খেলাঘরখেলাঘর

আস্থা

ছোট্ট শানুর দু দিন আগেই আট বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে বাড়ীতে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান হয়েছে। মা, ঠাম্মি,কাজের মাসি মিলে কিছু স্পেশাল রান্না করেছিলেন আর বাবা ফ্লুরিস থেকে একটা বিশাল কেক এনেছিলেন। অতিথি বলতে ছিলেন মামা, পিসি আর কাকুরা। বেলুন দিয়ে ঘর’টা সাজানো হয়েছিল। প্রত্যেকেই নানান উপহার দিয়েছেন, কিন্তু তারমধ্যে কোনটাই শানুর ভীষণভাবে চাওয়া সেই পি এস পি নয়! ভেবেছিলো বাবা বা মা হয়তো একটা সারপ্রাইজ গিফট দেবেন। কিন্তু না, তার বদলে কিনা ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া’র ঐ বিশাল ভারি ভারি বই গুলো! ধূর, অতো পড়বো কি করে? আর পড়েই বা কি হবে? অতো অতো পড়তে ভালো লাগেনা শানুর! আগে, আরো ছেলেবেলায় মা কেমন পাশে নিয়ে শুয়ে ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে সব বই গুলো পড়ে শোনাতেন! তখন বেশ ভালো লাগত। বোনি টা আসার পর সে সবই গেল। টানা সাতবছর একচ্ছত্র রাজ করার পর এই সহোদরাটির আগমনে শানুর ছোট্ট পৃথিবীটা যেন টলে গিয়েছিল। ঐ জ্যান্ত পুতুলটা যে সব্বাইকার মনোযোগ এইভাবে কেড়ে নেবে সে টা ভাবতেই পারেনি শানু। এমন কি মাও শানুর শোবার সময় হাত পা ছোঁড়ার অভ্যাস আছে বলে তাকে ঠাম্মির কাছে পাঠিয়ে দিল! কিচ্ছু ভাল লাগেনা শানুর! মাঝেমাঝে মনে হয় কেন যে তার দুনিয়া ওলটপালট করে দিতে এই আগন্তুকটি এল! বোনি প্রচণ্ড কাঁদতে থাকলে মা যখন তাকে কোলে নিয়ে আদরের নানান কথা বলে ওকে ভোলায়, ভীষণ কষ্ট হয় শানুর। গলার কাছটা কেমন যেন কাঁটা বেঁধার মত ব্যাথা হয়।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও শানু কেমন প্রতিদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেত আস্ত।শরতের সকালের নরম রোদ্দুরে মা কখনও ঝরে যাওয়া শিউলি ফুলের গন্ধ চেনাতে চেনাতে, কখনও বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ নিতে নিতে আবার কখনও বা দুপুর রোদে ঐ বড় গাছ টাতে বসা হলুদ পাখি টার ডাক কান পেতে শোনাতে শোনাতে শানু কে নিয়ে স্কুলের পথে যাতায়াত করতেন। মায়ের সঙ্গে সেই একান্ত নিভৃত সময়গুলো  সব কোথায় হারিয়ে গেল! ঐ পথেই ফুটপাথে্র একটা কোণে ঝুপরি তে থাকা ঢলঢলে প্যান্ট পরা খালি গায়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে প্রায়ই দেখতে পেত তারা। হাড় জিরজিরে রোগা ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। আপাত ভাবলেশহীন সেই দৃষ্টি টায় যে মায়ের হাত ধরে স্কুল যাবার ইচ্ছেটা যে উঁকি দিত সেটা মালা (শানুর মা) নিশ্চয়ই  বুঝতে পারতেন। শানুকে বলতেন “দেখ তো, গরীব হয়ে জন্মেছে বলে ওর কত কষ্ট!” মা কখনো ছেলেটিকে শানুর পুরনো জামাকাপড়, বই, কখনও খাবার দিতেন। সেদিন সকালসকাল সুবলদার সঙ্গে স্কুলে যেতে গিয়ে দেখল ছেলেটা কেমন মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে ঘুমচ্ছে। ভীষণ হিংসে হল শানুর। ছোট্ট শানুর কাছে তথাকথিত বৈভবের চেয়ে মায়ের কোলের কাছের ওম ভরা উষ্ণতা আনেক বেশি দামী।এসব ভাবতে ভাবতে রাত্রিবেলা খোলা জানালার দিয়ে শানু যখন বাইরে তাকিয়ে থাকে, দু’চোখ তার জলে ভরে আসে। শানুর ছোট্ট মনে জমে থাকা দুঃখ অভিমান তার বড়বড় দুটি চোখকে জলে ভাসিয়ে তার মাথার বালিশ টাকে সিক্ত করে তোলে। পাশের বাড়ির পলেস্তারা ওঠা শেওলাধরা দেওয়ালটায় রাস্তার শিরীষ গাছের ছায়া হাওয়া্য দুলতে দুলতে নানারকম আকৃতি তৈরি করে! ওগুলি কি সব অশরীরী দুষ্টু আত্মা? নেমে এসেছে রাতের অন্ধকারে? ঘুমোতে দেরি করলে যাদের আসার কথা ঠাম্মি বলে? ওরে বাবা গো। প্রচণ্ড দম বন্ধ করা ভয়ে শানু চোখদুটো জোরে চিপ্পে বন্ধ করে থাকে। তারপর কখন যে ঠাম্মির প্রবল নাসিকাগর্জন এর শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে চলে যায় শানু।
ঘুমের রাজ্য বড় মজার। আমাদের অপূর্ণ বাসনা গুলো কেমন সত্যি হয়ে যায় স্বপ্নের মধ্যে। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে শানু! কি যে সুন্দর স্বপ্ন! দেখে মোড়ের মাথায় নতুন মলটায় ইলেকট্রনিক্সের ঝকঝকে দোকানটায় গিয়ে নিজেনিজেই একটা দারুন পিএসপি কিনেছে সে। কি অপূর্ব যে জিনিস তা! কত্ত রকমের গেম, কার রেসিং, ফাইট! বিদ্যুতের গতিতে দু’হাতে বাটন টিপেটিপে খেলে যায় শানু। জিতের পর জিত। ওঃ কি যে মজা! পড়ার চিন্তা নেই, পরীক্ষার ভয়  নেই। বাবা, মা’র আশার উঁচু পাহাড়ের সামনে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে করবার মন খারাপ নেই - শুধু খেলা আর খেলা!
***
আজ সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠছে শানু। বোর্ডের পরীক্ষায় স্কুল ভাল ফল করেছে বলে ছুটি। যাই হোক তাই বলে কি মা আজ তাকে আদর করে ঘুম থেকে ওঠাতেও আসবেনা! নিশ্চয় বোনি কাল রাত্তিরে কেঁদে কেদে মাকে ঘুমোতে দেয়নি। গুটি গুটি পায় শানু মার ঘরের দিকে যায়, কোলের কাছে ঘেঁষে শুয়ে একটু আদর খাবে বলে।
এদিকে আজ সকাল থেকে বাড়িতে একটা চাপা উত্তেজনা চলেছে। সুমন মানে শানুর বাবা নাকি একটা নোটের বান্ডিল সে্দিন অফিস থেকে ফিরে ড্রয়ার এ রেখেছিলেন, সেটা এখন পাওয়া যাচ্ছেনা । মানসিক উষ্মার পারদ ক্রমশ চড়ছে। তার মধ্যে যেই না মালা বলেছেন, “তুমি ঠিক মনে করতে পারছ ওখানেই রেখেছিলে?” সুমন চিৎকার শুরু করলেন- “তার মানে আমাকে কি তোমার মতো ভুলো পেয়েছ? নির্ঘাত শানুর জন্মদিনের দিন ওটা গিয়েছে, বাড়িতে অত লোক এসেছিল!” তারপর একটু চাপা স্বরে যেন দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “তোমার দুটি অপোগণ্ড খুড়তুতো ভাই তো এই ঘরে বসে ল্যাপটপ এ কি সব করছিল”। ইঙ্গিত টা বুঝতে পেরে মালার ও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কান্নাকান্না গলায় বলে ওঠে, “কি – কি বলতে চাইছ তুমি? আমার কাকার অভাব থাকলেও ছেলেদের অসৎ হতে কখনও শেখান নি!” বলতে বলতেই দুর্বল স্থানে আঘাতে আহত মালা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। একটু  বেচাল কথা বলে পরিস্থিতি বেসামাল দেখে সুমন তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য তৈরি হতে শুরু করে।
মার কাছে এসেছিল শানু। সেও কথার মানে মাথা বুঝতে না পেরে, আবহাওয়া উত্তপ্ত দেখে দৌড়ে ঠাম্মির ঘরের দিকে পালিয়ে যায়।
ঠাম্মি বসে বোনের জন্য সোয়েটার বুনছেন আর পিসির সঙ্গে কথা বলছেন। পিসি শানুর জন্মদিনের আগে থেকে এসে এই কদিন এখানেই আছে। তাই শানুর বেশ মজা। ঘরে ঢুকতে গিয়ে শানু শুনতে পায় পিসি বলছে, “কোথায় টাকা টা যেতে পারে বলো তো’ মা? সেদিন তো দাদা আসার আগেই সব কাজের লোকও চলে গেছল!” ঠাম্মি পান চিবোতে চিবোতে উল বোনার কাঁটাগুলি তীব্র বেগে চালাতে চালাতে বলেন, “না না, সে সব সম্ভাবনা তো নেই ই। দ্যাখ গে সে টাকা বউ’মা বাপের বাড়িতে পাচার করেদিয়েছে। ওদিকে, মা বিধবা হবার পর ত ইনিই হাত খরচা সব জোটাচ্ছেন। যতোসব উটকো অশান্তি। মাঝখান থেকে আমার ছেলেটার কষ্ট!” কথার শ্লেষ আর তির্যক আক্রমণ শানু ঠাহর করতে না পারলেও টাকা নেবার ইঙ্গিত টা যে মায়ের দিকে সেটা শানু বুঝতে পারে । আর তখনই ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে শানুর। আর না  দাঁড়িয়ে দৌড়ে ফিরে যায় মায়ের ঘরের দিকে । সুমন  স্নান সেরে এসে প্যান্ট সার্ট পরতে পরতে বলে, “আচ্ছা শানু কি সেই পি এস পি না কি তার জন্য----- !” পুরো কথা শেষ হবার আগেই মালা চিৎকার করে কেঁদে বলে ওঠেন , “না কক্ষনও না – আমার ছেলে কোনোদিনও এ কাজ করতে পারে না”  মা এর আকস্মিক সরব কান্নায় ঘুমন্ত বোনি চমকে জেগে উঠে তারস্বরে কাঁদতে থাকে। বেগতিক দেখে সুমন তাড়াতাড়ি অফিসে বেরিয়ে যা্ন। শানকে ঘরে আস্তে দেখে মা বলেন “বোন কে একটু খেলা তো বাবা! আমি চান টা  সেরে আসি”। মালা বাথরুমে ঢুকে জলের কল জোরে খুলে দেন । জমে  থাকা বাকি কান্না টা কি ঐ জল তরঙ্গ চাপা দিতে পারল?
                                
***
বোনি টা একটা অদ্ভুত। তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে  দুম করে (শানুকে দেখেই বোধহয় )  “গি গি” আওয়াজ করে হাতের পুরো মুঠি টা নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে ওয়াক তুলতে থাকে। শানু আস্তে আস্তে তার হাত টা মুখ থেকে বার করে আনতে যায়। অই এক রত্তি পুটকে আবার হাত টা মুখের কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে আর মহানন্দে পা ছোড়ে। শানু কতবার ভেবেছে একে ব্যাল্কনিতে একা প্র্যামে শুইয়ে রেখে দিলে কেমন হয়! ওই যে বস্তা নিয়ে জিনিষ কুড়িয়ে বেড়ানো লোক গুলো ঠিক লুকিয়ে ওকে তুলে নিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেবে- কেউ জানতেও পারবেনা এদিকে শানু আবার মায়ের কাছে কাছে থাকতে পারবে! কিন্তু বোনি টা তার সদ্য বেরোনো দুটো দাঁত নিয়ে এমন একটা হাসি হাসল আর  ‘দ –দ-দ-দ’ করে গান জুড়ল যে শানুর মন টাও জুড়িয়ে গেল। সত্যি বলতে কি এই ‘দ-দ’ শব্দ টা শানুর শুনতে বেশ মজা লাগে- বেশ একটা বড় দাদা দাদা ভাব হয় শানুর।
ইতিমধ্যে  স্নান করে মা বেরিয়ে এসেছেন। শানুর মনে হল ছুট্টে মার কাছে যায়। কিন্তু যেতে পারে না, ভীষণ একটা কষ্ট হচ্ছে শানুর বুকের মধ্যে। মা ধীর পায়ে ঠাকুরের আসনের কাছে যান। অন্যমনস্ক ভাবে প্রদীপটা জ্বালান। প্রদীপের স্বর্ণাভ আলোর আভা’তে মা এর সদ্য স্নাত রক্তিম মুখ’টা কোন দেবীর মতই লাগে শানুর। এই সংসারে সন্তানের প্রতি স্নেহ, মায়া আর অগাধ বিশ্বাসের পরশ পাথর মাতৃত্ব কে যে দেবীতে উন্নীত করতে পারে।দৌড়ে গিয়ে শানু মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে “মা  মা ---আমি আমি----,” কিছুই কথা বলতে পারেনা শানু- শুধু মার কোলে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। আস্তে আস্তে মা শানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। তাঁর ও কপোল বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। বলেন “আর কোনও দিন কিছু পেতে ইচ্ছে হলে, এমন না বলে টাকা নিও না যেন” বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শানু ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঠে বসে, আশ্চর্য --- মা তাহলে সব জানতেন যে শানুই সেই টাকাটা PSP কেনার জন্য ......!! তাহলে সব কিছু জেনেও উনি বাবার সঙ্গে শানুর হয়ে লড়লেন? মা কে জড়িয়ে ধরে শানু আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। লজ্জা আর অনুতাপে মুহূর্তে শানু যেন অনেকখানি বড় হয়ে যায়। তবু বুঝতে পারে না সেদিনের মায়ের শানুর প্রতি গভীর আস্থাটাই যে শানুর মধ্যে স্বীকারোক্তির সৎ সাহস টা জুগিয়েছিল। সেটা  শুধু জানতেন মা।

পম্পা ঘোষ
সিঙ্গাপুর