সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
গাছ-পাখি আর তাতুনের গল্প

‘তুই গাছকে উড়তে দেখেছিস?’ সোফার এক কোণে গুঁড়িসুড়ি হয়ে বসে বেস্ট ফ্রেন্ড জেম্পুর সঙ্গে কথা বলছিল তাতুন। সারা দিনে সে ভাগ ভাগ করে ঘণ্টাখানেক মোবাইল দেখতে পায়। তাও অনেক চেয়েচিন্তে তবেই বাবার থেকে পারমিশন পাওয়া গেছে। সকালে আধ ঘণ্টা, বিকেলে বাকি অর্ধেক। তারও আবার শর্ত আছে, যে, ইউটিউব বেশি দেখা যাবে না। দেখলেও ভাল কিছু- ডকুমেন্টারি বা নিউজ। উলটো-পালটা জিনিস দেখা চলবেই না। বরং বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে পারে, ভিডিও কল করে। তাতুন তাই দুপুরে এটা-ওটা দেখে। আর বিকেলে প্রায় প্রত্যেক দিনই জেম্পুর সঙ্গে গল্প করে। সেদিন আবার তাতুনের মা বলেছে, শুধু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিলে হবে! দিম্মা, পিসিদেরও ফোন কর। সবার সঙ্গে কথা না বললে যোগাযোগ থাকবে কী করে! তাতুন কিছু না বলে শুধু আড়চোখে তাকিয়েছিল। এটা তার মি-টাইম। সে কাকে ফোন করবে সেটা তো সেই-ই ঠিক করবে। তাই না!

আজকেও তাতুন বসে বসে জেম্পুর সঙ্গে হাজার রকম কথা বলছিল। তাতুনের বাবা রূপমের এখনও ওয়ার্ক ফ্রম হোম। এই সময়টা কাজের চাপ একটু হালকা। কল-টল নেই। ল্যাপটপটা কোলে তুলে নিয়ে ওই সোফারই একটা ধারে বসে আলগোছে কাজ করছিল। আর তাতুনের মা এখন ওদের জন্য টিফিন বানাচ্ছে।

আচমকা তাতুনের মুখে গাছের ওড়ার কথা শুনে রূপম একটু অবাকই হল। তখুনি কিছু না বলে ল্যাপটপে মুখ রেখেই সে ছেলের কথাবার্তায় কান দিল। ওদিক থেকে জেম্পু হেসে গড়িয়ে পড়ছে, ‘গাছ উড়বে কী করে? গাছের কি ডানা হয়েছে?’ রূপম খেয়াল করে, তাতুন যেন একটু অপ্রস্তুত হল। একটা ভুল কথা বলে ফেলেছে এমন একটা ছায়া খেলে গেল তার মুখে। তবু সে বলল, ‘ডানা নেই জানি। তবু যদি উড়তে পারে…’ বলতে বলতে কথার খেই হারিয়ে ফেলল তাতুন। জেম্পু তখনও হাসছে আর বলছে যে, ‘গাছ কি প্লেন যে উড়বে?’ এরপর ওরা আরও পাঁচ-সাত কথা বলে। রূপম আর সে সব খেয়াল করে না। তবে তাতুন কেন গাছের ওড়ার কথা বলছে, এটা কায়দা করে ওর থেকে জেনে নিতে হবে। ঠিক করে নেয় সে। সেঁজুতি অবশ্য বিষয়টিকে পাত্তা দিল না। রূপমকে বলল, ‘ছোট ছেলে, ইউটিউবে কী দেখেছে না-দেখেছে সেই নিয়ে কথা বলছে। ও নিয়ে অত ভাবার কী আছে!’

কিন্তু ভাবনার যে একটা কারণ আছে সেটা সেঁজুতি খুব ভালই জানে। এমনিতে তাতুনের ঘুম খুব ভালো। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর মাঝখানে ওঠে না। কিন্তু এই কয়েকদিন সেঁজুতি খেয়াল করেছে, তাতুন যেন কেমন ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেঁজুতি টের পেয়ে একটু কাছে টেনে নিলে সেই কাঁপুনি থেমে যায়। তাতুনের বাবাকে কথাটা বলবে বলবে করেও বলা হয়নি সেঁজুতির।

তাতুন কিন্তু জানে গাছ উড়তে পারে। কিন্তু তার জন্য আগে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর যেন চলে যায় তাতুন। তারপর খেয়াল করে দেখে, আরে বেশিদূর তো যেতে পারেনি। তাদের ব্যালকনিটাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই ব্যালকনির উপর তখন মস্ত ডানা মেলে একটা গাছ উড়ে এসে বসে। তার পিছনে আর একটা। গাছগুলোর কোমর ভাঙা। ডাল ভাঙা। যেন অনেকগুলো হাত-পা নেই এমন গাছ উড়তে উড়তে এগিয়ে আসছে। তাতুন ভয় পায়। কেঁপে ওঠে। বলে, ‘তোমরা কারা? তোমাদের এই অবস্থা কারা করেছে?’ গাছেরা তখন ব্যালকনির রেলিং-এ ঠেস দিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। তাতুন ভয়ে দু-পা পিছিয়ে আসে। বলে, ‘রেলিং-এ বোসো না যেন, মা আমাকে রেলিং-এ ভর দিতে বারণ করে। বাই চান্স যদি পড়ে যাও!’
গাছ-পাখিরা তখন মৃদু হেসে বলে, ‘আমরা আর কোথায় পড়ে যাব, তাতুন? মস্ত বিপদে তো পড়েই আছি। আবার যদি পড়ে যাই, উড়তে উড়তে তবে অন্য কোথাও যেতে হবে।’ তাতুন প্রশ্ন করে, ‘তোমরা কি গাছ নাকি পাখি?’ গাছেরা বলে, ‘আমরা গাছ-ই। এখন অবশ্য পাখিও বলতে পারো। এসেছি যুদ্ধের দেশ থেকে।’

তাতুন এবার ওদের সঙ্গে ভাব জমায়। যুদ্ধের দেশ! মানে ইউক্রেন! তাতুন কিন্তু জানে যে ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে। একদিন সে জেম্পুকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘যুদ্ধের কথা তুই কিছু জানিস?’ জেম্পু উত্তর দিয়েছিল, শুধু টিভিতে দেখিয়েছে, এটুকুই জানে। তাতুনের বাবা কিন্তু তাকে বলেছে, সব খবর রাখতে। বলেছে, শুধু ঋষভ পন্থকে চিনলে হবে? পৃথিবীটা তো শুধু আর ক্রিকেট নয়।

অতএব তাতুন ইউটিউবে যুদ্ধের ক্লিপ দেখেছে। বেশি দেখেনি। তবে জানে যে, যুদ্ধটা রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে হচ্ছে। কিন্তু কেন যে হচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করতে বাবা বলেছিল, ‘সে অনেক কথা। বড় না হলে বুঝবি না। তবে একটা কথা মনে রাখিস…’ তাতুন বাবার মুখের দিকে তাকালে রূপম ছেলেকে বলে দিয়েছিল, ‘…যুদ্ধ কিন্তু নিজে নিজে বাধে না। যুদ্ধ বাধানো হয়। আর যখন যেখানেই যুদ্ধ হোক না কেন, মনে রাখবি, যুদ্ধটা না হলেও পারত।’ বাবার কথাটা ধাঁধার মতো লাগে তাতুনের। না-হলেই যদি পারত, তাহলে আর যুদ্ধ বাধানো হল কেন?

সেই যুদ্ধের দেশ ইউক্রেন থেকেই এসেছে গাছ-পাখিরা। ইউক্রেন! সে কতদূরের দেশ তা কল্পনা করতে পারে না তাতুন। তবে গাছ-পাখিদের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বোঝাই যায়, অনেকদূর থেকে উড়তে উড়তে এখানে এসেছে তারা। তাতুন জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দেশে এখন খুব খারাপ অবস্থা, না?’ গাছ-পাখিরা বলে, ‘সে আর বলতে! চারিদিক জ্বলছে আর জ্বলছে।’ তারপর নিজেদের দেখিয়ে বলে, ‘এই আমাদের দেখছ না! কারও কোমর ভেঙেছে, কারও ধড় আছে মুন্ড নেই, কার হাত উড়েছে, কারও পা নেই।’ তাতুন জিজ্ঞেস করে ফেলে, ‘তোমাদের এই অবস্থা কারা করল?’ তারপর সে নিজেই উত্তর দিয়ে বলে, ‘বুঝেছি যুদ্ধ।’ গাছ-পাখিরা বলে, ‘মানুষকে তবু সরিয়ে নিয়ে যায় মানুষ। কিন্তু এই আকালের দিনে আমাদের আর কে দেখবে বলো! আমাদের কতজন তো মরেই গেল, কেউ ফিরেও তাকাল না। সূর্যমুখীর খেত পুড়ে আঙরা হয়ে গেল। আর এই আমরা হাত-পা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলাম।’ শুনতে শুনতে তাতুনের চোখের কোনা চিকচিক করে।

গাছ-পাখিরা বলতে থাকে, ‘শুধু আমরা রাতদিন প্রার্থনা করতাম যে, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। খবর পাচ্ছিলাম জানো, চিড়িয়াখানাতে ভিতর পশুপাখিরা সব ভয়ে গোঙাচ্ছে। ওরা তো তবু ঘেরাটোপে আছে। আমাদের তো আর সে উপায় নেই। আমরা আগুন পিঠে নিয়ে পড়ে থাকলাম।’

গাছ-পাখিদের গায়ে হাত রাখার জন্য তাতুন একটু এগিয়ে যায়। তারাও তাকে কাছে টেনে নেয়। সে বলে, ‘আর কিছু হবে না তোমাদের। ভালো হয়ে যাবে তোমরা।’ গাছপাখিরা বলে চলে, ‘একদিন দেখলাম কে যেন আমাদের ডানা দিয়ে ওড়বার ক্ষমতা দিয়েছে। আমরা তখনই ওই ভাঙা শরীরে উড়ান দিলাম। যেদিকে দুচোখ যায়।’ তাতুন অবাক হয়ে বলে, ‘কিন্তু আমাদের বাড়ির রাস্তা তোমরা চিনলে কী করে!’ গাছ-পাখিদের একজন তাকে আদর করে কাছে ডেকে নিয়ে তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘তুমি যে আমাদের ভালোবাসো তাতুন। সেই যে একদিন ভিডিয়ো দেখতে দেখতে আমাদের দিকে তোমার চোখ পড়ল। মুখে কিছুই বলোনি। কিন্তু আমরা তো টের পেলাম, যে তুমি আমাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছ। আর তাই তো তোমাদের বাড়িতেই চলে এলাম।’

সেই থেকে প্রায় প্রত্যেকদিনই তাতুন ঘুমের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে। তার যে কয়েকজন বন্ধু গাছ-পাখি আছে সে কথা আর কাউকে বলতে পারে না তাতুন। ঘুমের ভিতর তো আর তার সঙ্গে কেউ থাকে না।

দিন দুই পরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গাছে জল দিচ্ছিল তাতুনের বাবা। তাতুনও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখনই রূপম প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ রে তাতুন, গাছ কি উড়তে পারে?’ তাতুন ভীষণ চমকে গেল। বাবা কি তবে গাছ-পাখিদের কথা জেনে গেছে! কী করে জানল! তাতুন অবাক হয়ে বলে, ‘তুমি কি গাছ-পাখিদের কথা জানো?’ রূপম বলল, ‘একটু একটু জানি। তুই যদি বলিস পুরোটা তো শুনব।’ তাতুন এবার আগ্রহভরে গাছপাখিদের সব কথা বলল বাবাকে।
সেঁজুতি রূপমের মুখে সবটা শুনে বলল, ‘একটা কথা তোমায় বলব বলব করে বলা হয়নি। তাতুন জানো তো মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে কেঁপে ওঠে।’ গাছ-পাখিদের জন্যই যে সবটা হচ্ছে, এবার সেটা বুঝল তাতুনের মা-বাবা।

*****

গাছ-পাখি আর তাতুনের গল্প

গাছ-পাখি আর তাতুনের গল্পটা অবশ্য এখানেই শেষ হল না। দিনকয় পরে যখন জেম্পুর জন্মদিন এল, ওকে কী গিফট দেওয়া যায় তাই নিয়ে তাতুন বেশ চিন্তিত। রূপম তখন তাতুনকে বলল, ‘তুই তোর গাছ-পাখিদের একজন দুজনকে জেম্পুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে। জন্মদিনে নতুন বন্ধু পাবে জেম্পু।’ তাতুন অবাক হয়ে বলল, ‘তা কী করে হবে? ওদের তো আমি ছাড়া কেউ দেখতেই পায় না। ইস! তুমি ঠিকই বলেছিলে। যুদ্ধটা না হলেই পারে! গাছ-পাখিদের যে চেহারার কী অবস্থা তা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম!’ রূপম তখন বলে, ‘তাহলে গাছপাখিদের একটা ছবি এঁকে দে জেম্পুকে। আর সত্যিকারের ক’টা গাছ আমি কিনে আনব, সেগুলোও দিস।’ কথাটা খুব মনে ধরল তাতুনের। কটাদিন খুব যত্ন করে সে গাছপাখিদের ছবি আঁকতে লাগল। তাদের ব্যালকনিতে পাখির মতো বসে আছে গাছ-পাখিরা। তাদের ক্ষতস্থানে কে যেন জুড়ে দিয়েছে ডানা। ব্যালকনির গাছগুলোর পাশে বসে থাকা সেইসব গাছপাখিরাও যেন তাতুনের বাড়ির সদস্যই। আর তাতুন তাদের সঙ্গে গল্পতে মশগুল।

জন্মদিনে সেই ছবিটা জেম্পুকে দিতে সে বলল, ‘এগুলোই তোর সেই উড়তে পারা গাছ?’ তাতুন মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ।’ তারপর বাবার কিনে দেওয়া গাছগুলো দেখিয়ে বলে, ‘এগুলোও তোর।’ জেম্পু প্রশ্ন করে, ‘এরাও উড়তে পারে?’ তাতুন একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘কে জানে! তবে ভালোবাসলে মনে হয় উড়ে যাবে না। তোর কাছেই থাকবে।’
সেদিন জেম্পুদের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে তাতুন ভাবছিল, গাছ-পাখিরা যুদ্ধের দেশ থেকে যে ভালোবাসে তার কাছে উড়ে যায়। জেম্পু কি সেটা কোনওদিন বুঝতে পারবে? কে জানে!
গাছ-পাখিরা বরং শুধু তারই বন্ধু হয়ে থাক, ভাবতে ভাবতে গাড়ির মধ্যে চোখ বোজে তাতুন। সারাদিনের হুটোপুটিতে তার চোখ জড়িয়ে যায় ঘুমে।

তাতুনের মা শুধু জানে, এখন আর সে ঘুমের মধ্যে একটুও কেঁপে ওঠে না।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা