খেলাঘরখেলাঘর

সোনালি ঢেউয়ের দেশে
 এবারে আমরা এমন একটা জায়গায় যাবো - যেখানে গেলে মনটা ভালো হয়ে যাবে। শহর থেকে, লোক জনের থেকে অনেক দূরে - যেখানে গাড়ির আওয়াজ নেই, ধোঁয়াও নেই। মাইলের পর মাইল শুধু গাছ, বালি আর পাথর। জায়গাটায় যেতে গেলে হেঁটে যেতে হয়। চার মাইল যাওয়া আর চার মাইল ফিরে আসা- মোট আট মাইল হাঁটতে হবে। শুনে ভয় পেয়ে গেলে নাকি?জায়গাটা অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য আদর্শ। হাতে ম্যাপ, কাঁধে ব্যাগ আর জলের বোতল নিয়ে সাহস করে বেরিয়ে পড়তে হবে।

জায়গাটাড় ছবি দেখো। আমি এর আগে কখনও এরকম কোন জায়গা দেখিনি। ওপরে নীল আকাশ আর নিচে সোনালি পাথরের ঢেউ। হটাৎ দেখলে মনে হবে যেন পৃথিবীর বাইরের কোন অন্য জায়গায় এসে পড়েছি। ভূ-বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে বলেছেন যে জায়গাটা ১৯০ মিলিয়ন বা ১৯ কোটি বছরের পুরোনো। একদিন এখানে ডাইনোসর চড়ে বেড়াতো। জায়গাটা ছিলো আদতে বালিয়াড়ী (sand dunes)। তারপর একসময়ে হটাৎ, যেন ম্যাজিকের মতো, বালিয়াড়ী জমে পাথর হয়ে গেলো - হয়তো বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য। জায়গাটার নাম ওয়েভ (Wave)। বাংলা করলে দাঁড়ায় ঢেউ। জায়গাটা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা আর উটাহা প্রদেশের সীমানায়।
সোনালি ঢেউ
 ওয়েভ ফটোগ্রাফারদের কাছে খুব জনপ্রিয়। যারা যায় তারা চোখ ভরে দেখতে আর ছবি তুলতে যায়। এই জায়গাটার ছবি প্রথম বেরোয় জার্মানীর একটা পত্রিকায়। তারপর থেকে ভিড় লেগেই আছে। জায়গাটা বালিপাথর বা স্যান্ডস্টোন এ তৈরি। এই পাথর সহজেই ক্ষয়ে যায় মানুষের পায়ের চাপ লেগে।অ্যারিজোণা সরকার তাই ওয়েভ এ যেতে একদিনে কুড়ি জনের বেশি পর্যটক কে অনুমতি দেয়না । আগে থেকে অনুমতিস জন্য আবেদন করতে হয়। কুড়িজনের বেশি লোক হলেই লটারিতে ঠিক হয় কে যেতে পারবে। তাই আমি আর পিউ ও একদিন সকালে অনুমতি পত্রের জন্য হাজির হলাম অ্যারিজোনার ব্যুরো অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (Bureau of Land Management)  এর অফিসে। ওখানেই লটারি হবে আর ঠিক হবে কারা কারা যেতে পারবে, আর কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো না। একটা মজার ঘটনা ঘটলো আর আমি আর পিউ অনুমতি পেয়ে গেলাম। মজার ঘটনাটা বলি।

আমাদের সাথে আরো চোদ্দো জন অপেক্ষা করছে। বুক দুরু দুরু করছে, চিন্তা হচ্ছে যে দশ জনের মধ্যে নাম উঠবে কিনা! ছয় জন হতাশ হয়ে ফিরে যাবে আজ। লটারি হয় বিঙ্গো মেশিনে। মেশিনের ষোলোটা বল আছে, যার ওপরে সংখ্যা লেখা আছে। একজন অফিসার বন বন করে মেশিনটা ঘোড়াতে শুরু করলো। এবার অপেক্ষা কোন সংখ্যাটা ছিটকে বেরিয়ে আসবে !আমাদের সংখ্যা ছয়। বিঙ্গো ঘুরেই চলেছে, কোন সংখ্যা বেরোনোর লক্ষণই নেই। হটাৎ একটা বোল ছিটকে এলো - তার সংখ্যা তিন - চারজনের একটা দল সুযোগ পেয়ে গেলো। তারপর একটা দুইজনের দল। আমাদের বুক ধড়ফড় করছে। আমি প্রাণপণে ঠাকুরের নাম করছি। পরে পিউ আমাকে বললো যে পিউও জোরে জোরে ঠাকুর নাম করছিলো। নাম না উঠলে এতদূর আসা ব্যর্থ হবে। বিঙ্গো মেশিনের চাকা ঘুরেই চলেছে। হটাৎ একটা ঘটনা ঘটলো যার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। একটা বল ঠকাস করে লাফিয়ে ছিটকে বাইরে পড়ে গেলো। যে গর্তটা দিয়ে বেরোয় সেখান দিয়ে নয় কিন্তু, অন্য কোন একটা জায়গা দিয়ে। পিউ আমার হাত চেপে ধরে আছে। উত্তেজনায় এতো জোরে চেপে ধরেছে যে রীতিমত লাগছে। কেউ একজন মেঝে থেকে বলটা কুড়িয়ে দিলো। ঘোষক বলের সংখ্যা দেখে ঘোষণা করলেন- ছয়! ছয়!-আরে, সেটা তো আমাদের সংখ্যা। আমার বুকটা একবার জোরে ধক করে উঠলো। আ-হা-হা-হা! কি আনন্দ! আমি আর পিউ শেষ পর্যন্ত ওয়েভ দেখতে যাচ্ছি। বাকি সময় গেলো পারমিট, ম্যাপ, এসব নিতে। সবকিছু করতে করতে বেলা দুপুর হলো। আমরা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে গেলাম। আগামিকালের জন্য তৈরি হতে হবে। বিশেষতঃ, রাস্তায় জল নেই, তাই আমাদের অবশ্যই অনেক জল নিয়ে যেতে হবে।

জায়গাটায় যাওয়ার জন্য কোন রাস্তা করা নেই। ম্যাপ, কম্পাস এবং/অথবা জি পি এস আবশ্যক। তবে আমাদের আগে এতো লোক গেছে যে বালির ওপর পায়ের ছাপে ভরা। কিছু কিছু জায়গায় মসৃণ  পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। সেইসব জায়গাগুলিতে ম্যাপ  আবশ্যক। এই পাথর এতো মসৃণ যে পা ফস্কে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সব সময়। এই পাথরগুলোকে বলে স্লিকরক (slick rock)। তাই এই জায়গায় চলার জন্য এমন জুতোর দরকার যেটা সহজে পিছলে যাবে না। আর যেসব জায়গায় পায়ের ছাপ নেই, সেখানে ম্যাপই ভরসা। আর তার সাথে সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।সমসময় খেয়াল রাখতে হবে ল্যান্ডমার্ক গুলির দিকে। আমাদের ল্যান্ডমার্ক ছিলো দুটো জিনিষ - টুইন বাট (Twin Butte) আর নচ(Notch)।
টুইন বাট
টুইন বাট
  নচএর ঠিক নিচেই আছে ওয়েভ। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর নচ দেখতে পাওয়া যায়। আমরা ওই নচ বরাবর চললাম।
 নচ 
নচ
আমরা প্রায় তিন ঘন্টা ধরে হাঁটছি। রাস্তায় আর কাউকে দেখতে পাইনি। সূর্য আসতে আসতে ওপরে উঠছে। সকাল সাড়ে ন'টা বাজে। এমন সময় রাস্তায় দেখতে পেলাম এক ডেসার্ট লিজার্ড কে।
ডেসার্ট লিজার্ড
ডেসার্ট লিজার্ড
 আমাদের পেছন দিকে দেখলে মনে হবে পাহাড়ে মাছের কাঁটা সাজানো আছে। এগুলো একসময়ে জলের তলায় ছিলো। জলের তলায় পলি জমে জমে একসময়ে পাথর হয়ে গেছে। এই পাথরগুলিকে দেখলে মনে হয় পেঁয়াজের খোসার মতো জমে আছে। এই পাথরগুলি হলো স্যান্ডস্টোন। ভূ-বিজ্ঞানীরা এই পাথরগুলিকে দেখে বলতে পারেন যে সময়ে এই পাথর তৈরি হয়েছে, সেই সময়ে জলের স্রোত কোনদিকে ছিলো, হাওয়া কত জোরে বইতো।
 
মাছের কাঁটা
মাছের কাঁটার মত পাথর
এতক্ষণে আমরা ওয়েভ এর কাছাকাছি এসে গেছি। সামনে ডান দিকে বাঁক নিয়ে কুড়ি ফুট মতো উঠতে হবে। কুড়ি ফুট চড়তেই সামনে অসাধারণ দৃশ্য! আমরা এসে গেছি ওয়েভ এ। গিয়ে দেখতে পেলাম আরো অনেকে আমাদের আগে এসে গেছে আর ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছে। নিচের ছবিতে একজন ভাবছে কিভাবে ছবি তুললে ভালো লাগবে।
 
ভাবছে
 এই যে ব্যান্ডগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলি হাজার হাজার বছর ধরে পলি জমে পরে তৈরি হয়েছে।জলে লোহার পরিমাণের ওপর নির্ভহর করে পাথরের রঙ হয়। কাছের থেকে ব্যান্ড গুলো এইরকম দেখায়।
ব্যান্ড
অনেক সময়ে পলি বিভিন্ন আকারে জমা হতে পারে। এই জায়গায় পলি জমে ঠিক যেন এক আইসক্রিমের কোন তৈরি হয়েছে।
আইস ক্রিম
এছাড়া আছে যেগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে। অন্য দিকে গেলে দেখা যাবে স্যান্ডস্টোন জমে যাওয়ার পর আর কি কি ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছে এই জায়াগায়।
নিচের ছবিটায় z - আকারটা দেখো। খেয়াল করলে দেখবে আকারটা ফাটা ফাটা।
 জেড-শেপ
 বা এই ছবিটা- ভাবতে অবাক লাগে কি কি রকমের ভৌগোলিক পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে এই জায়গাটায়।
জিগজ্যাগ
 এইরকম জায়গায় কিছুক্ষণ থাকলে মনে হবে প্রকৃতি কত বড়ো শিল্পী - এ যেন এক বিশাল শিল্পকর্ম, যা প্রকৃতি চুপচাপ বানিয়ে রেখেছিলেন আমরা দেখবো বলে।

বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চললো। আমাদের সামনে আবার তিন-চার ঘন্টা হাঁটা আছে। দিন থাকতে থাকতে ফিরতে হবে। আমাদের উঠতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ফিরতে হবে। এখানে রাস্তায় আলো নেই। রাস্তা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। বেরিয়ে আসার আগে শেষ একটা ছবি তুলে নিলাম।
মজা শেষ
দেখে ঠিক মনে হচ্ছে না, যে কমলা-সোনালি ঢেউয়ের ওপর ভেসে যাচ্ছি?
ব্যস, মজা শেষ। আবার হাঁটা শুরু।প্রায় তিন ঘন্টা পর আমরা এসে গেলাম গাড়ি রাখার জায়গায়। এই জায়গাটা মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে। আবার ইচ্ছে রইলো এখানে আসার। শুনেছি বরফ পড়লে জায়গাটা খুব সুন্দর লাগে। পরের বার ঠাণ্ডার সময়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এদিকে তো সেপ্টেম্বর পড়ে গেলো। অক্টোবর এ যাবো মনার্ক প্রজাপতিদের পরিযানের ছবি তুলতে। তোমাকে জানাবো প্রজাপতিদের ছবি তুলতে পারলাম কি না।
 
 
 
লেখা ও ছবিঃ
দেবাশীষ পাল
ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র