ছয় রাজহাঁসের গল্প
অনেকদিন আগে ছিল এক রাজা। একবার ঘোড়ায় চেপে শিকার করতে করতে মাঠ পেরিয়ে বন পেরিয়ে গাছগাছালির ছায়া পেরিয়ে রাজা চলে গেল অনেক দূর, এতদূর যে রাজার খেয়ালই নেই কখন তিনি তার সাথে তার যে সব রাজভৃত্যরা শিকারে এসেছিল তাদের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছেন। সন্ধ্যে নামতেই রাজার খেয়াল হল আসলে গভীর জঙ্গলে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে। তিনি জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলেন তার ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে কিন্তু কারুরই সাড়া পাওয়া গেলনা। এমন সময়ই সামনে থেকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে এক বয়স্ক মহিলাকে আসতে দেখলেন রাজা, সে আসলে ছিল ডাইনী। ডাইনীকে দেখেই রাজা জিজ্ঞেস করলো সে তাকে বন থেকে বেরোবার পথ দেখাতে পারবে কিনা। ডাইনী তো মাথা নেড়েই চলেছে, মাথা নাড়তে নাড়তেই সে রাজাকে বলল, বন থেকে বেরোতে সে সাহায্য করতে পারে কিন্তু তার একটা শর্ত আছে, আর রাজা যদি সেই শর্ত পূরন করতে না পারে তাহলে সারাজীবন এই গভীর বন থেকে তিনি বেরোতে পারবেন না আর খিদে তেষ্টায় এখানেই মারা যাবেন।
কি শর্ত? রাজা ডাইনীকে জিজ্ঞেস করলেন।
মাথা নাড়তে নাড়তে ডাইনী বলল, আমার এক সুন্দর মেয়ে আছে, সে অপরূপ সুন্দরী আর তোমার সঙ্গী হিসেবেই তাকে মানাবে। যদি তুমি তাকে বিয়ে করে তোমার রানি করে নিয়ে যাও তবেই আমি এই বন থেকে বেরোবার পথ তোমাকে দেখিয়ে দেব। ডাইনীর মেয়েকে রানী বানাবার প্রস্তাব মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও খানিকটা ভয়ে ভয়েই আর ওই গভীর জঙ্গলের থেকে বেরোবার কোন উপায় না পেয়ে রাজা তার সম্মতি দিলেন ডাইনীকে। ডাইনী রাজাকে নিয়ে বনের ভেতর তার ছোট্ট ঘরে নিয়ে এল, যেখানে তার মেয়ে আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরম করছিল। ডাইনীর মেয়ে যেন রাজার জন্যই অপেক্ষা করছিল, রাজা আসতেই তাকে সাদরে ঘরের ভেতর নিয়ে এসে তার সেবাযত্ন করল ডাইনীর মেয়ে। রাজা তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন যে সে সত্যিই অপরুপ সুন্দরী, কিন্তু তবুও রাজার মন থেকে ডাইনীর যাদুবিদ্যার ভয় কিছুতেই যেন কাটছিল না, কোন এক গোপন ভয়ের কথা চিন্তা করতে করতে তার বুক কেঁপে উঠছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাজা ডাইনীর মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ায় উঠলো, আর ডাইনীও তাকে বন থেকে বাইরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল। নিজের রাজ্যে ফিরে এসে ডাইনীর শর্ত অনুযায়ী রাজার সাথে ডাইনীর মেয়ের ধূমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল।
এদিকে হয়েছে আর এক বিপদ। রাজার প্রথম পক্ষের বউ এর ছয় ছেলে আর এক মেয়ে ছিল, আর প্রথম বউএর মৃত্যুর পর থেকেই রাজা তাদের নিজের প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসত ; এতটাই ভালোবাসত যে ডাইনীর মেয়েকে বিয়ে করে আনার পর থেকেই রাজার মনে এক দুশ্চিন্তা সবসময় কাজ করতে লাগল যে, হয়ত তাদের সৎমা তাদের অনিষ্ট করবে, তাদের ওপর অত্যাচার করবে; আর এই সব ভেবেই রাজা তার সাত ছেলে মেয়েকে বনের গভীরে লোকচক্ষুর আড়ালে এক দুর্গম দুর্গের মধ্যে রেখে দিয়ে এলেন। সে দুর্গ এমনই দুর্গম যে তিনি নিজেও তার পথ ভুলে যেতেন। একজন ভালো জাদুকর তাকে একটা জাদুবল দিয়েছিল সেই দুর্গের পথ মনে রাখার জন্য। যখনই রাজার তার সাত ছেলেমেয়েকে দেখতে যাওয়ার জন্য দুর্গে যেতে ইচ্ছে করত তখনই ওই জাদুবল কে তিনি তার সামনে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিতেন আর সেই বল তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত বনের ভেতর লুকিয়ে রাখা দুর্গের কাছে।
নতুন রানী, মানে ডাইনীর মেয়েও যে রাজার এই বারবার একা বনে চলে যাওয়াটা খেয়াল করেনি তা কিন্ত নয়। আর যথারীতি এ ব্যাপারে তার জানার ইচ্ছেটাও বেড়ে গেছে দিন দিন। রাজার প্রিয় চাকর বাকরদের প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে রাজা যে সেই দুর্গে যায় তার ছেলেমেয়েদের দেখতে আর সেই দুর্গে যাওয়ার রাস্তা জানার একটাই উপায় ওই জাদু বল- সে সব সর্ম্পকেই ডাইনীর মেয়ে ইতিমধ্যেই খবরও নিয়ে নিয়েছে। ডাইনীর মেয়ে তার মায়ের কাছ থেকে কিছু কিছু যাদুবিদ্যা শিখেছিল আর তা দিয়েই সে বানিয়ে ফেললো একটা সাদা রঙের যাদু কাপড়ের টুকরো যার মধ্যে জাদুমন্ত্র দিলেই সে রাজার রুপ ধারন করতে পারত।তারপর একদিন রাজা বনে শিকারে গেলে সেই সুযোগে সে ওই সাদা কাপড়ের টুকরো গায়ে জড়িয়ে ঘোড়ায় করে চলল সেই গোপন দুর্গের দিকে; ইতিমধ্যেই রাজা কোথায় সে জাদুবল রেখে যায় তার হদিশ সে পেয়ে গেছিল তাই বল গড়িয়ে দিতেই বনের ভেতর দিয়ে গোপন দুর্গের দিকে সেই বল ডাইনীর মেয়েকে নিয়ে চলল।
দূর থেকে ঘোড়ায় করে তাদের বাবারই মত কাউকে আসতে দেখে রাজার ছয় ছেলে আনন্দে দৌড়তে দৌড়তে দুর্গ দিয়ে বেরিয়ে এল; বেরিয়ে আসতেই ডাইনীর মেয়ে তাদের ওপর জাদু কাপড় ছুঁড়ে দিতেই তারা ছয় ভাই ছখানা রাজহাঁস হয়ে বনের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। ডাইনীর মেয়েও খুব আনন্দে রাজবাড়ীতে ফিরে এল; তার মনে এখন খুব আনন্দ এই ভেবে যে তার সৎ ছেলেমেয়েরা আর কেউ নেই তাকে বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু রানী জানতও না যে রাজার সাত ছেলে মেয়ের মধ্যে ছয় ছেলে দৌড়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু তাদের ছোট বোন তখনও দুর্গের মধ্যেই ছিল; রাজার আগের পক্ষের সব ছেলে মেয়েদের রাজহাঁস বানিয়ে উড়িয়ে এসেছে ভেবে রানী মনে মনে খুব খুশী হতে লাগল।
পরেরদিন রাজা সেই বনের ভেতর দিয়ে দুর্গে এসে পৌঁছোলেন তার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে দেখার জন্য। এসেই তো রাজা হতবাক! তার সাত ছেলে মেয়ের মধ্যে শুধু ছোট মেয়ে রয়েছে দুর্গের মধ্যে। ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করায় সে তার বাবাকে সবিস্তারে জানাল তার ভাইয়েরা কেমন করে রাজহাঁস হয়ে উড়ে গেছে গভীর বনের দিকে; জানলা দিয়ে সে দেখেছে তার ভাইদের রাজহাঁস হয়ে উড়ে যাওয়া; এমনকি রাজহাঁস হয়ে উড়ে যাওয়ার আগে তাদের ডানা থেকে খসে যাওয়া পালকও সে কুড়িয়ে রেখেছে রাজাকে দেখাবে বলে।
পালক হাতে নিয়েই রাজা পুরো ঘটনার সত্যতা বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে দুর্গের সামনের চাতালে বসে পড়লেন আর ভাবতে লাগলেন তার একমাত্র মেয়ের কথা। রাজার চিন্তায় তখনও আসেনি যে রানীই তার ছয় ছেলেকে রাজহাঁস বানিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, তার একমাত্র মেয়েকে বাঁচানোর।তিনি ভাবতে লাগলেন যে এই দুর্গ আর কোনমতেই সুরক্ষিত নয় তার মেয়ের পক্ষে আর দুর্গ থেকে তিনি তার একমাত্র মেয়েকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু, পরক্ষনেই মনে হতে লাগল যদি সৎমা তার মেয়েকে ভালো মনে মেনে না নিতে পারে তবে কি হবে! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাজা ঠিক করলেন তার মেয়েকে আর এক রাত্রির জন্য এই দুর্গে রাখবেন তারপর কালকের মধ্যেই কিছু না কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেবেন মেয়েকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার। এসব ভেবে তার মেয়েকে সে রাতের মত দুর্গে রেখে রাজা ফিরে এলেন একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে।
এদিকে, রাত হলে দুর্গের মধ্যে একা থাকতে থাকতে ছোট মেয়েটার ভীষন ভয় করতে লাগল। তার মনে হতে লাগল ভাইদের ছাড়া সে থাকতে পারবে না এক মূর্হুতও, আর যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, সে রাতেই সে একছুট্টে বনের দিকে বেরিয়ে গেল যেদিকে তার ভাইয়েরা রাজহাঁস হয়ে উড়ে গেছে। সারা রাত ধরে এতটুকু না থেমে ছোট মেয়েটা হাঁটতে থাকল বন পেরিয়ে বড় বড় গাছ পেরিয়ে, এমনকি তার পরেরদিন সারা সকাল ধরেও সে হাঁটতে লাগল বনের ভেতর দিয়ে, যতক্ষন না সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যে নামার খানিক আগেই বনের ভেতর সে একটা পোড়ো বাড়ি দেখতে পেল। চুপিসারে বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই তার চোখে পড়ল ঘরের ভেতর ছটা ছোট ছোট খাট পাতা। এতখানি পথ পেরিয়ে এসে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রাজার ছোট মেয়ে যে সে ঐ খাটের ওপরই রাতটা কাটিয়ে দেবার কথা ভাবল কিন্তু কিছুতেই সে খাটের ওপর উঠতে পারল না। শেষমেশ খাটের তলাতেই সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল; সন্ধ্যে নামার একটু আগেই ডানার ঝটপট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার; চোখ খুলতেই সে দেখল ছটা রাজহাঁস কোথা থেকে উড়ে এসে জানলার ধারে বসে একে অন্যের ডানার পালক খুঁটে দিচ্ছে, আর কিচ্ছুক্ষন পরেই তাদের সব ডানা খুলে পড়ে যেতেই ছোট মেয়ে অবাক হয়ে গেল রাজহাঁসের জায়গায় তার ছয় ভাইকে দেখে; ররাজার মেয়ে তো তখন যারপরনাই খুশী তার হারিয়ে যাওয়া ভাইয়েদের পেয়ে; ভাইয়েরাও তাদের একমাত্র বোনকে দেখতে পেয়ে ভীষন খুশী কিন্তু পরক্ষনেই তাদের মন দুঃখে ভরে গেল। তাদের একমাত্র বোনের কথা ভেবে চোখ জলে ভরে এল; তারা তাদের বোন কে বোঝালো যে এই পোড়ো বাড়িটা আসলে একটা ডাকাতদের আড্ডা আর তাই রাত হলেই ডাকাতরা সব চলে এলে তাদের ছোট বোন কে দেখলেই তারা তাকে মেরে দেবে। বোন তো ছোট, সে কি এত বোঝে! সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না যখন তার ছ ছটা ভাই তার সাথেই রয়েছে তাহলে ডাকাতদের ভয় পাওয়ার কি আছে! আসলে তাদের সৎমা মানে সেই ডাইনীর মেয়ের দেওয়া যাদুমন্ত্রে তার ছয় দাদারা সারাদিন রাজহাঁস হয়ে উড়ে উড়ে বেড়াত আর কেবল সন্ধ্যের ওই আধ ঘন্টাই তাদের ডানার পালক খসিয়ে মানুষ হতে পারত;
পুরো ঘটনা জেনে ছোট মেয়েটা কেঁদে উঠল, সে তার দাদাদের বলল তোমরা কি রানীর দেওয়া এই যাদুমন্ত্র থেকে মুক্ত হতে পারোনা?
তখন তার দাদারা বলল, সে ভারি শক্ত উপায়; রাজহাঁস থেকে মুক্ত করার একটাই উপায় আর তা হল ছ বছর ধরে তাদের ছোট বোন কোন কথা বলতে পারবেনা আর হাসতেও পারবে না আর এই ছ বছরে তাদের জন্য সাদা ঘাসের ছটা ছোট ছোট জামা তাকে বানাতে হবে ; জামা বানাতে বানাতে এই ছ বছরের মধ্যে যদি একটাও কথা সে বলে ফেলে কিমবা হেসে ফেলে একটুও তাহলে আবার শুরুর থেকে তাকে জামা বানাতে হবে; এই বলতে বলতে সন্ধ্যের সেই আধ ঘন্টা ফুরিয়ে গেল আর দাদারাও আবার রাজহাঁস হয়ে ওই পোড়ো বাড়ি থেকে উড়ে বনের দিকে ফিরে গেল।
সেই থেকে ছোট বোনও মনকে শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করল যে করেই হোক তার নিজের প্রানের বিনিময়েও সে তার দাদাদের উদ্ধার করবে আর এই ভাবতে ভাবতে সেও ওই পোড়ো বাড়ি ছেড়ে বনের দিকে ফিরে গেল; যেতে যেতে যেতে অনেক দূরে একটা বড় গাছের নিচে এসে সে বসে পড়ল আর অনেক সাদা ঘাস এরমধ্যেই সে জোগাড় করেছে বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে; সেই ঘাস দিয়ে সে একমনে জামা বানাতে লাগল; ঠিক করল মুখে একটাও শব্দ করবে না আর হাসবেও না ছ বছরের জন্য যতক্ষন না দাদাদের জন্য সে ঘাসের জামা তৈরী করতে পারছে।
সেই গাছের নিচে বসে ঘাসের জামা বানাতে বানাতে রাজকন্যার অনেক দিন কেটে গেল; এরমধ্যে রাজকন্যা আরও বড় হয়ে গেছে, দেখতেও ভারী সুন্দর হয়ে গেছে। এমনই সময় একদিন পাশের রাজ্যের রাজা শিকারে এলেন সেই বনে; তার দলবল শিকার করতে করতে সেই গাছের কাছে এসে পৌঁছলো আর সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখতে পেয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করল; কিন্তু রাজকন্যা দাদাদের জন্য জামা সেলাই শেষ না করে কথা বলতে পারবেনা তাই শুধু মাথা নাড়লো; কিন্তু তাতে কিছুই বুঝতে না পেরে রাজার দলবল তার সর্ম্পকে আরও জানতে ইচ্ছুক হল; তারা আবার তাকে জিজ্ঞেস করল সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে । কিন্তু রাজকন্যা একটাও শব্দ করল না। তখন রাজার দলবল তাকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে তারা তার কোন ক্ষতি করবে না কিন্তু তাতেও রাজকন্যার মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটা বেরোলো না; রাজকন্যা দেখতে ছিল অপরুপ আর তার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রাজার সৈন্যদের খুব মায়া হল তাই তাকে তারা ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে এল রাজার দরবারে; রাজা তাকে দেখেই অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল তার সর্ম্পকে কিন্তু সব প্রশ্নেতেই রাজকন্যাকে চুপ থাকতে দেখে রাজার ও ভীষন মায়া হল আর রাজা ঠিক করলেন মেয়েটাকে তারই কাছে রাখবেন; এদিকে রাজকন্যাকে দেখতেও ছিল খুব সুন্দর আর রাজপুরীর সুন্দর সুন্দর সাজগোজে তাকে দেখতে আরও সুন্দর হয়ে উঠল; রাজা ঠিক করলেই এমন মেয়েই রাজরানী হওয়ার যোগ্য; আর যেমন ভাবা তেমনি কাজ; রাজা সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন কিছু দিন পরেই।
এদিকে, রাজার মা ছিল ভীষন চালাক আর বদমাশ, সে কিছুতেই রাজার এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিল না তাই রাজকন্যাকে উঠতে বসতে রাজার মা খারাপ কথা বলতো আর ঝগড়া করতো; কিন্তু রাজকন্যা মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারন করত না শুধু এক মনে তার দাদাদের জন্য ঘাসের জামা বানাতো। কিছুদিন পর রাজকন্যা তার প্রথম সন্তানের জন্ম দিল; রাজার মা যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, সে সদ্য জন্মানো রাজপুত্রের মুখে খানিকটা লাল রং লাগিয়ে রাজার কাছে নালিশ করল রানী নাকি ডাইনী , তার ছেলেকে সে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু রাজা কিছুতেই সে কথা বিশ্বাস করলেন না কারন রানীকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। রানীরও তো মুখে রা নেই- এক মনে সে জামা সেলাই করে যাচ্ছে সাদা ঘাস দিয়ে।
আরও কিছুদিন পর রানি দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিলে রাজার দুষ্টু মা আবার একই কান্ড ঘটালো, কিন্তু এবারেও রাজা কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না কারন রাজকন্যা কোন উত্তর না দিলেও রাজা জানতেন তার রানী এতটাই সহজ সরল যে সে এ কাজ করতে পারে না।
কিন্তু তৃতীয় সন্তানের জন্মের পর রাজার মা রানীর কাছ থেকে তার ছেলেকে চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন আর রাজাকে এসে বললেন রানি তার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন; রাজা অন্দরমহল থেকে রানী কে ডেকে পাঠালেন সবিস্তার ঘটনা জানার জন্য; কিন্তু রানি তো তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কথা বলতে পারবেনা তাই মুখ থেকে একটাও শব্দ উচ্চারন করল না রানী। আর রাজা এবার পুত্রশোকে রেগে গিয়ে রানীকে দোষী সাব্যস্ত করলেন আর তার শাস্তি স্বরুপ আগুনে মৃত্যুদণ্ড ঘোষনা করলেন। মৃত্যুদণ্ডের দিনও ঘোষনা করা হল। রাজার মা তো ভীষন খুশি।
দেখতে দেখতে মৃত্যুদণ্ডের দিন হাজির। আর সে দিনই আসলে সেই ছ বছর ধরে কোন কথা না বলে এতটুকু না হেসে রাজকন্যার সাদা ঘাসের জামা বানানো্র শেষ দিনও ছিল। ছটা জামাও তার বানানো হয়ে গিয়েছিল। তাই যখন রাজকন্যাকে রাজার আদেশঅনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের জন্য ওপরে আনা হল, তখন তার হাতে করে সে ওই ছটা জামাও নিয়ে এসেছিল আর সারাক্ষন আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল কখন সেই ছটা রাজহাঁস উড়ে আসে; এদিকে ঠিক যখন রাজার আদেশ অনুযায়ী নিচে আগুন ধরানো হবে ওমনি সেই ছটা রাজহাঁস উড়ে এসে রাজকন্যার কাঁধে রাখা জামার কাছে এসে তাদের ডানার পালক ঘসলো আর সাথে সাথেই তাদের সব পালক খসে গিয়ে রাজহাঁসের ভেতর থেকে সুন্দর ছ ছটা রাজপুত্র বেরিয়ে এল; রাজা তো এসব দেখে অবাক; রাজার হুকুমে রাজকন্যাকে নিচে নামিয়ে আনা হল আর তারপর সে নিজে সমস্ত কথা রাজাকে খুলে বলল কারন এখন আর তার কথা না বলে থাকার কোন বিধিনিষেধ নেই; কিভাবে রাজার দুষ্টু মা তার তিন ছেলেকে লুকিয়ে রেখে তার নামে মিথ্যে দোষ দিয়েছে সে কথাও সে রাজাকে জানালো; সব শুনে আর রানীর ছয় ভাইকে কাছে পেয়ে রাজা ভীষন খুশি হল। সাথে সাথে রাজা তার মায়ের শাস্তিও দিল আর রাজার আদেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হল।
একদিকে রাজার আদেশে রাজার মায়ের শাস্তিও হল আবার অন্যদিকে রাজকন্যার দাদাদের ওপর থেকে সেই জাদুর মায়াও কেটে গেল। তারা আবার ফিরে পেল তাদের আগের চেহারা। আর তার সাথেই শেষ হল তাদের দুঃখের জীবন ; এর পর থেকে সেই রাজা রানী আর তার ছয় ভাই ওই রাজ্যে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে লাগল।
অনুবাদঃ
রমিত দে
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রমিত দে
- ক্যাটfগরি: বিদেশী রূপকথা