সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
চাঁদের বুড়ির চরকা-চিঠিঃ ১৪২৯/০৩- বছরশেষের গপ্পো

শেষ হয়ে গেল আরও একটা বছর, শেষ হল ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ। রাত পেরোলেই ২০২৩ এ পা দেব আমরা সবাই। ইচ্ছামতীর সঙ্গে এই বছরের পুরনো-নতুন ছবি উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। চোখে পড়ল দুটো বিশেষ ছবি। প্রথম ছবিটা সদ্য কাতারে শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার সময়ে ইচ্ছামতীর এক লেখকবন্ধু তুলেছেন। হাসিখুশি বাচ্চারা এই প্রতিযোগিতার আনন্দে মিশে গেছে। গায়ে তাদের প্রিয় ফুটবল দলের জার্সি । হইহই করে বড়দের সঙ্গে এসে তারা শামিল হয়েছে বিশ্বের এক বিশাল আনন্দ অনুষ্ঠানে। অন্য ছবিটা ইউনিসেফের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। প্রায় এক বছর ধরে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনের। সেখানে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বাড়িঘর, স্কুল;
ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ — সবাই এই প্রবল শীতে বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে, জল সংকটের মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কাতারে যখন বিশ্বকাপের আনন্দে মিলেমিশে একাকার বিশ্বের সব দেশের মানুষ, প্রায় একই সময়ে তোলা ইউনিসেফের এই ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি রাশিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে, খারকিভের এক মেট্রো স্টেশনে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে ছোটরা আধো অন্ধকারে নিজেদের মন ভালো রাখার চেষ্টা করছে। মোটামুটি চার হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি জায়গা, কিন্তু পরিবেশের কেমন আকাশ-পাতাল তফাত, তাই না? ছবিদুটো দেখতে দেখতে, একটা খুব ছোট্টবেলায় জানা গল্প মনে এল। ভাবলাম, ইচ্ছামতীর সঙ্গে সঙ্গে গল্পটা তোমাকেও বলি।

রামধনুর যে সাতটি রঙ আছে — বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ,কমলা আর লাল, সবাই একদিন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করল — কে সব থেকে ভালো? কে সবার সেরা? লাল বলে, "আমি ফুলের রানী গোলাপফুলের রঙ, তাই আমি সেরা;" কমলা বলে, "আমি শক্তিদায়ী গাজরের রঙ, অস্তগামী সূর্যের রঙ, তাই আমি সেরা;" হলুদ বলে, "আমি রোদ্দুরের রঙ, তাই আমি সেরা!" আর সবুজ বলে, "আমি হলাম গাছপালার রঙ , তাই আমি সবার সেরা!" বাকি রঙেরাও নিজেদের সেরা প্রমাণ করার জন্য জোরে জোরে তর্ক করতে লাগল। শেষে সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে গেল... আর কত ঝগড়া করা যায়! তাই সবাই মিলে গেল এক অতি বৃদ্ধ পন্ডিতের কাছে। দুনিয়ার হেন বিষয় নেই যার সমাধান তিনি করতে পারেন না। এবং তিনি সবসময়ে সঠিক বিচার করেন। তাই তিনি যাকে সেরা ঘোষণা করবেন, তাকে বাকিরাও সেরা মেনে নেবে।

বৃদ্ধ পন্ডিত খুব মন দিয়ে তাদের কথা শুনলেন। তারপরে বললেন, "তোমরা সবাই শান্ত হয়ে আমার কথা শোনো। তোমাদের একটা কাজ দিচ্ছি। আগে সেটা করো, তারপরে আমার কাছে আবার ফিরে এসো।

প্রথমে তোমরা যাও ভালো মায়াবীদের দেশে। সেখানে গেলে দেখবে তাদের রানী ছবি আঁকছেন। ভালো করে লক্ষ্য কোরো তিনি কেমন ছবি আঁকছেন। তারপরে তোমরা যাবে খারাপ মায়াবীদের দেশে। তাদের রানীও একই ভাবে ছবি আঁকেন। সেখানেও ভালো করে দেখে নিও কেমন সেই ছবি। তারপরে আমার কাছে ফিরে এস। তখন বাকি কথা হবে।"

তো, রঙেরা দল বেঁধে চলে গেল ভালো মায়াবীদের দেশে। সে দেশ বড় সুন্দর - চারদিক আলো ঝলমল করছে, গাছে গাছে রঙিন ফুল, উড়ছে রঙবেরঙের প্রজাপতি, সুরেলা গলায় ডাকছে নানা রঙের পাখি, খরগোশ-বেড়াল-কুকুরছানারা খেলে বেড়াচ্ছে সবুজ মাঠে। সেখানে ভালো মায়াবীদের রানী বিশাল এক দেওয়াল জুড়ে ছবি আঁকছেন। সে দেওয়ালের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যায় না। দেওয়াল জুড়ে তুলির টানে ফুটে উঠছে রঙিন গাছপালা- অপূর্ব সুন্দর দেখতে পশুপাখি-হাসিখুশি মানুষ-ঝকঝকে পাহাড়-নদ-নদী... ভালো মায়াবী রানীর তুলির ছোঁয়ায় সেই জাদু দেওয়ালে লাল আর হলুদ রঙ মিলেমিশে রাঙিয়ে তুলছে সুগন্ধী , লোভনীয় কমলালেবু — হাত বাড়িয়ে পেড়ে নিলেই হল! নীল আর হলুদ নানা পরিমাণে মিশে, নানা রকমের সবুজ হয়ে, রাঙিয়ে তুলল কতরকমের গাছের পাতা; সেইসব গাছে ফুলগুলিকে রঙিন করে দিল বেগুণী, লাল, কমলা রঙ। নীল, আকাশী, সবুজ, বেগুনী রঙ মিলেমিশে ময়ূরের পেখমে লাগতেই ময়ূর তার ঝলমলে ডানা মেলে ধরল। সোনালি রঙে সেজে উঠল পাকা ধানের ক্ষেত, রূপোলি রঙে ঝিলমিলিয়ে উঠল নদীর মাছ। কালো আর সাদা রঙে ফুটে উঠল ছোট্ট শিশুর চোখ— চারদিকের অপূর্ব ছবি দেখে ফোকলা মুখে হেসে উঠ সে।

এমন সব ছবি দেখার পরে রঙেরা সবাই একটু চিন্তায় পড়ল। সবুজ ভাবল, তাই তো,আমি তো জানতামই না যে নীল আর হলুদ মিলে গেলে আমারই মত সবুজ হয়ে যাবে; বেগুনি রঙ-ও বুঝল, লাল আর নীল রঙ কমবেশি মিলে গিয়ে কাজ করতে পারে ঠিক বেগুনির মতই। তাই হলে আর আলাদা করে নিজেকে সেরা ভেবে লাভ কি? এমনই সব ভাবনা ভাবতে ভাবতে তারা পৌঁছে গেল খারাপ মায়াবীদের দেশে।

সে দেশ দেখে রঙেরা খুব চমকে গেল, কেউ কেউ ভয় ও পেল। সেখানে চারদিকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ, নোংরা ছড়ানো। গাছপালারা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, কোনো সজীব প্রাণের চিহ্ন নেই প্রায়। সেখানে আকাশ জুড়ে কিচিরমিচির করা পাখিদের বদলে উড়ছে শুধুই ধোঁয়া-ধুলো, সবুজ ক্ষেতের বদলে শুকনো ফুটিফাটা জমি, নদীর জল ও সেখানে ঘোলাটে; নীল আকাশ ও দেখা যাচ্ছে না, আকাশ জুড়ে শুধুই চোখ জ্বালানো- বুক জ্বালানো থিকথিকে বাষ্প। আর সে দেশের রানী? খারাপ মায়াবীদের রানীও ছবি আঁকছে, একটা ভাঙাচোরা দেওয়ালে...কিন্তু এসব কেমন ছবি? তার ছবিতে মানুষে মানুষে যুদ্ধ করছে, একে অপরের দিকে অস্ত্র ছুঁড়ে দিচ্ছে, গাছপালা পুড়িয়ে দিচ্ছে! আহত মানুষের রক্ত আর ক্ষত সে ভরিয়ে দিল লাল রঙে; হলুদ আর কমলা মিশে হয়ে গেল বিস্ফোরনের আগুন; সবুজ রঙে সে ভরে দিল বিষের পাত্র। আর সব রঙকে জোর করে মিশিয়ে তৈরি করল এক ঘোলাটে রঙ, যা দিয়ে সে ঢেকে দিল তার দেওয়াল-ক্যানভাসের আকাশ। খারাপ মায়াবীদের দুনিয়ায় ঘোর আঁধার নেমে এল।

নিঝুম মুখে দল বেঁধে রঙেরা ফিরে এল সেই বৃদ্ধ পন্ডিতের কাছে। তিনি তাদের দেখে, অল্প হেসে বললেন, "কী? বুঝলে কিছু? — তোমাদের মধ্যে কেউই অন্যদের থেকে সেরা নও। সবাই একে অপরের সঙ্গী, একে অপরের পরিপূরক। আর তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে কাজে লাগার ক্ষমতা। সেটা ভালো কাজ ও হতে পারে, আবার খারাপ কাজ ও কতে পারে। যে রঙ দিয়ে ভালো কিছু আঁকা যায়, সেই রঙ দিয়ে খারাপ কিছুও আঁকা যায়। কেউ সব রঙ ব্যবহার করে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে, কেউ খুব খারাপ ছবি। তাই, যদি তোমাদের ব্যবহার করে ভালো বিষয়ের ছবি আঁকা হয়, তাহলে তোমরা খুশি হবে, আর খারাপ বিষয় আঁকা হলে তোমরা কষ্ট পাবে।"

চাঁদের বুড়ির চরকা-চিঠিঃ ১৪২৯/০৩- বছরশেষের গপ্পো

এ তো ছিল কল্পিত এক গল্প। এই রঙেদের বদলে যদি চরিত্রগুলো মানুষ হয়ে যায়, তাহলেই আমরা বুঝতে পারব, আমরা বেশিরভাগ সময়ে কেমন তুচ্ছ সমস্ত কারণে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত গড়ে তোলার বদলে শত্রুতা করতে থাকি। আমারা প্রত্যেকে নিজের দুনিয়া, নিজের চারপাশের দুনিয়াটাকে কেমন করে সাজিয়ে তুলব — সেটা যেন আমরা নিজেরাই ঠিক করতে পারি। এই পৃথিবীকে সুন্দর করায় দায়িত্ব আমাদের, আর খারাপ কিছু হলে তার দায়-ও আমাদের। আগামীদিনে এই পৃথিবীর অ্যালবাম, ইউনিসেফের অ্যালবাম, ইচ্ছামতীর অ্যালবাম ভীত- ক্ষুধার্ত শিশুদের বদলে হাসিমুখ-সুস্থ-সুন্দর শিশুদের ছবিতে ভরে উঠুক, নতুন বছরে শুরু হোক এমনই এক আশা নিয়ে।

তোমার নতুন বছর ভালো কাটুক, সুস্থতার সঙ্গে কাটুক।

৩১ ডিসেম্বর ২০২২
১৫ পৌষ ১৪২৯

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা