মৌমাছি ও শামুক
একদিন এক রানী মৌমাছি তার দলবল নিয়ে মধুর সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সজোরে ভোঁ ভোঁ করে শব্দ করে উড়তে উড়তে তারা এসে পড়ল এক শামুকের বাড়ির সামনে। মা শামুক ওদের দেখেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
বলল – ‘আমার ষোলোটা ছেলেমেয়ে বাড়িতে ঘুমাচ্ছে। তারা এখনও খুব ছোট। হাঁটতে শুরু করার আগে তাদের আরো পনেরো দিন ঘুমানোর দরকার। তোমরা সবসময় এরকম বিশ্রী কানফাটানো আওয়াজ করলে তারা ঘুমাবে কি করে? গতকাল তোমার বাড়ির লোকজন তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে সারাদিন এখানে ছিল আর ভীষন কোলাহল করেছে। আজ আবার তুমি এসেছ বিরক্ত করতে। এই ভয়ানক আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে আমার কোন ছেলেমেয়ে যদি মারা যায় তাহলে আমি গিয়ে তোমাদের গোটা বাড়ি ভেঙ্গে তছনছ করে দেব। তোমাদের কোথাও থাকার জায়গা থাকবে না তখন। তোমরা কি জানো যে এই গাছটা আমার নিজের। আমার মালিক কুড়ি বছর আগে আমাদের জন্যে এই গাছটা লাগিয়েছিল, যাতে এর ফল খেয়ে আমরা বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু প্রত্যেক বছর যখনই এই গাছে ফুল ফোটে তখনই তোমরা দল বেঁধে আস আর সব মধু চুরি করে খেয়ে চলে যাও। তার ওপর সারাক্ষন বিদ্ঘুটে শব্দ করে আমাদের বিরক্ত করো। এক্ষুনি যদি তোমরা এখান থেকে বিদায় না হও তো আমি আমার মালিক আর আমার বাড়ির অন্যান্য লোকজনদের ডাকবো।’
তখন রানী মৌমাছি বলল – ‘তোমরা ধূলো আর নোংরা থেকে জন্মেছ। তোমার কোন মালিক নেই। বাড়িতে অন্য কোন লোকজনও নেই। কোন কালে তোমার পূর্বপুরুষরা সবাই মারা গেছে। তাও কোন মানুষ গ্রাহ্য করনি। কারন এই বিশাল পৃথিবীতে তোমরা কারো কাজে লাগ না। কিন্তু আমরা হলাম মৌমাছি। আমাদের তৈরী মধু খেয়ে মানুষরা ভালো থাকে, শরীরে বল পায়, সাস্থ্য ভালো হয়। মধু ওষুধের থেকেও উপকারী। মৌমাছিরা সারা পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। সমগ্র মানবজাতি আমাদের ভালোবাসে। তাই আমাদের জন্যে তারা ফুল গাছ লাগায়। তোমরা কি মনে করো তোমরা মানুষের থেকেও উঁচু দরের কোন প্রানী?
একটা গল্প বলি শোন। একদিন একটা দুষ্টু ছেলে আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে দিতে এসেছিল। কিন্তু তার মা তাকে বলল – তুমি অনেক কিছু ভেঙ্গে নষ্ট করো। কিন্তু খবরদার মৌমাছির বাসায় হাত দিও না। ওরা সারাদিন কত পরিশ্রম করে আমাদের জন্যে মধু সংগ্রহ করে। কোন রানী মৌমাছিকে যদি তুমি মেরে ফেল তাহলে তার সব ছেলেমেয়েরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। তখন শীতকালে আমরা রুটি দিয়ে খাওয়ার মতো একটুও মধু পাবো না। তখন ছেলেটা মায়ের কথা শুনে এখান থেকে চলে গেল। সে পাখি ধরতে পারে, মাছ ধরতে পারে, ফুল ছিঁড়তে পারে, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে কক্ষনো বিরক্ত করবে না কারন আমরা খুব উপকারী প্রানী। তোমরা কী? তোমরা সারাদিন শুধু শম্বুক গতিতে চলাফেরা করো, কারো কোন কাজে লাগো না। ’
মা শামুক এই শুনে খুব রেগে গেল। সে বাড়িতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের বলল – ‘শোন সবাই। মৌমাছিরা আমাদের শত্রু। পনেরো দিন পরে তোমরা হাঁটতে শিখে যাবে। তখন তোমাদের মধ্যে পাঁচজন মৌমাছিদের বাড়ি গিয়ে ওদের মৌচাকটা ভেঙ্গে দিয়ে আসবে।’
বলল – ‘আমার ষোলোটা ছেলেমেয়ে বাড়িতে ঘুমাচ্ছে। তারা এখনও খুব ছোট। হাঁটতে শুরু করার আগে তাদের আরো পনেরো দিন ঘুমানোর দরকার। তোমরা সবসময় এরকম বিশ্রী কানফাটানো আওয়াজ করলে তারা ঘুমাবে কি করে? গতকাল তোমার বাড়ির লোকজন তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে সারাদিন এখানে ছিল আর ভীষন কোলাহল করেছে। আজ আবার তুমি এসেছ বিরক্ত করতে। এই ভয়ানক আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে আমার কোন ছেলেমেয়ে যদি মারা যায় তাহলে আমি গিয়ে তোমাদের গোটা বাড়ি ভেঙ্গে তছনছ করে দেব। তোমাদের কোথাও থাকার জায়গা থাকবে না তখন। তোমরা কি জানো যে এই গাছটা আমার নিজের। আমার মালিক কুড়ি বছর আগে আমাদের জন্যে এই গাছটা লাগিয়েছিল, যাতে এর ফল খেয়ে আমরা বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু প্রত্যেক বছর যখনই এই গাছে ফুল ফোটে তখনই তোমরা দল বেঁধে আস আর সব মধু চুরি করে খেয়ে চলে যাও। তার ওপর সারাক্ষন বিদ্ঘুটে শব্দ করে আমাদের বিরক্ত করো। এক্ষুনি যদি তোমরা এখান থেকে বিদায় না হও তো আমি আমার মালিক আর আমার বাড়ির অন্যান্য লোকজনদের ডাকবো।’
তখন রানী মৌমাছি বলল – ‘তোমরা ধূলো আর নোংরা থেকে জন্মেছ। তোমার কোন মালিক নেই। বাড়িতে অন্য কোন লোকজনও নেই। কোন কালে তোমার পূর্বপুরুষরা সবাই মারা গেছে। তাও কোন মানুষ গ্রাহ্য করনি। কারন এই বিশাল পৃথিবীতে তোমরা কারো কাজে লাগ না। কিন্তু আমরা হলাম মৌমাছি। আমাদের তৈরী মধু খেয়ে মানুষরা ভালো থাকে, শরীরে বল পায়, সাস্থ্য ভালো হয়। মধু ওষুধের থেকেও উপকারী। মৌমাছিরা সারা পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। সমগ্র মানবজাতি আমাদের ভালোবাসে। তাই আমাদের জন্যে তারা ফুল গাছ লাগায়। তোমরা কি মনে করো তোমরা মানুষের থেকেও উঁচু দরের কোন প্রানী?
একটা গল্প বলি শোন। একদিন একটা দুষ্টু ছেলে আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে দিতে এসেছিল। কিন্তু তার মা তাকে বলল – তুমি অনেক কিছু ভেঙ্গে নষ্ট করো। কিন্তু খবরদার মৌমাছির বাসায় হাত দিও না। ওরা সারাদিন কত পরিশ্রম করে আমাদের জন্যে মধু সংগ্রহ করে। কোন রানী মৌমাছিকে যদি তুমি মেরে ফেল তাহলে তার সব ছেলেমেয়েরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। তখন শীতকালে আমরা রুটি দিয়ে খাওয়ার মতো একটুও মধু পাবো না। তখন ছেলেটা মায়ের কথা শুনে এখান থেকে চলে গেল। সে পাখি ধরতে পারে, মাছ ধরতে পারে, ফুল ছিঁড়তে পারে, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু আমাদেরকে কক্ষনো বিরক্ত করবে না কারন আমরা খুব উপকারী প্রানী। তোমরা কী? তোমরা সারাদিন শুধু শম্বুক গতিতে চলাফেরা করো, কারো কোন কাজে লাগো না। ’
মা শামুক এই শুনে খুব রেগে গেল। সে বাড়িতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের বলল – ‘শোন সবাই। মৌমাছিরা আমাদের শত্রু। পনেরো দিন পরে তোমরা হাঁটতে শিখে যাবে। তখন তোমাদের মধ্যে পাঁচজন মৌমাছিদের বাড়ি গিয়ে ওদের মৌচাকটা ভেঙ্গে দিয়ে আসবে।’
২
দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল। মা শামুকের ছেলেমেয়েরা হাঁটতে শিখে গেল। তখন তাদের মধ্যে পাঁচজন শামুক মৌচাক ভাঙ্গা অভিযানে বেরলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা যখন মৌচাকের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন ঘরে কোন মৌমাছি ছিল না। সব মৌমাছি মধু সংগ্রহে বেরিয়েছে। তাই দেখে শামুকরা ভারি খুশি হল। বলল – ‘চলো আমরা এখন যত পারি মধু খাই।’ সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত তারা মধু খেয়েই চলল। এপাশে সন্ধ্যে হতেই সব মৌমাছিরা দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে বাজনা বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরে এলো। এসেই ঐ পাঁচটা শামুককে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হল তারা।
রানী মৌমাছি বলল – ‘তোমরা এখানে কেন এসেছ? আর কেনই বা আমাদের সব মধু খেয়ে নিচ্ছ? এটা তোমাদের বাড়ি নয় আর এই মধুও তোমাদের খাবার নয়। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তোমাদের বাড়ি ফিরে যেতে অসুবিধে হতে পারে। তাই আজকের রাত্রিটা আমি তোমাদের এখানে থাকতে দিতে পারি। কিন্তু তোমাদের কথা দিতে হবে যে ছোট্ট মৌমাছিদের তোমরা কোন ক্ষতি করবে না। ’
পাঁচটা শামুকের মধ্যে যে সব থেকে বড় ছিল সে হেসে উত্তর দিল – ‘তোমাদের মধুটা খেতে খুব ভালো। আমরা সপরিবারে এখানে চলে এসেছি। শুধু একটা বা দুটো রাত নয়। আমরা এখন থেকে বরাবরের জন্যে এখানেই থাকব। আর যতদিন না সব মধু শেষ হয়ে যায় ততদিন আমরা এই মধুই খেয়ে যাব।’
রানী মৌমাছি বলল – ‘শুধু একটা রাত্রি আমি তোমাদের থাকতে দিতে পারি। কোনভাবেই সারাজীবন তোমরা এখানে বসবাস করতে পারনা। তাছাড়া তোমরা কোন ভালো কাজ করেও আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। এখন তো তোমাদের একটা রাত্রি এখানে থাকতে দিতেও আমার চিন্তা হচ্ছে। যখন আমরা ঘুমাবো তখন হয়তো মৌচাকের সব মধু তোমরা খেয়ে শেষ করে ফেলবে বা আমার ছেলেমেয়েদের মেরে ফেলবে।’
চিন্তিত মুখে রানী মৌমাছি ওখান থেকে চলে গেল। তারপর বৃদ্ধ জ্ঞানী মৌমাছিদের ডেকে বলল – ‘আজ রাত্রে তোমরা ঘুমিয়ো না। আমি ঐ শামুকগুলোকে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
পরদিন সকালে জ্ঞানী মৌমাছিরা রানী মৌমাছিকে এসে জানালো – ‘মোট পঁয়ত্রিশটা শিশু মৌমাছি কাল রাত্রে মারা গেছে। শামুকগুলো আমাদের সব ঘরে ঢুকে সারা রাত ঘুরে বেড়িয়েছে। সব মধুতে মুখের নোংরা লাগিয়ে দিয়েছে। সব মধু বিষাক্ত করে দিয়েছে। এই বিষাক্ত মধু খেলে মানুষরা ও মারা যেতে পারে। মহামান্য রানী, আমাদের উচিত এক্ষুনি ওদেরকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া।’
রানী মৌমাছি বলল – ‘আমরা আর একদিন দেখবো। এর মধ্যে ওরা স্বেচ্ছায় চলে না গেলে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।’
তারপর রানী মৌমাছি গেল শামুকদের সঙ্গে কথা বলতে।
- ‘বন্ধুগন, তোমাদের বেশ সাস্থ্যবান দেখাচ্ছে। আমি জানি তোমরা এখানে বেশ মনের আনন্দে রয়েছ। এখানকার মধুও তোমাদের খুব সুস্বাদু লেগেছে। কিন্তু তোমরা আমাদের ঘরে থাকা শিশু মৌমাছিদের মেরে ফেললে কেন? আর কেনই বা আমাদের সব মধু নষ্ট করে দিয়েছ?’
শামুকরা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
- ‘আমার মনে হয় আমি জানি কেন এটা করেছ তোমরা। আমার বিশ্বাস তোমরা আমাদের শত্রু। কিছুদিন আগে এক মা শামুকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল যে আমাদের খুব বকাঝকা করেছিল। সে নিশ্চয় তোমাদের মা। সে যাই হোক। আমি এখন যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। কাল দুপুরের মধ্যে যদি তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে না চলে যাও তাহলে তোমরা সবাই এখানেই মারা যাবে।’
দুষ্টু ও অহংকারী শামুকের দল তাচ্ছিল্যের সুরে বলল – ‘তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করো। আমরা এখানেই থাকবো। আমরা স্বাধীন। আমাদের যেখানে ইচ্ছে করে সেখানে যাবো, যা ভালো লাগবে তাই খাবো। এখন আমাদের এই মৌচাকের মধু খেতে ভালো লাগছে, তাই আমাদের ইচ্ছে হলে সব মধু আমরা খেয়ে শেষ করে দেব। মোটকথা আমরা এখান থেকে নড়ব না। এখানেই থাকব। দেখি তোমরা কী করতে পারো। ’
দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল। মা শামুকের ছেলেমেয়েরা হাঁটতে শিখে গেল। তখন তাদের মধ্যে পাঁচজন শামুক মৌচাক ভাঙ্গা অভিযানে বেরলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা যখন মৌচাকের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন ঘরে কোন মৌমাছি ছিল না। সব মৌমাছি মধু সংগ্রহে বেরিয়েছে। তাই দেখে শামুকরা ভারি খুশি হল। বলল – ‘চলো আমরা এখন যত পারি মধু খাই।’ সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত তারা মধু খেয়েই চলল। এপাশে সন্ধ্যে হতেই সব মৌমাছিরা দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে বাজনা বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরে এলো। এসেই ঐ পাঁচটা শামুককে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হল তারা।
রানী মৌমাছি বলল – ‘তোমরা এখানে কেন এসেছ? আর কেনই বা আমাদের সব মধু খেয়ে নিচ্ছ? এটা তোমাদের বাড়ি নয় আর এই মধুও তোমাদের খাবার নয়। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তোমাদের বাড়ি ফিরে যেতে অসুবিধে হতে পারে। তাই আজকের রাত্রিটা আমি তোমাদের এখানে থাকতে দিতে পারি। কিন্তু তোমাদের কথা দিতে হবে যে ছোট্ট মৌমাছিদের তোমরা কোন ক্ষতি করবে না। ’
পাঁচটা শামুকের মধ্যে যে সব থেকে বড় ছিল সে হেসে উত্তর দিল – ‘তোমাদের মধুটা খেতে খুব ভালো। আমরা সপরিবারে এখানে চলে এসেছি। শুধু একটা বা দুটো রাত নয়। আমরা এখন থেকে বরাবরের জন্যে এখানেই থাকব। আর যতদিন না সব মধু শেষ হয়ে যায় ততদিন আমরা এই মধুই খেয়ে যাব।’
রানী মৌমাছি বলল – ‘শুধু একটা রাত্রি আমি তোমাদের থাকতে দিতে পারি। কোনভাবেই সারাজীবন তোমরা এখানে বসবাস করতে পারনা। তাছাড়া তোমরা কোন ভালো কাজ করেও আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। এখন তো তোমাদের একটা রাত্রি এখানে থাকতে দিতেও আমার চিন্তা হচ্ছে। যখন আমরা ঘুমাবো তখন হয়তো মৌচাকের সব মধু তোমরা খেয়ে শেষ করে ফেলবে বা আমার ছেলেমেয়েদের মেরে ফেলবে।’
চিন্তিত মুখে রানী মৌমাছি ওখান থেকে চলে গেল। তারপর বৃদ্ধ জ্ঞানী মৌমাছিদের ডেকে বলল – ‘আজ রাত্রে তোমরা ঘুমিয়ো না। আমি ঐ শামুকগুলোকে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
পরদিন সকালে জ্ঞানী মৌমাছিরা রানী মৌমাছিকে এসে জানালো – ‘মোট পঁয়ত্রিশটা শিশু মৌমাছি কাল রাত্রে মারা গেছে। শামুকগুলো আমাদের সব ঘরে ঢুকে সারা রাত ঘুরে বেড়িয়েছে। সব মধুতে মুখের নোংরা লাগিয়ে দিয়েছে। সব মধু বিষাক্ত করে দিয়েছে। এই বিষাক্ত মধু খেলে মানুষরা ও মারা যেতে পারে। মহামান্য রানী, আমাদের উচিত এক্ষুনি ওদেরকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া।’
রানী মৌমাছি বলল – ‘আমরা আর একদিন দেখবো। এর মধ্যে ওরা স্বেচ্ছায় চলে না গেলে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।’
তারপর রানী মৌমাছি গেল শামুকদের সঙ্গে কথা বলতে।
- ‘বন্ধুগন, তোমাদের বেশ সাস্থ্যবান দেখাচ্ছে। আমি জানি তোমরা এখানে বেশ মনের আনন্দে রয়েছ। এখানকার মধুও তোমাদের খুব সুস্বাদু লেগেছে। কিন্তু তোমরা আমাদের ঘরে থাকা শিশু মৌমাছিদের মেরে ফেললে কেন? আর কেনই বা আমাদের সব মধু নষ্ট করে দিয়েছ?’
শামুকরা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
- ‘আমার মনে হয় আমি জানি কেন এটা করেছ তোমরা। আমার বিশ্বাস তোমরা আমাদের শত্রু। কিছুদিন আগে এক মা শামুকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল যে আমাদের খুব বকাঝকা করেছিল। সে নিশ্চয় তোমাদের মা। সে যাই হোক। আমি এখন যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। কাল দুপুরের মধ্যে যদি তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে না চলে যাও তাহলে তোমরা সবাই এখানেই মারা যাবে।’
দুষ্টু ও অহংকারী শামুকের দল তাচ্ছিল্যের সুরে বলল – ‘তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করো। আমরা এখানেই থাকবো। আমরা স্বাধীন। আমাদের যেখানে ইচ্ছে করে সেখানে যাবো, যা ভালো লাগবে তাই খাবো। এখন আমাদের এই মৌচাকের মধু খেতে ভালো লাগছে, তাই আমাদের ইচ্ছে হলে সব মধু আমরা খেয়ে শেষ করে দেব। মোটকথা আমরা এখান থেকে নড়ব না। এখানেই থাকব। দেখি তোমরা কী করতে পারো। ’
তখন রানী মৌমাছি খুব গম্ভীর হয়ে গেল। সে তার সেনাবাহিনীকে ডেকে পাঠালো। তাদের বলল – ‘তোমরা সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। কাল দুপুর পর্যন্ত সব মোম প্রস্তুত করে রাখো। তরবারিতে ধার দিয়ে তৈরী থাকো যুদ্ধের জন্যে।’
সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। হুলই তাদের তরবারি। হাজার হাজার সেনা মৌমাছি তাদের হূল শানিয়ে অপেক্ষা করে রইল।
পরদিন দুপুর বেলা শামুকরা কেউ মৌচাক ছেড়ে গেলনা। তাই দেখে রানী মৌমাছি যুদ্ধ শুরুর আদেশ দিল। ‘সবাই রন হুংকার দিতে শুরু করো। দরকার পড়লে হুল ফুটিয়ে শামুকদের মেরে ফেলবে।’
আদেশ পেয়েই সেনা মৌমাছিরা ভয়ংকর জোরে ভোঁভোঁ আওয়াজ করে রন হুঙ্কার দিতে শুরু করল। শামুকরা সেই আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে যে যার নিজেদের খোলের মধ্যে গুটিয়ে ঢুকে গেল।
তখন রানী আদেশ দিল – ‘মোম আনো জলদি।’
কিছু সেনা মৌমাছি আওয়াজ করে ওদের ভয় দেখিয়ে চলল। আর কিছু মৌমাছি মোম নিয়ে এসে ওদের মুখের কাছে ঢেলে দিয়ে মুখটা পুরো বন্ধ করে দিলো। দু ঘন্টার মধ্যে শামুক গুলোর এমন অবস্থা হল যে তারা না পারল একটুও নড়াচড়া করতে, না পারল নিঃশ্বাস নিতে।
তখন রানী মৌমাছি সব শামুকদের উদ্দেশ্যে বলল – ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে তোমরা আমাদের বন্ধু। তাই তোমাদের রাত্রে থাকতে দিয়েছিলাম, পেট ভরে মধু খেতে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা ভেবেছ ভগবান এই গোটা পৃথিবীটা শুধু তোমাদের একার জন্যেই বানিয়েছেন। তোমরা ছাড়া আর কেউ সেখানে থাকতে পারবে না। তোমাদের এতো নীচু মন। তোমরা যদি এরকম ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রানী না হয়ে কোন পাখি বা জন্তুর মতো বড় ও শক্তিশালী প্রানী হতে তাহলে এই পৃথিবীতে আর অন্য কোন প্রানীরই স্থান হত না। এত করে বলা স্বত্ত্বেও এখান থেকে চলে যেতে রাজী হলে না, এখন এখানেই মরো। এটাই তোমাদের যোগ্য শাস্তি।’
তারপর রানী সব মৌমাছিদের নিয়ে আবার একটা নতুন মৌচাক তৈরী করল ও সেখানেই বসবাস করতে থাকল।
একদিন মৌমাছিদের মালিক এলো মধু নিতে। সে দেখল মৌচাকে কোন মৌমাছি নেই, শুধু পাঁচটা মরা শামুক পড়ে আছে। মালিক সববুঝতে পারল। বলল – ‘এই মৌচাকের মধু বিষাক্ত। এটা কে ভালো করে পরিস্কার করতে হবে।’ এই বলে সে সব বিষাক্ত মধু আর মরা শামুকদের মাটিতে ফেলে দিলো।
মৌমাছিরা বহাল তবিয়তে সুখে শান্তিতে বেঁচে রইল ও মানুষের উপকার করতে থাকল।
( নীতি বাক্য - গর্বিত ও স্বার্থপররা সব কিছু নিজেরা ভোগ করতে চায়, কিন্তু তারা কিছুই পাওয়ার উপযুক্ত নয়।)
সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। হুলই তাদের তরবারি। হাজার হাজার সেনা মৌমাছি তাদের হূল শানিয়ে অপেক্ষা করে রইল।
পরদিন দুপুর বেলা শামুকরা কেউ মৌচাক ছেড়ে গেলনা। তাই দেখে রানী মৌমাছি যুদ্ধ শুরুর আদেশ দিল। ‘সবাই রন হুংকার দিতে শুরু করো। দরকার পড়লে হুল ফুটিয়ে শামুকদের মেরে ফেলবে।’
আদেশ পেয়েই সেনা মৌমাছিরা ভয়ংকর জোরে ভোঁভোঁ আওয়াজ করে রন হুঙ্কার দিতে শুরু করল। শামুকরা সেই আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে যে যার নিজেদের খোলের মধ্যে গুটিয়ে ঢুকে গেল।
তখন রানী আদেশ দিল – ‘মোম আনো জলদি।’
কিছু সেনা মৌমাছি আওয়াজ করে ওদের ভয় দেখিয়ে চলল। আর কিছু মৌমাছি মোম নিয়ে এসে ওদের মুখের কাছে ঢেলে দিয়ে মুখটা পুরো বন্ধ করে দিলো। দু ঘন্টার মধ্যে শামুক গুলোর এমন অবস্থা হল যে তারা না পারল একটুও নড়াচড়া করতে, না পারল নিঃশ্বাস নিতে।
তখন রানী মৌমাছি সব শামুকদের উদ্দেশ্যে বলল – ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে তোমরা আমাদের বন্ধু। তাই তোমাদের রাত্রে থাকতে দিয়েছিলাম, পেট ভরে মধু খেতে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা ভেবেছ ভগবান এই গোটা পৃথিবীটা শুধু তোমাদের একার জন্যেই বানিয়েছেন। তোমরা ছাড়া আর কেউ সেখানে থাকতে পারবে না। তোমাদের এতো নীচু মন। তোমরা যদি এরকম ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রানী না হয়ে কোন পাখি বা জন্তুর মতো বড় ও শক্তিশালী প্রানী হতে তাহলে এই পৃথিবীতে আর অন্য কোন প্রানীরই স্থান হত না। এত করে বলা স্বত্ত্বেও এখান থেকে চলে যেতে রাজী হলে না, এখন এখানেই মরো। এটাই তোমাদের যোগ্য শাস্তি।’
তারপর রানী সব মৌমাছিদের নিয়ে আবার একটা নতুন মৌচাক তৈরী করল ও সেখানেই বসবাস করতে থাকল।
একদিন মৌমাছিদের মালিক এলো মধু নিতে। সে দেখল মৌচাকে কোন মৌমাছি নেই, শুধু পাঁচটা মরা শামুক পড়ে আছে। মালিক সববুঝতে পারল। বলল – ‘এই মৌচাকের মধু বিষাক্ত। এটা কে ভালো করে পরিস্কার করতে হবে।’ এই বলে সে সব বিষাক্ত মধু আর মরা শামুকদের মাটিতে ফেলে দিলো।
মৌমাছিরা বহাল তবিয়তে সুখে শান্তিতে বেঁচে রইল ও মানুষের উপকার করতে থাকল।
( নীতি বাক্য - গর্বিত ও স্বার্থপররা সব কিছু নিজেরা ভোগ করতে চায়, কিন্তু তারা কিছুই পাওয়ার উপযুক্ত নয়।)
(চীনা লোক কথা / নীতি কথা)
অনুবাদঃ
রুচিরা
বেইজিং,চীন
অনুবাদঃ
রুচিরা
বেইজিং,চীন
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
আবিষ্কার
১
' টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ '
মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। যাচ্ছি না ইচ্ছে করেই, মনে হচ্ছে এই বার না গেলে মার খাব। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলাম।
'একি অবস্থা করেছিস তুই?'
আমি নিজের দিকে তাকালাম। লাল হাফ প্যান্ট আর সবুজ গেঞ্জিতে মাটি মেখে একাকার। পায়ের মাটি তাজা। ঘরের মেছেতে ছোপছোপ দাগ। হাতের মাটি শুকিয়ে খড়খড় করছে।
'এই মাত্র পরিষ্কার জামাকাপড় পরে খেলতে গেলি, আর এর মধ্যে এত মাটি কোথা থেকে এল?'
'বাগান করছিলাম।'
'বাগান করছিলি? এই কি তার নমুনা? বাগান করলে এ রকম হয় কখনো? ঠিকঠিক বল কি করছিলি?
মাকে বলা যাবে না ঠিক কি করছিলাম। চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। ক'দিন আগে পিন্টুদের বাড়ি গিয়ে ছিলাম। ওদের দোতালায় একটা ঘর পুরোপুরি হতে এখন বাকি। তার মেঝেতে বালি ছিল এক ঢিপি। বালিটা বৃষ্টিতে ভিজে গেচ্ছিল। তার থেকে পিন্টু একটা বালির শহর করেছিল, মিশরের মত। নাম দিয়েছিল মিশর সভ্যতা। আমি ভুল করে পা রেখে দিয়েছিলাম আর ভেঙে যায় কিছুটা। ও তারপরে আর ঐ জায়গাটা ঠিক করে উঠতে পারেনি। আমার ওপরে খুব রেগে গিয়েছিল। কয়েকদিন তো কথাই বলেনি। তখন আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে ওকে আমি মিশর সভ্যতা নতুন করে বানিয়ে দেবো।
'কিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বল কি করেছিলি?'
' আমি মিশর সভ্যতা করার চেষ্টা করছিলাম।'
'মিশর সভ্যতা, বাগানে?'
' হ্যাঁ ; পিন্টু করেছিল আগে, ওদের বাড়িতে। আমাকে বলেছিল যে বালি ভিজিয়ে নাকি মিশর সভ্যতার মত শহর করা যায়।'
' তারপর?'
'আমাদের বাড়ির বাগানের কোনে যে বালির ঢিপিটা আছে তার ওপর জল ঢেলে ভেজানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ভিজছে না। কোথায় যেন চলে যাচ্ছে সব জল। আঠের বালতি জল ঢালার পর দেখি একটুও ভেজেনি। ভাবছিলাম কি করব। তখন তুমি ডাকলে।''
'ওফফ, তোকে নিয়ে আর পারি না। বালি কি কখন ওরকম করে ভেজে নাকি? কিন্তু জল, জল কোথা থেকে নিলি? এই রে সর্বনাশ, ড্রামের জল শেষ করেছিস নাকি?'
'না, না, কল থেকে বালতি করে নিয়ে গেছি।'
'বাঁচালি। বা, বাহ।' মা যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। 'দূর বোকা তুইও যেমন, বালি কি ওরকম করে ভেজান যায় নাকি?। যা যা, বাথরুম গিয়ে সব ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে করে আয়। অনেক খেলা হয়েছে তোর আজকের মত। এবার পড়তে বোস।'
কি আর করা। হাত মুখ ধুয়ে, পরিষ্কার করে পড়তে বসতে হল। কিন্তু আজ পড়ায় মন বসছে না। পিন্টুর সাথে শিগগিরি এই নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
২
'বুঝলি পিন্টু, মিশর সভ্যতা আর হল না।'
'হুমম'
ও কিছু বলল না। আমরা দুজন ফুটবল খেলার শেষে মাঠের এক কোনে বসে আছি। খেলার শেষে রোজই থাকি কিছুক্ষন। তবে খেলা যদি জমে যায় বা দু-চারটে গোল হয়, তাহলে অন্যরাও থাকে।
আজকে খেলা জমেনি। এমনিতেই ফুটবলটা আমার চেয়ে ও খেলে ভাল। তার ওপর আজকে আমি খেলেছি খুবই বাজে, একটা গোল তো আমার জন্যই খেয়েছি। ও খেলার জন্য চুপ করে রয়েছে না মিশর সভ্যতার জন্য সেটা ঠিক বুঝলাম না।
'আমি সেদিন বাড়িতে অত চেষ্টা করলাম, হলই না'। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে।''
ও আমার দিকে ফিরে বলল, 'তবে আমরা ইট দিয়ে চেষ্টা করতে পারি'
'ইট না হয় কয়েকটা জোগাড় করে নেব। কিন্তু গাঁথব কি দিয়ে? সিমেন্ট তো আর আমরা পাবনা, আর কেউ দেবেও না। ''
'হুমম', এই বলে ও গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়ল। ''তার মানে এই খেলাটা আর তেমন জমবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।'
'আচ্ছা, আমরা আবিষ্কারক হলে কেমন হয়? আমি কয়েকদিন ধরে প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পের বই পড়ছি। তাই থেকে এই আইডিয়াটা পেয়েছি, বুঝলি উনি না অনেক কিছু আবিষ্কার করেন, সারা পৃথিবী জোড়া নামডাক-'
'আমি তেমন পড়িনি, তা কি কি আবিষ্কার করেন বল দেখি?'
পিন্টু চিরকালই গল্পের বই পড়ে কম। এ ব্যাপারে ওর মাস্টার হচ্ছি আমি। বেশ উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলাম। কারন ইতিমধ্যে আমি মনে মনে প্রোফেসর শঙ্কুর বিরাট বড় ভক্ত হয়ে উঠেছি। 'ও বাবা, সে অনেক কিছু। রোবট তৈরী করেন। অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ, বন্দুক পিস্তল, মহাকাশযান কত কি।''
'বাহ ভাল তো, কিন্তু আমরা কি আবিষ্কার করব?'
'করব, কিন্তু তার আগে আমাদের একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে হবে। বড় বড় বিজ্ঞানীরা সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে। আমাদের ও সবকিছু নিজেদেরই জোগাড় করে নিতে হবে।'
'ঠিক আছে, কিন্তু কিভাবে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না।'
'আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা আগে একটা লিস্ট করে নেব কি কি লাগবে আর কি কি আমাদের আছে। তারপরে একটা নোটবই করতে হবে, আর সবকিছু লিখে রাখতে হবে। প্রোফেসর শঙ্কুও সব লিখে রাখেন।'
সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। আমরা উঠে পড়লাম। নতুন কোন উদ্যোগ নিলে ফূর্তির আর সীমা থাকে না। আজকেও আমরা বেশ লাফাতে লাফাতেই বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ল্যাবরেটরির ফর্দটা করে নিতে হবে। আর কোথায় ল্যাবরেটরি হবে সেটাও ঠিক করে নিতে হবে।
৩
কয়েকদিন পরে দেখা গেল বেশীরভাগ জিনিসই জোগাড় করা যাচ্ছে না। আমাদের ল্যাবরেটরির ব্যাপারটাকে বড়রা তেমন পাত্তাও দিল না কেউ। নিদেন পক্ষে দাদা-দিদিরাও না। লিস্টের থেকে অনেক কিছুই বাদ গেল। যে আগুন ছাড়া প্রায় কোন কিছুই আবিষ্কার প্রায় অসম্ভব, সেই দেশলাইটাই পাওয়া গেলনা। শেষমেশ লিস্টটা দাঁড়াল এইরকম।
(১) আতশ কাঁচ - আছে, এবং দুটো। আমাকে বাবা একটা মেলা থেকে কিনে দিয়েছিল। সবুজ রঙের। আর পিন্টুরটা কালো আর বড়। ওটা বেশ পুরনো।
(২) চুম্বক - আছে, কিন্তু এটা আমার কাছে নেই আছে ওর কাছে। ওদের বাড়িতে কিছুদিন আগে একটা পুরনো রেডিও খারাপ হয়ে গেছিল। পিন্টু ওর দাদার কাছ থেকে শুনে স্পীকার ভেঙে চুম্বক জোগাড় করেছে। আমি শুনেছিলাম চুম্বককে ঝুলিয়ে দিলে নাকি উত্তর-দক্ষিন দিকে মুখ করে থাকে। এটা থেকে অবশ্য তেমন বোঝার উপায় নেই। কারন এটা গোল, কোনটা উত্তর, কোনটা দক্ষিন বোঝার উপায় নেই। তবে অসুবিধে নেই। শুনেছি চুম্বক নাকি তৈরী করে নেওয়া যায়।
(৩) কাঁচি - মার একটা পুরনো কাঁচি আমাকে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাই দিয়ে কাগজ দিব্যি কাটা যাচ্ছে।
(৪) ছিপ - এটা জানি না বিজ্ঞানের কোন কাজে লাগবে। তবে পিন্টুদের বাড়ি নাকি কোন কালে একটা খুব ভাল ছিপ ছিল। ও সেই ছিপের হুইল'টা ল্যাবরেটরির জন্য খুলে নিয়ে এসেছে।
(৫) নোটবই - এটা বাবা আমাকে দিয়েছে। সব লেখা থাকবে এখানে।
আমরা বসেছিলাম আমাদের এক গোপন আস্তানায়। এটা নতুন। আমাদের গোপন ঘাঁটি কিছুদিন পরে পরেই জানাজানি হয়ে যায়। তখন আমরা আবার নতুন ঘাঁটি খুঁজে নিই। আমাদের আগের জায়গাটা দিব্যি ছিল। কেউ জানতেও পারেনি। কিন্তু সেখানে হঠাৎ এক বোলতার চাক হয়েছে বলে আমরা একটু খোলামেলা জায়গায় এসেছি এবার। আমাদের পাড়ায় একটা বাড়ি তৈরী হচ্ছিল কিন্তু কোন কারনে অর্ধেক হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ছাদ ঢালাই হয়েছে, মেঝে হয়নি। ইটগুলো দাঁত বার করে বসে আছে। আমি কাগজ কেটে একটু অন্য ধরনের এরোপ্লেন বানান যায় কিনা সেই চেষ্টা করছিলাম। আমি দুরকম জানি। একটা খুব সহজে তৈরী করা যায়, সেটা হচ্ছে জেট। আর অন্যটা একটু শক্ত, তবে ওড়ে বেশ।
পিন্টু আতশ কাঁচ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ও নাকি শুনেছে যে ঐ কাঁচ দিয়ে নাকি আগুন ধরান যায়। কি জানি কি করে। মনে হয় সেই চেষ্টাই করছিল। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল।
'কি রে কি হল?'
'আইডিয়া, মাটি খুড়লে কেমন হয়?'
'মাটি? কেন?'
পিন্টু অধৈর্যের মত ছটফট করে বলল, ''ওফফ তুই কিচ্ছু বুঝিস না। মাটি খুঁড়েও তো কত কিছু আবিষ্কার করা যেতে পারে। আগে কত লোক গুপ্তধন পেয়েছে মাটি খুঁড়ে। প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে মাটি খুঁড়েই। পুরনো দিনের কত কিছু। আমরাও তো কিছু একটা পেয়ে যেতে পারি'
যেমন কথা তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে আমরা খালি হাতেই মাটি খুঁড়তে লেগে গেলাম। আমাদের গোপন আস্তানা যে বাড়িতে তার মেঝেতেই। খুঁড়ে চলেছি, জামাকাপড়ের কি অবস্থা সেদিকে হুঁস নেই। কতক্ষন কেটে গেছে খেয়াল নেই এমন সময় আমার হাতে উঠে এল একটা হাড়। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। 'পাওয়া গেছে!!!'
পিন্টুও ছুটে এসে একরকম আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েই দেখতে শুরু করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,''হ্যাঁ রে, এখানে তো কেউ আগে কখনো থাকতো না, কিসের হাড় হবে বলে তোর মনে হয়।'
'আমার তো মনে হচ্ছে এটা কোন লুপ্ত প্রানীর হাড় হবে। ডাইনোসর হতে পারে। চল ভাল করে খুঁজি। আমার মনে হয় আরো পাওয়া যেতে পারে। তারপরে আমরা ডাক্তারজেঠুকে দেখিয়ে নেব-'
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে আর কোন সন্দেহ হইল না এটা কোন ডাইনোসরের হাড়। কারন আরো বেশ কিছু হাড় পাওয়া গেল। আমরা আনন্দে নাচানাচি শুরু করেদিলাম। ঠিক হল আমাদের নামে তার নাম দেওয়া হবে - টুবলুসরাস রেক্স বা পিন্টুসরাস রেক্স।
৪
আমরা আবার মাঠের কোনে বসে আছি। দুজনে দুজনের দিকে পিঠ দিয়ে। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।
ময়লা জামাকাপড়েই ছুটেছিলাম ডাক্তারজেঠুর বাড়ি। জেঠু চা খাচ্ছিলেন। আর আমরা টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রেখেছিলাম হাড়্গুলো। আমাদের অনেক পরিশ্রমের ফসল। বুক ঢিপঢিপ করছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিখ্যাত হয়ে যাব। এমন সময় জেঠু এসে হাড়্গুলো একবার দেখেই আমাদের দিকে গম্ভীরভাবে তাকালেন। 'এগুলো আমার টেবিলের ওপরে রাখতে কে বলেছে?'
'না, মানে কেউ বলেনি,আসলে আমরা একটু আগেই এই ডাইনোসরটাকে আবিষ্কার করেছি। এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে পেয়েছি এইসব হাড়।' আমতা আমরা করে বললাম।
'ডাইনোসরের হাড় না ঘোড়াড্ডিম। এগুলো কুকুরের হাড়। কোত্থেকে ময়লা ঘেঁটে আমার ডেস্কটা নোংরা করলি। তোদের নিয়ে আর পারি না। যা শিগগির ফেলে দে, আর বাড়ি গিয়ে ডেটল দিয়ে ভাল করে চান করবি। আমার কথা মনে থাকে যেন।'
হাড়্গুলো ফেলেদিয়ে এসে অবধি আমরা এইভাবে বসে আছি।
শেষে পিন্টুই মুখ খুলল,''আবিষ্কার করা মনে হয় আমাদের দ্বারা আর হল না'
'হুমম-'
'আমি ভাবছিলাম এর চেয়ে বরং গোয়েন্দা হওয়া যাক।'
'ঠিক বলেছিস', আমি হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বললাম।
অভ্র পাল
কারডিফ, ওয়েলস্ , যুক্ত্রারাষ্ট্র
অলংকরনঃ
কৌস্তুভ রায়
আহমেদাবাদ, গুজরাত
কৌস্তুভ রায়
আহমেদাবাদ, গুজরাত
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
সরল ও হাতি
সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে দিতে চায় নি, ক্ষেতের কাজে সরল আজকাল বেশ পোক্ত হয়েছে যে। কিন্তু পঞ্চায়েত থেকে বলেছে সব ছেলেমেয়েকে ইশকুলে পাঠাতেই হবে। ইশকুলের মাইনে, বইখাতা সব নাকি গরমেন্ট দেবে । দুপুর হলে পেট ভরে খিচুড়ি খেতেও দেবে । সেই শুনে বাবু রাজি হয়েছে । এমনিতে তো সরল সেই ছোট্ট থেকে সকাল হলেই বাবুর সঙ্গে আর দাদাদের সঙ্গে ক্ষেতের কাজ করতে যায় । দুপুরে একবার বাড়ি এসে বাবুর জন্যে, দাদাদের জন্যে ভাত নিয়ে যায় । ক্ষেতের কাজে ভারি মজা । শুকনো মাটিতে নিড়ানি দাও, শুকনো পাতা মাথায় করে ফেলে এসো, ঝারি করে জল নিয়ে গাছকে চান করিয়ে দাও । দু’সন ভালো ধান হয় নি । সে নিয়ে গাঁয়ের সবাই খুব ভাবনা করেছিল । এবছর ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তাই এমনিও বাবুর মেজাজ ভালো আছে । প্রথমে রাজি না হলেও সব শুনে টুনে বলল, ‘আচ্ছা, সরল ক’বছর ইশকুলে যাক না হয় । একজনের একবেলার খাওয়াটাও হবে ।‘
গরমেন্ট কে সরল জানে না । কিন্তু মনে মনে গরমেন্টকে প্রণাম করেছে সরল । গরমেন্ট নিশ্চয় একজন খুব ভালো লোক । তাই তো সরলের ইশকুলে যাবার সাধ মিটল ।
মাঝিপাড়ার পবন, গুলু, সোরেন আগেই ইশকুলে যাওয়া শুরু করেছে । সরলদের পাড়া থেকে সরল আর গণেশ ওদের সঙ্গেই চলে যাবে, বাবু বলে দিল । জেলেপাড়া নামোপাড়া থেকেও ক’জন ছেলে আছে । আট-দশজনের একটা দল । ইশকুল অনেক দূর । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আট দশ মাইল গেলে পাকা সড়ক । হাইওয়ে বলে সড়কটাকে, এখন জানে সরল । সেই হাইওয়ে ধরে আরো দু’মাইল প্রায় । তারপর দূর থেকে ইশকুল বাড়ি দেখা যায় ।
ইশকুলটা একটা ছোট পাহাড়ের ওপর । পাহাড়ের ঢালুতে একটা মস্ত জারুল গাছ । তার ঠিক পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, একেবারে ইশকুলের ফটক পর্যন্ত । ফটকের পাশে খেলার মাঠ, তার ওপর বালি ছড়ানো । আর ফটক দিয়ে ঢুকলেই ফুলের বাগান । লাল নীল হলুদ বেগুনী ফুলে ঝলমলে বাগানটায় ঢুকলেই সরলের মন ভালো হয়ে যায় ।
যাওয়ার গোটা পথটা মন ভালো করা । জঙ্গলের মধ্যে রোদ ঢোকে না, ছায়া ছায়া রাস্তা ধরে দৌড়ে দৌড়ে যায় সবাই মিলে । হলুদ সবুজ কত প্রজাপতি, বনের গাছে গাছে কত পাখির ডাক । গাছের পাতায় নানারকম সবুজ, হালকা সবুজ, ঘন সবুজ, হলুদ ছোপ ছোপ সবুজ, কালচে সবুজ । জোরে জোরে বাতাস বয়, রাশি রাশি পাতা গাছ থেকে টুপটাপ পড়তে থাকে মাথায়, মুখে । সবাই মিলে খোলা গলায় হাসে । বেশি জোরে হাসা, কথা বলা বারণ । বনদেবতা রাগ করবেন ।
বনের মধ্যে এক জায়গায় খোলা একটুখানি জায়গা আছে । সেখানে রোজ সরলরা একটুক্ষণ বসে । ঠিক মুখোমুখি একটা লেবুগাছ, তার পাতার নিচে মস্ত আটকোণা মাকড়সার জাল । সেই জালে রোদ্দুর পড়ে কেমন সোনালি চিকচিকে রঙ হয়, সেইটা রোজ দেখে সরল । খুদে খুদে জানোয়াররা ঘুরে বেড়ায়, মেঠো ইঁদুরগুলো সরলদের দেখে লুকিয়ে পড়ে । একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটে সরলরা ।
পাকা রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে একটা বড় শিমুল গাছ । সেই গাছটার ডালে বোলতারা মেটে রঙের মস্ত চাক বেঁধেছিল । গণেশের বড়জ্যাঠা একদিন বাঁশের আগায় মশাল বেঁধে সেই চাকে আগুন ধরিয়ে দিল । জ্বলতে জ্বলতে চাকটা মাটিতে পড়ল, আর কত কত বোলতা সেই আগুনে পুড়তে লাগল, রাগে আওয়াজ করতে করতে চারদিকে উড়তে লাগল । সরলদের সবার হাতে বড় বড় পাতাসুদ্ধ ডাল ধরিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা আগেই । ওরা সমানে সেই পাতাগুলো নিজেদের চারদিকে ঘোরাচ্ছিল । নইলে বোলতার হুল । বাব্বা ! ফুলে ঢোল হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে ব্যথা । সেই চাকভাঙা মধু নিয়ে সন্ধেবেলা সরলদের পাড়ায় কত হুল্লোড় হল ।
দুদিন ধরে সরলদের গ্রাম থেকে কেউ ইশকুলে যাচ্ছে না । একটা বুনো হাতি এসেছে । কদিন আগে সরলদের পাশের ক্ষেতে এসে সব ধান খেয়ে চলে গেছে । প্রতিবছরই হাতি এসে ফসল খেয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু হাতিদের আসার সঙ্গে গ্রামবাসীদের একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে । পরবের আগে কোনোদিন এ গ্রামে হাতি আসে নি । এবার হাতি শুধু আগে আগে আসে নি, প্রায় আট দশজনের ক্ষেতের ধান নষ্ট করেছে, ধান খেয়েছে, রাগে ক্ষেত মাড়িয়ে দিয়েছে ।
খবর পেয়ে তীরধনুক, মশাল, ক্যানেস্তারা, পটকা নিয়ে ছুটে গেল সবাই । তখন হাতি পালিয়ে গেল । কি রাগ, কি ভয়ানক চিৎকার, গোদা গোদা পায়ে সব ধান মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ।
কি ভাগ্যি, সরলদের ক্ষেতের ধানে সেদিন পা পড়ে নি হাতির । সেই থেকে সারাদিন ধরে, সারারাত জেগে গ্রামসুদ্ধ লোক ক্ষেত পাহারা দিচ্ছে । মশালের আগুনে হাতি ভয় পায়, পটকার আওয়াজেও ভয় পেয়ে পালায় । শুধু একদিন ক্যানেস্তারা বাজাতে বাজাতে সিধুজ্যাঠা বনের কাছ পর্যন্ত চলে গেছিল, সেদিন হাতিটা রেগে গিয়ে সিধুজ্যাঠাকে তাড়া করেছিল । আর একদিন পবনের ছোট ভাইটাকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দিয়েছিল, ভাগ্য ভালো প্রাণে বেঁচে গেছে, হাত ভেঙে পিঠের হাড় ভেঁঙে সদরের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ।
সবাই বলছে, ‘হাতিটা পাগলা হয়ে গেছে ।‘
পঞ্চায়েত অফিস থেকে কেরোসিন দিয়েছে, পটকা দিয়েছে । গাঁয়ের লোক গিয়ে বনদপ্তরে হাতির নামে নালিশ লিখিয়ে এসেছে । কিন্তু এখনও পাগলা হাতিকে ধরা যায় নি । ফরেস্টার বাবুরা এসে বন্দুক নিয়ে আকাশে গুলি ছুঁড়ে, ক্যানেস্তারা বাজিয়ে হাতি খেদিয়ে দূরের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে যায় ।
কোথায় লুকিয়ে থাকে হাতি কে জানে, ফরেস্টারবাবুরা চলে গেলেই এসে গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার মুখের অর্জুনগাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায় । খুব বুদ্ধি হাতির । মুন্ডাপাড়ার দিকে লোকজন পাহারা দিচ্ছে, হাতি মাঝিপাড়ার দিক দিয়ে এসে তান্ডব করে যায় ।
কদিন আগে কার্তিকদের ঘরের চাল উপড়ে দিয়ে গেছে । একদিন রাস্তার ওপর একটা গরুর গাড়ি উলটে দিয়েছে । দিন নেই, রাত নেই, কখন হাতি আসবে সেই ভয়ে গ্রামসুদ্ধ লোক অস্থির । ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছে । মুখে মুখে গল্প ঘুরছে । সেই যেবার বাদনা পরবের পরে মাঝিপাড়ার অমন জোয়ান ছেলেটাকে হাতি মেরে ফেলেছিল । এই তো গত বছর পাশের গাঁয়ের মোহন টুডুর একমাত্র কচি ছেলেটাকে শুঁড়ে করে আছড়ে মেরে ফেলেছিল ।
দেখেশুনে গাঁয়ের সবাই ঠিক করেছে, এখন আর সরলদের ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই । কখন হাতি তাড়া করবে কে জানে । বুনো হাতি এমনিই ভয়ঙ্কর, তার ওপর এ হল পাগলা হাতি । একেবারে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে ।
গরমেন্ট কে সরল জানে না । কিন্তু মনে মনে গরমেন্টকে প্রণাম করেছে সরল । গরমেন্ট নিশ্চয় একজন খুব ভালো লোক । তাই তো সরলের ইশকুলে যাবার সাধ মিটল ।
মাঝিপাড়ার পবন, গুলু, সোরেন আগেই ইশকুলে যাওয়া শুরু করেছে । সরলদের পাড়া থেকে সরল আর গণেশ ওদের সঙ্গেই চলে যাবে, বাবু বলে দিল । জেলেপাড়া নামোপাড়া থেকেও ক’জন ছেলে আছে । আট-দশজনের একটা দল । ইশকুল অনেক দূর । জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আট দশ মাইল গেলে পাকা সড়ক । হাইওয়ে বলে সড়কটাকে, এখন জানে সরল । সেই হাইওয়ে ধরে আরো দু’মাইল প্রায় । তারপর দূর থেকে ইশকুল বাড়ি দেখা যায় ।
ইশকুলটা একটা ছোট পাহাড়ের ওপর । পাহাড়ের ঢালুতে একটা মস্ত জারুল গাছ । তার ঠিক পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, একেবারে ইশকুলের ফটক পর্যন্ত । ফটকের পাশে খেলার মাঠ, তার ওপর বালি ছড়ানো । আর ফটক দিয়ে ঢুকলেই ফুলের বাগান । লাল নীল হলুদ বেগুনী ফুলে ঝলমলে বাগানটায় ঢুকলেই সরলের মন ভালো হয়ে যায় ।
যাওয়ার গোটা পথটা মন ভালো করা । জঙ্গলের মধ্যে রোদ ঢোকে না, ছায়া ছায়া রাস্তা ধরে দৌড়ে দৌড়ে যায় সবাই মিলে । হলুদ সবুজ কত প্রজাপতি, বনের গাছে গাছে কত পাখির ডাক । গাছের পাতায় নানারকম সবুজ, হালকা সবুজ, ঘন সবুজ, হলুদ ছোপ ছোপ সবুজ, কালচে সবুজ । জোরে জোরে বাতাস বয়, রাশি রাশি পাতা গাছ থেকে টুপটাপ পড়তে থাকে মাথায়, মুখে । সবাই মিলে খোলা গলায় হাসে । বেশি জোরে হাসা, কথা বলা বারণ । বনদেবতা রাগ করবেন ।
বনের মধ্যে এক জায়গায় খোলা একটুখানি জায়গা আছে । সেখানে রোজ সরলরা একটুক্ষণ বসে । ঠিক মুখোমুখি একটা লেবুগাছ, তার পাতার নিচে মস্ত আটকোণা মাকড়সার জাল । সেই জালে রোদ্দুর পড়ে কেমন সোনালি চিকচিকে রঙ হয়, সেইটা রোজ দেখে সরল । খুদে খুদে জানোয়াররা ঘুরে বেড়ায়, মেঠো ইঁদুরগুলো সরলদের দেখে লুকিয়ে পড়ে । একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটে সরলরা ।
পাকা রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে একটা বড় শিমুল গাছ । সেই গাছটার ডালে বোলতারা মেটে রঙের মস্ত চাক বেঁধেছিল । গণেশের বড়জ্যাঠা একদিন বাঁশের আগায় মশাল বেঁধে সেই চাকে আগুন ধরিয়ে দিল । জ্বলতে জ্বলতে চাকটা মাটিতে পড়ল, আর কত কত বোলতা সেই আগুনে পুড়তে লাগল, রাগে আওয়াজ করতে করতে চারদিকে উড়তে লাগল । সরলদের সবার হাতে বড় বড় পাতাসুদ্ধ ডাল ধরিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা আগেই । ওরা সমানে সেই পাতাগুলো নিজেদের চারদিকে ঘোরাচ্ছিল । নইলে বোলতার হুল । বাব্বা ! ফুলে ঢোল হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে ব্যথা । সেই চাকভাঙা মধু নিয়ে সন্ধেবেলা সরলদের পাড়ায় কত হুল্লোড় হল ।
দুদিন ধরে সরলদের গ্রাম থেকে কেউ ইশকুলে যাচ্ছে না । একটা বুনো হাতি এসেছে । কদিন আগে সরলদের পাশের ক্ষেতে এসে সব ধান খেয়ে চলে গেছে । প্রতিবছরই হাতি এসে ফসল খেয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু হাতিদের আসার সঙ্গে গ্রামবাসীদের একটা অলিখিত বোঝাপড়া আছে । পরবের আগে কোনোদিন এ গ্রামে হাতি আসে নি । এবার হাতি শুধু আগে আগে আসে নি, প্রায় আট দশজনের ক্ষেতের ধান নষ্ট করেছে, ধান খেয়েছে, রাগে ক্ষেত মাড়িয়ে দিয়েছে ।
খবর পেয়ে তীরধনুক, মশাল, ক্যানেস্তারা, পটকা নিয়ে ছুটে গেল সবাই । তখন হাতি পালিয়ে গেল । কি রাগ, কি ভয়ানক চিৎকার, গোদা গোদা পায়ে সব ধান মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ।
কি ভাগ্যি, সরলদের ক্ষেতের ধানে সেদিন পা পড়ে নি হাতির । সেই থেকে সারাদিন ধরে, সারারাত জেগে গ্রামসুদ্ধ লোক ক্ষেত পাহারা দিচ্ছে । মশালের আগুনে হাতি ভয় পায়, পটকার আওয়াজেও ভয় পেয়ে পালায় । শুধু একদিন ক্যানেস্তারা বাজাতে বাজাতে সিধুজ্যাঠা বনের কাছ পর্যন্ত চলে গেছিল, সেদিন হাতিটা রেগে গিয়ে সিধুজ্যাঠাকে তাড়া করেছিল । আর একদিন পবনের ছোট ভাইটাকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দিয়েছিল, ভাগ্য ভালো প্রাণে বেঁচে গেছে, হাত ভেঙে পিঠের হাড় ভেঁঙে সদরের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ।
সবাই বলছে, ‘হাতিটা পাগলা হয়ে গেছে ।‘
পঞ্চায়েত অফিস থেকে কেরোসিন দিয়েছে, পটকা দিয়েছে । গাঁয়ের লোক গিয়ে বনদপ্তরে হাতির নামে নালিশ লিখিয়ে এসেছে । কিন্তু এখনও পাগলা হাতিকে ধরা যায় নি । ফরেস্টার বাবুরা এসে বন্দুক নিয়ে আকাশে গুলি ছুঁড়ে, ক্যানেস্তারা বাজিয়ে হাতি খেদিয়ে দূরের জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে যায় ।
কোথায় লুকিয়ে থাকে হাতি কে জানে, ফরেস্টারবাবুরা চলে গেলেই এসে গাঁয়ে ঢোকার রাস্তার মুখের অর্জুনগাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায় । খুব বুদ্ধি হাতির । মুন্ডাপাড়ার দিকে লোকজন পাহারা দিচ্ছে, হাতি মাঝিপাড়ার দিক দিয়ে এসে তান্ডব করে যায় ।
কদিন আগে কার্তিকদের ঘরের চাল উপড়ে দিয়ে গেছে । একদিন রাস্তার ওপর একটা গরুর গাড়ি উলটে দিয়েছে । দিন নেই, রাত নেই, কখন হাতি আসবে সেই ভয়ে গ্রামসুদ্ধ লোক অস্থির । ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পাচ্ছে । মুখে মুখে গল্প ঘুরছে । সেই যেবার বাদনা পরবের পরে মাঝিপাড়ার অমন জোয়ান ছেলেটাকে হাতি মেরে ফেলেছিল । এই তো গত বছর পাশের গাঁয়ের মোহন টুডুর একমাত্র কচি ছেলেটাকে শুঁড়ে করে আছড়ে মেরে ফেলেছিল ।
দেখেশুনে গাঁয়ের সবাই ঠিক করেছে, এখন আর সরলদের ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই । কখন হাতি তাড়া করবে কে জানে । বুনো হাতি এমনিই ভয়ঙ্কর, তার ওপর এ হল পাগলা হাতি । একেবারে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে ।
ইশকুলে যাওয়া হচ্ছে না বলে সরলের খুব মনখারাপ । কত মজা হয় ইশকুলে । গরমেন্ট শুধু বইখাতা দেয় নি, ড্রয়িংবই ড্রয়িংখাতা আর রঙপেন্সিলও দিয়েছে । সেই খাতায় ইশকুলে বসে কত ছবি আঁকে সরল । বাড়িতে বসে বসে এত ছবি এঁকেছে সরল যে ড্রয়িংখাতার সব পাতা শেষ । ইশকুলে গেলে তবেই তো আর একটা ড্রয়িংখাতা পাবে !
তাছাড়া ভূগোল ক্লাসটার জন্যেও মনখারাপ করে । ভূগোল সবচেয়ে ভালো লাগে সরলের । মাস্টারমশাই কি সুন্দর দেশ বিদেশের গল্প বলেন । একটা লম্বা রঙচঙে কাগজ দেখিয়ে যেদিন বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখ, এইটা হল আমাদের দেশ’; সেদিনের কথাটা স্পষ্ট মনে আছে সরলের । দেশ মানে ভারত, সেইটা আগে থেকেই জানত । কিন্তু ভারত যে ওই কাগজটাকে বলে সেইটা জেনে তো সরল অবাক । তারপর মাস্টারমশাই বললেন, ‘এইটাকে মানচিত্র বলে ।‘ সেই মানচিত্রে নাকি ভারতের সব জায়গার নাম আছে । একেবারে ডান দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে এইটা গঙ্গা, এই হল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ .. আর এই দ্যাখো পুরুলিয়া, এইখানেই আমাদের কুলহি গ্রাম ।‘
অনেক খুঁজেও কুলহি নাম দেখতে পায় নি সরল, তখন মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, কাছাকাছি কোনো বড় জায়গার নাম দিয়ে বুঝতে হবে । সব ছোট ছোট জায়গার নাম তো থাকে না, শুধু রাজধানী বা বড় শহরের নাম থাকে । আর কোনো জায়গায় যদি কোনো দর্শনীয় জিনিস থাকে কিংবা কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই জায়গার নাম থাকে ।
ইস, সরলদের গ্রামে যদি একটা স্মরণীয় ঘটনা হত !
আর এখন তো ইশকুলেই যাওয়া হচ্ছে না । খুব মনখারাপ করে সরলের ।
সাত দিনেও কোনো সুরাহা হল না । আজ সকালে ক্ষেতে যাবার নাম করে বেরিয়েছে সরল । গাঁয়ের সব পুরুষমানুষ হয় ক্ষেতের কাছে নয় বনের দিকে পাহারায় । নদীর দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সরল । রাস্তা তো চেনাই আছে । পলাশ গাছটার পাশ দিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়বে । হাতি এলে কোথায় লুকিয়ে পড়বে তাও ঠিক করে নিয়েছে মনে মনে । যেমন করেই হোক, আজ ইশকুলে যাবেই ।
বনের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি এক ছুটে পেরিয়ে এসে মাকড়সার জালের কাছে এসে বসল সরল । আর একটুখানি । ওই আমলকি গাছটার পাশ দিয়ে গেলেই একটা জলা, জলা পেরোলেই শালগাছের বন, সেইটা পেরোলেই শিমুলগাছ । তারপরেই বড় রাস্তা । জলার কাছ পর্যন্ত ভালোভাবেই পেরিয়ে এল । তারপরই থমকে দাঁড়িয়েছে । কালো পাহাড়ের মতো বড় হাতিটা । জল খেতে এসেছিল নিশ্চয় । জল খেয়ে হাতিদের নুন খেতে হয় । হাতিটা জলার পাশের মাটি চাটছে । সরল জানে, ওটা নোনা মাটি । ওই জলায় জল খেয়ে সব ছোট বড় জানোয়ার মাটি চাটে । পাগলা হাতি মাটি চাটায় ব্যস্ত, সরলকে দেখতে পায় নি ।
পাশেই একটা বুড়ো মস্তবড় শিশু গাছ । একটুও আওয়াজ না করে সরল তরতর করে শিশু গাছে উঠে গেল । একটা পাতাওয়ালা ডাল দেখে লুকিয়ে বসল তারপর । সেইটুকু আওয়াজেই হাতি মুখ তুলে তাকিয়েছে, ভাগ্যিস সরলকে দেখতে পায় নি । তবু কি ভেবে হাতিটা এগিয়ে এসে শিশুগাছে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে গেল । গাছের ডাল আঁকড়ে বসে রইল সরল ।
হাতি চলে যাবার পরও নামে নি । যদি হাতিটা আবার ফিরে আসে । পাগলা হাতি পলকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দেবে ।
দেখতে দেখতে বেলা কাটল আরো । হাতি কাছাকাছিই আছে । মাঝেমাঝেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে কালো শরীর দেখা যাচ্ছে । কতক্ষণ সময় কাটল কে জানে । সেই সকালে বেরিয়েছে সরল, সূর্য এখন মাথার ওপর । খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে । শিশুগাছে না উঠে পাশের মহুয়া গাছটায় উঠলে ভালো হত । ছোট ছোট ফলে ও গাছটা ভরে আছে । তখন অত দিকে খেয়াল হয় নি ।
সরলের একটু একটু ভয় করছে । এমনিতে গাঁয়ের লোকজন এ রাস্তায় আসে, কিন্তু এখন হাতির ভয়ে কেউ আসছে না । কেউ যদি না আসে ! বাড়ি ফিরবে কি করে !
পাশের ডালে খুব ছোট একটা হনুমান, গায়ে একটু একটু লোম, কুচকুচে মুখ, পিটপিট করে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে বকতে লাগল সরলকে । যেন বলছে, ‘এটা আমার বাড়ি, তুই এখানে কেন ?’
আওয়াজ শুনে হাতিটা না ফিরে আসে । সরল চোখ পাকিয়ে তাকালো । তাতে রেগে গিয়ে হনুমানটা ভেংচি কেটে দিল । খানিক পরে একটা বড় হনুমান এসে ছোট হনুমান্টাকে মুখে করে তুলে নিয়ে গেল ।
যাক বাবা । মা-হনুমানটা ভাগ্যিস রাগ করে নি !
আরো খানিকক্ষণ পরে কালো শরীরটার নড়াচড়া দেখতে পেল সরল । কি একটা টেনে আনছে হাতিটা । একটু করে আসছে, আর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করছে । সে কি চিৎকার । ভয়ে সরলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল । হাতিটা খুব রেগে আছে । কি হবে এবার ?
একবার মহুয়া গাছের ডালটা হাওয়ায় সরে যেতেই হাতিটাকে দেখতে পেল । একটা বাচ্চা হাতিকে টেনে আনছে । মা-হাতি একটু করে টেনে আনছে, আর বাচ্চা-হাতিটা বেজায় চিৎকার করছে । সেই শুনে মা-হাতি আরো জোরে চিৎকার করছে । বাচ্চা-হাতির পায়ে লেগেছে বোধ হয়, চলতেই পারছে না । আহা রে, ওর পা ভেঙে গেছে ।
এবার বুঝেছে সরল । মা-হাতিটা মোটেই পাগল নয় । বাচ্চার পায়ে লেগেছে বলে ওরা দুজনে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে । দলের সঙ্গে হেঁটে যেতে পারে নি । কেউ কাছে এলেই মা-হাতি ভাবে ওর বাচ্চাকে মারতে আসছে বুঝি, তাই তেড়ে যায় । বোধহয় সরলদের গ্রামের কাছেই ছিল এতদিন, তাই গ্রামে ঢুকে তান্ডব করত যাতে কেউ ওদিকে না যায় । হাতি খেদানোর দল এলে তাই হাতি তাড়া করত ।
মা-হাতি বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, সেই ফাঁকে আস্তে গাছ থেকে নেমে পড়ল সরল । তারপর এক ছুটে গ্রামে । গ্রামের লায়াবুড়ো অনেকরকম ওষুধ জানে । দিকুমাঝির ঠাকুমাও জড়ি বুটি দিয়ে অনেক রোগ সারায় । তারপর বাবুকে রাজি করিয়ে গ্রামের লোকজনকে বুঝিয়ে আনা কম ঝক্কি !
চুপি চুপি গাছের আড়াল দিয়ে হাতির কাছ পর্যন্ত পৌঁছবার আগে হাতিও টের পায়নি ।
কাছে গিয়েই সরল মা-হাতিটার পিঠে চড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল । লায়াবুড়ো আর ঠাকুমা ওষুধ নিয়ে বাচ্চা-হাতির পায়ে লাগাতে বসল । ওষুধ দিয়ে মোটা কাপড় দিয়ে বাঁধা, একটু একটু করে পাতলা ওষুধ খাওয়ানো, অনেক সময় লাগল । বাচ্চা-হাতি প্রথমে ছটফট করছিল, একটু পরে শান্ত হয়ে মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল । বাবু মাথাটা কোলে নিয়ে বসল । মা-হাতি কি বুঝল কে জানে, কাউকে তেড়ে গেল না, চিৎকারও করল না, বরং চোখ বুজে সরলের আদর খেতে লাগল ।
লোকজন মিলে বাচ্চা-হাতিকে তুলে গ্রামে নিয়ে আসা হল । মা-হাতি সরলকে পিঠে নিয়ে শান্ত হয়ে গ্রাম পর্যন্ত এল । কতদিন ধরে বাচ্চা-হাতি ওদের গাঁয়েই থাকল তারপর । মা-হাতি জঙ্গলে থাকত, আর রোজ একবার এসে বাচ্চাকে দেখে যেত । একদিনও ক্ষেত মাড়ায় নি, কাউকে ভয় দেখায় নি ।
তাছাড়া ভূগোল ক্লাসটার জন্যেও মনখারাপ করে । ভূগোল সবচেয়ে ভালো লাগে সরলের । মাস্টারমশাই কি সুন্দর দেশ বিদেশের গল্প বলেন । একটা লম্বা রঙচঙে কাগজ দেখিয়ে যেদিন বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখ, এইটা হল আমাদের দেশ’; সেদিনের কথাটা স্পষ্ট মনে আছে সরলের । দেশ মানে ভারত, সেইটা আগে থেকেই জানত । কিন্তু ভারত যে ওই কাগজটাকে বলে সেইটা জেনে তো সরল অবাক । তারপর মাস্টারমশাই বললেন, ‘এইটাকে মানচিত্র বলে ।‘ সেই মানচিত্রে নাকি ভারতের সব জায়গার নাম আছে । একেবারে ডান দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে এইটা গঙ্গা, এই হল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ .. আর এই দ্যাখো পুরুলিয়া, এইখানেই আমাদের কুলহি গ্রাম ।‘
অনেক খুঁজেও কুলহি নাম দেখতে পায় নি সরল, তখন মাস্টারমশাই বুঝিয়েছিলেন, কাছাকাছি কোনো বড় জায়গার নাম দিয়ে বুঝতে হবে । সব ছোট ছোট জায়গার নাম তো থাকে না, শুধু রাজধানী বা বড় শহরের নাম থাকে । আর কোনো জায়গায় যদি কোনো দর্শনীয় জিনিস থাকে কিংবা কোনো স্মরণীয় ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই জায়গার নাম থাকে ।
ইস, সরলদের গ্রামে যদি একটা স্মরণীয় ঘটনা হত !
আর এখন তো ইশকুলেই যাওয়া হচ্ছে না । খুব মনখারাপ করে সরলের ।
সাত দিনেও কোনো সুরাহা হল না । আজ সকালে ক্ষেতে যাবার নাম করে বেরিয়েছে সরল । গাঁয়ের সব পুরুষমানুষ হয় ক্ষেতের কাছে নয় বনের দিকে পাহারায় । নদীর দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সরল । রাস্তা তো চেনাই আছে । পলাশ গাছটার পাশ দিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে পড়বে । হাতি এলে কোথায় লুকিয়ে পড়বে তাও ঠিক করে নিয়েছে মনে মনে । যেমন করেই হোক, আজ ইশকুলে যাবেই ।
বনের মধ্যে দিয়ে অনেকখানি এক ছুটে পেরিয়ে এসে মাকড়সার জালের কাছে এসে বসল সরল । আর একটুখানি । ওই আমলকি গাছটার পাশ দিয়ে গেলেই একটা জলা, জলা পেরোলেই শালগাছের বন, সেইটা পেরোলেই শিমুলগাছ । তারপরেই বড় রাস্তা । জলার কাছ পর্যন্ত ভালোভাবেই পেরিয়ে এল । তারপরই থমকে দাঁড়িয়েছে । কালো পাহাড়ের মতো বড় হাতিটা । জল খেতে এসেছিল নিশ্চয় । জল খেয়ে হাতিদের নুন খেতে হয় । হাতিটা জলার পাশের মাটি চাটছে । সরল জানে, ওটা নোনা মাটি । ওই জলায় জল খেয়ে সব ছোট বড় জানোয়ার মাটি চাটে । পাগলা হাতি মাটি চাটায় ব্যস্ত, সরলকে দেখতে পায় নি ।
পাশেই একটা বুড়ো মস্তবড় শিশু গাছ । একটুও আওয়াজ না করে সরল তরতর করে শিশু গাছে উঠে গেল । একটা পাতাওয়ালা ডাল দেখে লুকিয়ে বসল তারপর । সেইটুকু আওয়াজেই হাতি মুখ তুলে তাকিয়েছে, ভাগ্যিস সরলকে দেখতে পায় নি । তবু কি ভেবে হাতিটা এগিয়ে এসে শিশুগাছে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে গেল । গাছের ডাল আঁকড়ে বসে রইল সরল ।
হাতি চলে যাবার পরও নামে নি । যদি হাতিটা আবার ফিরে আসে । পাগলা হাতি পলকে শুঁড়ে তুলে আছাড় দেবে ।
দেখতে দেখতে বেলা কাটল আরো । হাতি কাছাকাছিই আছে । মাঝেমাঝেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে কালো শরীর দেখা যাচ্ছে । কতক্ষণ সময় কাটল কে জানে । সেই সকালে বেরিয়েছে সরল, সূর্য এখন মাথার ওপর । খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে । শিশুগাছে না উঠে পাশের মহুয়া গাছটায় উঠলে ভালো হত । ছোট ছোট ফলে ও গাছটা ভরে আছে । তখন অত দিকে খেয়াল হয় নি ।
সরলের একটু একটু ভয় করছে । এমনিতে গাঁয়ের লোকজন এ রাস্তায় আসে, কিন্তু এখন হাতির ভয়ে কেউ আসছে না । কেউ যদি না আসে ! বাড়ি ফিরবে কি করে !
পাশের ডালে খুব ছোট একটা হনুমান, গায়ে একটু একটু লোম, কুচকুচে মুখ, পিটপিট করে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে বকতে লাগল সরলকে । যেন বলছে, ‘এটা আমার বাড়ি, তুই এখানে কেন ?’
আওয়াজ শুনে হাতিটা না ফিরে আসে । সরল চোখ পাকিয়ে তাকালো । তাতে রেগে গিয়ে হনুমানটা ভেংচি কেটে দিল । খানিক পরে একটা বড় হনুমান এসে ছোট হনুমান্টাকে মুখে করে তুলে নিয়ে গেল ।
যাক বাবা । মা-হনুমানটা ভাগ্যিস রাগ করে নি !
আরো খানিকক্ষণ পরে কালো শরীরটার নড়াচড়া দেখতে পেল সরল । কি একটা টেনে আনছে হাতিটা । একটু করে আসছে, আর দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করছে । সে কি চিৎকার । ভয়ে সরলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল । হাতিটা খুব রেগে আছে । কি হবে এবার ?
একবার মহুয়া গাছের ডালটা হাওয়ায় সরে যেতেই হাতিটাকে দেখতে পেল । একটা বাচ্চা হাতিকে টেনে আনছে । মা-হাতি একটু করে টেনে আনছে, আর বাচ্চা-হাতিটা বেজায় চিৎকার করছে । সেই শুনে মা-হাতি আরো জোরে চিৎকার করছে । বাচ্চা-হাতির পায়ে লেগেছে বোধ হয়, চলতেই পারছে না । আহা রে, ওর পা ভেঙে গেছে ।
এবার বুঝেছে সরল । মা-হাতিটা মোটেই পাগল নয় । বাচ্চার পায়ে লেগেছে বলে ওরা দুজনে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে । দলের সঙ্গে হেঁটে যেতে পারে নি । কেউ কাছে এলেই মা-হাতি ভাবে ওর বাচ্চাকে মারতে আসছে বুঝি, তাই তেড়ে যায় । বোধহয় সরলদের গ্রামের কাছেই ছিল এতদিন, তাই গ্রামে ঢুকে তান্ডব করত যাতে কেউ ওদিকে না যায় । হাতি খেদানোর দল এলে তাই হাতি তাড়া করত ।
মা-হাতি বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে, সেই ফাঁকে আস্তে গাছ থেকে নেমে পড়ল সরল । তারপর এক ছুটে গ্রামে । গ্রামের লায়াবুড়ো অনেকরকম ওষুধ জানে । দিকুমাঝির ঠাকুমাও জড়ি বুটি দিয়ে অনেক রোগ সারায় । তারপর বাবুকে রাজি করিয়ে গ্রামের লোকজনকে বুঝিয়ে আনা কম ঝক্কি !
চুপি চুপি গাছের আড়াল দিয়ে হাতির কাছ পর্যন্ত পৌঁছবার আগে হাতিও টের পায়নি ।
কাছে গিয়েই সরল মা-হাতিটার পিঠে চড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল । লায়াবুড়ো আর ঠাকুমা ওষুধ নিয়ে বাচ্চা-হাতির পায়ে লাগাতে বসল । ওষুধ দিয়ে মোটা কাপড় দিয়ে বাঁধা, একটু একটু করে পাতলা ওষুধ খাওয়ানো, অনেক সময় লাগল । বাচ্চা-হাতি প্রথমে ছটফট করছিল, একটু পরে শান্ত হয়ে মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল । বাবু মাথাটা কোলে নিয়ে বসল । মা-হাতি কি বুঝল কে জানে, কাউকে তেড়ে গেল না, চিৎকারও করল না, বরং চোখ বুজে সরলের আদর খেতে লাগল ।
লোকজন মিলে বাচ্চা-হাতিকে তুলে গ্রামে নিয়ে আসা হল । মা-হাতি সরলকে পিঠে নিয়ে শান্ত হয়ে গ্রাম পর্যন্ত এল । কতদিন ধরে বাচ্চা-হাতি ওদের গাঁয়েই থাকল তারপর । মা-হাতি জঙ্গলে থাকত, আর রোজ একবার এসে বাচ্চাকে দেখে যেত । একদিনও ক্ষেত মাড়ায় নি, কাউকে ভয় দেখায় নি ।
এদিকে আর এক কান্ড । ইশকুলে গিয়ে সরলরা যখন হাতির গল্পটা বলেছে, প্রথমে তো কেউ বিশ্বাসই করে না । তারপর মাস্টারমশাইরা ডেকে ডেকে গল্পটা শুনতে চাইলেন । হেডমাস্টারমশাইও ওদের ডেকে সব শুনলেন । কি থেকে কি হল কে জানে, একদিন টিভি থেকে খবরের কাগজ থেকে কত লোক কত ক্যামেরা সরলদের গ্রামে এসে হাজির । বাচ্চা-হাতির কত ছবি তুলল তারা । সরলের সঙ্গে বাচ্চা-হাতির ছবি তুলল । মুখের সামনে মাইক ধরে ধরে সরলের গল্পটা বলতে বলল ।
তারপর আরো এক কান্ড ।
হেডমাস্টারমশাই বাবুকে আর সরলকে সদরের বড় অফিসে নিয়ে গেলেন । সরল সাহসিকতার পুরষ্কার পাবে । সদরের অফিসের সবাই এসে বাবুকে আর সরলকে দেখতে লাগল । সরলের দিল্লী যাবার সব ব্যবস্থা হল । বাবু ভয়ে দিল্লী যেতেই চাইল না । তখন হেডমাস্টারমশাই সরলকে নিয়ে দিল্লী গেলেন । বড়দাদাও সঙ্গে গেল ।
সরলের এই প্রথম ট্রেনে চাপা ।
তারপর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে যেদিন পুরষ্কার পেল, সেদিনটার কথা কোনোদিন ভুলবে না সরল । রাষ্ট্রপতি মিষ্টি হেসে সরলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, হোটেলের ঘরে বসে সেই ছবিটা টিভিতেও দেখেছে । কত হাততালি । কত বাজনা । কত ছবি তোলা । সব স্বপ্নের মতো ব্যাপার স্যাপার ।
দেখতে দেখতে সরলের মাথায় একটা কথা এল । এই যে ঘটনাটা ঘটল, এটাকে কি স্মরণীয় ঘটনা বলা হবে ? ভারতের মানচিত্রে কি বেরাপোতা গ্রামের নাম উঠবে ? কিংবা সরলের ইশকুলের গ্রাম কুলহির নাম ? বড়দাদা তো কথাটা বুঝতেই পারল না, হেডমাস্টারমশাই শুনে এমন হাসতে লাগলেন যে আর কিছু জবাব দিতেই পারলেন না ।
গ্রামে ফিরেও অনেকদিন এমন মজা আর আনন্দে কাটল ।
তারপর একদিন মা-হাতি বাচ্চা-হাতিকে নিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল । গ্রামের সব ছোট ছেলেমেয়ে খুব কাঁদল, মা জ্যেঠিরা মা-হাতিকে সিঁদুর পরিয়ে দিল, বাচ্চা-হাতিকে সাদা টিপ পরিয়ে দিল । সরলেরও খুব কান্না পাচ্ছিল । আর একটা কথা নিজে নিজেই বুঝে ফেলল সরল । মানচিত্রে স্মরণীয় না-ই হোক, সরলের কাছে এই ঘটনাটা সারা জীবনের জন্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
সরল বইয়ে পড়েছে, হাতিদের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো, মানুষের থেকেও বেশি । তাই সরল জানে, হাতিরাও এই ঘটনাটা মনে রাখবে । সরল হাসিমুখে মনখারাপের চোখের জল মুছে নিল ।
তারপর আরো এক কান্ড ।
হেডমাস্টারমশাই বাবুকে আর সরলকে সদরের বড় অফিসে নিয়ে গেলেন । সরল সাহসিকতার পুরষ্কার পাবে । সদরের অফিসের সবাই এসে বাবুকে আর সরলকে দেখতে লাগল । সরলের দিল্লী যাবার সব ব্যবস্থা হল । বাবু ভয়ে দিল্লী যেতেই চাইল না । তখন হেডমাস্টারমশাই সরলকে নিয়ে দিল্লী গেলেন । বড়দাদাও সঙ্গে গেল ।
সরলের এই প্রথম ট্রেনে চাপা ।
তারপর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে যেদিন পুরষ্কার পেল, সেদিনটার কথা কোনোদিন ভুলবে না সরল । রাষ্ট্রপতি মিষ্টি হেসে সরলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, হোটেলের ঘরে বসে সেই ছবিটা টিভিতেও দেখেছে । কত হাততালি । কত বাজনা । কত ছবি তোলা । সব স্বপ্নের মতো ব্যাপার স্যাপার ।
দেখতে দেখতে সরলের মাথায় একটা কথা এল । এই যে ঘটনাটা ঘটল, এটাকে কি স্মরণীয় ঘটনা বলা হবে ? ভারতের মানচিত্রে কি বেরাপোতা গ্রামের নাম উঠবে ? কিংবা সরলের ইশকুলের গ্রাম কুলহির নাম ? বড়দাদা তো কথাটা বুঝতেই পারল না, হেডমাস্টারমশাই শুনে এমন হাসতে লাগলেন যে আর কিছু জবাব দিতেই পারলেন না ।
গ্রামে ফিরেও অনেকদিন এমন মজা আর আনন্দে কাটল ।
তারপর একদিন মা-হাতি বাচ্চা-হাতিকে নিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল । গ্রামের সব ছোট ছেলেমেয়ে খুব কাঁদল, মা জ্যেঠিরা মা-হাতিকে সিঁদুর পরিয়ে দিল, বাচ্চা-হাতিকে সাদা টিপ পরিয়ে দিল । সরলেরও খুব কান্না পাচ্ছিল । আর একটা কথা নিজে নিজেই বুঝে ফেলল সরল । মানচিত্রে স্মরণীয় না-ই হোক, সরলের কাছে এই ঘটনাটা সারা জীবনের জন্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
সরল বইয়ে পড়েছে, হাতিদের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো, মানুষের থেকেও বেশি । তাই সরল জানে, হাতিরাও এই ঘটনাটা মনে রাখবে । সরল হাসিমুখে মনখারাপের চোখের জল মুছে নিল ।
আইভি চ্যাটার্জি
জামশেদপুর, ঝাড়খন্ড
জামশেদপুর, ঝাড়খন্ড
অলংকরনঃ
কৌস্তুভ রায়
আহমেদাবাদ, গুজরাত
কৌস্তুভ রায়
আহমেদাবাদ, গুজরাত
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প