কুলতলির ময়নামাসি
কুলতলির ময়নামাসি সেদিন উড়ে এল পলাশপুরে। পলাশপুরে গিয়ে পৌঁছোল শালিকদিদির কাছে।
-কী ব্যাপার ময়নামাসি হঠাৎ এলে যে হেথা?- শালিকদিদি বলল।
-কাজে এসেছি বোন, ভীষণ জরুরি কাজ। ছেলেটাতো বড়ো হয়েছে, ইয়ে পাশ করেছে একটা, বে থা তো দিতে হবে।
- ও এ তো খুবই ভালো খবর। তা মেয়ে ঠিক করে দিতে হবে, এই তো?- শালিকদিদি বলল।
ময়নামাসি বলল, তা যা বলেছিস্;
-তা তোমার ছেলের কী কী শখ আছে মাসি?
-সে গাইতে জানে, সে নাইতে জানে, সে ধুলোবালি মাখতে জানে। গোরুর পিঠে চড়তে জানে, মানুষ -খোকাদের ঠোকরাতে জানে।
-বাব্বা তবে তো দেখছি ছেলে অনেক কিছু শিখেছে- শালিকদিদি বলল।
-কার ছেলে তা তো দেখতে হবে।- বেশ গর্বের সঙ্গে বলল ময়নামাসি।তারপরই বলল, তা শুধু কথাই বলবি, না কিছু খেতে দিবি?
-কী খাবে বলো।-শালিকদিদি বলল।
-কী রেখেছিস শুনি?
-কেঁচো আছে, বাদামের খোসা আছে, আখের ছোবড়া আছে জ্যান্ত পোকামাকড়ও আছে।
ময়নামাসি বলল, কুলতমিতে আজকাল আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠা হয়েছে বুঝলি, আমরা একটু আধটু বড়োলোকও হয়েছি, কাজেই ফলের বিচিই দে, সেটা খাওয়াই ঠিক হবে। পোকামাকড় গরিবেরা খাক, কি বলিস?
শালিকদিদি বলল, তা যা বলেছ। বলেই তিনটি খেজুর-বিচি খেতে দিল ময়নামাসিকে।
চেটেপুটে তাই খেল ময়নামাসি। তার পর বলল, চল্ এবারে, মেয়ে দেখতে যেতে হবে।
শালিকদিদি ময়নামাসিকে নিয়ে উড়ে চলল কুসুমপাড়ায়। কুসুমপাড়ায় থাকে শালিকদিদির বন্ধু কুসুমদিদি। তাকে সবাই বলে কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি।
কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি পলাশপুরের শালিকদিদিকে দেখে তো খুব খুশি।
পলাশপুরের শালিকদিদি বলল, তোর তো একটা মেয়ে আছে?
-হ্যাঁ তা তো আছে।
-ওর জন্য বিয়ের খবর নিয়ে এসেছি।-পলাশপুরের শালিক বলল।
-এ তো খুবই ভালো খবর।- কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি বলল।
-এরই জন্য তো ময়নামাসি এসেছে। কুলতুলির ময়নামাসি। বড়ো উচ্চ ঘর ওদের, সাত পুরুষ ধরে ওরা ওখানে আছে, নিজস্ব ঘরবাড়ি। খেত-খামার চারদিকে রয়েছে, খাবারদাবাদের কোন অভাব নেই। ওরই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়।
-বাঃ এ তো খুবই ভালো খবর। তা কিছু মিষ্টিমুখ তো আগে করতে হবে। বলল কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি।
-না না তার দরকার নেই। পলাশপুরেই খেয়ে এসেছি- বলল ময়নামাসি।
-তা কি হয়? দুটো আখের ছিবড়ে দিচ্ছি , একটু চেখে দেখুন, একেবারে টাটকা। আজই আমার মেয়ে অনেক কষ্টে বাগান থেকে নিয়ে এসেছে।
তা শেষ পর্যন্ত আখের ছিবড়ে খেতেই হল ময়নামাসি ও পলাশপুরের শালিকদিদিকে।
ময়নামাসি বলল, তা এবার তোমার মেয়ে দেখাও।
কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি বলল, মেয়ে এখন সাজ করছে, সাজ শেষ হলেই নিয়ে আসব। তা আপনার ছেলে কী কী করে শুনি?
-কী আর করবে, এ বছর ইয়ে পাশ করেছে। নানা কাজে ওকে কখনো পলাশপুর, কখনও শিমুলতলি কখনও হাটতলায় যেতে হয়।ঘর পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। শুনছি ও নাকি কুলতুলির নেতা হবে। খাওয়াদাওয়ার কোনই অভাব নেই আমাদের ওখানে। ডালগমের ক্ষেত আছে। কাজেই আমাদের ঘরে সবসময়ই খাবার মজুত থাকে। পোকামাকড় বড়ো একটা খাই না। আমরা এখন উচ্চঘর কি না!
-বাঃ এ তো ভালো খবর। আমার মেয়ে তবে সুখেই থাকবে, বলল কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ সুখে থাকবে বৈ কী! শুধু ঘর দেখবে আর কাচ্চাবাচ্চা সামলাবে।কাজকর্ম বিশেষ করতে হবে না, এটুকু বলতে পারি।
-হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই বলেছে ময়নামাসি। বলল পলাশপুরের শালিকদিদি। এরপর আরো দু-তিন কথার মধ্যেই শালিকমেয়ে এসে পড়ল ওদের মাঝখানে।
ময়নামাসি বলল, তা তোমার নাম কী মা?
-টি-টি-টি, বলল শালিকমেয়ে।
-বাহ্, কী কী কাজ করতে পারো?
-আখের মাঠ থেকে আখের ছিবড়ে আনতে পারি, জলে গিয়ে নাইতে পারি, কেউ বললে গাইতে পারি।
-আর কী কী পারো মা?
- মাসির বাড়ি যেতে পারি, পিসির বাড়ি যেতে পারি, রেলগাড়ির মাথায় চড়তে পারি, একলা একলা হাঁটতে পারি।
-বাহ্, খুব ভালো, বাহ্ খুব ভালো। এবার যেতে পারো মা।- বলল ময়নামাসি।
এরপর আলাদা করে কুসুমপাড়ার ময়নাদিদিকে বলল ময়নামাসি, তা বিয়েতে কী কী দিতে পারবে শুনি? আমার ছেলে তো ইয়ে পাশ করেছে, নেতাও হবে, ওর তো কিছু চাই।
-বেশ্, সজনখালির মাঠ আমাদের নামে ছিল, ওটা তোমার ছেলের নামে করে দেব, কুসুমপাড়ার ঘাট তোমার ছেলের নামে করে দেব আর কুসুমপাড়ার ভোট তাও তোমার ছেলে পাবে, এটুকু বলতে পারি।
এসব শুনে ময়নামাসির খুবই আনন্দ হল। পলাশপুরের শালিকদিদিকে বলল, ভালোই হল, এবার ছেলেকে গিয়ে সব বলতে হবে। তুমি আমার জন্য অনেক করলে বোন।
-এ এমন আর কী! বলল পলাশপুরের শালিকদিদি।
-তোমাকে কিন্তু আমাদের সঙ্গে বরযাত্রী যেতে হবে। তোমার নিমন্ত্রণ রইল। যাবে তো?
নিশ্চয়ই যাব, বলল শালিকদিদি।
কুসুমপাড়ার ময়নাদিদিকে ময়নামাসি এবারে বলল, মেয়ে পছন্দ হয়েছে, এবারে যাই।
-আবার আসবেন, হাসিমুখে বলল কুসুমপাড়ার ময়নাদিদি।
-আচ্ছা। বলল ময়নামাসি।
বেলা গড়াল।
এরপর একজন উড়ে চলল কুলতলিতে আর একজন উড়ে চলল পলাশপুরে।
সূর্যঠাকুর তখন পশ্চিম আকাশে যাই যাই করছেন।
সুনির্মল চক্রবর্তী
প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুনির্মল চক্রবর্তী তাঁর এই গল্পটি ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত হবার অনুমতি দিয়েছেন। এই গল্পটি পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে। মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সুনির্মল চক্রবর্তী
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ইলিশ
মাসির বাড়ি যাবার কথা শুনলে বুম্বা ও টুলু নাচতে থাকে তাই রথের সময় মাসির বাড়ি যাবার প্ল্যান হয়েছে শুনে তো ওরা আনন্দে আত্মহারা – বুম্বা তখনই ক্যালেন্ডার দেখে বলে দিলো আর মাত্র চার দিন। তবে চার দিনও যে কাটতে চায় না – স্কুল থেকে ফিরেই দুজনে মায়ের পেছনে ঘুরছে – কখন বেরুতে হবে, কদিন থাকবো ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নে লতিকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। বুম্বা ও টুলুর মত লতিকা আর ওর ছোট বোন বিথীকা বছর দুয়েকের ছোট বড় আর দুই বোনে ভীষণ ভাব। প্রায় রোজই ফোনে ঘন্টা খানেক গল্প হবেই তাতেও মনে হয় স্বাদ মেটে না – তাই ছেলে মেয়েদের মত লতিকার মনেও খুসির জোয়ার। ওদের বর অতনু ও সোহম বা সমু আবার কলেজের বন্ধু – বুম্বা ও টুলু সমুকে মেসোকাকু বলেই ডাকে। সমু ও বিথীর মেয়ে ময়না বয়সে প্রায় টুলুর সমান তাই দেখা হলেই ওদের আর আলাদা করা যায় না – খাওয়া, শোয়া সবই প্রায় একই সাথে – দুজনেই আবার বুম্বাদাদার ভীষণ ভক্ত। সমু এখন সেচ বিভাগের কুলপি অফিসের বড় ইঞ্জিনিয়ার – এবার রথযাত্রার ছুটির সাথে শণি রবিবার ইত্যাদি মিলিয়ে দিন চারেকের ছুটি তাই সমু ফোন করেছিলো ওদের চলে আসার জন্য। এই সময়ের ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে খুব ইলিশ মাছ উঠছে গঙ্গাতে আর এটা ইলিশ মাছ খাওয়ার নিমন্ত্রণ তাছাড়া অন্য প্ল্যানও আছে তবে সেটা খোলসা করে বলে নি। কুলপি ডায়মন্ড হারবার ছাড়িয়ে আরও নিচে গঙ্গার ধারে ডিষ্ট্রিক্ট টাউন আর ওখানকার সেচ বিভাগের মাথা হচ্ছে সমু অতএব দুবার ভাবার ব্যাপারই নয়। অতনুরা ভেবেছে এবার নিজেদের গাড়ি নিয়েই যাবে – ডায়মন্ড হারবারের রাস্তাটা ভালোই – ভোর ভোর বেরুলে ঘন্টা ছয়েকের মধ্যে পৌছে যাবে।
যাবার আগের দিন থেকেই বুম্বা ও টুলুর ভীষণ উত্তেজনা – রাত্রে ঘুম আর আসতে চায় না – ঘন্টায় ঘন্টায় উঠে ঘড়ি দেখছে – শেষে মার ঘড়ির এলার্ম বাজার আগেই দুজনে উঠে চান টান করে একেবারে জুতো মোজা পরেই ঘর থেকে বেরিয়েছে। লতি তো হেসে অস্থির – অতনুকে ডেকে বললো,
‘তোমার ছেলে মেয়েকে দ্যাখো – মাসির বাড়ি যাবার জন্য কাক ভোরে উঠে দুজনেই রেডি আর স্কুলের দিন হলে তো বিছানা থেকে টেনে তোলাই মুস্কিল। তা হলে আর দেরি কেন – বেরিয়ে পড়লেই হয় – রাস্তায় কোথাও চা টা খেয়ে নেওয়া যাবে।’
ছটার আগেই ওরা বেরিয়ে পড়লো – সুন্দর রাস্তা আর এত ভোরে প্রায় ফাঁকা। ঘন্টা খানেক পর একটা ছোট জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মাটির ভাড়ে চা আর ল্যাড়ে বিস্কুট খাওয়া হলো। তারপর ডায়মন্ড হারবার শহরে কচুরি ও গরম জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট। এর মধ্যে সমুর ফোন – ন্যাসনেল হাইওয়ে থেকে ওদের বাড়ি পর্যন্ত মাইল দশেক রাস্তা বৃষ্টিতে খারাপ হয়ে খানা খন্দে ভরে আছে – ওখানটা অতনু যেন সাবধানে চালায় আর গাড়ির জানালা যেন অবশ্যই বন্ধ রাখে না হলে ট্রাক কিংবা বাস কাদা ছিটিয়ে একাকার করবে। কুলপির রাস্তায় ঢুকে গাড়িতে আর স্পিড দেওয়া যাচ্ছে না – গাড়ি, বাস, ট্রাকের সাথে গরুর গাড়ি, মোষ, ছাগল সবই চলেছে তার মধ্যে আবার ঝির ঝির বৃষ্টির শুরু। এর মধ্যে একটা ট্রাক ওদের পাশ কাটাবার সময় গাড্ডায় পড়ে ওদের ছোট্ট গাড়িকে একেবারে কাদা স্নান করিয়ে দিয়েছে – ভাগ্যিস সমুর কথা মত গাড়ির জানালা বন্ধ ছিলো। অবশেষে প্রায় একটা নাগাদ ওরা সমুদের বাড়ি পৌছালো। গাড়ির আওয়াজে প্রথমেই ময়না দৌড়ে বেড়িয়ে এসে টুলুর গলা জড়িয়ে ধরেছে – এর মধ্যে বিথী ও সমুও এসে গিয়েছে – টুলু ও ময়নার মত লতি বিথীও পারলে গলা জড়িয়ে নাচ শুরু করে। বেচারি বুম্বা গম্বীর মুখে গাড়ির ডিকি থেকে সুটকেস দুটো বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সমু তাড়াতাড়ি বুম্বাকে হাত ধরে নিয়ে এসে বিথীকে বললো,
‘তোমরা কিন্তু এ বেচারিকে পাত্তাই দিচ্ছো না – এটা অন্যায়।’
বিথী দিদিকে ছেড়ে এসে বুম্বাকে জড়িয়ে ধরলো,
‘আমার বুম্বা দাদার রাগ হয়েছে বুঝি – এবার মাছি তোকে আর ছাড়বে না। চলো, চলো সবাই ভেতরে চলো তো – এই ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে আর ভিজতে হবে না। এই দুই মেয়ে – তোরা কি বাইরেই নাচবি না ভেতরে আসবি?’
সমু হাসলো,
‘আয়, আয় সবাই ভেতরে আয় – বাচ্চাদের তো ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছে – তাই না রে বুম্বা। তোদের জন্য স্পেশাল অর্ডারে আজ সকালে এখানকার মাছের সব থেকে বড় আড়তদার ইয়াসিন মল্লিক একটা আড়াই কিলোর ইলিশ দিয়ে গিয়েছে – এই চওড়া পেটি – এ রকম বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দারুণ জমবে। কি রে বুম্বা, ইলিশ মাছ তো তোর ভীষণ প্রিয় – তোর জন্য সব থেকে বড় পেটি গুলো মাসি রেখেছে।’
হাত মুখ ধুয়ে সবাই খাবার টেবিলে – বিথী টেবিল গুছিয়েই রেখেছিলো – ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি থালায় সাজিয়ে দিলো সেই সাথে ইলিশ মাছ ভাজা – যত ইচ্ছে।
‘এ্যাই দিদি, তোর আর আমার কিন্তু প্রথমে সাদা ভাত – ইলিশ মাছ ভাজার তেলটা আলাদা করে রেখেছি আর মুড়োটা একেবারে কুড়কুড়ে ভাজা।’
‘অপূর্ব, এই না হলে আমার বোন – কত দিন ইলিশ মাছ ভাজার তেল দিয়ে ভাত খাইনি রে আর তার সাথে কুড়কুড়ে মুড়ো ভাজা – আহাঃ।’
অতনু একটু চিমটি কাটলো,
‘লতি একটু সামলে – না হলে জিভের জলে যে টেবিল ভেসে যাবে।’
টুনু ও ময়নার মাছ বেছে দিতে দিতে বিথী বললো,
‘আর বদমাইসি না করে খাওয়াতে মন দাও তো তনুদা – সব ঠান্ডা হয়ে গেলো। দেখ তো বুম্বা কেমন লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে যাচ্ছে।’
খেতে খেতে সমু ওর অন্য প্ল্যানটা বললো – কাল সকালে ওরা লঞ্চে করে সুন্দরবন বেড়াতে যাবে। সব ঠিক হয়ে গিয়েছে – লঞ্চে রান্না, খাওয়া, শোওয়া সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। কপাল ভালো হলে সুন্দরবনের মহারাজের সাথেও দেখা হতে পারে। বড় মাঝি কাদের মিঞা আরো দুজন বিশ্বাসী মাঝিকে সঙ্গে নেবে। বুম্বা ও টুলু খাওয়া বন্ধ করে হাঁ হয়ে সমুর কথা শুনছিলো – টুলু জিজ্ঞেস করলো,
‘মেসোকাকু, মহারাজটা কে?’
বুম্বা গম্বীর মুখে উত্তর দিলো,
‘এটাও জানিস না? সুন্দরবনের মহারাজ হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার – চিড়িয়াখানায় দেখিস নি? মনে নেই ওটা ডাকতে তোর কি হয়েছিলো – বলবো?’
‘এই দাদা, একদম না – তাহলে কাট্টি হয়ে যাবে কিন্তু।’
ওদের খাওয়া শেষ হতে না হতেই কাদের মিঞা এসে খবর দিয়ে গেলো লঞ্চ রেডি আছে – চাল, ডাল, তরি তরকারির সাথে দুটো মুরগি ও ডিজেল তুলে নিয়েছে। কাল সকালে জোয়ারের পরে সকাল আটটা নাগাদ রোওয়ানা হবে। ভর দুপুরে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভূরিওভোজের পর সবারই ঢুলুনি এসে গিয়েছে – সমু ও অতনু তো সোজা বিছানাতে। বাচ্চারাও একটু সময় এদিক ওদিক করে আর জেগে থাকতে পারলো না তবে লতি ও বিথী বিছানাতে শুয়ে শুয়ে নিজেদের গল্পে মেতে রইলো।
পর দিন সকালে পাওরুটি মাখন আর ডিম সেদ্ধ খেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লো গঙ্গার ঘাটের দিকে। নৌকা দেখে বুম্বা অবাক – কত বড় তার মধ্যে আবার ঘরও আছে – ওপরে রেলিং দেওয়া ছাত তাতে আবার চেয়ার টেবিল পাতা। গঙ্গাতে স্রোত বেশ – নদী কি বিরাট চওড়া এখানে – ওপাড় প্রায় দেখাই যায় না। স্রোতে নৌকা বেশ দুলছে – কাদের মিঞা ওদের হাত ধরে কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে নৌকাতে নিয়ে এলো। লতির বেশ ভয় ভয় করছিলো – এই প্রথম নৌকাতে চড়েছে তার ওপর কি স্রোত রে বাবা – বার বার বাচ্চাদের সাবধান করছিলো,
‘তোরা একদম রেলিং এর পাশে যাবি না কিন্তু।’
কাদের মিঞা হেসে বলল,
‘ভয় পাইয়েন না মা ঠাকরান – আমরা আছি – কিছু হইবো না।’
জিনিষ পত্র নিচে রেখে সবাই ছাতে গিয়ে বসতে কাদের মিঞা বদর বদর বলে নৌকার গলুইতে নদীর জল ছিটিয়ে হাল ধরলো আর এক জন মাঝি নৌকার কাছি খুলে দিতেই স্রোতের টানে নৌকা পাড় থেকে খানিকটা দূরে এসে কাদের মিঞার হালের কেরামতিতে হেলতে দুলতে এগিয়ে চললো। গঙ্গার জল বেশ ঘোলা আর ঢেউ গুলো ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পাড়ে এসে ধাক্কা দিচ্ছে – মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে তাই গরম একেবারেই নেই। আকাশে নানা রঙ্গের মেঘে ভেসে চলেছে – কোনটা ধূসর, কোনটা কালচে আর ওদের মাঝে সাদা মেঘেরাও মিলে মিশে চলেছে ঘাড়ে ঘাড় মিলিয়ে তবে বাঁচোয়া যে বৃষ্টি নেই। নদীর পাড়ে গাছ পালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝেই দেখা যায় ছোট ছোট গ্রাম – মাটি কেটে নারকেল গাছ ফেলে তৈরি হয়েছে নদীর ঘাট – মাছ ধরার নৌকা গুলো ঘাটের কাছেই বাঁধা আর তার আশে পাশে বেশ কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাছ ধরার জাল গুলোকে কয়েক জন পরিষ্কার করছে নদীর ধারে। কাদের মিঞা বললো, ভোর বেলা মাছ ধরে জেলেরা ফিরেছে এখন পাইকারি ক্রেতারা দাম দর করছে মাছ কেনার জন্য। নদীতে কত ছোট বড় নৌকা চলেছে – নদীর মাঝখান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে স্টিমার চলেছে বেশ কয়েকটা। একটু পর দূর থেকে একটা মস্ত বড় জাহাজ আসতে দেখা গেলো – ওটাকে সম্ভ্রম দেখিয়েই বোধ হয় সব কটা নৌকা, স্টিমার সরে গেলো নদীর মাঝখান থেকে। জাহাজটা কাছে আসতেই আসল কারণটা বোঝা গেলো - জাহাজের পেছনের টার্বাইন ব্লেডের ধাক্কায় সাদা ফেনা ছড়িয়ে বেশ বড় বড় ঢেউ উঠে দুদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আর তার ধাক্কায় ছোট ছোট নৌকা গুলো বেশ জোরেই দুলে উঠলো এমন কি একটু পরেই ওদের নৌকাকে দুলিয়ে ঢেউ গুলো পাড়ে আছড়ে পড়লো। কাদের মঞা বললো,
‘বিদেশের জাহাজ – অনেক মাল নিয়া চলছে ডায়মন্ড হারবার। আপনাগোর কোলকাতায় এত বড় জাহাজ যাইতে পারে না নদীর পলির জন্য।’
চারদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে কি করে সময় কেটে যাচ্ছে বোঝাই গেলো না – এমন কি লতি বিথীও গল্প করা ভুলে গিয়েছে। দুপুরের খাবার আসতে বোঝা গেলো প্রায় একটা বাজে – একটু লালচে চালের ভাত, ঝুর ঝুরে মৌরালা মাছ ভাজা, পেঁয়াজ দিয়ে মশুর ডাল আর শুকনো শুকনো করে রান্না মুরগির মাংস। কাদের মিঞা বললো,
‘সকালে মৌরালা মাছ পাইয়া গেলাম – দ্যাখেন মা ঠাকরানরা খালেদ ভাই কেমন রান্না করলো। পোলাপানের জন্য মরিচ একেবারেই দেয় নাই।’
এই অপূর্ব পরিবেশে খাওয়াটাও অপূর্ব লাগছে – গঙ্গার বুকে চলতে চলতে এই খাওয়া ভাবাই যায় না। বহুদিন পর লতিরা এই রকম মৌরালা মাছ ভাজা খেলো আর মুরগি রান্না তো যে কোন বড় হোটেলের সাথেই পাল্লা দিতে পারে। সমু আস্তে করে লতিকে বললো,
‘এই জন্যই কাদের মিঞাকে নেওয়া – ও ঠিক বুঝতে পারে আমাদের জিভ।’
খাওয়া দাওয়ার পর সবাই বিশ্রাম করতে গেলেও বুম্বা ছাত থেকে নামলো না – ওখানে বসে বসেই কাদের মিঞার সাথে কত গল্প আর ওর হাজারো প্রশ্নের উত্তর কাদের মিঞা হাসি মুখে দিয়ে গেলো। ওরা এখন সুন্দরবনের দিকে চলেছে – নৌকা গঙ্গা থেকে সরে একটা খাড়ির মধ্যে চলে এসেছে। আস্তে আস্তে দুই পাড়ের চেহারাও পালটে যাচ্ছে বাঁ পাড়ে ধান ক্ষেত, গ্রাম দেখা গেলেও ডান দিকে জঙ্গল। কাদের মিঞা জানালো, এখানকার জলে বেশ বড় বড় কুমির আছে তবে তা থেকেও ভয়ের হলো কামট বা ছোট হাঙ্গর – নদীর ঘাটে সাবধানে দেখে শুনে জলে না নামলে টের পাবার আগেই হাত বা পা কেটে নিয়ে যাবে। বুম্বা অবাক হয়ে ভাবছিলো কাদের মিঞা কি করে নদীর রাস্তা মনে রেখেছে – এক খাড়ি থেকে আর এক খাড়িতে এঁকে বেঁকে চলেছে – বুম্বার কাছে সবই তো সমান মনে হচ্ছে। অবশ্য ডান দিকের জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে এসেছে – এদিকের খাড়িতে বিশেষ নৌকা দেখা যাচ্ছে না। ভাটার জন্য নদীর ধারে বিশেষ করে ডান দিকে ভীষণ কাদা আর তার মধ্যে লাঠির মত কি সব দাঁড়িয়ে আছে – শুধু পাড়েই নয় ওই ডান্ডা গুলো জঙ্গলের ভেতর দিকেও ছড়িয়ে আছে। কাদের মিঞা বললো এগুলো সুন্দরী গাছের শেকড় – জোয়ারের সময় অনেকটা জঙ্গলও নোনা জলে ডুবে যায় তাই শেকড় গুলো খাড়া ওপর দিকে দু তিন ফুট ওঠে আলো হাওয়ার জন্য। এখানকার সব গাছ পালা নোনা জলেই বেঁচে থাকে – এটাই সুন্দরবনের বিশেষত্ব। এর মধ্যে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে অন্য মাঝি বসির আলি একটা ছোট জাল বের করে নৌকার পেছন থেকে ঘুরিয়ে ছুঁড়তে ওটা খোলা ছাতার মত গিয়ে জলে পড়লো। বুম্বা তাড়াতাড়ি নৌকার পেছনে এসে দেখে বসির ধীরে ধীরে জালটাকে টেনে তুলছে আর তার মধ্যে বেশ কিছু ছোট বড় মাছ লাফাচ্ছে। এর মধ্যে খালেদ ভাইও এসে গিয়েছে – ওরা কিছু মাঝারি সাইজের মাছ বেছে নিয়ে বাকিদের জলে ছেড়ে দিলো।
দুপুরের দিবা নিদ্রার শেষে বিথী নৌকার ছাতে এসে অবাক হলো,
‘কি রে বুম্বা, তুই সারা দুপুর এখানেই বসে ছিলি?’
‘মাসি, কাদের মিঞার কাছে কত কিছু শিখলাম – জানো, আমরা এখন সুন্দর বনে চলে এসেছি – ওই যে কাদা আর জঙ্গলের মধ্যে লাঠি গুলো দেখছো ওগুলো কিন্তু সুন্দরী গাছের শেকড় – এখানের সব গাছপালা নোনা জলেই হয়।’
হঠাৎ কাদের মিঞা নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো,
‘দ্যাখেন, দ্যাখেন, এক দল হরিণ আইসে পানি খাইতে।’
সবার নজর ওই দিকে – গোটা দশ বারো হরিণ সজাগ চোখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে কাদা পেরিয়ে নদীর ধারে জল খেতে এসেছে। কি সুন্দর রং – সারা গায়ে হলুদ রঙের মধ্যে কালো বুটি বুটি আর এই বড় বড় টানা টানা চোখ – কয়েকটার আবার বড় বড় শিং আছে – চোখ ফেরানো যাচ্ছে না এত অপূর্ব দেখতে। জল খেতে খেতে ওরা মাঝে মাঝেই মুখ তুলে চার দিক দেখে নিচ্ছে – হঠাৎই একটা বড় শিংওয়ালা হরিণ ছট ফট করে কেমন একটা অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠতেই সব কটা হরিণ জল খাওয়া ছেড়ে লম্বা লম্বা লাফে কাদা পেরিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেলো। নৌকার পেছন থেকে খালেদ ভাই বললো,
‘ও কাদের মিঞা, কুমির আইসে – নৌকার ডাইনে দ্যাখেন।’
সবাই তাকিয়ে দেখে একটা বড় কুমির পাড়ের কাদার গা ঘেঁসে জলে ভাসছে আর ওটাকে দেখতে পেয়েই হরিণদের সর্দার ওই ভাবে ডেকে উঠেছিলো। লতি ও বিথী শিউরে উঠলো,
‘চিড়িয়াখানায় দেখা আর এখানে দেখার মধ্যে কত তফাৎ।’
কাদের মিঞা ধীরে ধীরে বললো,
‘এত গুলান হরিণ এই খানে – মহারাজ কাছেই হইবেন – কি কও খালেদ ভাই?’
‘মনে তাই হয় মিঞা। এই সময়টা তো ওনার খুব প্রিয় – সব জন্তু জানোয়ার গুলান নদীতে পানি খাইতে আসে।’
সমু জিজ্ঞেস করলো,
‘কি কাদের মিঞা, মহারাজ দর্শন দেবেন নাকি?’
‘দেখা যাউক। ও খালেদ ভাই তুমি আর বসির আলি একটুকান বৈঠা টানো দেখি। মহারাজ বৈঠার আওয়াজটা পছন্দ করেন বলিয়াই তো জানি।’
বুম্বা অবাক হলো,
‘বৈঠার আওয়াজ কেন মেসোকাকু?’
‘বৈঠার আওয়াজ শুনে বাঘ বুঝতে পারে নৌকা চলেছে – শুনেছি নদী সাঁতরে এসে ছোট নৌকার ওপর অনেক সময় হামলা করে লোক তুলে নিয়ে গিয়েছে।’
লতি হয়ে কেঁপে উঠলো,
‘এই সমুদা, আমাদের নৌকায় হামলা করবে না তো? কাদের মিঞা তো বৈঠার আওয়াজে নিমন্ত্রণ করছে। তুমি বলো ইঞ্জিন চালিয়ে তাড়া তাড়ি এখান থেকে সরে যেতে। দরকার নেই মহারাজার দর্শনের।’
কাদের মিঞা হাসলো,
‘ভয় পাইয়েন না মা ঠাকরান – আমাগো বড় নৌকা – এই খানে উনি উঠতে পারবেন না। আর আমরা তো মাঝ নদীতে।’
হঠাৎই দূর থেকে একটা গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো। কাদের মিঞা বললো,
‘ওই শুনেন উনার হাঁক – মনে লয় অন্য দিকে চইলা গ্যাছেন শিকারে।’
বুম্বা টুলুর দিকে তাকালো,
‘কি রে টুলু, শুনলি তো মহারাজের হাঁক – তোর কিছু হয় নি তো?’
‘দাদা, আমি বড় হয়েছি – উলটো পালটা কথা বলবি না একদম।’
ধীরে ধীরে গোধূলির আলোতে জঙ্গলে আলো থেকে ছায়ার খেলা বেড়ে গেলো। হাজার হাজার নাম না জানা পাখীর ঘরে ফেরার আওয়াজে চারদিক ভরে গিয়েছে – গাছের ওপর ওদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আসছে। কাদের মিঞা জানালো আর একটু এগিয়ে খাড়িটা যেখানে অনেকটা চওড়া হয়েছে ওখানেই নদীর মাঝখানে আজ রাতের জন্য নৌকার নঙ্গর ফেলবে – অন্ধকারে নৌকা চালানো ঠিক হবে না। গোধূলির আলোর পর অন্ধকার খুব তাড়াতাড়ি নেমে এলো। বসির আলি গোটা তিনেক প্যাট্রমাক্স জ্বালিয়ে ছাতে, ঘরে আর নৌকার সামনে রাখলো আর সেই আঁধো ভূতুরে আলোতে কাদের মিঞা নৌকা এগিয়ে নিয়ে গেলো যেখানটায় খাড়িটা অনেকটা চওড়া আর নদীর বাঁ দিকে একটা গ্রামও দেখা যাচ্ছে – গ্রামের আলোগুলো জোনাকি পোকার মত চিক চিক করছে। সমু আস্তে করে বললো,
‘সুন্দরবনের আরও ভেতরে বোম্বেটেদের আনাগোনা আছে আর চোরা চালানকারীদেরও ফলাও ব্যবসা বাংলা দেশের সাথে। তবে এদিকে এখনও শোনা যায় নি।’
বিথী ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
‘কি দরকার ছিলো রাত্রে নদীতে থাকার। তোমার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি – এখন ভালোয় ভালোয় কালকে বাড়ি ফিরে যেতে পারলে বাঁচি।’
কাদের মিঞা ভরসা দিলো,
‘ভয়ের কিছু নাই – ডাকাইতরা এই দিকে আসে না। বাংলা দেশেই বেশী জ্বালায়।’
রাত্রের খাওয়াটাও জমিয়ে হয়েছে – সরষে ইলিশ আর পার্শে মাছের ঝোল। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে ছাতে বসেই গল্প চললো। ডান দিকের জঙ্গল থেকে নানা রকম রাত জাগা পাখীর আওয়াজ আসছে – এই আঁধো অন্ধকারে কেমন যেন গা ছম ছম করা ভাব। পেট্রোমাক্সের আলো চার পাশের অন্ধকারকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের আলো গুলো এক এক করে নিভতে শুরু করেছে – চারদিকে কেমন যেন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। দূরে কোথাও হরিণের ডাক শোনা গেলো তারপরই আবার সেই হুঙ্কার। লতি ভয়ে কেঁপে উঠলো,
‘আর নয় – ছাতে বসে এমনিতেই গা ছমছম করছে তার মধ্যে আবার মহারাজের ডাক – চলো সবাই নিচে শুতে – আমার এখানে ভয় করছে।’
সবাই শুয়ে পড়লেও বুম্বার আর ঘুম আসে না – অনেক ক্ষণ এদিক ওদিক করে চুপি চুপি দরজা খুলে এসে ছাতের সিঁড়িতে বসলো। এখন একটা মাত্র পেট্রোমাক্স জ্বলছে তাও আলোটা খুব কমানো ফলে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার – নদীর দুই পাড়ে জোনাকি পোকারা জ্বলছ নিভছে। মাঝে মাঝে অন্য কোন জন্তু জানোয়ার বোধ হয় নদীতে জল খেতে আসছে – ওদের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠছে। মাঝিরাও ঘুমিয়ে পড়েছে। বুম্বার কিন্তু একেবারেই ভয় করছে না – আপন মনে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আরো কিছু দেখা যায় কিনা তার চেষ্টাই করে চললো। হঠাৎ মনে হলো ডান দিকে নদীর ধারে দুটো বড় বড় চোখ জ্বল জ্বল করেই আবার হারিয়ে গেলো – একটু পরেই আবার ফিরে এলো। বুম্বা শক্ত হয়ে বসে ওই দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে – এখন আর অন্ধকারে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিছু সময় নদীর ধারে নানা জায়গায় ওই চোখ জোড়া দেখা গেলো যেন কোন জন্তু নদীর ধারে পায়চারি করছে। একটু পরেই ছপ ছপ শব্দ করে কেউ যেন জলে নামলো তারপরই ওই জ্বলজ্বলে চোখ দুটো জলে ভেসে ভেসে এগিয়ে এলো। বুম্বার মনে ঝড়ের বেগে অনেক গুলো চিন্তা এসে গিয়েছে – ওই চোখ দুটো তো মহারাজ ছাড়া আর কারো হতেই পারে না – ওটা কি নৌকার দিকেই আসছে? ও কি করবে? মাঝিদের ডাকবে? তারপর ভাবলো দেখাই যাক না মহারাজ কি করেন – হয়তো বা সাঁতরে ওপাশের গ্রামের দিকে চলেছেন গরু ছাগলের খোঁজে – তাছাড়া কাদের মিঞা বলেছে ওদের নৌকা অনেক উঁচু। আস্তে করে সিঁড়ি থেকে নেমে বুম্বা নৌকার গলুইএর দিকে এগিয়ে গেলো – ওখানে বসির ভাই ঘুমাচ্ছে। দেখে ধীরে ধীরে ওই ভাটার মত জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর সাথে মস্ত বড় মাথা গলুইএর কাছে এসে গিয়েছে – কিন্ত ওখানটা তো জল থেকে প্রায় পাঁচ ফুট ওপরে – তাহলে? গলুইএর পাশে রাখা বৈঠাটাকে দু হাতে শক্ত করে ধরে বুম্বা রেডি হয়ে বসলো – হঠাৎ বাঘটা অদ্ভুত কায়দায় জল থেকে লাফিয়ে উঠে নৌকার ধারটা ধরে ফেলেছে আর ওর ওজনে নৌকা সামনের দিকে আরো নিচু হয়ে গিয়েছে – বুম্বার থেকে মাত্র ফুট পাঁচেক দূরে। এই বড় মাথা, থাবার নখ গুলো ইঞ্চি তিনেক করে বেরিয়ে এসেছে – ভাটার মত চোখ দুটো একবার বুম্বাকে দেখছে আর একবার ঘুমন্ত বসির ভাইকে। বুম্বা প্রাণের ভয়ে ‘বসির ভাই - বাঘ’ বলে প্রচন্ড চিৎকার করে গায়ের সমস্ত জোরে বৈঠাটাকে তুলে বাঘটার নাকের ওপর মারলো - -
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
‘এ্যাই বুম্বা, ভোর সন্ধ্যে বেলা ঘুমের মধ্যে এমন গাঁক গাঁক করে চেঁচাচ্ছিস কেন।’
বলে বিথী দৌড়ে এসেছে – পেছন পেছন লতিও হাজির। বুম্বা উঠে বসেছে – সমস্ত গা ঘামে ভেজা। লতিই বললো,
‘ঠিক উলটো পালটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। হবে না? ভর পেট খিচুড়ির সাথে ওতো গুলো ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে দুপুরে ঘুমিয়েছে – পেট গরম তো হবেই।’
অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্নাটক
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন নাথ
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প