খেলাঘরখেলাঘর

 

‘এই ডোমটা তো ৭২০এ-মেইন আর আমার নম্বর হলো ৭২০এ-এম-৪৮৭৩৬-স্যাংপো - ঠিক কিনা বল?’ ‘ঠিক। ওই পৃথিবীর লোক তো আমাদের মত এত উন্নত ছিল না তাই ওদের শুধু নামই থাকতো আর প্রত্যেকটা দেশেরও আলাদা নাম ছিলো – যেমন ধর চিন, ভারতবর্ষ, অ্যামেরিকা, এই রকম। প্রত্যেক দেশের আবার ভাষাও ছিলো আলাদা এমন কি একটা দেশেই হয় তো কুড়ি পঁচিশটা ভাষা ফলে এই নিয়ে সব সময় গোলমাল লেগেই থাকতো। একুশ শো শতকের সেই সুজলা সুফলা পৃথিবী তো এখন শুধুই কল্পনা – তোরা তো ছবিতেই দেখেছিস সেই সুন্দর পৃথিবীকে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবীর বুকে খুব অত্যাচার করেছিলো – জঙ্গলের সমস্ত গাছ কেটে পরিষ্কার করে দিয়েছিলো, পরিবেশ সংরক্ষণের কথা কখনই ভাবে নি যার ফলে অবাধে মানুষের তৈরি নানা রকমের বিষাক্ত গ্যাস বায়ু মন্ডলকে দূষিত করে আকাশে ওজোনের যে ঘেরাটোপ এই পৃথিবীকে রক্ষা করতো সূর্যের নানা রকম রশ্মী ও গরম থেকে সেটাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিতে থাকে ফলে গরম বাড়তে শুরু করলো সেই সাথে বৃষ্টিও ভীষণ কমে গেলো ফলে ধীরে ধীরে সেই চির সবুজ পৃথিবী হয়ে গেলো একেবারেই নেড়া – শুধু শুকনো মাটি আর পাথর – বৃষ্টির অভাবে নদীগুলোও গেলো শুকিয়ে। তার উপর গরমে সমস্ত উঁচু উঁচু পাহাড় আর দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের জল স্তরকে বাড়াতে লাগলো ফলে সমস্ত সমতল এলাকা ডুবে গেলো সমুদ্রের জলে। তখন সেই সব জায়গার লোকরা কোথায় যাবে? ওরা উঁচু এলাকাতে যাবার চেষ্টা করায় ওখানকার লোকের সাথে যুদ্ধ লেগে গেলো। ফলে বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে দেশে দেশে এই যুদ্ধ মহাযুদ্ধের আকার নিলো – এটাকে পৃথিবীর ইতিহাসে তৃতীয় মহাযুদ্ধ বলে। মহাযুদ্ধের সাথে মহামারি ও সমুদ্রের নোনা জলে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে খেতে না পেয়ে ধীরে ধীরে সেই পৃথিবীর প্রায় নব্বই ভাগ লোকই মরে গেলো। বাকিরা বাঁচার তাগিদে ভুলে গেলো নিজেদের আলাদা আলাদা ভাষা, ধর্ম, আচার ব্যবহার – বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে তৈরি হলো নতুন পৃথিবীর মানুষ – এদের ভাষা হলো আজকের আমাদের এই আন্তর্জাতিক ভাষা, একমাত্র পরিচয় হলো মানুষ এবং মানবিকতাই একমাত্র ধর্ম।’ ‘আচ্ছা বাবা, সমুদ্রের জল বেড়ে বেড়ে পৃথিবী তো ডুবে যেতে লাগলো তাহলে এই মানুষরা কোথায় থাকতো?’ ‘ওরাই তো আমাদের পূর্বপুরুষ রে – ওরা বানালো সমুদ্রের জলের নিচের এই ডোম গুলো। তুই তো জানিস এই সব ডোম শহরে যে বিশাল কম্পিউটার আছে সেই সামলায় সমস্ত রকম ঝক্কি ঝামেলা যেমন ধর ডোমের ভেতরের আবহাওয়া ঠিক রাখা, সমুদ্রের ঢেউ দিয়ে ভাসমান টার্বাইন চালিয়ে ও ভাসমান সোলার সেল দিয়ে সূর্যের আলো থেকে শহর চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করা, সমুদ্রের জল শোধন করে খাবার জল সবার বাড়িতে পৌছে দেওয়া, এই রকম হাজারো দৈনন্দিন কাজ। সব থেকে বড় প্রয়োজনীয় ব্যাপার হলো খাদ্য - সমুদ্রের বিশাল খাদ্য ভাণ্ডারকে ব্যবহার করতে আমরা শিখেছি এ ছাড়াও গড়ে তুলেছি আলাদা আলাদা ডোমে ধান, গম, শাক সব্জির চাষ – ওখান থেকেই আমাদের সবার খাবার আসে আর ওই সব ক্ষেত, কারখানার সাথে যোগাযোগ তো টানেলের ভেতর দিয়ে মনোরেলেই হয়। সমস্ত ডোম শহরেই এই রকম ব্যবস্থা আছে। আর এই সমস্ত ডোম শহরগুলোর মধ্যে যোগাযোগও টানেলের ভেতর দিয়ে খুব দ্রুত চলা ট্রেনে। তাছাড়া সমুদ্রের নিচের ধাতু তুলে এনে আমরা আমাদের দরকারের সমস্ত জিনিষই বানাই। তুই তো জানিস তোর মা শাক সবজি উৎপাদনের ওখানে কাজ করে আর আমি কাজ করি ওই ধাতু নিষ্কাশনের কারখানায়। তুই বড় হয়ে কি করবি সেটাও তো ওই বড় কম্পিউটার তোর জন্মের আগে থেকেই ঠিক করে দিয়েছে – তাই না?’ ‘হ্যাঁ বাবা, আমি বড় হয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের ওখানেই কাজ করবো। চল না একদিন মনোরেলে করে অন্য ডোম কারখানা গুলো দেখে আসি।’ ‘ঠিক আছে, আমি অনুমতি নিয়ে রাখবো আগামী রবিবার ওখানে যাবার। ওই দ্যাখ আমাদের ডোমের আকাশে সন্ধ্যে হয়ে এলো – আজ তো পূর্ণিমা তাই কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। এবার তো বাড়ির দিকে যেতে হবে।’ ‘জানো বাবা, পুরাতন পৃথিবীতেও এই রকম চাঁদ উঠতো আকাশে – আমরা সিনেমাতে দেখেছ।’ ‘তবে কি জানিস, পুরাতন পৃথিবীর চাঁদটাই হলো সত্যিকারের চাঁদ – চাঁদ তো পৃথিবীর উপগ্রহ। আমাদের ডোমের আকাশে কৃত্রিম উপায়ে সমস্ত কিছুই সেই পুরাতন পৃথিবীর মতই করা হয়েছে যাতে আমরা বুঝতে না পারি যে আমরা সমুদ্রের জলের অনেক নিচে আছি তাই তো আজ পূর্ণিমা বোঝাতে এই গোল চাঁদ উঠেছে ডোমের আকাশে।’