বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমিও ছোটবেলায় চিনতাম না। একদিন দেখলাম আমাদের বাড়ির সবাই সন্ধ্যেবেলায় খুব সেজে গুজে কোথাও যাবার তোড়জোড় করছে।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছ মা?
মা বললো পাশের মাঠে।
কিহবে সেখানে?
'পথের পাঁচালী'সিনেমা দেখানো হবে।
আমিও সঙ্গ নিলাম সবার। দেখলাম অপুকে...দুর্গাকে...তাদের পিসি ইন্দিরঠাকরুনকে...মা সর্বজয়াকে
...বাবা হরিহরকে।
তার বেশ কিছুদিন পরে পড়েছিলাম 'আম আঁটির ভেপু'। পরিচয় হয়েছিলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যিনি এই অপু, দুর্গার সৃষ্টিকর্তা।
গতবারের ইচ্ছামতীর শীত সংখ্যায় পড়েছিলে বিভূতিভূষণের ডায়রীর কিছু অংশ। এবার একটু জেনে নিই তার সম্বন্ধে।
১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কাঁচড়াপাড়ার কাছে মুরাতিপুরে গ্রামে মামার বাড়িতে বিভূতিভূষণের জন্ম হয়। তাঁর নিজের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাকপুরে। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃতের পন্ডিত। পান্ডিত্য এবং কথকথার জন্য তিনি শাস্ত্রী উপাধি পেয়েছিলেন। মা মৃণালিনী দেবী। বাবার কাছে পড়াশুনোর হাতে খড়ি। তারপর নিজের গ্রাম আর অন্য কয়েকটা গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনো করার পর ভর্তি হন বনগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ে। তিনি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন তখন তাঁর বাবা মারা যান। এরপর অনেক কষ্ট করে বিভূতিভূষণ পড়াশুনো করেছেন। থেমে থাকেননি। সেই গ্রামের ছেলেটা একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি টপকেছিলো। আশীর্বাদ পেয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। আরো কত বিখ্যাত...আরো কত সাধারণ মানুষের। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়েছিলেন মনের ইচ্ছে থাকলে আর পরিশ্রম করতে পারলে একদিন স্বপ্ন সার্থক
হয়।
'প্রবাসী' সেই সময়কার বিখ্যাত এক সাহিত্য পত্রিকা। এই পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প 'উপেক্ষিতা'। সেতো ১৯২১ সালের কথা। এর আটবছর পর প্রকাশিত হবে 'পথের পাঁচালী'। আর বিভূতিভূষণ জয় করে নেবেন অসংখ্য মানুষের মন। এরপর একের পর এক লিখবেন 'অপরাজিত', 'দৃষ্টিপ্রদীপ', 'আরণ্যক', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' ইত্যাদি উপন্যাস। ছো্টদের জন্য লিখবেন 'চাঁদের পাহাড়', 'আইভানহো', 'হীরা মাণিক জ্বলে' আরো অনেক কিছু। তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে আসে আমাদের গ্রামের কথা... ভালোলাগা নদীটির কথা... দেশের কথা... আর এক অন্তহীন পথ চলার কথা...।
বিভূতিভূষণ আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর।
এর ঠিক পাঁচ বছর পরেই তরুণ গ্রাফিক আর্টিস্ট সত্যজিত রায় তাঁর প্রথম ছবির জন্য 'পথের পাঁচালী'কে বাছেন। তারপরের গল্প এক অন্য ইতিহাস।
উত্তরপাড়া, হুগলী
মৌমিতা সরকার
বালি, হাওড়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
পিঁপড়ের লড়াই
কীট-পতঙ্গের মধ্যে পিঁপড়েদের জীবন কাহিনী খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। এরা সামাজিক প্রানী এবং দলবদ্ধভাবে বাস করে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেনীর বহু পিঁপড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভিন্ন জাতের অধিকাংশ দলেই সাধারণত স্ত্রী,পুরুষ ও কর্মী-এই তিন শ্রেনীর পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কোনও কোনও জাতের কর্মীদের মধ্যে আবার ছোট কর্মী,বড় কর্মী ও যোদ্ধা এই তিন রকমের বিভিন্ন আকৃতি বিশিষ্ট পিঁপড়ে দেখা যায়। বাসগৃহ নির্মাণ,খাদ্য সংগ্রহ, সন্তানপালন এমন কি, যুদ্ধ বিগ্রহ পর্যন্ত যাবতীয় কাজ ক্রীতদাসের মতো এই কর্মীদেরই করতে হয়। স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপড়ের একমাত্র কাজ বসে বসে খাওয়া এবং বংশ বৃদ্ধি করা। আমাদের দেশেও বিভিন্ন জাতীয় বহুবিধ পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো জাতের পিঁপড়ের দলে হাজার হাজার কর্মী থাকে। আবার কোনো কোনো জাতের পিঁপড়ের দলে কর্মীর সংখ্যা ত্রিশ-চল্লিশটি মাত্র। অধিকাংশ পিঁপড়েই গর্তের মধ্যে অথবা বৃক্ষ কোটরে বাস করে থাকে। আবার কেউ কেউ বড় গাছের উপরে সবুজ পত্র-পল্লবের সাহায্যে বাস গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করে। উগ্র প্রকৃতি ও বিষাক্ত দংশনের জন্যে নালসো নামে এক জাতীয় লাল রঙের পিঁপড়ে আমাদের দেশে সর্বজন পরিচিত। হাজার হাজার নালসো এক বাসার মধ্যে একসঙ্গে বাস করে।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য
বাংলার কীট-পতঙ্গ
পড়ে পাওয়া বিভাগে আমরা আমাদের পছন্দের লেখক বা মনিষীদের লেখা থেকে বা তাঁদের জীবনের কিছু টুকরো তুলে ধরব। তোমার পছন্দের লেখক কে? তুমি কি তাঁর ছোটবেলা সম্বন্ধে কোন গল্প জানো ? জানলে লিখে পাঠাও আমাদের। আমরা সবাই মিলে সেই লেখা পড়ব ।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন বইপোকা
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
আমার ছোট্টবেলাঃপর্ব ২
আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে ছিল হরিশ। ওর দাদার নাম ছিল জিকা। ও খেজুর গাছ থেকে রস বার করত। মাঝে মাঝে সকালে এসে ডাকাডাকি শুরু করে দিত-"কী বেণুবাবু, একটু রস হবে নাকি? গেলাস নিয়ে এস..." শীতের ভোরে হি হি কাঁপতে কাঁপতে দুই গ্লাস রস ঢক ঢক করে গিলে ফেলতাম। এই অনুভূতিটা বলে বা লিখে বোঝানো যায়না। পারলে একবার গ্রামে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা করে এস। ভুলতে পারবে না কখনো।
যাকগে, যে কথা বলছিলাম... সকালের খাওয়ার পাট চুকলে যতক্ষন না পাঠশালা যাবার সময় হচ্ছে ততক্ষন যা খুশি কর।
এই সময়ে দাদু মাঝে মাঝে হারমনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বসতেন। তিনি ভাল গান করতেন। এক এক দিন আমাকে ডেকে নিতেন। দাদুর সঙ্গে গলা মেলাতাম ঠিকই তবে কতটা হত বলা মুশকিল। এরকম একটা গানের কথা মনে আছে -"আজি এসেছি বন্ধু হে..."
পাঠশালা যাওয়ার সময় দিয়ানি স্নান করিয়ে খাইয়েদাইয়ে বইপত্র গুছিয়ে দিতেন। বই পত্রের কথা বললাম যেন কতই বই ছিল তোমাদের মত!। মাত্র তো দুখানা বই! একটা বর্ণপরিচয় আর একটা ধারাপাত। এছাড়া ছিল সেই ভারি স্লেট খানা আর পেন্সিল।
আমার শিক্ষার শুরু হয়েছিল যাঁদের হাতে তাঁদের প্রথম জনের নাম তো আগেই বলেছি। তিনি আমার দাদু। এর পর যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন পাঠশালার "হেড স্যার", যিনি "বড় মাস্টার" নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। মোট তিনজন শিক্ষকের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রধান। নাম ছিল রামসুন্দর বাবু। গ্রামের লোকেরা পাঠশালাকে বলত রামসুন্দরের পাঠশালা।
অতি সাধারণ পোষাক ছিল তাঁর। হাঁটুর ওপর তোলা ধুতি, গায়ে ফতুয়া, পায়েও একটা কিছু থাকত। দেখতে কালো, রোগা, ঢ্যাঙামত এবং মাথায় কদমছাঁট পাকা চুল। আর বয়স? পঞ্চাশ থেকে সত্তর - যে কোন একটা।
যেকোন কারনেই হোক, তিনি মাঝে মাঝেই কামাই করতেন। যেদিন আসতেন বেশির ভাগ দিনই মেজাজ থাকত তিরিক্ষি। হাতে একটা লিকলিকে বেত নাচাতে নাচাতে পড়াতেন। কী যে ভয় করত, বাপরে! জানা জিনিস ভুল হয়ে যেত। অবশ্য আমি কোনদিন শাস্তি পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। সোমবারটা হত ভয়ঙ্কর। বেঞ্চিতে সপাং করে বেতটা মেরে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করতেন "আজ কী বার?"-অর্থাৎ গতকাল রবিবার ছিল, তাই সোমবার পড়া চাই-ই চাই!!
তোমরা "পথের পাঁচালি" বইটা পড়েছ, বা সিনেমাটা দেখেছ? অপুর পাঠশালার কথা মনে পড়ে? সেই যে গুরুমশাই যিনি মুদিখানা চালাতেন, পাড়ার মাতব্বরদের সাথে আড্ডা দিতেন, আবার পড়াতেন ও!
আমাদের বড় মাস্টার ও কতকটা সেরকমই ছিলেন। তিনি দোকান চালাতেন না, তবে পাশা খেলার দারুন নেশা ছিল।খেলতেন আবার আমার দাদুর সাথে। সেই কারণেই বোধহয় আমি কখনো শাস্তি পেতাম না। আমাদের ধারাপাত মুখস্থ করতে দিয়ে তিনি চলে যেতেন পাশা খেলতে!
ধারাপাত মুখস্থ করার ব্যপারটা ছিল বেশ মজার। শ্রেণীর সবচেয়ে গাঁট্টাগোট্টা ছেলে ছিল আমার বন্ধু ছানু, তাকেই ডেকে নিতেন তিনি। ছানু জোরে চেঁচিয়ে বলত, "একে চন্দ্র-অ-অ-অ" বাকিরা একসাথে চিতকার করে সেটাই আবার বলত। এরকম করে এক থেকে একশো পর্যন্ত চলত। শুনবে নাকি কিছু কিছু? প্রথমে এক থেকে দশ এরকম -
একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ,
তিনে নেত্র, চারে বেদ,
পাঁচে পঞ্চবান, ছয়ে ঋতু,
সাতে সমুদ্র, আটে অষ্টবসু,
নয়ে নবগ্রহ, দশে দিক।
এর পরে "একের পিঠে এক এগারো, একের পিঠে দুই বারো..." এমন করে চলত, "নয়ের পিঠে নয় নিরানব্বই, একে শূণ্য দশ, দশে শূণ্য 'শ। অর্থাৎ এক থেকে একশো পর্যন্ত গোনা শেষ। এরকম বলতে হত বারবার। ক্লান্ত হয়ে পড়তাম একেবারে, গলা নেমে আসত আমাদের।
পাঠশালা ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে। পাশা খেলার হারজিতের খবর সবটাই কানে আসত পরিষ্কার ভাবে। বেশ মজা পেতাম আমরা। বড় মাস্টার জিতলে চিতকার করে দাদুকে দুয়ো দিয়ে পাড়া মাথায় করতেন।
একটা করে দান শেষ হওয়ার পর খেয়াল হত ছাত্রদের পড়তে দিয়ে আসার কথা। তাই মাঝে মাঝে হাঁক পাড়তেন আমাদের উদ্দেশ্যে। আমাদের ক্লান্ত গলা আবার হয়ে উঠত চনমনে।
তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ভুলেই যেতেন যে আমাদের পড়তে দিয়ে এসেছেন। তাই অন্য সকলের সাথে আমাদেরও সেদিনের মত ছুটি হয়ে যেত।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সন্তোষ কুমার রায়
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
খলসী ফুলের গন্ধ
দখিণা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে নদীর জল
আমার জানলার ধারে লাইট পোষ্টের তারের ওপর দুটো কাক বেশ কিছুদিন ধরে বাসা বাঁধছিলো। এবার দেখলাম তারা ডিম পেড়েছে আর মনের আনন্দে বসে বসে তা দিচ্ছে। পাঁচটা ডিম,অবশ্য তার মধ্যে কটা কোকিলের সেটা আমি জানি না। বেশি বলতেও চাইনা। ফস করে কাক গুলো যদি শুনে ফেলে।
কটা কোকিলের ডিম কে জানে!
স্নেহার অবশ্য এদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে শুধু জানে অনেক দিন বন্ধ থাকার পর এবার তাদের সুইমিং ক্লাস আবার শুরু হবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সাঁতার কাটতে তার বেশ ভালো লাগে।
কিন্তু পাখিরালা গ্রামের আনন্দির বেশ মন খারাপ। নৌকার ওপর চুপ করে বসে আছে।
আনন্দী
কাল রাতেও তো বাঘের ডাক শুনেছে আনন্দি। জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ,আরো কত বিপদ আছে জঙ্গলে সেসব জানে আনন্দি। বাবার মধু আনতে যাওয়া মানে মায়ের মুখভার ,ঠাকুমার কান্নাকাটি। আর বাবা যতদিন না বাড়ি ফিরে আসছে ততদিন তার মা সূর্য ওঠার আগে রান্না করবে। সেই রান্না তারা সারাদিন ধরে খাবে। চুলে তেল দেবে না। মাছ-মাংস ছোঁবে না। আর সবসময় মনে মনে জঙ্গলের দেবী মা বনবিবি আর বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়কে স্মরণ করবে। বারবার প্রার্থনা করে বলবে তার বাবা আর গ্রামের সবাই যেন ভালোভাবে ফিরে আসতে পারে।
বনবিবি আর দক্ষিণ রায়
এই সময় সুন্দরবনের জঙ্গল আলো করে ফুটে থাকে হরেক রকমের ফুল। তার মধ্যে খলসী ফুলকেই সবচেয়েভালো লাগে আনন্দীর।
খলসী ফুল- যা দেয় সোনারঙা মধু
এই ফুলের মধুর রঙ যেন গলানো সোনা। আর খেতে? এই মনখারাপের সময়েও যেন জিভে জল এলো আনন্দির। চটপট উঠে পড়লো বাড়ি ফিরে পড়তে বসতে হবে। কারণ বিকেলে সে বাবার সাথে হাটে যাবে পুজোর বাজার করতে।
আন্দুবস্তির সুরেশ রাভা দাওয়ায় বসে ঢুলছে। সামনে খোলা কিশলয় বই। আমি গিয়ে সুরেশের মাথায় হাত দিলাম। সুরেশের ঘুমের চটক ভাঙলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "স্কুলে গিয়েছিলে?" সুরেশ ঘাড় নেড়ে জানালো "হ্যাঁ"। এই সুরেশকে গতকাল সারা রাত ভুট্টার ক্ষেত পাহাড়া দিতে হয়েছে। উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলে এখোনো বেশ শীত। রাতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা পড়ে। সুরেশের ক্ষেত একেবারে জঙ্গলের গায়ে।
ভুট্টার ক্ষেতে যাচ্ছে কি?
আর সেটাই বিপত্তি ও ভয়ের কারণ। পালে পালে হাতি এই সময় গ্রামে ঢুকে পড়ে ভুট্টা খাওয়ার লোভে। তাদেরকে ভয় দেখিয়ে আবার জঙ্গলে পাঠাতে হয়। সেই কাজটা খুব একটা সুবিধের নয়। ক্ষেতের লাগোয়া জায়গায় বাঁশ দিয়ে উঁচু করে একটা ছাওনি করা হয়। যাকে বলা হয় মাঁচা। সেখান থেকে ক্ষেতের ওপর নজর রাখতে হয়। হাতি এলে মুখে আওয়াজ করে, আগুন জ্বালিয়ে, টর্চের আলো গায়ে ফেলে, টিন পিটিয়ে তাদের তাড়াতে হয়। নাহলে এতদিন ধরে যে ভুট্টার গাছ গুলোকে বড় করতে সুরেশরা পরিশ্রম করেছে তা সবই হাতির পেটে যাবে। তখন সুরেশরা খাবে কি?
আন্দু বস্তির ছেলেমেয়েরা
তাই সুরেশ সারাদিন স্কুল আর কাজের পর রাত জাগে গোটা গ্রামের সাথে। এখন এটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। সামনেই আসছে রন্তুক পুজো। তার প্রস্তুতি চলছে গ্রামে। সেদিকেই গেল সুরেশ।
ঠিক এরকমই এক বসন্তের সকালে পরিচয় হয়েছিলো অন্ধ গায়ক, তেরো বছরের বেচয়ানের সাথে। বিহারের সমস্তিপুরের নাম শুনেছো কি? সেই সমস্তিপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল মাইসট। সেই মাইসটের এক অনেক দূরের গ্রাম ঝারোলাটোলা।
বেচয়ানের গ্রাম
এই গ্রামেই বেচয়ান থাকে। গোটা গ্রামকে সে গান শোনায়। আর সবাই খুশি হয়ে যা দেয় তাই দিয়ে তার মা সংসার চালান। এই গ্রামের সবাই খুব গরীব। এতো গরীব গ্রাম আমি এর আগে দেখিনি। গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষ কাজের সূত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকেন। আর হোলির সময় গ্রামে ফেরার চেষ্টা করেন। খুব মজা আর আনন্দে কাটে কয়েকদিন।
হোলির দিনে সবাই মিলে আনন্দ
গ্রামের ছেলেদের মধ্যে বেচয়ান এখনো পর্যন্ত বাইরে কাজ করতে যায় নি। তার বন্ধুরা সবাই চলে গেছে কেউ কলকাতায়, কেউ দিল্লী, কেউ মুম্বাই। তাদের সবার কাছে গল্প শুনে বেচয়ান ঠিক করলো সেও এবার কিছু একটা কাজ করবে। বন্ধুদের মতো রোজগার করবে। বোনের বিয়ে দেবে। ছট পুজোয় মাকে দেবে নতুন শাড়ি। গ্রামে তার ইজ্জত বেড়ে যাবে। বেচয়ান যখন আমাকে তার এই স্বপ্নের কথা বলছিলো তখন আমি মজা করে তার গল্প শুনছিলাম। আর ভুলেও গিয়েছিলাম। কাজের সুত্রে সেবার কয়েকদিন বেচয়ানদের গ্রামে থাকতেও হয়েছিলো। একদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো কান্নাকাটির শব্দে। গ্রামের রাস্তায় একটা ছোটখাটো মিছিল। সেই মিছিলের আগে বেচয়ান। হাতে একটা পুঁটলি নিয়ে গড়গড় করে হাঁটছে। আর তার পিছন পিছন বেচয়ানের মা, বোন কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে। আর তার পেছনে গ্রামের আরো বউ,বাচ্চা। আমি গিয়ে মিছিলটাকে থামাই।
বেচয়ানকে জিজ্ঞেস করি,"এত সকালে কোথায় চললে বেচয়ান?" বেচয়ান হাসি মুখে বললো,"বড়া শহর"। আমি বললাম "সেকি তুমি তো কোনোদিন গ্রামের বাইরেই যাওনি।" মহিলারা আরো হু হু করে কেঁদে উঠলো। এক বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন,"বাবু মাইসটের ছেলেদের এতো কমজোরী ভাববেন না। ওরা সব পারে।" আমার শুধু অবাক হওয়ার পালা। কখোনো ভাবতে পারিনি যে বিহারের সেই ছোট্ট গ্রামের একরত্তি ছেলে মুখে যা বলে কাজেও সেটা করে দেখানোর সাহস রাখে। এই বেচয়ান সত্যি একদিন অনেক টাকা নিয়ে ফিরে আসবে। তার বোনকে বিয়ে দেবে। মাকে কিনে দেবে ছট পুজোয় শাড়ি। আর কখোনো কোনো বড় শহরের রাস্তায় যদি তোমার সাথে বেচয়ানের দেখা হয়ে যায় তাহলে সে তোমাকে শোনাবে তার গ্রামের কথা, সূর্যমুখী ক্ষেতের কথা। আর মন ভালো থাকলে হয়তো গাইবে কমলা নদীর সেই গানটা যেটা সে গুনগুন করে সব সময় গাইতো।
বেচয়ানের গ্রামের সূর্যমুখীর ক্ষেত -বাসন্তী রোদে ঝলমল করছে
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
প্রথম পাতাঃবসন্ত সংখ্যা ২০০৯
কিছুদিন আগে মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে হয়ে গেল সরস্বতী পুজো। হলুদ শাড়ি বা সাদা পাঞ্জাবি পরে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দিয়েছিলে তো? আর দুপুরে কি খেলে? খিচুড়ি আর পাঁপড়ভাজা? পুজোর আগে আবার ভুল করে কুল খেয়ে ফেলনি তো? পুজোর পরের দিন দই-খই এর ফলার খেয়ে দেবী সরস্বতী তো তাঁর রাজহাঁস কে নিয়ে চলে গেলেন নিজের মায়ের কাছে। আর এখানে? আশীর্বাদের সাথেই তোমার আর তোমার মায়ের জন্য রেখে গেলেন বার্ষিক পরীক্ষা!! আরো অন্য বন্ধু- দাদা-দিদিদেরও শুরু হয়ে গেছে, বা খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে নানা রকমের পরীক্ষা। ভাল লাগে কারো? - কিন্তু কি আর করবে বল? পরীক্ষার পড়া তো করতেই হবে। বরং পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে, ইচ্ছামতীর সাথে ভাব করে ফেল। দেখবে, মন ভাল হয়ে যাবে।
সরস্বতী পুজো চলে যাওয়া মানেই কিন্তু শীতের ছুটি। শীতবুড়ো যে নিজের লেপ-কম্বল পিঠে ফেলে চলে গেছে, সেটা তো একটু একটু করে বাড়তে থাকা গরম, দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া আর ক্রমশঃ বড় হওয়া দিন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামনেই আবার আসছে দোলপূর্ণিমা। উত্তর ভারতের 'হোলি' আর বাঙ্গালিদের 'দোল' - একই উতসবের দুই নাম। ফাল্গুনমাসের পূর্ণিমায় এই উতসব বয়ে নিয়ে আসে নতুন জীবনের বার্তা। শীতঘুমের রেশ কাটিয়ে চারিদিকে বড় বড় গাছের ন্যাড়া ডালে জেগে উঠেছে কচি সবুজ পাতা। শহরের মাঝে ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে যেতে হঠাত দেখা হয়ে যায় দশতলা বাড়ির পাশে লাল টকটকে পলাশ ফুলে ভরা একলা গাছটার সঙ্গে। একা একাই জানিয়ে দিচ্ছে - বসন্ত এসে গেছে। তোমার বাড়ির কাছে কি কোন পার্ক আছে? বা গাছপালায় ভরা বাগান? যদি থাকে, চলে যাও একদিন বিকেলবেলা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নাও। দেখবে কত রকমের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসবে - আমের মুকুল, শিরীষ, মধুমালতি, কৃষ্ণচূড়া, করবী -রঙ আরে সুগন্ধে দিকবিদিক ভরিয়ে তুলে জানান দেবে- এসে গেছে ঋতুরাজ বসন্ত।
দেখতে দেখতে ইচ্ছামতীও তৃতীয় সংখ্যায় পা দিল। 'বসন্ত সংখ্যা ২০০৯' এসে গেল তোমার জন্য নিয়ে অনেক গল্প আর জানা অজানা নানা তথ্য। এই সংখ্যায় 'দেশে-বিদেশে' বিভাগে আমরা বেড়াতে যাব জাপানের টোকিও, পশ্চিমবঙ্গের টাকি আর ফ্লোরিডার প্যারট জাঙ্গল-এ। অন্যান্য ধারাবাহিক এবং নিয়মিত বিভাগ গুলি ছাড়াও থাকছে নতুন একটি বিভাগ - তোমার এবং আমার প্রিয় কমিকস চরিত্রগুলির খবরাখবর নিয়ে 'কমিকস কাহিনী'। আরও আছে। এই দখিনা হাওয়ার দিনগুলি কেমন কাটে পাখিরালার আনন্দীর আর আন্দুবস্তির সুরেশের? - জানতে হলে পড়ে ফেল এই 'বসন্তের কথা'। গত সংখ্যায় চেয়েছিলাম 'রঙ' নিয়ে গল্প। কিন্তু আমাদের কোন পাঠক-পাঠিকাই এই বিষয় নিয়ে গল্প/লেখা পাঠায়নি। তাই এই সংখ্যায় বিষয়ভিত্তিক কোন গল্প রইল না।
ইচ্ছামতী যে শুধু ছোটদের কথাই বলছে না, বড়দেরকেও ফিরিয়ে দিচ্ছে ছোটবেলার স্বাদ, আমাদের 'চিঠি পাঠাও' বিভাগ দেখলেই সেটা বুঝতে পারা যাবে। ইচ্ছামতীকে সবার ভাল লাগছে জেনে আমিও খুব খুশি। একটা ছোট্ট তথ্য তোমার সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। গত দুটি সংখ্যার ইচ্ছামতী পড়ে ফেলেছেন পৃথিবীর ছাব্বিশটি দেশের প্রায় ছয়শোর ও বেশি পাঠক-পাঠিকা! আমাদের ছোট্ট ইচ্ছামতী এত মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে জেনে তোমারও নিশ্চয় খুব ভাল লাগছে? ছোট -বড় সব পাঠকের ভাললাগা আর ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে যাবে ইচ্ছামতী- এই তো চাই। তোমার এবং তোমার বন্ধুদের আরো আরো লেখা আর ছবি চাই কিন্তু ইচ্ছামতীকে সাজিয়ে তোলার জন্য।
চাঁদের বুড়ি
- বিস্তারিত