সেই গাছের নিচে বসে ঘাসের জামা বানাতে বানাতে রাজকন্যার অনেক দিন কেটে গেল; এরমধ্যে রাজকন্যা আরও বড় হয়ে গেছে, দেখতেও ভারী সুন্দর হয়ে গেছে। এমনই সময় একদিন পাশের রাজ্যের রাজা শিকারে এলেন সেই বনে; তার দলবল শিকার করতে করতে সেই গাছের কাছে এসে পৌঁছলো আর সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখতে পেয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করল; কিন্তু রাজকন্যা দাদাদের জন্য জামা সেলাই শেষ না করে কথা বলতে পারবেনা তাই শুধু মাথা নাড়লো; কিন্তু তাতে কিছুই বুঝতে না পেরে রাজার দলবল তার সর্ম্পকে আরও জানতে ইচ্ছুক হল; তারা আবার তাকে জিজ্ঞেস করল সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে । কিন্তু রাজকন্যা একটাও শব্দ করল না। তখন রাজার দলবল তাকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে তারা তার কোন ক্ষতি করবে না কিন্তু তাতেও রাজকন্যার মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটা বেরোলো না; রাজকন্যা দেখতে ছিল অপরুপ আর তার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রাজার সৈন্যদের খুব মায়া হল তাই তাকে তারা ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে এল রাজার দরবারে; রাজা তাকে দেখেই অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল তার সর্ম্পকে কিন্তু সব প্রশ্নেতেই রাজকন্যাকে চুপ থাকতে দেখে রাজার ও ভীষন মায়া হল আর রাজা ঠিক করলেন মেয়েটাকে তারই কাছে রাখবেন; এদিকে রাজকন্যাকে দেখতেও ছিল খুব সুন্দর আর রাজপুরীর সুন্দর সুন্দর সাজগোজে তাকে দেখতে আরও সুন্দর হয়ে উঠল; রাজা ঠিক করলেই এমন মেয়েই রাজরানী হওয়ার যোগ্য; আর যেমন ভাবা তেমনি কাজ; রাজা সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন কিছু দিন পরেই।
এদিকে, রাজার মা ছিল ভীষন চালাক আর বদমাশ, সে কিছুতেই রাজার এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিল না তাই রাজকন্যাকে উঠতে বসতে রাজার মা খারাপ কথা বলতো আর ঝগড়া করতো; কিন্তু রাজকন্যা মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারন করত না শুধু এক মনে তার দাদাদের জন্য ঘাসের জামা বানাতো। কিছুদিন পর রাজকন্যা তার প্রথম সন্তানের জন্ম দিল; রাজার মা যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, সে সদ্য জন্মানো রাজপুত্রের মুখে খানিকটা লাল রং লাগিয়ে রাজার কাছে নালিশ করল রানী নাকি ডাইনী , তার ছেলেকে সে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু রাজা কিছুতেই সে কথা বিশ্বাস করলেন না কারন রানীকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। রানীরও তো মুখে রা নেই- এক মনে সে জামা সেলাই করে যাচ্ছে সাদা ঘাস দিয়ে।
আরও কিছুদিন পর রানি দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিলে রাজার দুষ্টু মা আবার একই কান্ড ঘটালো, কিন্তু এবারেও রাজা কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না কারন রাজকন্যা কোন উত্তর না দিলেও রাজা জানতেন তার রানী এতটাই সহজ সরল যে সে এ কাজ করতে পারে না।
কিন্তু তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর রাজার মা রানীর কাছ থেকে তার ছেলেকে চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন আর রাজাকে এসে বললেন রানি তার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন; রাজা অন্দরমহল থেকে রানী কে ডেকে পাঠালেন সবিস্তার ঘটনা জানার জন্য; কিন্তু রানি তো তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কথা বলতে পারবেনা তাই মুখ থেকে একটাও শব্দ উচ্চারন করল না রানী। আর রাজা এবার পুত্রশোকে রেগে গিয়ে রানীকে দোষী সাব্যস্ত করলেন আর তার শাস্তি স্বরুপ আগুনে মৃত্যুদণ্ড ঘোষনা করলেন। মৃত্যুদণ্ডের দিনও ঘোষনা করা হল। রাজার মা তো ভীষন খুশি।
দেখতে দেখতে মৃত্যুদণ্ডের দিন হাজির। আর সে দিনই আসলে সেই ছ বছর ধরে কোন কথা না বলে এতটুকু না হেসে রাজকন্যার সাদা ঘাসের জামা বানানো্র শেষ দিনও ছিল। ছটা জামাও তার বানানো হয়ে গিয়েছিল। তাই যখন রাজকন্যাকে রাজার আদেশঅনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের জন্য ওপরে আনা হল, তখন তার হাতে করে সে ওই ছটা জামাও নিয়ে এসেছিল আর সারাক্ষন আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল কখন সেই ছটা রাজহাঁস উড়ে আসে; এদিকে ঠিক যখন রাজার আদেশ অনুযায়ী নিচে আগুন ধরানো হবে ওমনি সেই ছটা রাজহাঁস উড়ে এসে রাজকন্যার কাঁধে রাখা জামার কাছে এসে তাদের ডানার পালক ঘসলো আর সাথে সাথেই তাদের সব পালক খসে গিয়ে রাজহাঁসের ভেতর থেকে সুন্দর ছ ছটা রাজপুত্র বেরিয়ে এল; রাজা তো এসব দেখে অবাক; রাজার হুকুমে রাজকন্যাকে নিচে নামিয়ে আনা হল আর তারপর সে নিজে সমস্ত কথা রাজাকে খুলে বলল কারন এখন আর তার কথা না বলে থাকার কোন বিধিনিষেধ নেই; কিভাবে রাজার দুষ্টু মা তার তিন ছেলেকে লুকিয়ে রেখে তার নামে মিথ্যে দোষ দিয়েছে সে কথাও সে রাজাকে জানালো; সব শুনে আর রানীর ছয় ভাইকে কাছে পেয়ে রাজা ভীষন খুশি হল। সাথে সাথে রাজা তার মায়ের শাস্তিও দিল আর রাজার আদেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হল।
একদিকে রাজার আদেশে রাজার মায়ের শাস্তিও হল আবার অন্যদিকে রাজকন্যার দাদাদের ওপর থেকে সেই জাদুর মায়াও কেটে গেল। তারা আবার ফিরে পেল তাদের আগের চেহারা। আর তার সাথেই শেষ হল তাদের দুঃখের জীবন ; এর পর থেকে সেই রাজা রানী আর তার ছয় ভাই ওই রাজ্যে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে লাগল।
অনুবাদঃ
রমিত দে
কলকাতা