সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
রাজার চিঠি ও অমলদের গল্প

অমলকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো। সে রাজার চিঠির জন্য অপেক্ষা করত। এদিকে কবিরাজ তাকে ঘরের বাইরে বেরোতে বারণ করেছে। বন্দিদশায় অমলের কেবলই অপেক্ষা আর অপেক্ষা; কবে আসবে রাজার চিঠি। তারপর একদিন সে-চিঠি এল। যদিও অমল তা পড়তে পারে না। উৎসুক হয়ে ওঠে সে, কী লেখা আছে চিঠিতে জানার জন্য। ফকির, তার বন্ধু, তাকে বলে যে, রাজা লিখেছেন, তিনি স্বয়ং তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

হ্যাঁ, ঠিকই, আমি 'ডাকঘর'-এর অমলের কথা বলছি। এই অনুমানের জন্য কোনও পুরস্কার নেই। যদি তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'ডাকঘর' না পরে থাকো,তাহলে পড়ে দেখতে পারো।আসলে আমি অনেক অমলের গল্প তোমাকে শোনাতে চাইছি। তাই গোড়াতে এই ভূমিকাটুকু করে নেওয়া।

ধরে নাও, তাদের সবারই নাম অমল। একটি বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছে তাদের। না, তারা কোনও অপরাধ করেনি। যে-কারণে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল, তার জন্য তারা দায়ীও নয়। তবু বন্দি যারা করে, তারা এমনই নিষ্ঠুর আর অযৌক্তিক যে, অমলরা যে নির্দোষ, এ-যুক্তি তাদের কাছে টেকে না। এই অমলদের আটকে রাখা হয়েছিল, কারণ তারা ইহুদি। তাদের দেশ ছিল পোল্যান্ড। যে সময়ের কথা বলছি, তখন পোল্যান্ডকে কবজা করেছে কুখ্যাত হিটলার। হিটলার যে কেমন লোক ছিল, যারা জানো তারা তো জানোই। যারা জানো না, তাদের জন্য একটি মাত্র উদাহরণ দিই। ইহুদি হওয়ার কারণে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল এই পরাক্রান্ত রাষ্ট্রনায়ক। প্রথমে বন্দিশালায় আটকে রাখা হত মানুষগুলোকে। পরে গ্যাসচেম্বারের ভিতর ঢুকিয়ে প্রাণবিন্দু শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হত। সেই নিষ্ঠুরতা আমাদের কল্পনার অতীত, অথচ বাস্তবে এমনটা-ই ঘটেছিল। এহেন হিটলারই কবজা করেছিল পোল্যান্ডকে, এবং আমাদের এই অমলরাও তার হাতেই ছিল বন্দি।

অনাথাশ্রমের শিশুদের সঙ্গে কোর্‌চাক
অনাথাশ্রমের শিশুদের সঙ্গে ইয়ানুশ কোর্‌চাক

অথচ একদিন তাদের কী চমৎকার একটা 'রাজ্য' ছিল। সেই রাজ্যটি স্থাপন করেছিলেন ইয়ানুশ কোর্‌চাক (Janusz Korczak)। এটি অবশ্য তাঁর আসল নাম নয়। আসল নাম ছিল হেনরিক গোল্ডস্মিথ (Henryk Goldszmit)। কিন্তু ইয়ানুশ নামেই তিনি ছোটোদের জন্য লেখালিখি করতেন এবং সেই নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যেমন আমাদের জটায়ু। তো এই কোর্‌চাক একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। সেখানেই ছিল আমাদের অমলরা। তারা ওই আশ্রমে একেবারে নিজেদের রাজত্ব বানিয়ে ফেলেছিল। মানে, সত্যিই সত্যিই তাদের আলাদা খবরের কাগজ ছিল, আলাদা কোর্ট-কাছারি ছিল। আর, সব দায়িত্ব পালন করত ছোটোরাই। আসলে কোর্‌চাক মনে করতেন, ছোটোদের উপর বড়োদের সমাজের নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিয়ে লাভ নেই। বরং তারা নিজেরা যেভাবে ভাবছে, যেভাবে বিচার করছে, যেভাবে পৃথিবীকে দেখতে চাইছে, সেই স্বাধীনতা তাদের দেওয়া উচিত। কোর্‌চাকের অনাথ আশ্রম তাই ছিল অমলদের শান্তিনিকেতন। হিটলার যেই পোল্যান্ড দখল করল, কোরচাক বাধ্য হলেন তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে ইহুদিদের জন্য নির্ধারিত বস্তির মতো এলাকা বা ঘেটোয় ঠাঁই নিতে। অর্থাৎ, বন্দি হলেন সকলে।

বাঁদিকে ইয়ানুশ কোর্‌চাকের অনাথাশ্রম, ডান দিকে অনাথাশ্রমের ছোটদের নিজেদের খবরের কাগজ
বাঁদিকে অনাথাশ্রম, ডান দিকে অনাথাশ্রমের ছোটদের নিজেদের খবরের কাগজ

হিটলারের নিষ্ঠুরতা আর কেউ না-জানুক, কোর্‌চাক খুব ভালোই জানতেন। অমলদের মৃত্যু যে আসন্ন তা তিনি বুঝতেই পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর অবস্থা তখন 'ডাকঘর'-এর ফকিরের মতো। এই ভয়াবহ কথা তিনি অমলদের বলবেন কী করে! আবার এখান থেকে যে তাদের বের করবেন, তেমন শক্তিও নেই। কোর্‌চাক ঠিক করলেন, তিনি এমন একটি অবস্থা তৈরি করবেন, যেখানে মানসিকভাবে হলেও এই নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে অমলরা। এবং ভবিষ্যতে ভয়াবহ যা-কিছু আসুক না কেন, বাচ্চারা যেন তা গ্রহণ করার মতো মনের জোর পায়। মনস্থ করলেন, মঞ্চস্থ করবেন রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর', পোলিশ অনুবাদে। এই নাটকের মধ্য দিয়ে বাচ্চারা সকলে টের পাবে বন্দিদশা, যেখানে অমলের মতো তাদেরও যেন বাইরে যাওয়া মানা। অমলের মতো, তারাও জানে না, পৃথিবী রূপ-রং আর তাদের দেখা হবে কি না। কিন্তু অমলের মতোই তারাও প্রত্যাশা করে রাজার চিঠির। এবং, কথামতো আসে রাজার চিঠি। এই নাটকে অভিনয় করেছিল বন্দি অমলরাই। অভিনয়ের আগের দিন সকলের মারাত্মক পেটের অসুখ হয়। তা সত্ত্বেও সুস্থ হয়ে সকলে নাটকটি করেছিল। আর অভিনয়ের কিছুদিনের মধ্যেই কোর্‌চাক ও ১৯৫ জন অমলকে তুলে নিয়ে চলে যায় জার্মান সৈন্য। হিটলারের কুখ্যাত গ্যাসচেম্বারেই তাদের ঠুসে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করা হয়।


বাঁদিকে ইয়ানুশ কোর্‌চাক, ডান দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে রাখতে হবে, এই সময়ে, হিটলারের নির্দেশে, 'ডাকঘর' অভিনয় করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু কোর্‌চাক সেই নির্দেশের তোয়াক্কা করেননি। সেদিন এই নাটকটিই ছিল ওই অমলদের কাছে রাজার চিঠি। অথবা তাদের যে রাজা, স্বয়ং কোর্‌চাক, তিনি যেন এই নাটকটির মাধ্যমেই সান্ত্বনার কথা, আশার কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন বন্দি অমলদের। এমনকি রাজা নিজেও হয়তো খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন, কারণ অমলদের মনে যে ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছিল, ক্ষণিকের জন্য হলেও তা তিনি একটু কম করতে পেরেছিলেন। বোঝাতে পেরেছিলেন, এই দমবন্ধ বন্দিদশাই শেষ কথা নয়। বাইরের একটা পৃথিবী আছে, অপেক্ষায়। মুক্তি আছে।

'ডাকঘর'-এ অমলের যে বন্ধু, মালীনির মেয়ে সুধা, সে কিন্তু অমলের ঘুমিয়ে পড়ার পরেও তার জন্য ফুল নিয়ে এসেছিল। আর অমলের কানে কানে বলে দিতে বলেছিল, যে, সুধা তাকে ভোলেনি। কী আশ্চর্য এই কথাটা। একজন বন্ধুই তো শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুকে মনে রাখতে পারে। যদি আমরা কেউ কাউকে বন্ধু মনে করি, তাহলে যাই-ই হয়ে যাক না কেন, আমরা তার জন্য ফুল নিয়ে আসি। তাকে ভুলতে পারি না।

আমরা ডাকঘর-এর অমলকে যেমন ভুলতে পারি না, তেমনই ভুলব না এই পোল্যান্ডের বন্দি অমলদেরও। তারা বন্দিশালায় বন্দি ছিল। কিন্তু অনেকসময় এক ধরনের কারাগার হয়, যা চোখে দেখা যায় না। অথচ আমরা সেই সব কারাগারে বন্দিই থাকি। যদি আচমকা দেখি, যে, আমাদের কোনও বন্ধুকে হিটলারের মতো কেউ বন্দি করার উপক্রম করছে, আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে আছি, তাহলে বুঝতে হবে, আমরাও আসলে এক বন্দিশালাতেই বাস করছি। সত্যি বলতে কি, অবস্থা একরকম তাই-ই। এই যে আমাজন-এ বনাঞ্চল পুড়িয়ে দেওয়া হল, কত দগ্ধ জন্তুর হাহাকার আমাদের পীড়িত করল, পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হল, তবু আমরা কিছুই তেমন করে উঠতে পারলাম না। এও কি একরকম বন্দিদশা নয়! কাশ্মীরে যারা বাস করে, যে-কোনো কারণেই হোক তারা যে দিনের পর দিন একেবারে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, অথচ আমরা উপায়ন্তর না-দেখে প্রায় নিস্পন্দের মতো বসে ছিলাম, এও তো আসলে আমাদের বন্দিদশা-ই। যেন, কেউ আমাদের বাইরে বেরোতে বারণ করেছে। কিন্তু সত্যি কি তাই-ই। নাকি আমরাই ভয়ে বেরচ্ছি না! অনেক সময়ই আমাদের মনে হয়, এত বড়ো বড়ো বিপর্যয়ে আমরা একা ঝাঁপিয়ে পড়ে কী করব!

কিন্তু এ-কথা সর্বদা সত্যি নয়। তুমি গ্রেটা থানবার্গকে তো দেখতে পাচ্ছ। কী অসীম সাহসে প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে সে। তুমি মালালা ইউসুফজাইয়ের কথা শুনেছ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে সর্বদা লড়াই করে গেছে, এবং সে কারণে গুলি খেতেও পিছপা হয়নি। এই যেমন একটা দিক গেল, আর একটা দিকও দেখার আছে। তুমি হয়তো শুনেছ, বহু মানুষ আছেন যাঁরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনভূমিকে একটু একটু করে পুনরায় সাজিয়ে তুলছেন। তুমি নিশ্চিত খেয়াল করেছ, অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য কী মমত্ব নিয়ে কত মানুষ কাজ করে চলেছেন সারা পৃথিবীতেই। এও আসলে বন্দিদশা থেকে বেরনো। আমরা আদৌ কিছু পারব কি না, এই চিন্তা আমাদের চারিদিকে যে দ্বিধার কারাগার তৈরি করে তা থেকে বেরনোর জন্য এই মানুষরা স্বয়ং যেন রাজার চিঠি। যেমন পোল্যান্ডের অমলদের কাছে কোর্‌চাক। যেখানে কিছুই হওয়ার নয়, সেখানেও তিনি দুর্গের ফাটল দিয়ে আলো দেখানোর ব্যবস্থাটুকু করেছিলেন। পরিস্থিতি যত ভয়াবহ হোক, আর পরিণতি যত অনিবার্যই হোক না কেন, রাজার চিঠি চিরটাকাল মুক্তির হাওয়া হয়েই আসে। শুধু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা দেখত পাব, আমাদের চারপাশকে। আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধুকে। আমরা কী করে ভুলে যাব যে, এই পৃথিবী শুধু হিটলারের মতো ভয়ানক মানুষের নয়, বরং রবীন্দ্রনাথ কি মাদার টেরাসার মতো মানুষেরও।

কে বন্ধু? কে প্রতিবেশী? এ নিয়ে অবশ্য আমাদের প্রশ্ন জাগে। কারণ, এখন আমরা চিরটাকাল না একটা জায়গায় থাকি, না সব বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। ফলে চেনা সংজ্ঞায় সবকিছু ফেলা যায় না। তাহলে? মজা হল, উত্তর আমাদের হাতের সামনেই আছে। শুধু একটু চোখ পালটে দেখতে হবে। যেভাবে আমাদের ভাবানো হচ্ছে, তার বাইরের পথ ধরেও ভাবতে হবে। এই যে, গোটা বই পরীক্ষার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে বলা হয়, সে তো ভালো রেজাল্টের জন্য। যে-পাতাটা পড়ি না সেখানেও আছে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর। যদি এই পাতাটা জরুরি না-হত, তাহলে তো বইয়ে থাকতই না। কিন্তু শুধু পরীক্ষাতে কাজে লাগে না বলেই, ওই পাতাটির প্রতি আমাদের মনোযোগ নেই প্রায়। আমাদের এভাবেই ভাবানো হয়েছে। কিন্তু যদি ভেবে দেখি, যে, যা দরকারি বলেই বইয়ে রাখা হয়েছে, তা আমরা দেখছি না কেন, তাহলে বুঝব, কোথাও একটা মস্ত ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। আসলে এই পাতা সরাসরি পরীক্ষায় কাজে না লাগলেও, আমাদের বেঁচে থাকার নানা পরীক্ষায় পাশ করতে শেখায়। তাই চোখের সামনে যা দেখতে পাবে,সে সমস্ত বিষয়ে আরও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করে যাও,প্রশ্ন করো, সঠিক উত্তর খুঁজে বের করো।

দেখবে, কে বন্ধু, কে প্রতিবেশী তা চিনতে আমাদের কোনও অসুবিধা হওয়ার-ই কথা নয়। আর, কে যে অমলদের বাইরে বেরোতে মানা করছে, অর্থাৎ বন্দি করে রাখছে, আমরা তাদেরও চিনে নিতে পারব। পোল্যাণ্ডের দুর্ভাগা অমলদের মতো পরিণতি যেন আর কারও না-হয়, তা নিশ্চিত করতেও আমরা ভুলব না। কারণ ততক্ষণে আমরা বুঝে যাব, সুধাদের মতো আমাদেরও বন্ধুর জন্য ফুল তুলে নিয়ে যেতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, যে, বন্ধুরা কখনও বন্ধুকে ভোলে না, যেমন সুধা ভোলেনি অমলকে।

ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও পিক্সাবে

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা