ছোট্ট ইডার ফুল গুলি
"আমার সব ফুলগুলো প্রায় মরেই গেল", বলল ছোট্ট ইডা, " গতকাল সন্ধাবেলায় এগুলি কত সুন্দর ছিল, আর এখন, সব পাতাগুলি কেমন ঝুলে পড়েছে। এরকম কেন হয় ..." সে সোফায় বসে থাকা তার বাবার ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করল। এই ছাত্রকে তার খুব পছন্দ, সে নানারকমের মজার মজার গল্প বলে, সুন্দর সুন্দর ছবি কেটে দেয়ঃ মেয়েরা নাচছে, দরজা খুলে যাওয়া রাজপ্রাসাদ, ফুল, পাতা; ওকে তার খুব পছন্দ। " আমার ফুলগুলি আজকে এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন?" সে আবার জিজ্ঞাসা করল, নিজের হাতের শুকিয়ে যাওয়া ফুলের তোড়াটার দিকে তাকিয়ে।
"তুমি জাননা ওদের কি হয়েছে?" ছাত্রটি বলল, " ফুলগুলি গত রাতে একটা বল নাচের আসরে গেছিল, আর সেই কারণে, খুব স্বাভাবিকভাবেই, ওরা ক্লান্ত।"
"কিন্তু ফুলেরা কি নাচতে পারে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ছোট্ট ইডা।
"হ্যাঁ , অবশ্যই, ওরা নাচতে পারে, " বলল ছাত্রটা। " যখন অন্ধকার হয়ে যায়, আর সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, ওরা তখন আনন্দে নেচে বেড়ায়, প্রায় প্রতি রাত্রেই।"
" ছোটরা কি এই নাচের আসরে যেতে পারে?"
"হ্যাঁ, " বলল সেই ছাত্র। " ছোট্ট ছোট্ট ডেইসি আর লিলি অফ দ্য ভ্যালি।"
"এই সুন্দর ফুলগুলি কোথায় নাচতে যায়?" জিজ্ঞেস করল ছোট্ট ইডা।
"তুমি কি শহরের দরজার বাইরে বিরাট প্রাসাদটাকে দেখনি, যেখানে রাজা গ্রীষ্মকালে থাকতে আসেন, আর যেখানে একটা ফুলে ভর্তি দারুণ সুন্দর বাগান আছে? আর যখন রাজহাঁসগুলি তোমার দিকে ভীড় করে এসেছে, তুমি তাদেরকে রুটি খেতে দাওনি? ঐখানেই, ফুলেদের নাচের আসর বসে, বিশ্বাস কর !"
" আমি তো গতকালই মায়ের সাথে ওই বাগানে গেছিলাম, " বলল ইডা, " কিন্তু সব গাছ থেকে পাতা পড়ে গেছিল, আর একটা ফুল ও ছিল না। ওরা সব কোথায় গেল? আমি গরমকালে কত ফুল দেখেছিলাম।"
" ওরা সবাই রাজপ্রাসাদে ছিল, " বলল সেই ছাত্র, " শোন, যেই রাজা আর তাঁর মন্ত্রী-সান্ত্রীরা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যান, সব ফুলগুলি তখন বাগান ছেড়ে প্রাসাদে চলে যায়, আর খুব আনন্দে থাকে। সবথেকে সুন্দর দুটো গোলাপফুল সিংহাসনে বসে, তাদেরকে বলা হয় রাজা আর রানী, আর লাল মোরগঝুঁটি ফুলেরা দুই পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করে, তারা যেন রাজসভার অমাত্য। তারপরে সুন্দর ফুলেরা সবাই সভায় আসে, আর এক বিশাল নাচের আসর বসে। নীলরঙা ভায়োলেটরা হয় নৌসেনা, আর তারা হায়াসিন্থ আর ক্রোকাস্দের মত সুন্দরী মেয়ে ফুলেদের সাথে নাচ করে। টিউলিপ আর টাইগার লিলিরা হয় বয়স্ক অভিজাতদের মত, তারা খেয়াল রাখে রাজসভার নাচ নিয়ম কানুন মেনে হচ্ছে কিনা।"
" কিন্তু, " জিজ্ঞেস করল ছোট্ট ইডা, " রাজার প্রাসাদে নাচ করার জন্য কেউ ফুলগুলিকে বকে না?"
"কেউ তো জানতেই পারে না, " বলল সে ছাত্র। "প্রাসাদের বুড়ো প্রহরী, যে কিনা রাতের প্রহরায় থাকে, সে মাঝে মাঝে ভেতরে আসে; কিন্তু তার সঙ্গে থাকে একটা বিশাল বড় চাবির গোছা, আর ফুলেরা যখনই সেই চাবিগুলির ঝন্ঝন্ শব্দ শুনতে পায়, তারা গিয়ে লম্বা পর্দাগুলির পেছনে লুকিয়ে পড়ে, আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু মাঝেমধ্যে একটু উঁকি মারে। আর বুড়ো প্রহরী বলে, " আমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছি..." , কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না।"
"ওহ, কি দারুণ ব্যাপার," হাততালি দিয়ে বলল ছোট্ট ইডা, " আমি কি এই ফুল গুলিকে দেখতে পাব?"
"হ্যাঁ," বলল সেই ছাত্র, " এর পরের বার তুমি যখন যাবে, খেয়াল রেখ একটু , আর তুমি ওদেরকে দেখতেই পাবে, যদি তুমি জানালা দিয়ে উঁকি মার। আমি আজকে তাই করেছিলাম, আর আমি দেখলাম সোফার ওপরে একটা লম্বা হলুদ লিলি টান্টান্ হয়ে শুয়ে আছে। সে ছিল রানীর সখী।"
"আচ্ছা, বোটানিকাল বাগান থেকে কি সেখানকার ফুলগুলি এই বল নাচের আসরে যেতে পারে?" জিজ্ঞেস করল ইডা ।" ওখান থেকে পথ তো অনেকটা !"
"হ্যাঁ , হ্যাঁ, " বলল সেই ছাত্র, " ওরা যখনই চায়, তখনই উড়তে পারে। তুমি কি সেই সুন্দর লাল, সাদা আর হলুদ রঙের প্রজাপতিগুলিকে দেখনি, যেগুলিকে ফুলের মত দেখতে? সেগুলি তো একসময়ে ফুলই ছিল। ওরা নিজেদের ডাঁটা ছেড়ে , আর নিজেদের পাতাগুলিকে ছোট ছোট ডানার মত নেড়ে উড়ে গেছে। তারপরে, যদি ওরা লক্ষ্মী হয়ে থাকে, ওদেরকে অনুমতি দেওয়া হয় দিনের বেলা উড়ে বেড়ানোর।ওদের আর চুপ করে ডাঁটার ওপরে বসে থাকতে হয় না, আর এইভাবে একসময়ে ওদের পাতাগুলি সত্যিকারের ডানা হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, এটা হতে পারে, যে বোটানিক্যাল বাগানের ফুলগুলি কোন দিন রাজার প্রাসাদে যায়নি, আর তাই, তারা ওখানে যে সব মজা হয়, সেসবের সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমি তোমাকে বলছি তুমি ক করবে, আর ওই যে গাছপালার মাস্টারমশাই, যিনি তোমার পাশের বাড়িতে থাকেন, তিনি একদম অবাক হয়ে যাবেন। তুমি তো ওনাকে ভাল করেই চেন, তাই না? তাহলে শোন, এর পরে যেদিন তুমি ওনার বাগানে যাবে, তুমি যেকোন একটা ফুল কে বলে দেবে যে প্রাসাদে একটা বিরাট বল নাচের আসর বসবে, তাহলে সেই ফুলটা অন্যদেরকেও বলে দেব, আর ওরা সবাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রাসাদে উড়ে চলে যাবে। আর যখন ওই মাস্টারমশাই নিজের বাগানে হাঁটতে যাবেন, তখন একটাও ফুল থাকবে না। ভাব একবার, উনি কিরকম অবাক হয়ে যাবেন !"
"কিন্তু একটা ফুল অন্য ফুলগুলিকে বলবে কি করে? ফুলেরা কি কথা বলতে পারে?"
"না, তা পারে না, " উত্তর দিল ছাত্রটি, " কিন্তু ওরা সঙ্কেত পাঠাতে পারে। তুমি কি দেখনি যখন জোরে বাতাস বয়, তখন ওরা কেমন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়, আর নিজেদের সবুজ পাতাগুলি দিয়ে খস্খস্ শব্দ করে?"
"মাস্টারমশাই কি সঙ্কেতগুলি বুঝতে পারবেন?" জিজ্ঞেস করল ইডা।
"হ্যাঁ, সে উনি বুঝতে পারবেন। উনি একদিন সকালে নিজের বাগানে গেছিলেন, গিয়ে দেখেন একটা কাঁটাওয়ালা বিছুটি একটা সুন্দর লালা কার্নেশন কএ বিরক্ত করছে। সেটা বলছে, "তুমি কি সন্দর, আমার তোমাকে খুব পছন্দ"। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের এই দুষ্টুমি পছন্দ হল না, কিন্তু বিছুটি কান মুলে দিতে গেলেন। তখন বিছুটি, নিজের কাঁটাগুলি দিয়ে, যেগুলি কিনা আসলে তার আঙুল , ওনাকে এত জোরে খোঁচা দিয়েছে, আর ওনার এমন চুলকানি হয়েছে, যে তারপর থেকে উনি আর বিছুটির ধারে কাছে ঘেঁষেন না।"
"ওহ, কি মজার ব্যাপার," হেসে উঠে বলল ইডা।
সোফায় বসেছিলেন একজন মুখ গোমড়া উকিলবাবু, যিনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি ছাত্রটিকে মজাদার ছবি কাটতে দেখলেই রেগে গজগজ করতেন। সে হয়ত কাগজ কেটে বানিয়েছে ঝাঁটায় চড়ে উড়ে যাওয়া এক ডাইনিবুড়ি, অথবা, আকাশ থেকে ঝুলে থাকা একটা লোক, আর তিনি দেখলেই রগে গিয়ে বলতেন, "কি করে একটা শিশুর মাথায় এইসব আজগুবি কথা কেউ ঢোকাতে পারে! কি অসম্ভব বাজে কথা সব !!" আজকেও তিনি গজগজ করে বললেন, "কি করে একটা ছোট্ট শিশুর মাথায় এইসব কথা কেউ ঢোকাতে পারে?"
কিন্তু ছোট ইডার কাছে, ছাত্রটি এই যে ফুল নিয়ে গল্পগুলি বলেছিল, সেগুলি খুব মজাদার লাগল, আর সে সেগুলি নিয়ে অনেক অনেক ভাবল। ফুলগুলি সত্যিই মাথা ঝুঁকিয়ে ছিল, কারণ ওরা সারারাত নেচেছে, আর খুব ক্লান্ত ছিল, আর হয়ত ওদের একটু শরীর খারাপও ছিল। তারপরে সে ফুলগুলিকে নিয়ে সেই ঘরে গেল যেখানে একটা ছোট্ট সুন্দর টেবিলে অনেক খেলার জিনিষ রাখা ছিল, আর টেবিলের ড্রয়ারটা নানারকমের সুন্দর জিনিষে ভর্তি ছিল। তার পুতুল সোফি নিজের ছোট্ট বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। ইডা তাকে বলল, "সোফি, এবার তোমাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে, আজ রাতের জন্য তুমি কষ্ট করে ড্রয়ারে থাক, ফুলগুলি খুব ক্লান্ত, আর তোমার বিছানায় আজকে ফুলগুলি শোবে, তাহলে হয়ত ওরা ভাল হয়ে যাবে।" এই বলে সে পুতুলটাকে তুলে নিল। সোফির মুখ দেখে মনে হচ্ছিল খুব রেগে গেছে, কিন্তু সে কিনা বিছানা ছাড়তে হচ্ছে বলে খুব রেগে গেছিল, তাই সে কোন কথা বলল না। ইডা ফুলগুলিকে পুতুলের বিছানায় শুইয়ে দিল, তাদের গায়ের ওপরে কাঁথা টেনে দিল। তারপরে সে তাদেরকে বলল লক্ষ্মী হয়ে শুয়ে থাকতে। তারপরে সে তাদের জন্য খেলার কেতলিতে চা বানিয়ে খেতে দিল, যাতে তারা একটু ভাল বোধ করে , আর পরের দিন ভাল হয়ে উঠতে পারে। তারপরে সে ছোট্ট বিছানাটার চারপাশ দিয়ে ভাল করে পর্দা টেনে দিল, যাতে তাদের চোখে রোদ না লাগে। সেই ছাত্র তাকে যা বলেছিল, সেইসব নিয়ে সারা সন্ধ্যা ধরে সে ভাবতেই থাকল। আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে, সে আর থাকতে না পেরে, জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে বাগানের দিকে উঁকি দিল, যেখানে তার মায়ের হাতে করা সুন্দর ফুলগুলি ফুটে ছিল - হায়াসিন্থ , টিউলিপ, আরো কত কি! তারপরে সে চুপিচুপু তাদেরকে বলল, "আমি জানি তোমরা আজ রাতে একটা বল নাচের আসরে যাবে।" কিন্তু ফুলগুলি এমন ভাবে স্থির রইল, যেন তারা কিছুই বোঝেনি, একটা পাতাও নড়ল না। কিন্তু ইডা একদম নিশ্চিত হয়ে গেল যে সে সব কিছু বুঝে গেছে। বিছানায় শুয়েও সে অনেকক্ষণ জেগে রইল, আর ভাবতে লাগল, রাজার প্রাসাদে সব ফুলগুলি যখন নাচবে, তখন দেখতে না জানি কতই ভাল লাগবে! "আমার ফুলগুলো কি সত্যি সত্যিই ওখানে গেছিল..." ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের বেলা ইডার ঘুম ভেঙে গেল। সে স্বপ্নের মধ্যে তার ফুলগুলিকে, সেই ছাত্রকে আর সেই গোমড়ামুখো উকিলবাবুকে দেখছিল। তার শোবার ঘর নিঃস্তব্ধ, তার বাবা আর মা অঘোরে ঘুমাচ্ছেন, শুধুমাত্র রাতবাতিটা টিমটিম করে জ্বলছে। " আমার ফুলগুলো কি এখনো সোফির বিছানায় ঘুমিয়ে আছে," ভাবল ইডা, "জানতে পারলে বেশ হয়।" সে বিছানার থেকে মাথাটা একটু তুলল, আর পাশে যে ঘরে তার খেলনা আর ফুলগুলি ছিল, সেই দরজার দিকে তাকাল। দরজাটা আধা খোলা ছিল, আর তার মনে হল, সেই ঘরে কে যেন খুব আস্তে, মিষ্টি সুরে পিয়ানো বাজাচ্ছে। এমন বাজনা সে আগে কোনদিন শোনেনি। "এখন সব ফুলগুলো নিশ্চয় ওখানে নাচ করছে, "ভাবল সে, " ওহ, আমার কি দেখতে ইচ্ছা করছে! " কিন্তু সে বিছানা থেকে নড়ল না, বাবা-মায়ের যদি ঘুম ভেঙে যায়! " আহা, ওরা যদি এই ঘরে আসত," সে ভাবল। কিন্তু কেউই এলনা, আর ওদিকে বাজনাটা এত সুন্দর ভাবে চলতেই থাকল যে সে আর ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারল না। সে নিজের ছোট্ট বিছানা ছেড়ে উঠে, পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিল। ওহ! কি দারুণ এক দৃশ্য সেখানে দেখা গেল! সেই ঘরে কোন রাত বাতি জ্বলছিল না, কিন্তু ঘরের মধ্যে যথেষ্ট আলো ছিল, কারণ জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে মেঝেতে পড়ে প্রায় দিনের মতই ঝকঝক করছিল। সমস্থ হায়াসিন্থ আর টিউলিপেরা লম্বা সারি দিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল , জানালায় বা ফুলদানিগুলিতে একটা ফুলও ছিলনা। ফুলগুলি তাদের লম্বা লম্বা সবুজ পাতা দিয়ে একে অপরকে ধরে, মেঝেতে ঘুরে ঘুরে নাচ করছিল। পিয়ানোয় বসে বাজাচ্ছিল একটা বড় হলুদ রঙা লিলি। ইডার মনে হল এই ফুলটাকে সে গ্রীষ্মকালে দেখেছে, কারণ তার মনে পড়ল, সেই ছাত্রটা বলেছিল হলুদ লিলিটাকে দেখতে তার পিয়ানো দিদিমণি মিস লীনার মত। তখন সবাই তার কথা শুনে হেসেছিল, কিন্তু, এখন ইডার মনে হল, সেন সেই লম্বা, হলুদ ফুলটাকে দেখতে সত্যিই মিস লীনার মত ! তাঁর মতনই ফুলটা মাথা এদিক ওদিক ঝুঁকিয়ে বাজাচ্ছিল , আর বাজনার তালে তালে মাথা দোলাচ্ছিল। তারপরে সে দেখতে পেল একটা উজ্জ্বল বেগুনী রঙা ক্রোকাস এক লাফে গিয়ে উঠল তার খেলার টেবিলের ওপরে, আর গিয়ে পুতুলের বিছানার চারপাশ থেকে পর্দা সরিয়ে দিল; সেখানে শুয়ে ছিল সেই অসুস্থ ফুলগুলি, কিন্তু তারা এক লাফে উঠে বসল, আর অন্যদের দিকে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে জানান দিল যে তারাও নাচ করতে চায়। পুরনো কাপড়ের পুতুলটা, যার কিনা মুখ ভাঙা, সে উঠে ফুলগুলিকে লম্বা কুর্নিশ জানাল। তাদের দেখে মনেই হচ্ছিল না যে তারা অসুস্থ, বরং তারা আনন্দে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু তারা কেউই ছোট্ট ইডাকে খেয়ালই করল না।
তারপরে মনে হল টেবিলের ওপর থেকে কি যেন একটা লাফ দিয়ে পড়ল। ইডা দেখল, মেলায় কেনা রংচঙে লম্বা লাঠিটা ফুলেদের মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে এমন হাবভাব দেখাচ্ছে যেন সে তাদেরই একজন। লাঠিটার মাথায় সেই উকিলবাবুর মত চওড়া টুপি পড়া একটা ছোট্ট মোমের পুতুল বসে ছিল। লাঠিটা ফুলেদের মাঝখানে পা ঠুকে ঠুকে নাচতে শুরু করল; ফুলেরা তার সাথে তাল মেলাতে পারল না, তাদের পা অত শক্ত নয় কিনা! হটাত করে লাঠীড় মাথায় বসে থাকা মোমের পুতুলটা যেন বড় আর লম্বা হতে থাকল, আর সে ঘুরে বসে ফুলগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, " এইসব কথা তোমরা কি করে একটা শিশুর মাথায় ঢোকাতে পার? যত্ত সব আজগুবি ব্যাপার!" তখন পুতুলটাকে সেই উকিলবাবুর মতই রাগী রাগী দেখতে লাগছিল। কিন্তু কাগজের পুতুলগুলি তার রোগা রোগা পায়ে পিটুনি দিতেই, সে আবার ছোট হয়ে গিয়ে আগেকার মত পুঁচকে মোমের পুতুল হয়ে গেল। সেই দেখে ইডার এত মজা লাগল, যে সে না হেসে আর পারল না। লাঠিটা নেচেই চলল, আর তাই উকিলবাবুও নাচতে বাধ্য হলেন। তিনি নিজেকে বড় আর লম্বাই বানান, বা পুঁচকেই থাকুন, নাচতে তাঁকে হবেই। শেষ পর্যন্ত সব ফুলেরা গিয়ে অনেক কষ্টে রঙিন লাঠিকে নাচ থামাতে বাধ্য করল, বিশেষ করে সেই অসুস্থ ফুলগুলি।
এই সময়ে যে ড্রয়ারের ভেতরে ইডা সোফিকে ঢুকিয়ে রেখেছিল। তার ভেতর থেকে জোরে ঠকঠক আওয়াজ শোনা গেল। সেই শুনে কাপড়ের পুতুলটা এক দৌড়ে টেবিলের কোণায় গিয়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ড্রয়ারটাকে টেনে খুলল।
তখন সোফি ভেতর থেকে উঁকি মেরে, চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, " আজ রাতে মনে হচ্ছে এখানে একটা বল্ নাচের আসর বসেছে...আমাকে কেউ বলেনি কেন?"
"তুমি আমার সাথে নাচ করবে?" জিজ্ঞাসা করল কাপড়ের পুতুলটা।
" হ্যাঃ, তোমার সাথে নাচ করি আর কি !" এই বলে সোফি মুখ ঘুরিয়ে পিছু ফিরে বসল।
সে ড্রয়ারের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে ভাবল, কোন একটা ফুল হয়ত তাকে নাচ করতে ডাকবে, কিন্তু কেউ এল না। তখন সে খুক খুক করে একটু কাশল, তা শুনেও কেউ এলনা। ওদিকে কাপড়ের পুতুলটা নিজে নিজেই নাচছে, আর খুব একটা খারাপ নাচ করছে না। যেহেতু কোন ফুলই তার দিকে নজর দিচ্ছে না, তাই সোফি ড্রয়ার থেকে মেঝেতে লাফ দিল, যাতে খুব জোর আওয়াজ হয়। সেই শুনে সব ফুলেরা তার দিকে দৌড়ে এল, আর জিজ্ঞাসা করল, তার কোথাও লেগেছে কিনা - বিশেষ করে সেই ফুলগুলি যারা তার বিছানায় শুয়ে ছিল। কিন্তু তার তো লাগেইনি। আর ইডার ফুলগুলি তার সঙ্গে খুব ভাল করে কথা বলল আর তাকে ধন্যবাস জানাল তার সুন্দর বিছানাটা তাদেরকে ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য। তারা তাকে ঘরের মাঝখানে, যেখানে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল, নিয়ে গেল, আর তার সঙ্গে নাচ করল। অন্য সব ফুলেরা তাদের ঘিরে ঘিরে নাচতে থাকল। তখন সোফি খুব খুশি হল, আর তাদেরকে বলল, তারা চাইলে তার বিছানায় আরো বেশি সময় থাকতে পারে, তার ড্রয়ারে থাকতে আপত্তি নেই। কিন্তু ফুলগুলি তাকে অনেক করে ধন্যবাদ জানাল, আর বলল -
"আমরা বেশিদিন তো বেঁচে থাকতে পারব না। আগামি কাল সকালে আমরা আরো শুকিয়ে যাব; আর তুমি ছোট্ট ইডাকে বলে দিও আমাদের যেন বাগানে ক্যানারি পাখির কবরের পাশে মাটি চাপা দিয়ে দেয়, তাহলে, পরের গ্রীষ্মে, আমরা আরো সুন্দর হয়ে ফুটে উঠব।"
"না, তোমরা মরে যেতে পারবে না, " বলে সোফি ফুলেদের চুমু খেল।
তারপরে ঘরের অন্য দরজাটা খুলে গেল, আর একগাদা ফুল নেচে নেচে ঘরে ঢুকল। ইডা ভেবেই পেল না তারা কোথা থেকে এসেছে, এক যদি না তারা রাজার বাগানের ফুল হয়। প্রথমে এল মাথায় ছোট্ট সোনালি মুকুট পরা দুটি গোলাপ, তারা রাজা আর রানী। তাদের পিছু পিছু এল সুন্দরী স্টক আর কার্নেশনরা, তারা সবাইকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল। তাদের সঙ্গে বাজনার ব্যবস্থাও ছিল। বড় বড় পপি আর পিওনিরা বাদামের খোলা দিয়ে বাজনা বানিয়েছিল, আর তাতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে নিজেদের মুখ লাল করে ফেলেছিল। নীল হায়াসিন্থ আর সাদা স্নো-ড্রপেরা নিজেদের ঘন্টার মত দেখতে ফুলগুলিকে নাড়িয়েই যাচ্ছিল, যান সেগুলি সত্যিকারের ঘন্টা। তারপরে এল আরো অনেক ফুল ঃ ভায়োলেট, ডেইসি, লিলি অফ দ্য ভ্যালি, আরো অনেকে, আর তারা সবাই একসঙ্গে নাচ করতে থাকল। সে এক দেখার মত দৃশ্য হল বটে!
শেষ অবধি ফুলেরা একে অপরকে শুভরাত্রি জানাল। তারপরে ছোট্ট ইডা চুপি চুপি ফিরে এসে তার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল, আর যা যা দেখেছে তার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। পরের দিন সকালে যখন তার ঘুম ভাঙ্গল, সে ছুট্টে গেল তার টেবিলটার কাছে, ফুলগুলি আছে কিনা দেখার জন্য। সে পুতুলের বিছানার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেল, তারা সবাই শুয়ে আছে, কিন্তু আগের দিনের থেকে অনেক বেশি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সোফি সেই ড্রয়ারটাতেই ছিল যেখানে ইডা তাকে রেখে গেছিল, কিন্তু তাকে দেখে মনে হল তার খুব ঘুম পেয়েছে।
"তোমার কি মনে আছে তোমাকে ফুলেরা আমাকে কি বলতে বলেছিল ?" জিজ্ঞেস করল ছোট্ট ইডা। কিন্তু সোফিটা বোকার মত তাকিয়ে রইল, কিছুই বলল না।
"তুমি মোটেও ভাল মেয়ে নও, " বলল ইডা, "তাও ওরা তোমার সাথে নাচ করেছিল।"
তারপরে সে সুন্দর পাখির ছবি আঁকা একটা ছোট্ট কাগজের বাক্স নিল, আর শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলিকে তার মধ্যে শুইয়ে দিল।
"এইটা হবে তোমাদের সুন্দর কফিন," সে বলল; "আর হ্যাঁ, আমার দাদারা যখন বেড়াতে আসবে, ওদের সাথে আমি তোমাদের বাগানে কবর দেব, যাতে তোমরা পরের গ্রীষ্মে আরো সুন্দর হয়ে ফুটতে পার।"
তার দুই খুড়তুতো দাদা ছিল জেম্স্ আর অ্যাডল্ফাস। তাদের বাবা তাদেরকে একটা করে তীর ধনুক কিনে দিয়েছিলেন, আর তারা সেগুলি ইডাকে দেখাতে নিয়ে এসেছিল। সে তাদেরকে শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলির কথা বলল। তারপরে বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে বাগানে ফুলগুলিকে কবর দিতে চলল। আগে আগে চলল দুই ভাই, তীর ধনুক কাঁধে নিয়ে, পেছনে চলল ইডা, সেই শুকিয়ে যাওয়া ফুলে ভরা বাক্সটা হাতে নিয়ে। তারা বাগানে একটা ছোট্ট কবর খুঁড়ল। ইডা তার ফুলেদের আদর করে বাক্সটা মাটিতে পুঁতে দিল। তাদের কাছে কিনা বন্দুক বা কামান কিছুই ছিলনা, তাই জেম্স্ আর
অ্যাডল্ফাস কবর দেওয়ার পরে একবার করে তাদের তীর ধনুকই চালিয়ে দিল।
হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন এর 'লিট্ল ইডা'স ফ্লাওয়ার্স' অবলম্বনে।
অনুবাদঃ
মহাশ্বেতা রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: বিদেশী রূপকথা