার্ক্স টার্ক্সের ব্যাপার সে এখনও তত বোঝে না। সে স্কুল থেকে ফিরে এসে উপমাকে কাঁদতে দেখে বলল, "দিদিভাই তুই কাঁদছিস কেন রে?"

এক চিলতে স্নেহের পরশ পেয়ে উপমা আরো হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মা তখন আর্যকে বকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।

বিকেলবেলা মাসি মেসো পিকলুদাকে নিয়ে এসে হাজির। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় পিকলুদা নিজের স্কুল থেকে হাইয়েস্ট পেয়েছে। মাসি মেসোর মুখ গর্বে উজ্জ্বল। মা-বাবার মুখ যেন আরো কালো হয়ে গেছে। টেনে টেনে বললেন, "হ্যাঁ, পিকলু তো খুবই ভাল ছেলে।" মাসি-মেসো পিকলুদা জয়েন্টে কী রকম পজিশান পাবে সেই নিয়ে বলে চলেছিলেন হঠাৎ পিকলুদা বলল, "আরে আজকে ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের টেনের রেজাল্ট বেরিয়েছে না? তোর কেমন হল উপমা? যদিও টেনের রেজাল্টের এখন আর তেমন গুরুত্ব নেই, তাও কেমন হল?"

উপমা কিছুই বলল না। মুখ নিচু করে বসে রইল। মা-বাবার কাছে উপমার রেজাল্টের কথা শুনে মাসি-মেস তাড়াতাড়ি পিকলুদাকে নিয়ে চলে গেলেন যেন উপমাদের বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকলে পিকলুদারও রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে! যাক গে, ওরা তো তাও বাইরের লোক। মা-বাবার ব্যবহারেই সব চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে উপমা। শুধু রেজাল্টের ওই নম্বরগুলোই কি সব হল? পিকলুদা গতবার ওদের বাড়িতে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে ওদের খাটটা ভেঙ্গে দিয়েছিল। তার আগেরবার মার প্রিয় ফুলদানীটা অক্কা পেয়েছিল! উপমা কোনদিন কারো বাড়িতে ইয়ে ওই রকম করেছে? মা তখন বলেছিলেন, "পিকলুটা দিন কে দিন বাঁদর হয়ে চলেছে! দিদি-জামাইবাবু কেন যে ওকে কিছু বলেন না!" তাও আজকে সেই পিকলুদাই কিনা হিরো হয়ে গেছে আর উপমা সবার লজ্জার কারণ!

রাতে ডিনারে কিছুই প্রায় খেতে পারল না উপমা। সারা রাত বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করল। মা-বাবা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছেন অন্য ঘরে। বাবা অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই সেটা চলছে। নির্ঘাত ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে। ওনারা চাইছিলেন ও সাইন্স নিয়ে পড়ুক। কোন স্কুল আর হয়তো ওকে বিজ্ঞান পড়তে নেবে না ওই রেজাল্ট নিয়ে। ভোর হবার ঠিক আগে উপমার হঠাৎ মনে হল সূর্যোদয়টা দেখলে মন্দ হয় না তো! কোনদিন তো আর এত সকালে ঘুম ভাঙ্গে না ওর তাই সূর্যোদয়ও দেখা হয় না। সুপ্রিয়াদি বলে ওদের ফ্ল্যাটটা আটতলা বলে ছাদ থেকে দারুণ সূর্যোদয় দেখা যায়। সুপ্রিয়াদিদের অনামিকা অ্যাপার্টমেন্টস তো মাত্র দুটো বাড়ি পরেই। সেটা ভেবেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল উপমা। বাড়িটা অন্ধকার, নিস্তব্ধ। মা-বাবা, আর্য সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পায়ে চটি গলিয়ে বাড়ির দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।

গেটে পাহারাদার আছে সুপ্রিয়াদিদের কিন্তু সে উপমাকে চেনে। 'সুপ্রিয়াদিদের বাড়ি যাচ্ছি সূর্যোদয় দেখতে' বলতে সে গেটটা খুলে দিল। উপমা লিফটে করে আটতলা পর্যন্ত গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল। ও ভেবেছিল ছাদের দরজা হয়তো বন্ধই থাকবে কিন্তু দরজাটা খোলাই ছিল। পুবের আকাশ তখন ধীরে ধীরে রাঙ্গা হচ্ছে। উপমা মন দিয়ে সূর্যোদয় দেখতে লাগল। আহা কী রঙের বাহার! সুপ্রিয়াদি ঠিক বলেছিল এখান থেকে সূর্যোদয় অসাধারণ! চারিদিক ফর্সা হচ্ছে, পাখিরা কলরব করছে। এত ওপর থেকে নীচটা কেমন লাগে দেখার জন্যে উপমা যেই পাঁচিলের কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করছে ঠিক সেই সময় চিৎকারটা এল, "এই কী হচ্ছেটা কী! রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?"

উপমা চমকে ফিরে তাকাল। জলের ট্যাঙ্কের পিছন থেকে একটা মেয়ে ওকে দেখছে। ছাদের তাহলে আরো লোক রয়েছে, এতক্ষণ ও বিভোর হয়ে সূর্যোদয় দেখতে গিয়ে খেয়ালই করেনি! কিন্তু এই মেয়েটা জানল কী করে ওর রেজাল্টের কথা?
ওকেই জিজ্ঞেস করল উপমা, "আমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে সেটা তুমি জানলে কী করে?"
মেয়েটা ঠোঁট উলটে বলল, "সেটা আর নতুন কি? সবাই জানে!"
"তুমি কে? তোমাকে তো আগে দেখিনি।"

উপমা মেয়েটার কাছে গিয়ে ভয়ানক ভাবে চমকে গেল! মেয়েটার দুটো হাতই নেই! অথচ জলের ট্যাঙ্কের পিছনে রাখা ইজেল্র ওপর ভোরের আকাশের একটা সুন্দর জলরং আঁকা চলছে।

"হাঁ করে দেখছ কী? কি করে আঁকলাম ভাবছ? আমি মুখ দিয়ে আঁকি। আমি তিন দিন হল মার সঙ্গে মাসির বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। সুপ্রিয়াদিরা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। ওই কালকে তোমার মার কাছে তোমার রেজাল্টের কথা শুনেছে ফোনে। ওদের বাড়িতে তোমার ছবি দেখলাম তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি," বলে মেয়েটা অল্প হাসল।

উপমা তখনো ঠিক যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মুখ দিয়ে কেউ অমন সুন্দর আঁকা আকতে পারে ওর ধারণাই ছিল না!

ভোর

"আমার যখন অ্যাক্সিডেন্টে হাতগুলো খোওয়া গিয়েছিল তখন আমারও ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করত। সারা দিন শুধু কাঁদতাম। তারপর একদিন বাবা রবিন স্যারকে নিয়ে এলেন। বিশ্বাস করবে না ওনার হাত তো নেই, পাও নেই! হুইলচেয়ারে করে ঘুরে বেড়ান আর ছবি আঁকেন। আমি তো সবে শিখেছি, স্যারের আঁকা দেখলে না মাথা ঘুরে যাবে! ওনার আঁকা ছবি দিয়ে অনেক গ্রিটিং কার্ড হয়েছে। এখন একটা বইয়ের জন্যে আঁকছেন। তাই বলছিলাম রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে? হিম্মত হারলে তো চলবে না। ভাল স্কুলে অ্যাডমিশান না পেলেই তো আর সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। আমি তো এতদিন হাসপাতালে ছিলাম যে স্কুলেই যেতে পারিনি। তারপর প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।"

উপমা বলল, "তুমি ভুল বুঝেছো! আমি মোটেই ছাদ থেকে লাফ দিতে আসিনি। আমি রোজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠি তাই কোনদিন সূর্যোদয় দেখা হয়নি তাই আজকে যখন ঘুম আসছিল না তখন ভাবলাম সূর্যোদয়টা দেখে আসি। সুপ্রিয়াদি বলে এখান থেকে দারুণ দেখা যায় তাই এই ছাদে এসেছিলাম!"
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল, "এ বাবা! এই ব্যাপার! আর আমি বকেই চলেছি!"
"তুমি এখন কিছুদিন থাকবে তো?"
"হ্যাঁ, মাসখানেক থাকব।"
"ঠিক আছে তাহলে আবার দেখা হবে। এখন আমাকে যতে হবে দেরি হয়ে গেছে। কাউকে কিছু বলে আসিনি তো। আমি পরে আবার আসব। তখন তোমার আঁকা ছবি দেখব।"
"হ্যাঁ, এসো। সুপ্রিয়াদিদের বাড়িতে এলেই আমাদের ওখানে এসো কিন্তু!"

উপমা আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হল। মনটা বেশ হালকা লাগছে। অন্য স্কুলে বা প্রাইভেটে পড়লে ক্লাসের বন্ধুগুলোকে মিস করবে ঠিকই কিন্তু সেটা উপমা মানিয়ে নিতে পারবে।

বাড়িতে ঢুকে চমকে উঠল উপমা। এ কী! এত ভীড় কেন? প্রতিবেশীরা সবাই প্রায় এসে হাজির! ওকে দেখেই সবাই হই হই করে উঠল। মা কাঁদছেন, আর্য কাঁদছে, বাবারও মুখ গম্ভীর!

"কোথায় গিয়েছিলে মামণি? আমরা তো ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! রেজাল্ট খারাপের জন্যে বকুনি খেয়ে তুমি মন খারাপ করে বাড়ি ছেড়ে..."

উপমা আমতা আমতা করে বলল, "আমি মানে...না মানে আমার ঘুম আসছিল না তাই আমি সুপ্রিয়াদিদের বাড়ির ছাদ থেকে সূর্যোদয় দেখতে গিয়েছিলাম। কোনদিন তো এত সকালে ওঠা হয় না তাই ভাবলাম..."

ওর মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে মা বললন, "তোমার বন্ধু মোনিকা ফোন করেছিল। তোমার বাবা তোমার রোল নম্বরটা ভুল দেখেছিলেন! তুমি নাইন্টি পার্সেন্ট পেয়েছো। তোমাদের স্কুলে সেকেন্ড হাইয়েস্ট সেটা!"

আর্য ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, "দিদিভাই তুই বলেছিলি ভাল নম্বর পেলে আইসক্রিম আর চকোলেট খাওয়াবি, নে এবার খাওয়া!"

উপমার মুখটা তখন আনন্দে ভোরের আলোর মতনই ঝলমল করে উঠল।


ছবিঃঅর্কপ্রিয়া কোলে

অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা