পুজোর চিঠি
সারা রাতের ট্রেনের ধকল ছিলো। ঘুমও হয়নি ভালো করে। ঝম ঝমে বৃষ্টির মধ্যে যখন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছিলাম তখন ভাবতেও পারিনি রাত দশটা পাঁচের দার্জিলিং মেলটা ধরতে পারবো। শিয়ালদহ থেকে তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠে দেখি গোটা কামরা জলে থৈ থৈ। জল পরিষ্কার করে, আমার জিনিসপত্র রেখে, সব দিক দেখে শুনে, ধীরে-সুস্থে বসতে বসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। তখোনো তোমার চিঠিটা আমার ব্যাগে সিরাজুল। খোলা হয়নি নীল খামটাও।
রফিকুল ক্যানিং লোকাল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে এসেছিলো। ভেবেছিলো আমার ট্রেন হয়তো ছেড়ে গেছে। হাঁপাচ্ছিলো রফিকুল। ও এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। শুনলাম তোমাদের গ্রামে আবার নদীর জল ঢুকছে হু হু করে। তোমার ছোট্ট বোনকে নিয়ে মা চলে গেছেন মামার বাড়ি,পবিত্র রমজানে আনন্দের ছিটেফোঁটাটুকু নেই। রফিকুলের দেওয়া টুকরো টুকরো খবরে আমার মন যখন একটু একটু করে কষ্ট পাচ্ছে তখন দেখি ট্রেনের কামরার সহযাত্রীরা একটুখানি জল দেখেই কি হই-চই বাধিয়ে ফেলেছে। আর আমার মনে পড়ছে তোমার গ্রামকে। সুন্দরবনের সেই ছোট্ট গ্রাম পাখিরালার কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম সিরাজুল।
সকাল ঠিক আটটার সময় দার্জিলিংমেল আমাদের নামিয়ে দিলো নিউ জলাপাইগুড়ি স্টেশনে। সারা রাতের ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও হলো যখন দেখতে পেলাম ঝকঝকে শরতের রোদে ভেসে যাচ্ছে স্টেশন চত্ত্বর। বেশ কিছু বিদেশী ট্যুরিস্ট নিজেদের মধ্যে হৈ-হৈ করছে। আর ছোট ছোট জিপ থেকে চালকরা জোরে জোরে হাঁক দিচ্ছে "কালিম্পং, দার্জিলিং,ফুন্টসিলিং..."। তোমার বয়সী একদল স্কুলের ছেলে মেয়ে কালিম্পঙের বাসটায় উঠলো। আর ঠিক তখনি আমার গাড়ির চালক জয়কে দেখতে পেলাম। হাসি-খুশি জয় সবসময় আমার সফর-সঙ্গী।
আমরা যাবো শিলিগুড়ির খুব কাছেই সরস্বতীপুরে। সেখানে কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের পাশেই থাকে মালতী নার্জিনারী। ঠিক ধরেছো সিরাজুল, মালতী তোমার মতো ক্লাস সেভেনে পড়ে। যাওয়ার পথে হঠাত গাড়ি থামালো জয়। তাকিয়ে দেখি তিস্তার চর সেজে উঠেছে কাশফুলে। মনে পড়ে গেলো পুজো্র আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি।
তিস্তার চরে কাশফুল
কাঁঠালগুড়িতে গিয়ে মালতীর দেখা পেলাম না। শুনলাম মামার বাড়ি গেছে। অতদূর থেকে এসেছি বুঝতে পেরে শুক্লা ওরাঁও বললেন,"একটু বসুন, আমি আপনাদের গ্রামটা ঘুরে দেখাই।" তিস্তার পাশে জঙ্গল আর চা বাগানে ঘেরা মেচ আর ওরাঁও জনজাতির গ্রাম। শুক্লার সাথে গ্রাম ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সবাই চা-পাতা তোলার কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ জঙ্গল থেকে বয়ে নিয়ে আসছেন শুকনো কাঠ।
চা বাগান
খুব তাড়াতাড়ি আমরা আবার চলা শুরু করলাম। যেতে হবে অনেকটা পথ। রাজাভাতখাওয়া ছাড়িয়ে আরও ঘন্টা দুয়েকের পথ। সন্ধ্যা নামছে। বড় রাস্তা থেকে জঙ্গলে ওঠার মুখে জয় আবার গাড়ি থামালো। আমরা সবাই চুপ। আকাশে নানা রকমের রঙ ছড়িয়ে সূর্যিমামা পাটে নামছেন। এরপরে জঙ্গল, পথে পড়বে রায়ডাক নদী।
সিরাজুল, তোমার গ্রামে যখন রাতে ছিলাম তখন মনে আছে বাজারের সেই অন্ধকার পথটা? তুমি আমাকে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলে। অনেক রাতে ঘুম থেকে তুলে আমাকে শুনিয়েছিলে হাড় হিম করা বাঘের ডাক। মাগো, সেদিন কি ভয় পেয়েছিলাম! মনে আছে সিরাজুল? আর সেই লস্কর মন্ডল, টাইগার রিজার্ভের বনরক্ষী। যিনি আমাদের সেই রাতেই নিয়ে গিয়েছিলেন নৌকাতে। আর সারা রাত আমরা ছোট ছোট খাঁড়ি ঘুরে বেড়ালাম বাঘের খোঁজে। লস্করকাকু আলো নিয়ে খুঁজতে থাকলেন বাঘের পায়ের ছাপ। আর বলতে থাকলেন সেই দুষ্টু কুমীরটার গল্প। যে শুধু ওত পেতে থাকে কখন কার ছাগলটা, বাছুরটা তার নাগালে আসবে। সত্যি সেই রাতের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না সিরাজুল।
রাতের নৌকা
অনেক রাতে একশো বছরের পুরনো রায়ডাক বন বাংলোয় এসে যখন পৌঁছোলাম তখন চারিদিকে পটকা ফাটার শব্দ...টিন পেটানোর আওয়াজ...। বুড়ো চৌকিদার এসে বললেন পাশের গ্রামে হাতি ঢুকেছে। আজ বোধহয় একটা ধানও থাকবে না। সারা রাত ধরে হাতি তাড়ালো গ্রামের মানুষ। সকালে ঘুম ভাঙলো একটা চেনা মিষ্টি গন্ধে। বারান্দায় এসে দেখলাম, সিঁড়ির কাছে ছোট্ট মাঠে ছড়িয়ে আছে শিউলি ফুল।
শিউলি ফুল
পশ্চিম চ্যাংমারী গ্রামে থাকে ঊষা নার্জিনারী। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে কোনো বিদ্যুত নেই। পাকা শৌচাগার নেই। ঠিকমতো রাস্তা নেই। সবার হাতে কাজ নেই। খুব চেনা লাগছে কি সিরাজুল? এই গ্রামটাও কিন্তু তোমার গ্রামের মতোই। তোমার গ্রামটা যেমন ঘিরে থাকে নদী, তোমার গ্রামে এখন যেমন নোনা জলে সব নষ্ট ঠিক তেমনই এখানে বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি নেই। বছরে একবার এখানে ধান হয়। তাও বৃষ্টির জলকে ভরসা করে। এই গ্রামটাকেও ঘিরে থাকে জঙ্গল, পাহাড়। আর ঘিরে থাকে ভয়। কখন হাতি আসে। তবুও ঊষা আর তার বন্ধুরা এখান থেকে বেশ কিছু দূরের স্কুলে গিয়ে পড়াশুনো করে। চেষ্টা করে এই প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার। তোমার চিঠিটা আমার সবটা পড়া হয়ে গেছে সিরাজুল। একবার নয় অনেকবার। ধান ক্ষেতের পাশে বসেই তোমাকে লিখছি। আর কোথা থেকে একটা নীলকন্ঠ পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে ছবির মতো গ্রামটার দিকে।
সবুজে ঘেরা গ্রাম
ঊষা এসে খবর দিলো নাচের দল রেডি। কেতকী, আশা, রেবা আজ আর কাউকেই চিনতে পারছি না। সবাই নিজেদের অর্থাত মেচ জনজাতির ট্রাডিশনাল পোষাকে সেজেগুজে এসেছে। শুরু হল 'বাগারুম্বা'(মানে নাচ)।
বাগারুম্বা
নাচ দেখে জঙ্গলের পথ ধরলাম আমরা। বিশ্বেশ্বর শৈব্য বললেন,"হাতিপোতায় আজ হাট বসেছে স্যার, দেখতে যাবেন?" লোভ সামলাতে পারলাম না সিরাজুল। প্রায় একঘন্টা হেঁটে হাতিপোতায় যখন পৌঁছোলাম তখন একটু একটু অন্ধকার হতে শুরু করেছে। রিঙ্কুর সাথে পরিচয় হল। রিঙ্কু হাটে বিক্রি করতে এসেছে কাঁচা সবজী। ক্লাস ফোরে পড়ে। বাড়ি ফিরে তেলের কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসবে। সামনেই পরীক্ষা তার।
রিঙ্কু
যে ছবিগুলো তোমাকে পাঠালাম, যাদের কথা তোমাকে বললাম সবাই তারা পিছিয়ে পড়া গ্রামে থাকে। হ্যাঁ ঠিক তোমার মতনই ওরা কষ্ট করে পড়ছে সিরাজুল। আর আমি কি ভাবছি জানো? একদিন তুমি, রিঙ্কু, ঊষা, মালতী যখন অনেক বড় হবে- বলতে শিখবে নিজের গ্রামের কথা, নদীর কথা, সমস্যার কথা। নিজেরাই এগিয়ে আসবে সামনের সারিতে...সেদিন সত্যি শরত তার অরুণ আলোর অঞ্জলীতে ভরিয়ে দেবে চারিদিক। সেদিন পবিত্র ঈদে সবাই পাবে প্রাণের জোয়ার...বাগুরাম্বায় থাকবে মনের আনন্দ...আর ঠিক তখনই শুরু হবে সত্যিকারের উতসব। যে উতসবে আমরা মেতে উঠবো সবাই।
ভোরের আলো
মন দিয়ে পড়াশুনো কোরো। মা আর বাবাকে আমার প্রণাম জানিও। আশা করছি হেমন্তের কোনো এক সকালে আবার তোমার সাথে দেখা হবে সিরাজুল। তখন আবার আমরা ছোট্ট নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়বো খাঁড়িতে, কাঁকড়া ধরতে।
ভালো থেকো।
কল্লোল
- বিস্তারিত
প্রথম পাতাঃশরত সংখ্যা ২০০৯
জানো তো, লৌকিক মতে, মা দুর্গা প্রতি বছর বিভিন্ন বাহনে করে মর্ত্যে আসেন এবং কৈলাশে ফিরে যান। এবার দুর্গা বাপের বাড়ি আসছেন দোলায় চেপে, যার ফল কিনা মড়ক। সত্যি করে মড়ক হোক আর না হোক, আমাদের চারিদিকে কিন্তু অনেক মানুষই খুব কষ্টে আছেন। খবরের কাগজে হয়ত পড়ে থাকবে, বা টেলিভিশনে দেখে থাকবে - সারা দেশের নানা জায়গায় হচ্ছে ভয়ানক বন্যা, ডুবে গেছে ঠিক তোমার মত কত ছোটদের ঘর-বাড়ি। অন্যদিকে কোথাও আবার অনাবৃষ্টি, খরা। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের পাকা ধান, জলের তোড়ে ভেসে গেছে কমলি গাই, ভাংছে নদির পাড়, নেই তেষ্টার জল বা মাথার ওপরে ছাত। পুজোর আনন্দের মাঝে মাঝে কিন্তু এইসব মানুষদের ভুলে যেওনা। অষ্টমীর সকালে যখন মা দুর্গার কাছে অঞ্জলি দিয়ে মনে মনে নিজের পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট বা নতুন সাইকেল অথবা ভিডিওগেম চাইবে, তখন কিন্তু এইসব অগুন্তি মানুষের জন্যেও চেয়ে নিও মুখের হাসি, পেট ভরা খাবার, মাথা গোঁজার আশ্রয়। তবেই না তোমার পুজো হয়ে উঠবে সত্যিকারের আনন্দ উতসব।
তাই বলি, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, ধূপ-ধুনো আর ফুলের গন্ধ, প্রসাদ আর ভোগের স্বাদ, ঢাকের বাদ্যি আর সমবেত মন্ত্রের শব্দ, নতুন জামা আর বেলুনের রঙ, সব মিলে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক এক নতুন আলো, কেটে যাক সব অন্ধকার।
দুগগা ঠাকুর ভালো
তাঁর রূপে ভুবন আলো
এসো, সেই আলোয় পথ দেখে, মায়ের হাত ধরে, আরেকবার নতুন করে সবাইকে ভালোবাসতে শিখি আমরা...
চাঁদের বুড়ি
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
মারথোমা নাসরানিদের দেশে
পূর্ব্দিকে সুদীর্ঘ বিস্তৃত পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আর পশ্চিমে বিশাল সমুদ্র কেরল ভূখন্ডকে পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলো থেকে এমনভাবে লুকিয়ে আড়াল করে রেখেছে, যে বহু শতাব্দী ধরে মানুষজন এর অস্তিত্বের কথাই জানতো না। কিন্তু দেশের মানুষ না জানুক, বাইরের সুবিশাল জগতের সঙ্গে-বিশেষ করে পাশ্চাত্যের সঙ্গে কেরলের ছিলো সুপ্রাচীণ বানিজ্যিক সম্পর্ক - আর সেই সূত্রেই বহু দেশের হরেক রকম সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের যাতায়াত ছিলো এই কেরলে, যাদের মধ্যে অনেকেই এখানে পাকাপাকিভাবে আস্তানাও গেড়েছিলো।
ব্যাকওয়াটার -কোট্টায়ম থেকে আলেপ্পি যাওয়ার পথে
ব্যাকওয়াটারের ধারে মানুষের বসতি; প্রত্যেক বাড়ির নিজস্ব ঘাট ও নৌকা আছে
প্রথমেই বলেছি যে সেই কত হাজার বছর আগে থেকেই কেরলে কত বিচিত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এসেছে স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে। তাই বহু প্রাচীন কাল থেকেই এখানে যেমন ছিলো স্থানীয় হিন্দু মন্দির, তেমনি সুরীয় খ্রীষ্টানদের গীর্জা, ইহুদী সিনাগগ, মুসলমানদের মসজিদ, বৌদ্ধদের প্যাগোডা, এমনকি গ্রীক ও রোমানদের মন্দির ! বেশ কিছু বছর আগেই কেরলের সমুদ্র উপকূলে খননকার্য চালিয়ে প্রত্নতাত্বিকেরা খুঁজে পেয়েছেন একটি বিশালকায় গ্রীক দেবতা আপোল্লোর মন্দির ! তাই বহুযুগ ধরেই কেরলে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে এমন এক সমন্বয় ও আদান-প্রদান ভিত্তিক সম্পর্ক দেখা গেছে তার সত্যিই জুরি মেলা ভার। অনেক সময় দেখা যায়,কেরলের মন্দির ও প্রাচীন গীর্জাগুলি একই রকম পাথরে তৈরি আর অবিকল এক দেখতে। কারণ হলো, একই স্থপতি সব কিছু তৈরি করতো।
কোট্টায়মের প্রাচীন গীর্জা; পাশেই উঁকি দিচ্ছে মসজিদের মিনার
কোচিনে প্রাচীন মন্দির; পাশেই রয়েছে ইহুদীদের সিনাগগ; চূড়া দেখা যাচ্ছে
সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান গীর্জার সামনে গোপুরম বা পতাকাস্তম্ভ; প্রতিটি মন্দিরের সামনেও থাকে। পর্বদিনে পতাকা উত্তোলন করা হয়।
কেরলের এই প্রাচীণ খ্রীষ্টিয়ানেরা নিজেদের মলয়ালম ভাষায় বলে থাকে 'মারথোমা নাসরানিঙ্গল' বা 'মারথোমা নাসরানি'। সিরিয়্যাক ভাষায় 'মার' মানে প্রভু বা সন্ত আর 'নাসরানি' হলো আরবী শব্দ যার মানে খ্রীষ্টিয়ান, কারণ যীশু খ্রীষ্টের পৈতৃক ভিটে ছিলো 'নাসরৎ' নামক গ্রামে। অর্থাৎ এরা নিজেদের 'সাধু থোমার খ্রীষ্টিয়ান'- এই নামে অভিহিত করে। তাই সাধু থোমা বা সেন্ট টমাস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছেন - যেন এক রূপকথার চরিত্র। সেন্ট টমাস, যিনি তাদের পূর্বপুরূষদের দীক্ষা দিয়েছিলেন দুহাজার বছর আগে, তাদের কাছে কোন নিছক প্রবাদবাক্য নয়। সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান পরিবারের প্রতিটি শিশুই আম, নারকোল, বাগদা চিংড়ি আর নানারকম মসলার স্বাদ-গন্ধের মতোই সেন্ট টমাসের কাহিনী তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে করতেই বেড়ে ওঠে।
চেঙ্গান্নুরে প্রাচীন সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান গীর্জা; বলা হয়, ১৭০০ বছরের পুরোনো,অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত
গীর্জার সামনে প্রাচীন গ্র্যানাইট ক্রুশ; গায়ে রয়েছে খোদাই করা পশু, পাখি্, মানুষ, নক্সা
ফাদার ভার্গিজ, একজন সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান মালপান ( সিরিয়্যাক ভাষার শিক্ষক)-এর সাথে আমি
আবীরলাল মিত্র
মানিকতলা, কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: জানা-অজানা
সোনালি ঢেউয়ের দেশে
জায়গাটাড় ছবি দেখো। আমি এর আগে কখনও এরকম কোন জায়গা দেখিনি। ওপরে নীল আকাশ আর নিচে সোনালি পাথরের ঢেউ। হটাৎ দেখলে মনে হবে যেন পৃথিবীর বাইরের কোন অন্য জায়গায় এসে পড়েছি। ভূ-বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে বলেছেন যে জায়গাটা ১৯০ মিলিয়ন বা ১৯ কোটি বছরের পুরোনো। একদিন এখানে ডাইনোসর চড়ে বেড়াতো। জায়গাটা ছিলো আদতে বালিয়াড়ী (sand dunes)। তারপর একসময়ে হটাৎ, যেন ম্যাজিকের মতো, বালিয়াড়ী জমে পাথর হয়ে গেলো - হয়তো বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য। জায়গাটার নাম ওয়েভ (Wave)। বাংলা করলে দাঁড়ায় ঢেউ। জায়গাটা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা আর উটাহা প্রদেশের সীমানায়।
আমাদের সাথে আরো চোদ্দো জন অপেক্ষা করছে। বুক দুরু দুরু করছে, চিন্তা হচ্ছে যে দশ জনের মধ্যে নাম উঠবে কিনা! ছয় জন হতাশ হয়ে ফিরে যাবে আজ। লটারি হয় বিঙ্গো মেশিনে। মেশিনের ষোলোটা বল আছে, যার ওপরে সংখ্যা লেখা আছে। একজন অফিসার বন বন করে মেশিনটা ঘোড়াতে শুরু করলো। এবার অপেক্ষা কোন সংখ্যাটা ছিটকে বেরিয়ে আসবে !আমাদের সংখ্যা ছয়। বিঙ্গো ঘুরেই চলেছে, কোন সংখ্যা বেরোনোর লক্ষণই নেই। হটাৎ একটা বোল ছিটকে এলো - তার সংখ্যা তিন - চারজনের একটা দল সুযোগ পেয়ে গেলো। তারপর একটা দুইজনের দল। আমাদের বুক ধড়ফড় করছে। আমি প্রাণপণে ঠাকুরের নাম করছি। পরে পিউ আমাকে বললো যে পিউও জোরে জোরে ঠাকুর নাম করছিলো। নাম না উঠলে এতদূর আসা ব্যর্থ হবে। বিঙ্গো মেশিনের চাকা ঘুরেই চলেছে। হটাৎ একটা ঘটনা ঘটলো যার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। একটা বল ঠকাস করে লাফিয়ে ছিটকে বাইরে পড়ে গেলো। যে গর্তটা দিয়ে বেরোয় সেখান দিয়ে নয় কিন্তু, অন্য কোন একটা জায়গা দিয়ে। পিউ আমার হাত চেপে ধরে আছে। উত্তেজনায় এতো জোরে চেপে ধরেছে যে রীতিমত লাগছে। কেউ একজন মেঝে থেকে বলটা কুড়িয়ে দিলো। ঘোষক বলের সংখ্যা দেখে ঘোষণা করলেন- ছয়! ছয়!-আরে, সেটা তো আমাদের সংখ্যা। আমার বুকটা একবার জোরে ধক করে উঠলো। আ-হা-হা-হা! কি আনন্দ! আমি আর পিউ শেষ পর্যন্ত ওয়েভ দেখতে যাচ্ছি। বাকি সময় গেলো পারমিট, ম্যাপ, এসব নিতে। সবকিছু করতে করতে বেলা দুপুর হলো। আমরা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে গেলাম। আগামিকালের জন্য তৈরি হতে হবে। বিশেষতঃ, রাস্তায় জল নেই, তাই আমাদের অবশ্যই অনেক জল নিয়ে যেতে হবে।
জায়গাটায় যাওয়ার জন্য কোন রাস্তা করা নেই। ম্যাপ, কম্পাস এবং/অথবা জি পি এস আবশ্যক। তবে আমাদের আগে এতো লোক গেছে যে বালির ওপর পায়ের ছাপে ভরা। কিছু কিছু জায়গায় মসৃণ পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। সেইসব জায়গাগুলিতে ম্যাপ আবশ্যক। এই পাথর এতো মসৃণ যে পা ফস্কে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সব সময়। এই পাথরগুলোকে বলে স্লিকরক (slick rock)। তাই এই জায়গায় চলার জন্য এমন জুতোর দরকার যেটা সহজে পিছলে যাবে না। আর যেসব জায়গায় পায়ের ছাপ নেই, সেখানে ম্যাপই ভরসা। আর তার সাথে সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।সমসময় খেয়াল রাখতে হবে ল্যান্ডমার্ক গুলির দিকে। আমাদের ল্যান্ডমার্ক ছিলো দুটো জিনিষ - টুইন বাট (Twin Butte) আর নচ(Notch)।
টুইন বাট
নচ
ডেসার্ট লিজার্ড
মাছের কাঁটার মত পাথর
নিচের ছবিটায় z - আকারটা দেখো। খেয়াল করলে দেখবে আকারটা ফাটা ফাটা।
বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চললো। আমাদের সামনে আবার তিন-চার ঘন্টা হাঁটা আছে। দিন থাকতে থাকতে ফিরতে হবে। আমাদের উঠতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ফিরতে হবে। এখানে রাস্তায় আলো নেই। রাস্তা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। বেরিয়ে আসার আগে শেষ একটা ছবি তুলে নিলাম।
ব্যস, মজা শেষ। আবার হাঁটা শুরু।প্রায় তিন ঘন্টা পর আমরা এসে গেলাম গাড়ি রাখার জায়গায়। এই জায়গাটা মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে। আবার ইচ্ছে রইলো এখানে আসার। শুনেছি বরফ পড়লে জায়গাটা খুব সুন্দর লাগে। পরের বার ঠাণ্ডার সময়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এদিকে তো সেপ্টেম্বর পড়ে গেলো। অক্টোবর এ যাবো মনার্ক প্রজাপতিদের পরিযানের ছবি তুলতে। তোমাকে জানাবো প্রজাপতিদের ছবি তুলতে পারলাম কি না।
দেবাশীষ পাল
ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
ম্যারাথনের মোকাবিলা
ম্যারাথন দৌড় নাকি খুব লম্বা, তাবড় তাবড় দৌড় বীরেরাই নাকি শেষ করতে পারে না-এইসব বলে বন্ধুরা আমাকে খুব ভয় দেখিয়েছিলো।
কত লম্বা?
তা সে ২৬ মাইল ২৮৫ গজ, মানে ২৬ পূর্ণ ৭/৩২ মাইল, মানে কিনা ৪২ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার হবে। বাপরে!প্রাণের মধ্যে একটা বিষম খেলাম। তবে ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে,ম্যারাথনের চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ফেলেছি। ফেদিপ্পিদেস বলে এক গ্রীক যোদ্ধা নাকি ম্যারাথনের যুদ্ধে ওই রকম দৌড়ে গতায়ু হয়েছিলেন। এরপরে কি আমার পালা? আর তাও তো উনি পুরোটা দৌড়োন নি,১৮৯৬ সালের অলিম্পিকেই যখন এই দৌড় অন্তর্ভূক্ত হলো তখন অবধি তাঁরা দৌড়োতেন মোটে ২৪ দশমিক ৮৫ মাইল।
সাতপাঁচ ভেবে দেখলাম গভীর জলে যখন পড়েইছি তখন একটু হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরানোর চেষ্টা করি। এই ভেবে ম্যারাথন নিয়ে ভারী পড়াশুনো করতে লাগলাম আর লেংটির মতো একটা হাফ প্যান্ট কিনে ফেললাম। অথচ এত কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও আমার দৌড়ের কোনো উন্নতি হলো না। ঠিক এমন একটা সন্ধ্যাবেলায় ম্যারাথনের কথা ভাবছি আর উলটো দিকের দোকান থেকে এই ভরা বৃষ্টিতে কিছু তেলেভাজা আনার উদ্যোগ করছি, এমন সময় সেই কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে আমার এক বন্ধু এসে বললো-কিরে দৌড়তে যাবি? নাকি আজকের প্র্যাকটিস অলরেডি হয়ে গেছে? তোর তো সামনে আবার ম্যারাথন। এইসব কথা শুনে বড়ই বিপদে পড়লাম। মনে মনে নিজেকে ছি ছি করে বেরোলাম জাহাজঘাটার সামনেটায় দৌড়োতে। কিন্তু দৌড়োবো কি? হাঁসফাঁস করছি, শীত লাগছে, আঙুল অবশ হয়ে গেছে, কানের লতিতে যন্ত্রণা করছে, কোমর চুলকোচ্ছে, নাকের ডগা অসাড়,মনে হচ্ছে এক্ষুণি ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলি। কিন্তু লোকজনের সামনে তো এসব চলে না, কোনোক্রমে কিছুদূর গিয়ে আর পারছি না বলে দু-ঘন্টা বাদে দাঁড়িয়ে পরে দেখি সবে কুড়ি মিনিট হয়েছে। মাথা মুছতে মুছতে ভাবলাম,এবারে কিছু একটা করতেই হচ্ছে, দৌড়ের আর মোটে আড়াই মাস বাকি।
দেখলাম রাতে একা শীতের মধ্যে দৌড়োনোর আইডিয়াটা ভালো। শুধু ঠান্ডা না লাগলেই হলো। এটা সেই ভদ্রলোকের মতন, যিনি নাকি সব সময় এক সাইজ ছোটো চটি কিনতেন যাতে বাড়ি ফিরে চটিটা ছাড়তে ভারি আরাম লাগে। আমারও তেমনি, কষ্টের মধ্যে দৌড়লে আসল দিনে হেসে খেলে বেরিয়ে যাবো। শুরু হল দৌড়। কুড়ি মিনিট থেকে পঁচিশ মিনিট,তারপরে আধ ঘন্টা, একঘন্টা-আস্তে আস্তে সময় বাড়াচ্ছি-রোজই একটা জায়গায় এসে মনে হয়, আর না, এইবারে ঠিকরে পড়বো, সেইখানে চোখের জলে নাকের জলে এক হয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে তবে শেষ করি। ইতিপূর্বে একবার দুম করে প্রচুর দৌড়োতে গিয়ে হাঁটুতে টান লেগে দেড় মাস কিছু করতে পারিনি। আর আরেকবার জিমে দৌড়োতে গিয়ে পায়ের বারোটা বাজাতে বাকি রেখেছিলাম। জিমে দৌড়ানোর মেশিন যে পায়ের পক্ষে কি খারাপ সে আর কি বলবো। পয়সা দিয়ে পায়ের লোকসান। তার চেয়ে রাস্তায় গাড়ি চাপা না পড়ে দৌড়ানো ভালো। সবচেয়ে ভালো নাকি ঘাসে দৌড়ানো। কিন্তু আমি ঘাস পাচ্ছি কোথায়? জ্ঞানের কথা থাক, একদিন শনিবার ভোরে ভাবলাম একটা লম্বা দৌড় দেয়া যাক। দৌড়োতে দৌড়োতে কখন যে ফিরেছি তার তার খেয়াল নেই, দম প্রায় শেষ, মাথা কাজ করছে না, রাস্তার ধুলো ধোঁয়ায় মুখে এক পরতা কালি পড়ে গেছে, চোখে ঘাম ঢুকে জ্বালা করছে। পা গুলো মনে হচ্ছে আর পায়ের জায়গায় নেই। ঘড়িতে দেখলাম তিন ঘন্টা দশ মিনিট। নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ালাম শাবাশ! শাবাশ!
ভরসা হলো। আমিও হয়তো শেষ করবো। ঘন্টার পর ঘন্টা হা হাঁ করে দৌড়োলেই কিন্তু চলে না। ওটা করতে গিয়েই প্রতি একশোটার মধ্যে অন্তত পঁচিশটা লোক শেষ করতে পারে না। প্রায় স্লো মোশানে শুরু করে বডি ধীরে ধীরে গরম করে এমন স্পীড নিয়ে যেতে হবে যে তখন আর নতুন করে কোন কষ্ট হবে না। রাস্তা যত ঢালে যাবে গতি তত বাড়বে আর চড়াই যত হবে গতি তত কমবে। হাঁফ ধরলেই দৌড়োতে দৌড়েতেই রেস্ট। আর ক্ষিদে তেষ্টা তো একটু একটু আছেই। বেশি খাবার বা জল খেয়ে কত লোক যে বমি করে ভাসিয়ে দেয় তার ইয়ত্তা নেই। আবার কিছু লোক ঠিক তার উলটো, জল-খাবার কিছুই খায় না ফলে কিছুক্ষণ পরে মাথা ঘুরে মাটিতে ঠিকরে পড়ে। ওই সময় চিনি জাতীয় জিনিসে খুব চট করে এনার্জি পাওয়া যায়। তাই হাঁটতে হাঁটতে এক মিনিটে অল্প জল আর কিশমিশ, বা ছোট চকোলেট খেলে মনে হয় যেন ভেতর থেকে কেউ একটা ব্যাটারি চালু করে দিলো। ওই এক মিনিটে কিচ্ছু সময় নষ্ট হয় না। বরং মনে হয়, এই তো, এইবারে অনায়াসে আরও আধ ঘন্টা দৌড়ে নেবো। কিন্তু সাবধান, বেশি দৌড়োলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হুহু করে কমে যায়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই এই সময়ে জ্বর, সর্দি কাশি, পায়ে চোট। তাই পা যদি বলে, শোনো, আর পারছি না, তাহলে তার কথা শুনে হাল্কা দেওয়াই ভালো। কুড়ি মাইলের পর পায়ের কথা শুনে লোকজন খামোখা স্পিড বাড়াতে গিয়ে মাটিতে পড়ে থেকে হাহুতাশ করে। আর একবার থেমে গিয়ে পা যদি জমে যায়, তবে সব পন্ড।
আমি দেখে চেনার চেয়ে ঠেকে শিখি বেশি।তাই একগাদা ভুলচুক করে আর তার খেসারত দিয়ে শেষমেষ দৌড়টাকে একটা পর্যায়ে এনে ফেললাম। এমনকি দৌড়ের আগের রবিবার কুড়ি মাইল দৌড়ে দেখলাম, হ্যাঁ, কষ্ট হচ্ছে বটে কিন্তু পারছি। তারপরে এক সপ্তাহ টুকটাক সাঁতার এইসব-ওতে চোট লাগে কম। ম্যারাথনের আগের রাতে তেড়ে ভাত খেলাম। ওটাই আমাকে পরের দিন গ্লাইকোজেন হয়ে পেশীতে চটজলদি এনার্জি দেবে। খুব মন দিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম যে আমি হাসতে হাসতে দু আঙুলে ভিকট্রি সাইন দেখিয়ে লাইন পেরোচ্ছি। তখনো বুঝিনি কপালে কি আছে।
দৌড়ের দিন ভোরবেলা, বাতাসের তাপমাত্রা শূণ্য কি এক ডিগ্রি হবে,প্রায় দশ হাজার লোক জমায়েত হলো। মাইকে সেকি চিতকার, কি হট্টগোল। চতুর্দিকে বিজ্ঞাপন, সবাই বাঁশি বাজিয়ে প্রতিযোগিদের চিয়ার আপ করছে। আমরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গা ঘষে চিয়ার আপ হচ্ছি, না দৌড়লে ভীষণ শীত। ঠিক সাড়ে আটটায় বন্দুকের শব্দ হলো-আর আমরা কয়েক হাজার লোক হো...ও...ও...শব্দ করে দৌড়োতে শুরু করলাম। ম্যারাথনের মজা হল সবাই সঙ্গে থাকলে কষ্ট কম হয়, মজা লাগে। আর এইভাবে দৌড়ে একটা শহরের কত জায়গা যে দেখা হয়ে যায় তা আর বলার কথা না। এমনিতে অনেকক্ষণ দৌড়োলে মাথা ফাঁকা থাকে, সময় অনেক স্লো লাগে, তাই নানান হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে দৌড়োলে দিব্যি টাইম কাটে। খালি দুম করে আলটপকা কোথাও পা হেলে বা ঘুরে যাতে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। এরমধ্যে আবার ছুটকো-ছাটকা মজা হচ্ছে। একটা ব্রিজের তলা দিয়ে যেতে যেতে একশো্টা লোকের চিতকার দিয়ে যে দারুন প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করা যায় সেটাই জানতাম না। কোথাও কোথাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একগাদা বাচ্চা আমাদের হাত ছোঁবে বলে সার বেঁধে জমায়েত হয়েছে। কেউ কেউ আবার দৌড়ের লাইনের ঠিক সাইডে মুসাম্বি বা কোনো ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর এইসব মজার মধ্যে সবাই জানে, যে জলের স্টেশন প্রতি তিন মাইলে একটা। আর বাথরুম হলো ছয়ে এক।
প্রথম পনেরো কিলোমিটার তো এইসব ভাবতে ভাবতেই কেটে গেলো। মনে হলো, গা গরম হচ্ছে না। আর তখনই সেই ভুলটা হলো। আমার পাশ দিয়ে দু-তিন জন পক্ককেশ বৃদ্ধ সাঁ সাঁ করে আমাকে আগেই পেরিয়েছিলেন। তাতে মনে হয় আমার মনে একটু ব্যাথা লেগেছিলো। কিন্তু সাড়ে চার ফুট লম্বা, মানে বেঁটে,মাথায় ব্যান্ডানা বাঁধা এক বুড়ি যখন পনেরো কিলোমিটারে আমায় উল্কার বেগে অতিক্রম করলেন তখন আমার যেন কেমন সব গুলিয়ে গেলো...সুপারম্যান হবার ইচ্ছে হল। নিজের কথা না ভেবে মনে মনে বুড়ির সঙ্গে কম্পিটিশান শুরু করলাম। বুড়ি স্পিড বাড়াচ্ছে, আমিও বাড়াচ্ছি। মনে মনে কে যেন বলছে, যে পরে মহা ফ্যাসাদে পড়বো। কিন্তু থামতে পারছি না। পঁচিশ কিলোমিটারের মাথায় এই সার সত্যটা আবিষ্কার করলাম যে বুড়ি পোড় খাওয়া দৌড়বীর। ওনাকে ধরা আমার সাধ্যের বাইরে। এইভেবে যেই একটু দম ছেড়েছি অমনি টের পেলাম যে আমার দম একেবারে বেরিয়ে গেছে। আমি এসেছি মোট অর্ধেকের একটু বেশি রাস্তা। আর একশো মিটারও যেতে পারবো কিনা সন্দেহ। এই অবস্থাকে ম্যারাথনে নাকি বলে-হিটিং দা ওয়াল। সামনে একটা দেওয়াল যেটা পেরোনো অসম্ভব। আমার মুখ দেখে বোঝাই যাবে না যে আর এক মিনিটের মধ্যে আমি বসে পড়বো। তারপরে পায়ে খিঁচুনি শুরু হবে,এম্বুলেন্সে করে তুলে নিয়ে যাবে - কি লজ্জার ব্যাপার।
ঠিক এইরকম সময় শুনি বিক্রম!বিক্রম! চালিয়ে যা! বলে চিতকার। কি আনন্দ-কি দৃশ্য। সব বন্ধুরা দেখি ওই এলাকাতেই প্রতি মাইল দু মাইলে একজন দুজন করে দাঁড়িয়েছে। ওরা ঠিক জানে যে এইরকম কোনো একটা জায়গাতেই আমি কুপোকাত হতে পারি। ওদের লাফালাফিতে আমার শরীরে বল ভরসা ফিরে এলো। আবার দৌড়োতে লাগলাম। উঁচু রাস্তা, নিচু রাস্তা, ব্রিজ, কোথাও থামলাম না। কুড়ি মাইলের পর এক মহা উতপাত শুরু হলো। লোকে খালি তালি দেয় আর বলে, আরে শাবাস...শাবাস...দৌড় প্রায় শেষ, এই তো আর একটু। মুশকিল হলো এই যে দৌড় মোটেই প্রায় শেষ নয়। আরো প্রায় নয় কিলো মিটার বাঁকি। কিন্তু মন কি আর তখন মনের মধ্যে আছে? মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে যে আমি বোধহয় একটা মাইলপোষ্ট দেখতে না পেয়ে মিস করে গেছি, তাই এত সময় লাগছে। পরের মাইলপোষ্টে গিয়ে ভুল ভাঙে। ততক্ষণে আমার চারিদিকে নানা কারণে ও অকারণে লোকে শয্যাশায়ী হয়েছে,এম্বুলেন্স এসেছে ইত্যাদি। বাইশ মাইল নাগাদ, পাদুটো তখন কি করে চলছে কে জানে, হঠাত বুঝলাম যে আমার একটু বাথরুমে যাওয়া উচিত ছিলো। অতি ক্ষীণ ধারায় আমার প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে, নেহাত গাঢ় রঙ বলে প্যান্টের সাথে তফাত করা যাচ্ছে না। সে কি কান্ড-এইরকম প্রায় মাইল দুয়েক চললো। আবার দু মাইলে শুকিয়েও গেলো।
শেষ দু মাইল দৌড় যে কি অসহ্য কষ্টের সে কেবল নানা লোকের লেখাতেই পড়েছিলাম। এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। পঁচিশ মাইলের মাথায় দেখি ডান দিকে ঘুরেই আমাদের ফিনিশ লাইন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেই ঢুকতে যাবো, দেখি আরও সোয়া এক মাইল ওই লাইনের ঠিক পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাইন পেরিয়ে গেছি কিন্তু রেস শেষ হয়নি। এই কষ্টটা আর নেওয়া গেলো না। পুরোটা ঘুরে মুখ কুঁচকে প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে কাতরাতে কাতরাতে লাইনে ঢুকলাম। আমার হিরো হীরালালের মতো প্রবেশের আশা একেবারেই মাটি। ঢুকে যেই না থামা, পা দুটো একেবারে জমে গেলো, হঠাত প্রচন্ড শীত করতে লাগলো। ঠক ঠক করে কাঁপছি, আর মনে হচ্ছে যেন পায়ের নিচের মাটি তখনও নড়তে নড়তে এগোচ্ছে। অবস্থা বিপাক দেখে দু তিনজন স্বেচ্ছাসেবী আমায় তাপ নিরোধক রাংতা দিয়ে জড়িয়ে পায়ের পরিচর্যা করতে লাগলেন, মালিশ ওষুধ এইসব দিয়ে। পনেরো মিনিট বাদে পা ছাড়লো। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে মেডেল আনতে যাওয়া। কতক্ষণ সময় লাগলো? পাক্কা সাড়ে চার ঘন্টা। আর যে ফার্স্ট হলো, তার সময় দু-ঘন্টা নয় মিনিট, ভাবা যায়?
আমার পায়ের ব্যাথা শেষ পর্যন্ত মরলো দু-হপ্তা বাদে। দৌড়ের ছবি গুলো পেলাম এক মাস বাদে। দেখে মনে হচ্ছে যেন এখনি দুম করে পড়ে যাবো। ওই বাইশ থেকে পঁচিশ মাইলের মধ্যেও ছবি আছে। মন দিয়ে প্যান্টের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছি। না বলে দিলে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
লেখাঃ
বিক্রম
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
আহমেদাবাদ, গুজরাত
- বিস্তারিত